মেয়েটি বোকা ছিলো

মেয়েটি বোকা ছিলো

খেজুর গাছ দিয়ে বানানো ঘাটে পা ভিজিয়ে বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেই চলেছে শাপলা। একটু পরপর চোখ মুছতে মুছতে চোখ ফুলে লাল হয়ে গেছে। কিছু সময় পর শাপলার মা লুৎফা বেগমের কণ্ঠ শোনা গেল।

“এই ভর সন্ধ্যায় ঘাটে বইসা কি করোস? হায় হায় পানিয়ে পাও দিছোস? উঠা জলদি।” শাপলার পা দুটো পানি থেকে উঠিয়ে দিলেন লুৎফা বেগম।

“ঘরে চল মা। সন্ধ্যার সময় পানির কাছে আসতে নাই। বিপদ হইতে পারে।”

শাপলা গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। এই মুহূর্তে সে খুব রেগে আছে। তার কান্নার রোল আরো বাড়তে লাগল। কান্না গলায় যা বলছে কিছুই স্পষ্ট নয়। কেবল লুৎফা বেগম নেহাৎ শাপলার মা বলে মেয়ের গোঙ্গানো কথা বুঝতে পারেন। “আমি যামু না। আব্বারে কও ঐ বেটিরে ঘর থেইকা বাইর হইতে। আমারে খালি মারে।” লুৎফা বেগমের মনটাও যেন একটু সময়ের জন্য খারাপ হয়ে গেল। কারণ নতুন মানুষটাকে বের করে দেবার মতো অধিকার তার নেই। শাপলার বাবা আকতার মিয়া হঠাৎ করেই একদিন লাল শাড়ি পরা, ঘোমটা দিয়ে কড়া সাজুগুজু করা একটা মহিলাকে ঘরে এনে তুলেছেন। শাপলার মা আকতার মিয়ার ঘরের এখন প্রথম বউ। আর নতুন মানুষটা দ্বিতীয় বউ।

একদিন সন্ধ্যবেলা লুৎফা বেগম আর শাপলা আকতার মিয়ার জন্যে অপেক্ষা করছিল। সেই ভোরবেলা থেকে সকাল যায়, দুপুর যায়, বিকেলটাও গড়িয়ে যায়। রাত পোহায়, সকাল হয়। আকতার মিয়ার আর খবর মেলেনা। শাপলার মা এদিক ওদিক অনেকভাবে খবর নেয়। তবুও আকতার মিয়া বেপাত্তা। টানা চারদিন পর আকতার মিয়া ফিরে আসে। তবে একা না। সঙ্গে লম্বা ঘোমটা টানা, শরীরে লাল টুকটুকে শাড়ি পেঁচানো একটা মেয়ে। বয়স কুড়ি কি একুশ হবে। আকতার মিয়ার পরনেও একটা নতুন পাঞ্জাবী। লুৎফা বেগম ঘরে গিয়ে কুপিটা জালিয়ে আনে। আবছা আলোয় লুৎফার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে ওঠে। শাপলাও হা করে তাকিয়ে আছে নিজের বাপের দিকে। আর উৎসুকভাবে দেখছে নতুন শাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা নতুন মানুষটাকে।

“এতগুলা দিন কই ছিলেন?”

“আকতার মিয়া চুপ।”

“কি হলো বলেন। কই ছিলেন আপনে? ঘরে চাল নাই, ডাল নাই, কুপি ধরানোর মতো এক ফোঁটা তেলও নাই। আর আপনেরও কোনো খবর নাই। এই বেডি কে? কারে নিয়া আসছেন আপনে? কথা বলেন না ক্যান? কে ও?” “আমি ওরে বিয়া করছি। অরে ঘরে লইয়া যা।”

লুৎফা বেগম কাঁদো কাঁদো আর ঝাঁঝালো গলায় আকতার মিয়াকে জেরা করছিলো। আকতার মিয়ার প্রত্যুত্তরে লুৎফা বেগম একদম বাকহীন হয়ে উঠানের মাঝখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। আকতার মিয়া লুৎফার দিকে তাকিয়ে চোখের খানিক বিরক্তি ঢেলে নতুন মানুষটাকে নিয়ে ঘরে চলে গেল। শাপলা ছুটে এসে লুৎফার আঁচল টেনে দাঁড়ালো। লুৎফা বেগম শাপলাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে।

এখন আর আকতার মিয়া শাপলার খবর নেয় না। স্ত্রী লুৎফারও খবর নেয়ার প্রয়োজন মনে করে না। যেন ঘরের চারদিকে ঘুরে বেড়ানো নতুন মানুষটাই আকতার মিয়ার সব। লুৎফা বেগমের কলিজায় টান পরে। ঘরের কপাটের ওপারে যখন নতুন মানুষ আর স্বামীর চাপা হাসির শব্দে রাত ভারী হয়, লুৎফা বেগম তখন মুখে কাপড় গুঁজে কাঁদতে থাকে। সংসারটা এভাবে ভাঙ্গার কথা ছিলো না তো। ওদের কাটানো প্রতিটা সেকেন্ড যেন লুৎফা বেগমের বুকের ভেতরটাকে ক্ষত বিক্ষত করতে থাকে। দিন দিন বাচ্চা শাপলাকেও তার বাবা অনাদর করতে থাকে। নতুন মানুষটা একটু এদিক ওদিক হলেই শাপলার গায়ে হাত তোলে। আকতার মিয়া সব দেখে বুঝেও চেপে যায়। লুৎফা বেগম তো বাধা কাজের লোক।

“শুনছেন? ছোড বউ আজকে শাপলারে মারছে।”

“ক্যান? কি করছে শাপলা?”

“ছোড বউয়ের পাউডারের ডিব্বা ধরছিলো তাই।”

“তরে না কইছি, শাপলারে চোখে চোখে রাখতে? ছোড বউয়ের ঘরে মানা করার পরেও গেলে মাইর তো খাইবোই।”

“আপনে কিছুই কইবেন না ছোড বউরে? এতটুক মাইয়াডারে কি জোরে থাপ্পর মারছে। এই যে দেখেন, দাগ হইয়া গেছে।” শাপলাকে টেনে এনে পেছন ঘুরিয়ে পিঠে বসে যাওয়া থাপ্পড়ের দাগ দেখালো লুৎফা। শাপলা হেচকি তুলে কাঁদছে। “মাইয়ারে সামলাইয়া রাখতে পারলে থাক। নাইলে বাপের বাড়ি চইলা যা। ছোড ছোড বিষয় নিয়া নালিশ করবি না। এখন ছোড বউরে গিয়া ক আমি ডাকতেছি।” লুৎফা আর কোনো কথা বললো না। তার অবাক লাগছে আকতার মিয়াকে দেখে। একটা মানুষ কত সহজে বদলে যেতে পারে। কতটা পরিবর্তন হলে একটা মানুষ তার সন্তানকে করা আঘাতটা দেখেও চুপ করে থাকতে পারে।

এরপর মাস যায়, বছর যায়। আরও অনেক বসন্ত পেরোয়। শাপলা বড় হতে থাকে। লুৎফা বেগমেরও সব সয়ে যায়। নতুন মানুষটার পেটে আরেকটা নতুন মানুষ আসে। আকতার মিয়ার কড়া আদেশ, ছোট বউয়ের যত্নের কোনো ত্রুটি যেন না হয়। লুৎফা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে।

একদিন খুব ভোরবেলা শাপলার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মা মা করে কাঁদতে কাঁদতে এদিক সেদিক খুঁজতে থাকে লুৎফাকে। কিন্তু লুৎফাকে কোথাও পাওয়া গেলো না। আকতার মিয়া সম্মানের ভয়ে লুৎফাকে ফিরিয়ে আনতে খোঁজ লাগালেন। কিন্তু লুৎফা নিখোঁজ। শাপলা তার বাবার কাছে গিয়ে অনেকবার তার মায়ের খবর জানতে চায়। কিন্তু আকতার মিয়া কোনো উত্তর দিতে পারে না। এর কিছুদিন পরে জানা যায়, পাশের গ্রামের সবুজ শেখের ছেলে শরীফের সাথে লুৎফা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে। অনেকদিন ধরেই তাদের সম্পর্কটা চলছিলো। শেষমেষ সব ছেড়ে বিয়ে করে নিলো। তারা কেউই আর গ্রামে থাকে না। কোথায় থাকে সেটাও কেউ সঠিক জানে না।

লুৎফা চলে যাবার বেশ কয়েক বছর পর শাপলার বয়স ১৪ তে পরেছে। বেশ কয়েকটা জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসছে। ছোট বউয়ের একটা ফুটফুটে ছেলে সন্তান হয়েছে। তার বয়সও এখন বছর সাড়ে তিন চলছে। নাম রেখেছে মারুফ। সারাদিন মারুফ শাপলার পেছন পেছন ঘুরে বেড়ায়। ভাই বোনের এই জুটি দেখে কেউ বুঝতে পারবে না যে তারা সৎ ভাই বোন। কিন্তু ছোট বউ কেন যেন শাপলাকে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। শাপলাকে তাড়ানোর জন্যে আকতার মিয়ার কাছে রোজ রোজ বায়না চলছেই। আকতার মিয়া তাই শাপলার জন্য ছেলে খুঁজতে থাকে।

গেল সপ্তাহে গ্রামের মাতবর সালাম তার একমাত্র ছেলের জন্য শাপলাকে আকতারের কাছে চেয়েছিল। ছেলেটা যদিও কাজ কর্ম তেমন কিছু করে না। কিন্তু বাপের যা আছে তা দিয়েই জীবন চলে যাবে। শুধু বাপের আছে বলেই ২৮ বছরের যুবক সাগর কিছু করে না তা না। নিজের অলসতাও এর জন্যে অনেকাংশে দায়ী। আকতার মিয়া ভাবছে শাপলাকে সাগরের সাথে বিয়ে দিলে কেমন হয়। তারও একটা সংসার হবে, ছোট বউও শান্ত হবে।

শাপলা সারাদিন পরে ঘরের সব কাজ সেরে বিছানায় তার ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে অতীতগুলো ভাবে। আধো ঘুম চোখে মনে হয় লুৎফা এসে মাথার কাছে বসে আছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ঠিক যেমন ছোটবেলায় খেলা শেষে ক্লান্ত শাপলা দৌড়ে এসে মায়ের কোলে আছড়ে পরে ঘুমিয়ে যেত। আর লুৎফা শাপলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো শাপলার পড়াশোনা হয় না। গ্রামের ছেলেমেয়েগুলো বই হাতে মাটির রাস্তা ধরে স্কুলে যায়। শাপলা ঘরের খুঁটি আঁকড়ে ধরে তাকিয়ে থাকে। আকতার মিয়া শাপলার বিয়ে পাকাপাকি করে ফেলে। ছোট বউকে রাতে সেটা জানায়। “আপদটা বিদায় হইলেই বাইচা যাই।” দরজার ওপাশ থেকে ছোট বউয়ের তাচ্ছিল্য শুনে শাপলা কষ্ট পায়। মনে মনে মাকে খোঁজে। আজ যদি মা থাকতো, বুকে ধরে অন্তত একটু কাঁদা যেতো। মনের কথা শোনার মতো কেউ নেই। বাবা নেই, মা নেই। শাপলা শুধুই একার আমি।

বাড়িটা সাজানো হচ্ছে। বিয়ের দিনটাতেও শাপলার ছুটি নেই। কাজের ফাঁকে ছোট বউয়ের কথার ঝাঁঝে শাপলা আজ বিক্ষত হচ্ছে না। যাক এবার তাহলে একটু মুক্তি হবে। আজ শাপলার মন ভালো। সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। রাতের বাতিগুলো শাপলার ভালো লাগছে। মেয়েরা “জামাই আইছে, জামাই আইছে” বলে শাপলাকে রেখেই ঘর থেকে সবাই ছুটে বেরিয়ে যায়। শাপলা লজ্জা পায়। লাল বেনারসিতে শাপলাকে পরীর মতো লাগে। বাইরে বিয়ের সানাই বাজছে। আজ শাপলার বিয়ে। কিছুদিন পর ওই বাড়িতে শাপলার নতুন জীবন চলছে। আকতার মিয়া সেদিন বাড়িতেই ছিলো। খবর আসে শাপলার অবস্থা শোচনীয়। ও বাড়ির লোকেরা ডাক্তারের কাছে নেয়নি। আকতার মিয়া কিছু বলার আগেই ছোট বউ বলে বসে “বিয়ার পর বাপের বাড়ির কোনো দায়িত্ব নাই। সব ওই বাড়ির। মরলেও ওই বাড়ির। এই বাড়িতে কোনো কাম নাই।”

আকতার মিয়ার কিছু বলার থাকে না। চুপচাপ ছোট বউয়ের কথা মেনে নেয়। আস্তে আস্তে আকতার মিয়া মেয়ের কথা ভুলে যায়। শ্বশুরবাড়িতে শাপলা অপেক্ষায় থাকে। বাবা তাকে দেখতে আসবে। কিন্তু বাবা আর আসে না। সারাদিন কাজ করার পরেও রাতে স্বামীর অত্যাচার এখন শাপলার কাছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। শাপলা এখন আর কারো জন্যে অপেক্ষা করে না। তার দেখা স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। বাবা থেকেও নেই। মা-ও চলে গেছে। শাপলাকে বোঝার মতো কেউ নেই। সবাই নিজের কথা ভাবে। আজ শাপলাও স্বপ্নের বাড়ি এসে ঠকে গেল।শাপলা নিজেকে বোকা ভাবে। বোকা না হলে কি এতকিছুর পরেও বেঁচে থাকা যায়?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত