মন পবন: ০১-০৫. সেই মুখখানা যেন আজও

মন পবন: ০১-০৫. সেই মুখখানা যেন আজও

০১-০৫. সেই মুখখানা যেন আজও

সেই মুখখানা যেন আজও ভুলতে পারিনি।

সত্যি, এমন এক একটি মুখ এক এক সময় আমাদের চোখে পড়ে যা কখনও বুঝি মনের পাতা থেকে মুছে যায় না।

সে মুখের কোথায় যেন এক বিশেষত্ব মনের পাতায় গভীর আঁচড় কেটে যায়।

এবং সেই মুখখানা যখনই মনের পাতায় ভেসে উঠেছে, তখনই মনে হয়েছে কেন এমন হল? শেষের সেই বিয়োগান্ত দৃশ্যের জন্য দায়ী কে?

কিরীটীর মতে অবিশ্যি সেই বিচিত্র শক্তি, যে শক্তি অদৃশ্য, অমোঘ সেই নিয়তি, নিষ্ঠুর নিয়তিই দায়ী।

কিন্তু তবু আমার এক এক সময় মনে হয়েছে সত্যি কি তাই, পরক্ষণেই আবার মনে হয়েছে তাই যদি না হবে তো এমনটাই বা ঘটে কেন?

ঘটেছে কেন?

থাক, যার কথা আজ বলতে বসেছি তার কথাই বলি।

.

কিস্তি।

কথাটা বলে কিরীটী হাত তুলে নিল।

দেখলাম শুধু কিস্তিই নয়, মাত।

পর পর তিনবার মাত হলাম এইবার নিয়ে এবং ব্যাপারটা যে সুখপ্রদ হয়নি সেটা বোধ হয় আমার মুখের চেহারাতেই প্রকাশ পেয়েছিল।

এবং কিরীটীর নজরেও সেটা এড়ায়নি, প্রকাশ পেল তার কথায় পরক্ষণেই।

বলল, কি রে, একেবারে যে চুপশে গেলি! মাত হয়েছিস তো আমার হাতে–

অদূরে সোফায় বসে কৃষ্ণা একটা নভেল পড়ছিল। এবং এতক্ষণ আমাদের খেলার মধ্যে একটি কথা বলেনি বা কোন মন্তব্য প্রকাশ করেনি।

কিরীটীর ঐ কথার সঙ্গে সঙ্গে এতক্ষণে সে কথা বললে, হ্যাঁ, কিরীটী রায় যখন তখন মাত হওয়াটাও তো তোমার গৌরবেরই সামিল হল ঠাকুরপো তার হাতে।

কিরীটী দেখলাম তার স্ত্রীর দিকে একবার আড়চোখে তাকাল মাত্র কিন্তু কথা বলল।

কৃষ্ণা স্বামীর আড়চোখের দৃষ্টি লক্ষ্য করেও যেন লক্ষ্য করেনি এমনি ভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বললে, তবে তোমাকে একটা সংবাদ দেওয়া কর্তব্য বলে বোধ করছি, ভদ্রলোক নিজেও এবারে মাত হয়েছেন।

কিরীটী তার ওষ্ঠধৃত পাইপটায় একটা কাঠি জ্বেলে পুনরায় অগ্নিসংযোগে উদ্যত হয়েছিল, হঠাৎ তার উদ্যত হাতটা থেমে গেল এবং স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললে, কি বললে?

বললাম আপনিও এবারে মাত হয়েছেন!

কথাটা বলে যেন একান্ত নির্বিকার ভাবেই কৃষ্ণা নভেলের পাতায় আবার মনঃসংযোগ করল।

মাত হয়েছি?

হুঁ।

পূর্ববৎ সংক্ষিপ্ত জবাব।

মানেটা যদি বুঝিয়ে বলতে সখি!

মানে?

হুঁ।

সে তো অতিশয় প্রাঞ্জল, বেচারী নির্মলশিব সাহেব না বুঝতে পারলেও আমার কিন্তু বুঝতে দেরি হয়নি।

কি, ব্যাপার কি বৌদি? আমি এবার প্রশ্নটা না করে আর পারলাম না। কিরীটী মাত হয়েছে, বেচারী নির্মলশিব সাহেব

এতক্ষণে কিরীটী হো হো করে হেসে ওঠে।

এবার আমি কিরীটীকেই প্রশ্ন করি, ব্যাপার কি রে?

জ্বলন্ত পাইপটায় একটা সুখটান দিয়ে কিরীটী বললে, তোকে বলা হয়নি সুব্রত, গত এক মাস ধরে নির্মলশিব সাহেব আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।

তা যেন বুঝলাম, কিন্তু নির্মলশিব সাহেবটি কে?

মনে নেই তোর, সেই যে কি আশ্চর্য নির্মলশিব সাহেব! একদা ব্যারাকপুর থানার ও. সি. ছিল, বছর দুই হল হেড কোয়ার্টারে বদলি হয়ে এসেছে।

এতক্ষণে আমার মনে পড়ে।

এবং সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোকের চেহারাটিও মনের পাতায় ভেসে ওঠে।

.

মোটাসোটা নাদুসনুদুস নাড়ুগোপাল প্যাটার্নের হুড়িয়াল সেই ভদ্রলোক।

এবং দেহের অনুপাতে পদযুগল যার কিঞ্চিৎ ছোট এবং চৈনিক প্যাটার্নের বলে বাজারের যাবতীয় জুতোই যার পায়ে কিছুটা সর্বদাই বড় হত!

যার প্রতিটি কথার মধ্যে বিশেষ মুদ্রাদোষ ছিল, কি আশ্চর্য!

বললাম, হঠাৎ সেই নির্মলশিব সাহেব তোকে গত এক মাস ধরে অতিষ্ঠ করে তুলেছে মানে?

বলিস না আর তার কথা। আমিও শুনব না, সেও শোনাবেই।

কৃষ্ণা ঐসময় টিপ্পনী কেটে বলে ওঠে, অত ভণিতার প্রয়োজন কি? কেউ কোন কথা দশ হাত দূরে বসে বললেও যার ঠিক ঠিক কানে যায়, সে ঐ ভদ্রলোকের কথা শোনেনি এ কথাটা আর যেই বিশ্বাস করুক ঠাকুরপোও বিশ্বাস করে না—আমিও করি না। কিন্তু সত্যি কথাটা বলতেই বা অত লজ্জা কিসের! কেন বলতে পারছ না, শুনে বুঝতে পেরেছ, রীতিমত জটিল ব্যাপার, শেষ পর্যন্ত মাত হবে তাই শুনেও না শোনার ভান! এড়িয়ে যাবার অছিলা করছ একমাস ধরে!

তাই, সখি, তাই। পরাজয় স্বীকার করছি, হার মানছি। কিরীটী বলে ওঠে।

হ্যাঁ, তাই স্বীকার কর, তাই মান।

বললাম তো, তোমার কাছে হার মানি সেই তো মোর জয়। কিরীটী হাসতে হাসতে আবার বলে।

কথা বললাম এবার আমি।

কিন্তু কি ব্যাপারটা রে?

কে জানে কি ব্যাপার! বলছিল—

কিরীটীর কথা শেষ হল না, সিঁড়িতে জুতোর শব্দ শোনা গেল।

সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর শ্রবণেন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে, সে বলে, ঐ যে এসে গিয়েছেন জুতো!

হ্যাঁ রে, মনে নেই তোর, নির্মলশিব সাহেবের জুতো সম্পর্কে তার অধীনস্থ কর্মচারীদের সেই বিখ্যাত রসিকতাটা? কে যায়। জুতো, কার? না ভুড়ির। ভুড়ি কার? নির্মলশিব সাহেবের। সাহেব কোথায়? আর একটু উপরে

কিরীটীর কথা শেষ হল না, সত্যি সত্যি নির্মলশিব সাহেবই ঘরে এসে প্রবেশ করল।

এবং ঘরে ঢুকেই আমার মুখের দিকে কিয়ৎক্ষণ কুঞ্চিত করে তাকিয়ে রইল।

তারপরই হঠাৎ জ্ব সোজা হয়ে এল এবং সহাস্যমুখে বলে ওঠে, কি আশ্চর্য! আরে সুব্রতবাবু না?

হ্যাঁ। নমস্কার। চিনতে পেরেছেন তাহলে!

চিনব না মানে? কি আশ্চর্য! বলেই হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠে নির্মলশিব সাহেব।

বসুন নির্মলশিববাবু। কিরীটী এবার বলে।

কি আশ্চর্য! বসব না? আরে বসবার জন্যেই তো আসা। আর আজ যতক্ষণ না হ্যাঁ বলবেন উঠব না—একেবার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েই এসেছি।

কথাগুলো বলতে বলতে জাঁকিয়ে বসে নির্মলশিব এবং কথা শেষ করে বলে, এই বসলাম।

কি ব্যাপার বলুন তো নির্মলশিববাবু? এবার আমিই প্রশ্ন করি।

কি আশ্চর্য! কিছুই জানেন না সত্যি বলছেন আপনি?

সত্যিই জানি না।

কি আশ্চর্য! আরে মশাই সে এক বিশ্রী নাজেহালের ব্যাপার! বুঝলেন সুব্রতবাবু, গোল্ড একেবারে যাকে বলে সত্যি সত্যি pure gold মশাই!

গোল্ড?

হ্যাঁ, হ্যাঁ—সোনা, খাঁটি সোনা এন্তার স্মাগল করছে।

.

০২.

নির্মলশিববাবুর মুখে গোল্ড এবং সেই গোল্ড স্মাগল-কথা দুটি শুনেই বুঝেছিলাম তার বক্তব্যটা কোন পথে এগুচ্ছে।

এখন আরও স্পষ্ট হল। নির্মলশিববাবু আবার বলতে শুরু করে, কিছুই খবর রাখেন না দেখছি!

মৃদু হেসে বললাম, আদার ব্যাপারী আমি। ওসব সোনাদানার ব্যাপার—কিন্তু কিরীটীর শরণাপন্ন হয়েছেন যখন–

সাধে কি আর হয়েছি মশাই! আমি তো ছাড়, সরকারের এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ, কাস্টমস এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চ সকলের চোখে ধুলো দিয়ে স্রেফ যাকে বলে সকলকে একেবারে গত কয়েক মাস ধরে বুদু বানিয়ে ছেড়ে দিল।

বুদ্ধু?

তা না হলে আর বলছি কি। স্রেফ বুদ্ধু!

তা কোন হদিসই করতে পারলেন না এখনও?

কি আশ্চর্য! কি বললাম তবে?

তা যেন হল, কিন্তু ব্যাপারটা হঠাৎ কেমন করে আপনাদের নজরে এসে পড়ল। —অর্থাৎ বলছিলাম, ব্যাপারটা টের পেলেন কি করে? শুধালাম।

কিরীটী কিন্তু একান্ত নির্বিকার ভাবে তখন পাইপ টেনেই চলেছে সোফায় হেলান দিয়ে দুটি চক্ষু বুজে।

কিন্তু যতই সে চক্ষু দুটি মুদ্রিত করে থাকুক না কেন, স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম তার ঐ নিষ্ক্রিয়তা আদৌ নিষ্ক্রিয়তা নয়, রীতিমতই যাকে বলে তার শ্রবণেন্দ্রিয় দুটি জাগ্রত হয়ে রয়েছে।

অনাগ্রহের ভাবটা তার ভান মাত্রই।

কি আশ্চর্য! সেও এক অদ্ভুত ব্যাপার! আবার কথা বলে নির্মলশিব।

কি রকম? শুধালাম।

একটা চিঠি—

চিঠি?

হ্যাঁ। একটা বেনামা চিঠি পেয়ে কর্তাদের সব টনক নড়ে উঠেছে। তাঁদের টনক নড়েছে—আর প্রাণান্ত হচ্ছে আমাদের।

তা সে বেনাম চিঠিটা আপনি দেখেছেন?

তা আর দেখিনি! কি আশ্চর্য! কি যে বলেন?

কি লেখা ছিল চিঠিতে?

কি আশ্চর্য! মুখস্থ করে নিয়েছি চিঠিটা, আর কি লেখা ছিল তা মনে থাকবে না? শুনুন, লিখেছে, মাননীয় কমিশনার বাহাদুরের সমীপেষু—ভেবে দেখুন একবার সুব্রতবাবু, ইয়ার্কির মাত্রাটা। কমিশনার বাহাদুরের সমীপেষু, কেন রে বাপু, পাকামি করতে কে বলেছিল, জানাতে যদি হয় তো আগে আমাদের জানালেই হত!

তা তো নিশ্চয়ই।

তবেই বুঝুন! পাকামি ছাড়া কি আর বলুন তো!

কিন্তু চিঠিতে কি লেখা ছিল যেন বলছিলেন—

হ্যাঁ, সেই কথাই তো বলছি, লিখেছে, আপনি কি খবর রাখেন, স্বাধীন ভারত থেকে একদল চোরাকারবারী কত সোনা গত এক বছর ধরে পাকিস্তানের ভিতর দিয়ে আমেরিকায় চালান করে দিয়েছে আর আজও দিচ্ছে? এখনও যদি ঐভাবে সোনার চোরাই রপ্তানিতে বাধা না দিতে পারেন তো জানবেন, আর দুএক বছরের মধ্যে এক তোলা বাড়তি সোনাও এ দেশে আর থাকবে না।

বলেন কি, সত্যি?

কি আশ্চর্য! সত্যি মানে, চিঠিতে তো তাই লিখেছে—

লিখেছে বটে, তবে–

তবে কি?

মানে উড়ো চিঠি তো!

মানে?

মানে বলছিলাম, এমনও তো হওয়া অসম্ভব নয় যে আপনাদের খানিকটা নাজেহাল করার জন্যই কোন দুষ্ট প্রকৃতির লোক ঐ উড়ো চিঠিটা দিয়েছে।

হুঁ, আপনি বুঝি তাই ভাবছেন সুব্রতবাবু?

মানে বলছিলাম, ব্যাপারটা খুব একটা অসম্ভব কি?

আরে মশাই, না না—সোনাদানার ব্যাপার, ও ঠিকই—তাছাড়া—

তাছাড়া?

গত বছর-দুই ধরে কতকগুলো খবরও যে আমরা পেয়েছি সোনা স্মাগলিংয়ের ব্যাপারে! তারপর ঐ চিঠি

কিরীটী এতক্ষণ চুপচাপই ছিল।

আমাদের কথার মধ্যে কোন মন্তব্য করেনি।

হঠাৎ ঐ সময় কিরীটী কথা বললে। প্রশ্ন করল, নির্মলশিববাবু!

আজ্ঞে?

বলছিলাম, কিরীটী বললে, চিঠিটা আপনারা কিভাবে পেয়েছিলেন নির্মলশিববাবু? হাতে, না ডাক মারফত?

কি আশ্চর্য! ওসব চিঠি বেনামা—উড়ো ব্যাপার, ডাক মারফতই চলে জানবেন চিরদিন।

চিঠিটা হাতে লেখা, না টাইপ করা? পুনরায় প্রশ্ন করে কিরীটী।

টাইপ করা।

খামে, না পোস্টকার্ডে?

খামে।

খামের ওপর ডাকঘরের ছাপটা দেখেছিলেন?

কি আশ্চর্য! বিলক্ষণ, তা আর দেখিনি? ভবানীপুরের পোস্ট অফিসের ছাপ মারা ছিল খামটার গায়ে।

ভবানীপুর ডাকঘরের?

হুঁ।

কিরীটী তারপর চোখ বুজে যেন কি ভাবে।

তারপর একসময় চোখ খুলে বলল, চিঠিটা আপনারা যা ভাবছেন, সত্যিই যদি তাই হয়, তাহলে তো–

কি?

তাহলে তো এক দিক দিয়ে আপনারা নিশ্চিন্তই হতে পারেন!

নিশ্চিন্ত হতে পারি?

হুঁ।

কি রকম?

হ্যাঁ, ধরে নিই যদি ব্যাপারটা সত্যিই, তাতে করে আপনাদের চিন্তার কি আছে এত?

কি আশ্চর্য! চিন্তার ব্যাপার নেই মানে?

নিশ্চয়ই। ভাঙনের মুখে আর কতদিন বাঁধ দিয়ে রোধ করবেন।

কি বলছেন?

ঠিক বলছি। বুঝতে পারছেন না, দলে ভাঙন ধরেছে! দলের কেউ মীরজাফরের রোল নিয়েছে এ নাটকে। অতএব নিশ্চিন্ত থাকুন, পলাশীর যুদ্ধ একটা শীঘ্রই হবে এবং হতভাগ্য সিরাজের পতন অবশ্যম্ভাবী!

কি আশ্চর্য!

আশ্চর্যের আর কি আছে? প্রবাদই তো আছে–History always repeats itself! ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি-এ যে সর্বকাল ও সর্ববদিসম্মত। আপনার কর্তাদের শুধিয়ে দেখবেন, তারা কথাটা স্বীকার করবেন।

দোহাই আপনার মিঃ রায়, নির্মলশিববাবু বলে ওঠে, আর কি আশ্চর্য! আর আমাকে নাকানিচোবানি খাওয়াবেন না, একটা বুদ্ধি বাতলান।

কিরীটী আবার স্তব্ধ হয়ে যায়। কোন সাড়াই দেয় না।

মিঃ রায়? করুণ কণ্ঠে আবার ডাকে নির্মলশিববাবু! কি আশ্চর্য! বুঝতে পারছেন না কি বিপদেই পড়েছি! এযাত্রা আমাকে সাহায্য না করলে এই পেনসনের কাছাকাছি এসে সত্যি বলছি যাকে বলে ভরাড়ুবি হয়ে যাব, বিশ্রী কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।

অবশ্যই নির্মলশিব সাহেবকে সেবার কিরীটী শেষ পর্যন্ত সাহায্য করেছিল। এবং কিরীটী সাহায্য না করলে সেবারে সোনা পাচারের ব্যাপারটা আরও কতদিন ধরে যে চলত তার ঠিক নেই।

.

০৩.

এবং সে কাহিনীও বিচিত্র।

তবে এও ঠিক, কৃষ্ণা সেবারে অমনভাবে হঠাৎ সেদিন খোঁচা দিয়ে সুপ্ত সিংহকে জাগালে নির্মলশিববাবুর শিবত্বপ্রাপ্তি তো হতই তার এক চাকুরে ভাই মোহিনীমোহনের মত এবং চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালের দর্শন আমরা পেতাম না হয়ত।

শুধু কি চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল।

সেই তিলোত্তমাসম্ভব-কাব্য।

চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল!

তিলোত্তমা!

সত্যি বার বার কত ভাবেই না অনুভব করছি, কি বিচিত্র এই দুনিয়া!

কিন্তু যাক, যা বলছিলাম।

কিরীটীর ঐ ধরনের নিরাসক্তির কারণটা নির্মলশিববাবুর জানা ছিল না, কিন্তু আমাদের—মানে আমার ও কৃষ্ণার জানা ছিল খুব ভালই।

সে কিরীটীর এক ব্যাধি।

মধ্যে মধ্যে সে এমনভাবে শামুকের মত নিজেকে খোলের মধ্যে গুটিয়ে নিত যে কিছুতেই তখন যেন তার সেই নিরাসক্তির জাগ্রত তন্দ্রা ভাঙানো যেত না।

সত্যিই বিচিত্র তার সেই আত্মসমাহিতের পর্ব।

বলাই বাহুল্য, আত্মসমাহিতের সেই পর্ব তখন কিরীটীর চলেছিল বলেই নির্মলশিববাবু প্রত্যহ এসে এসে ফিরে যাচ্ছিল।

শেষ পর্যন্ত একদিন, বিধি যদি হন বাম তো ভাগ্যর হাতেই আত্মসমর্পণ ব্যতীত আর উপায় কি ভেবে সে কৃষ্ণার কাছেই আত্মসমর্পণ করল, আমাকে এবারটা বাঁচান মিসেস রায়।

তাই তো নির্মলশিববাবু, মহাদেবটির আমার এখন জেগে ঘুমোবার পালা চলেছে। নিজের নেশায় নিজে এখন উর্ধ্বনেত্র। ওর কানে তো এখন কোন কথাই যাবে না। কৃষ্ণা বলে।

কিন্তু আমি যে অনন্যোপায় মিসেস রায়!

আচ্ছা দেখি।

কিন্তু নানাভাবে অনেক চেষ্টা করেও কৃষ্ণা কিরীটীর সাড়া জাগাতে পারে না।

তবু নির্মলশিবও আশা ছাড়ে না, সে-ও আশা ছাড়ে না।

অবশেষে সেদিন কিস্তিমাতের ব্যাপারের মোক্ষম মুহূর্তে ছোট্ট একটি মোক্ষম বাণে কিরীটীর নিদ্রাভঙ্গ হল।

.

কিন্তু পরের কথাপ্রসঙ্গে জানতে পেরেছিলাম, সেবারকার কিরীটীর নিরাসক্তির ব্যাপারটা সত্যি-সত্যিই নিরাসক্তির তন্দ্রা ছিল না।

সোনা স্মাগলের ব্যাপারটা ইতিপূর্বেই তার মনকে নাড়া দিয়েছিল। এবং কিছুদিন যাবৎ ঐ ব্যাপারের প্রস্তুতির মধ্যেই ড়ুবেছিল সে।

কাজেই কৃষ্ণার কিরীটীর তন্দ্রা ভাঙানোর ব্যাপারটা বাইরে আকস্মিক হলেও ভিতরে ভিতরে সত্যিই আকস্মিক ছিল না।

কিন্তু যা বলছিলাম, সেদিনকার কথা—

কিরীটীর সহসা আবার সাড়া পাওয়া গেল।

নির্মলশিববাবু!

আজ্ঞে?

মোহিনীমোহন চৌধুরীর কথা মনে আছে আপনার?

মোহিনীমাহন-মানে আমাদের সেই ব্রাদার অফিসার মোহিনীমোহন?

হ্যাঁ, যিনি অকস্মাৎ মাস ছয়েক আগে এক রাত্রে এই কলকাতা শহর থেকে, সুব্রতর ভাষায়, যাকে বলে যে একেবারে কপূরের মত উবে গেলেন! এবং যার কোন পাত্তাই এখনও পর্যন্ত আপনাদের বড়কর্তারাও করতে পারেননি, মনে আছে তার কথা?

আহা, মনে থাকবে না—মনে আছে বৈকি। মোহিনীর বেচারী বুড়ী মার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, সে কি কান্না

কিন্তু আপনার তো শুধু মাতৃদেবীই নন, ঐ সঙ্গে স্ত্রী ও আপনার পঞ্চকন্যা আছে –একসঙ্গে বারো জোড়া চক্ষু যদি কাদতে শুরু করে!

মানে—মানে—

মানে অতীব প্রাঞ্জল। সোনার কারবার যাদের, তাদের হৃদয়টা ঐ সোনার মতই নিরেট হয়ে থাকে বলেই আমার ধারণা।

সত্যি কথা বলতে কি, ঐসময় আমারও কিরীটীর কথাটা কেমন যে হেঁয়ালির মতই বোধ হচ্ছিল। কারণ তখনও আমি বুঝতে পারিনি, অতঃপর কোন্ দিকে কিরীটী মোড় নিচ্ছে।

নির্মলশিববাবু! আবার কিরীটী ডাকল।

বলুন?

এবং প্রায় ঐ সময়েই এই কলকাতা শহরে একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল–মনে আছে বোধ হয় সেই ঘটনাটাও সকলেরই আপনাদের?

কোন্‌–কোন্ হত্যাকাণ্ডের কথাটা বলছেন, বলুন তো মিঃ রায়?

বলছি, তবে একটা ব্যাপার সে-সময় অনেকেই লক্ষ্য করেননি যে-নৃশংস দ্বিতীয় সেই হত্যাকাণ্ডটা ঘটে ঠিক মোহিনীমোহনের নিরুদ্দেশ হবার সাতদিন পরে

তার মানে?

এতক্ষণে দেখলাম সত্যি-সত্যিই যেন নির্মলশিববাবু সচকিত হয়ে ওঠে।

মানে আর কি–খুব সম্ভবত অর্থাৎ মোহিনীমোহনের নিরুদ্দেশ ও ঐ হত্যাকাণ্ড ব্যাপার দুটো যোগ দিলে দুয়ে দুয়ে চারের মতই তাদের যোগফল দাঁড়াবে।

কিন্তু-কিন্তু–

তাই বলেছিলাম, এ সোনা নয়—মায়ামৃগ! মৃত্যুবাণ যে কখন কোন্ পথে কার বুক এসে বিঁধবে!

মনে হল কিরীটীর এই কথায় যেন নির্মলশিব সত্যিসত্যিই একেবারে হাওয়া-বেরহয়ে-যাওয়া বেলুনের মতই চুপসে গেল মুহূর্তে।

এবং হঠাৎ যেন একেবারে চুপচাপ হয়ে গেল।

কিরীটীর সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথায় আমার তখন মনে পড়ে যায়, ছমাস আগেকার সত্যি-সত্যিই সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথাটা।

.

নৃশংসতারও বুঝি একটা সীমা আছে। কিন্তু সেই বিশেষ হত্যাকাণ্ডটা যেন সে সীমাকেও অতিক্রম করে গিয়েছিল।

সংবাদপত্রে সেদিন প্রথম ব্যাপারটা জানতে পেরে সত্যিই যেন মূক হয়ে গিয়েছিলাম।

আজকের দিনের সভ্য মানুষের মনের কি নির্মম বিকৃতি!

অবশ্যই আজকের দিনে শিক্ষা কৃষ্টি ও আভিজাত্যের দিক দিয়ে মানুষ যত এগিয়ে চলেছে, তাদের চরিত্রও যেন ততই বিচিত্র সব বিকৃতির মধ্যে দিয়ে বীভৎস হয়ে উঠছে।

তবু কিন্তু সেদিনকার সেই মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডটা মনকে আমার বিমূঢ় বিকল করে দিয়েছিল।

কোন একটি মানুষের দেহকে সম্ভবত কোন অতীব ধারাল অস্ত্রের সাহায্যে টুকরো টুকরো করে দেহের সেই টুকরোগুলো বালিগঞ্জ স্টেশনের ধার থেকে কালীঘাট ব্রীজের ওপারে বেলভেডিয়ার পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

শহরের এক বিখ্যাত সার্জেনের সাহায্যে পুলিসের কর্তৃপক্ষ পরে সেই দেহখণ্ডগুলিকে একত্রিত করে সেলাই করে জোড়া দেয়।

কিন্তু তথাপি সে দেহ কোনমতে আইডেনটিফাই করতে পারে না।

কারণ সেই খণ্ডগুলিতে কোন চামড়া নখ বা কেশর কোন অস্তিত্ব না থাকায় দেহটি পুরুষ না নারীর সেটুকুও তখন বোঝাবার উপায় ছিল না।

কিরীটীর সাহায্য নেবার জন্য কর্তৃপক্ষ সেসময় তাকেও ডেকে নিয়ে মর্গে সেই সেলাই করা দেহটি দেখিয়েছিল।

কিরীটী সে-সময় কর্তৃপক্ষকে কেবল বলে এসেছিল—ঐ সেলাই করা বস্তুটির একটা ফটো তুলে রাখুন আর এই তল্লাট ও এর আশপাশের এলাকাগুলো ভাল করে একবার খোঁজখবর করে দেখুন।

বলাই বাহুল্য, সেই সময়ের কিছু আগে থাকতেই কিরীটীর নিষ্ক্রিয় জাগরণ-নিদ্রা চলেছে।

অতএব সুপ্ত সিংহকে জাগানো যায় নি ঐ সময়।

অবশ্যই ব্যাপারটা ঐখানেই সে-সময় চাপা পড়ে গিয়েছিল।

তবে কিরীটী কর্তৃপক্ষকে ঐ সময় আরও একটা কথা বলেছিল, যার মধ্যে মোহিনীমোহন চৌধুরীর নিরুদ্দেশের ব্যাপারের একটা যোগাযোগের ইঙ্গিতও ছিল।

কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেদিকে তখন দৃষ্টি দেওয়াই প্রয়োজন বোধ করেননি।

তাদের তখন স্থির বিশ্বাস, মোহিনীমোহন চৌধুরী সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস নিয়েছেন, কারণ তার চরিত্রের মধ্যে সর্বস্বত্যাগের নাকি একটা সুস্পষ্ট ইঙ্গিত তো ছিলই–তার কোষ্ঠীতেও নাকি সন্ন্যাস যোগ ছিল।

আরও একটা বিচিত্র ব্যাপার সে-সময় ঘটেছিল।

মোহিনীমোহনের মা মোহিনীর নিরুদ্দিষ্ট হবার ঠিক পাঁচদিন পরে হরিদ্বার থেকে ডাকযোগে পুত্রের হস্তলিখিত একটা চিঠি পান।

তাতে লেখা ছিল—আমি চললাম, আমার খোঁজ করো না।–ইতি মোহিনী।

কর্তৃপক্ষ ঐ চিঠিটা পেয়ে সে-সময় দুর্নাম ও অকৃতকার্যতার লজ্জার হাত থেকে বুঝি নিষ্কৃতিও পেয়েছিল।

.

০৪.

নির্মলশিব আবার প্রশ্ন করল, কিন্তু কোন হত্যাকাণ্ডের কথাটা বলছিলেন, মিঃ রায়?

কিরীটী তখন সংক্ষেপে সেই বীভৎস হত্যাকাণ্ডের কথাটা বিবৃত করে গেল।

I see! আপনি সেই হত্যাকাণ্ডের কথাটা বলছেন?

হ্যাঁ।

কিন্তু—

কি?

কিন্তু মোহিনীমোহন তো সন্ন্যাস নিয়েছেন এবং তার প্রমাণও আছে–তার সেই চিঠি–

হ্যাঁ সেই চিঠি, কিন্তু সে চিঠি যে তারই লেখা—তার তো অবিসংবাদী প্রমাণ সেদিন আমরা পাইনি নির্মলশিববাবু!

সে কি! পেয়েছি বইকি। তার মা-ই তো ছেলের হাতের লেখা দেখে চিনেছিলেন!

না।

মানে?

মানে হচ্ছে, মোহিনীমোহনের মা তখন চোখে ছানি পড়ায় কিছুই একপ্রকার দেখতে পান না।

ছানি পড়েছিল তার চোখে?

হ্যাঁ।

কিন্তু সেকথা আপনি জানলেন কি করে, মিঃ রায়?

কারণ মোহিনীমোহনের একজন ছোট ভাই আছে, জানেন?

হ্যাঁ, রমণীমোহন।

সেই রমণীমোহন সে-সময় এসেছিল আমার কাছে ঐ ব্যাপারে তাদের সাহায্য করবার জন্য। এবং তার মুখেই সেদিন সেকথা আমি শুনেছিলাম।

কিন্তু–

যাক সেকথা নির্মলশিববাবু, বলছিলাম সেদিনও যা বলেছিলাম আপনার কর্তৃপক্ষকে–আজ আপনাকও তাই বলব, সে চিঠি মোহিনীমোহন চৌধুরীরই যে হাতের লেখা তার কোন সত্য বা নির্ভরযোগ্য প্রমাণ ছিল না।

তবে কি আপনি মনে করেন, মিঃ রায়, সত্যিসত্যিই–

হ্যাঁ, সেই সোনার হরিণের পশ্চাদ্ধাবনের জন্যই তার মৃত্যু—অর্থাৎ তার অকালমৃত্যু হয়েছিল দানবীয় নৃশংস ভাবে।

ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করছিলাম ধীরে ধীরে নির্মলশিব সাহেবের সমস্ত উৎসাহই যেন নির্বাপিত হয়ে এসেছে।

তাহলে দেহটা তার কোথায় গেল? শুধাল এবার একটা ঢোক গিলে নির্মলশিব।

দেহ?

হ্যাঁ।

খোঁজেননি ভাল করে চোখ মেলে তাই পাননি, নচেৎ নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই পেতেন।

কিন্তু–

তবে মনে হচ্ছে এবারে সন্ধান পাবেন।

পাব?

পাবেন।

কৃষ্ণা কখন একফাকে ইতিমধ্যে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিল লক্ষ্য করিনি।

এমন সময় জংলীর হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে সে পুনরায় ঘরে প্রবেশ করল।

আমি ও কিরীটী একটা করে ধূমায়িত চায়ের কাপ তুলে নিলাম, কিন্তু নির্মলশিববাবু জংলীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, চা নয়—আমাকে এক গ্লাস জল দাও।

নির্মলশিবের শুষ্ক কণ্ঠে সেই এক গ্লাস জল কথাটি যেন অতিকষ্টে উচ্চারিত হল।

কৃষ্ণা হেসে বলে, নিন নিন, চা খান!

করুণ দৃষ্টিতে তাকাল নির্মলশিব কৃষ্ণার মুখের দিকে এবং পূর্ববৎ শুষ্ক কণ্ঠেই বললে, চা খাব?

হ্যাঁ, নিন।

কিরীটী টিপ্পনী কাটল, আরে মশাই, মৃত্যুকে ভয় করলে কি আপনাদের চলে? আপনাদের তো জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য।

অতঃপর চা নয়, যেন চিরতার জল—এইভাবে অতিকষ্টে একটু একটু করে গলাধঃকরণ করলে নির্মলশিব সাহেব।

তারপর নিঃশেষিত চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, কি আশ্চর্য! এ। যে দেখছি কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরুল বলে মনে হচ্ছে!

কিরীটী মৃদু হেসে আবার টিপ্পনী কাটল, হ্যাঁ, ঢোঁড়া নয়, জাতসাপ একবারে। তা যাক গে সেকথা, আপনাকে আমি সাহায্য করব নির্মলশিববাবু, তবে এক শর্তে–

শর্তে!

হ্যাঁ আপাতত আপনি ঐ ব্যাপারে আমাকে যে সঙ্গে নিয়েছেন, সেকথা কাউকেই জানাতে পারবেন না।

বেশ।

আপনার কর্তৃপক্ষকেও নয় কিন্তু—

তাই হবে।

সেদিনকার মত নির্মলশিব গাত্রোখান করল।

.

নির্মলশিবের প্রস্থানের পর আধ ঘণ্টা কিরীটী যেন কেমন ধ্যানস্থ হয়ে বসে রইল।

দুটি চক্ষু বোজা।

বুঝলাম কিরীটী নির্মলশিবের ব্যাপারটাই চিন্তা করছে।

অগত্যা আজ আর এসময় এখানে বসে থাকা বৃথা। উঠব উঠব ভাবছি, এমন সময় কিরীটী সহসা চক্ষু মেলে একটা আড়মোড়া ভেঙে বলল, চল্ সুব্রত, একটু সন্ধ্যার হাওয়া খেয়ে আসা যাক পদব্রজে।

জুন মাস। প্রচণ্ড গ্রীষ্মের সময় সেটা।

ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে এলেও বাইরের প্রচণ্ড তাপ যে এখনও অগ্নিবর্ষণ করছে সে সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ আমি।

কিরীটীর এয়ারকন্ডিশন ঘর বরং আরামেই বসে আছি; তাই বললাম, বাইরে এখনও গরম–

চল্ চল, বেশ ফুরফুরে দখিনা হাওয়া বাইরে দেখবি!

সত্যিই-সত্যিই অতঃপর কিরীটী উঠে দাঁড়াল।

কৃষ্ণাও এবারে স্বামীর মুখের দিকে একটু বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে শুধাল, সত্যিই বেরুচ্ছ নাকি?

হ্যাঁ, যাই, অনেকদিন ঘরের বাইরে পা দিইনি—ভবানীপুর অঞ্চলটার মধ্যে নিশ্চয়ই অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বলতে বলতে কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

কিরীটী ঘর থেকে বের হতেই সহাস্যে কৃষ্ণা বললে, ভাগ্যে তুমি দাবা খেলায় আজ ওর কাছে মাত হয়েছিলে ভাই, নচেৎ সত্যি বলছি, গত ছ-সাত মাস ও ঘরের বাইরেই পা দেয়নি–

কিন্তু তাতে করে তো তোমার দুঃখ হওয়া উচিত নয় বৌদি। বরং–

না ভাই, ওকে নিষ্ক্রিয় দেখলে কেমন যেন আমার ভয়-ভয় করে!

ভয় করে নাকি?

হ্যাঁ, সে সময়টা ও যেন কেমন আলাদা মানুষ হয়ে যায়। কেমন অন্যমনস্ক।

হবেই তো, ও হচ্ছে প্রতিভার আত্মকণ্ডুয়ন। প্রতিভা জেনো চিরদিনই এককনিঃসঙ্গ।

আমাদের কথার মধ্যেই কিরীটী প্রস্তুত হয়ে পুনরায় ঘরে এসে ঢুকল। বলল, চল্।

.

০৫.

দুজনে রাস্তায় বের হয়ে হেঁটে চললাম।

সন্ধ্যার অন্ধকার সবে ঘন হয়ে এসেছে, চারিদিকে রাস্তায় ও দোকানে দোকানে আলো জ্বলে উঠতে শুরু করেছে।

কিরীটী কিন্তু মিথ্যা বলেনি।

বাইরে সত্যিই যেন ভারি একটা মিষ্টি হাওয়া ঝিরঝির করে বইছিল।

সারাটা দিনের প্রচণ্ড তাপের দহনের পর ঐ ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা হাওয়াটুকু সত্যিই উপভোগ্য।

কিন্তু রাস্তায় বের হয়ে কিরীটী যেন হঠাৎ কেমন বোবা হয়ে যায়।

নিঃশব্দে রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে লক্ষ্য করলাম, কেবল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।

অফিসের ছুটির পর ঘরমুখো হাজার হাজার চাকুরেদের রাস্তায় ও ট্রামে-বাসে বাদুড় ঝোলা ভিড় চোখে পড়ে।

হঠাৎ কিরীটী একসময় বলে, শেষ কবে আদমসুমারী হয়েছে রে সুব্রত?

কেন?

না, তাই বলছি। অনেকদিন বোধ হয় জনসংখ্যা গোনা হয় নি!

বুঝলাম মানুষের ভিড়কে লক্ষ্য করেই কিরীটীর ঈদৃশ বক্রোক্তি।

হেসে বললাম, জনসংখ্যা তো বাড়ছেই।

বাড়ছে বলেই তো এত খাদ্যাভাব, এত বাসস্থানের অভাব, আর তাই ক্রাইমও বেড়ে চলছে। তবে লোকগুলোকে বাহবা না দিয়ে পারছি না!

কাদের কথা বলছিস?

কেন? যারা স্বর্ণর ব্যবসায়ে নেমেছে! যারা নির্মলশিবের মাথার চুলগুলো প্রায় পাকিয়ে তুলল!

হাসলাম আমি সশব্দে।

না রে না, হাসি নয়। কথায়ই তো আছে—অভাবে স্বভাব নষ্ট, কিন্তু আমি ভাবছি–

কি?

ভেক না নিলে তো ভিক্ষার্জন হয় না! তা কিসের ভেক নিয়েছে তারা ঐ স্বর্ণমৃগয়ায়? বলত বলতে চড়কভাঙার কাছাকাছি এসে থেমে পড়ল ও।

কি রে, থামলি কেন?

বিরাট ঐ নিয়ন-বোর্ডটা লক্ষ্য করেছিস? লাল সবুজের ঝিলিক হেনে জ্বলছে। নিভছে! মাসছয়েক আগেও তো ওটা দেখেছি বলে কই মনে পড়ছে না।

কিরীটীর কথায় সামনের দিকে তাকাতেই নজরে পড়ল, বিরাট একটি নিয়নবোর্ড চারতলা একটা নতুন বাড়ির একতলার মাথায় জ্বলছে নিভছে।

ওভারসিজ লিঙ্ক।

বিচিত্র নামটা।

নিচে লেখা গভর্মেন্ট কনট্রাকটার অ্যান্ড জেনারেল অর্ডার সাপ্লায়ার।

বাড়িটা তো দেখছি নতুন! কিরীটী পুনরায় মৃদুকণ্ঠে বললে।

হ্যাঁ, তবে একেবারে নতুন নয়, বছরখানেক হল বাড়িটা তৈরি হয়েছে।

ওভারসিজ লিঙ্ক কারবারটিও তাহলে নতুনই বল!

ফুটপাতের উপর দাঁড়িয়েই দেখলাম সে সেই নতুন চারতলা বাড়িটাই লক্ষ্য করছে।

লক্ষ্য করতে করতেই আবার একসময় বললে, দোতলা তিনতলা আর চারতলা–দেখছি ফ্ল্যাট সিস্টেমে ভাড়া দিয়েছে। কিন্তু–

কিন্তু কি?

ব্যবসার আড্ডা ছেড়ে এখানে এসে অমন জাঁকজমক করে অফিস খুলেছে–

সে অঞ্চলে হয়ত তেমন মনোমত বাড়ি পায়নি।

তা বটে। বলতে বলতে লক্ষ্য করি, সেই অফিসের দিকেই এগুচ্ছে কিরীটী।

একটু অবাক হয়েই প্রশ্ন করি, কোথায় চললি?

চল একবার অফিসটায় ফুঁ দিয়ে আসা যাক। খোলাই যখন আছে, এখনও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে!

তা যেন হল, কিন্তু হঠাৎ অর্ডার সাপ্লাই অফিসে তোর কি প্রয়োজন পড়ল?

আমার যে এখন সেই অবস্থা। খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশ পাথর! চল–চল।

আমাকে আর দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন বা বাদ-প্রতিবাদের অবকাশমাত্রও না দিয়ে সহসা লম্বা লম্বা পা ফেলে, সত্যি সত্যি দেখি, ও ওভারসিজ লিঙ্কের খোলা দ্বারপথের দিকেই এগিয়ে চলেছে।

অগত্যা অনুসরণ করতেই হল ওকে।

দরজার গোড়াতেই চাপদাড়ি শিখ দারোয়ান রাইফেল হাতে একটা টুলের উপর বসে প্রহরায় নিযুক্ত ছিল।

আমাদের দেখে সেলাম জানিয়ে কাচের স্প্রিংডোর ঠেলে রাস্তা করে দিল।

ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঠাণ্ডা একটা হাওয়ার ঝাপটা যেন সর্বাঙ্গ জুড়িয়ে দিল।

এয়ার-কনডিশন করা ঘর বুঝলাম। ঘর বলব না, বিরাট একটা হলঘরই বলা উচিত। একধারে কাউন্টার, অন্যদিকে পর পর তিনটি কাঠের পার্টিশন দেওয়া কিউবিকল। দেওয়ালে দেওয়ালে ফ্লরেসেন্ট টিউবের সাদা ধবধবে আলো জ্বলছে।

ঝকঝকে তকতকে পালিশ করা সব চেয়ার টেবিল।

এক কোণে সুসজ্জিত সোফা ইত্যাদি-ভিজিটারদের বসবার স্থান।

মেঝেতে দামী পুরু কার্পেট বিস্তৃত, কিন্তু সমস্ত কক্ষটিতে তখন নজরে পড়ল গুটি দু-তিন লোক মাত্র কাউন্টারের অপরদিকে টেবিলের সামনে বসে কি সব কাগজপত্র নিয়ে কাজ করছে।

একজন উর্দিপরা বেয়ারা এগিয়ে এল, কি চাই?

বড় সাহেব আছেন তোমাদের?

সাহেব তো নেই। সেক্রেটারি দিদিমণি আছেন।

সেক্রেটারি দিদিমণি?

আজ্ঞে।

বেশ, তাকেই বল গিয়ে একজন বাবু জরুরি কাজের জন্য দেখা করতে চান।

বসুন, খবর দিচ্ছি। বেয়ারা চলে গেল।

লক্ষ্য করলাম বেয়ারা অদূরবর্তী একটা কিউবিকলের সুইংডোর ঠেলে ভিতরে গিয়ে ঢুকল।

আমরা সোফায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

বসে বসে আমি ভাবছি কিরীটীর মতলবখানা কি!

দুম করে এই অফিসে এসে ঢুকল কেন ও, তবে কি ওর ধারণা এই অফিসটাই চোরাই সোনার কারবারের কেন্দ্রস্থল?

কিন্তু যদি ব্যাপারটা সত্যিই হয় তো স্বীকার করতেই হবে, অমন একটা চোরাই কারবার এমন প্রকাশ্য একটা স্থানে বসে জাকজমকসহ করার মধ্যে দুঃসাহসিকতা আছে সন্দেহ নেই।

এবং যারাই ঐ কারবার করুক না কেন তাদের সে দুঃসাহসটা রীতিমতই বুঝি আছে।

যাই হোক একটু পরেই কিন্তু বেয়ারা ফিরে এল।

বললে, চলুন–

বেয়ারার নির্দেশমত আমরা সেক্রেটারি দিদিমণির কিউবিকলের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলাম।

এবং প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই সুমিষ্ট নারীকণ্ঠে আহ্বান এল, বসুন!

কণ্ঠস্বর নয়, যেন সুরলহরী।

আর শুধু কি সুরলহরীই, ঐ সঙ্গে রূপ এবং সাজসজ্জায়ও যেন অসামান্যা। এক কথায় সত্যিই অতুলনীয়। এবং সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য পড়ল সম্মুখে উপবিষ্টা সেই অসামান্যা নারীর চক্ষুর প্রতি।

তীক্ষ্ণ ধারাল ছুরির ফলার মত সে দুটি চক্ষুর দৃষ্টি। যে দৃষ্টি কিরীটীর প্রতি স্থিরনিবদ্ধ। মুহূর্তের স্তব্ধতা। তারপরই প্রসন্ন একটুকরো হাসিতে তরুণীর মুখখানা যেন ভরে গেল।

সে বললে, বসুন।

পরের পর্ব :
০৬-১০. বসলাম পাশাপাশি দুজনে দুটি চেয়ারে
১১-১৫. তারপরও কিরীটী একটা সপ্তাহ
১৬-২০. তারপরের দিন ও রাত
২১-২৬. আপনি জানেন না

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত