১১-১৫. কিরীটী বোধহয় মুহূর্তের জন্য ভাবে
কিরীটী বোধহয় মুহূর্তের জন্য ভাবে, ঠিক কি ভাবে কেমন করে তার বক্তব্যটা সদ্যপরিচিতা এক ভদ্রমহিলার কাছে ব্যক্ত করবে!
কি ভাবে কোথা থেকে শুরু করে বিশাখা চৌধুরীর কাছে যেটুকু জানবার জেনে নেবে!
দেখুন বিশাখা দেবী, ডাক্তার সেন আপনার পরিচিত এবং আমারও পরিচিত। সেই সূত্রেই অবিশ্যি এই অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করতে এলাম—
বিশাখা সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর কথার জবাব দেয় না।
নিঃশব্দে কেবল কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
অবিশ্যি আজ এই সময় না হলেও কাল বা পরশু যখনই হোক আপনার কাছে আমাকে আসতে হতো, কারণ–
মৃদুকণ্ঠে বাধা দিয়ে বিশাখা বললে, আপনি অত কিন্তু করছেন কেন মিঃ রায়, আপনি কেন এসেছেন তা আমি বুঝতে পেরেছি–
পেরেছেন?
তা পেরেছি বৈকি। সুনন্দার মৃত্যু সম্পর্কেই বোধ হয় কিছু জিজ্ঞাস্য আছে আমার কাছে আপনার!
ঠিক তাই। তবে–
অবিশ্যি সত্যি কথাই বলছি, আপনি যখন এসেছেন এবং আপনি যখন ডাঃ সেনের বন্ধু, তখন অনুমানই করে নিয়েছি সুনন্দার মৃত্যুর রহস্যের সন্ধানের ভারটা আপনার বন্ধুর অনুরোধেই হয়ত আপনি হাতে নিয়েছেন। তাই নয় কি?
কিরীটী বিশাখার শেষ কথাতেই বুঝতে পারে, মেয়েটি বুদ্ধিমতী।
মৃদু হেসে কিরীটী বলে, অনুমান আপনার মিথ্যে নয় বিশাখা দেবী। সেনের অনুরোধেই যেমন এ ব্যাপারে আমি হাত দিয়েছি, তেমনি সেই ব্যাপারেই এ সময়ে আপনার এখানে আমার আসা। কিন্তু আপনিও কি চান না বিশাখা দেবী–
কি?
সে রাত্রে অমন নৃশংসভাবে যে আপনাদের পরিচিত সুনন্দা চ্যাটার্জীকে হত্যা করেছে সে ধরা পড়ক!
চাই বৈকি। কিন্তু আমি ঠিক আপনাকে যে সে ব্যাপারে কিভাবে সাহায্য করতে পারি, সেটাই এখনো বুঝে উঠতে পারছি না!
সে-রাত্রে সুনন্দা দেবীর হত্যার ব্যাপারটা রহস্যে আবৃত হয়ে আছে নিঃসন্দেহে। আর সাহায্যের কথা বলছেন! কার কাছে যে কিভাবে সাহায্য পাবো, কে কতটুকু সূত্র আমার হাতে তুলে দেবেন তাও আগে থাকতে বলা দুষ্কর। তবু আপনারা সে-রাত্রে যাঁরা অকুস্থানে উপস্থিত ছিলেন—
উপস্থিত শুধু আমরা কজনাই তো নয় মিঃ রায়, নিমন্ত্রণ-বাড়িতে সে রাত্রে প্রায় পাঁচশ জন উপস্থিত ছিলেন।
তা অবিশ্যি ছিলেন কিন্তু সুনন্দা চ্যাটার্জীর পরিচিত আপনারা যে কজন ছিলেন, আপাততঃ তাঁদের যা বলবার তা জানতে পারলেই মনে হচ্ছে হয়তো আমার কাজটা অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
আপনি সত্যিই কি তাই মনে করেন মিঃ রায়?
প্রশ্নটা করে সোজাসুজি স্পষ্ট দৃষ্টিতে যেন তাকিয়ে থাকে বিশাখা কিরীটীর মুখের দিকে।
কিরীটীর সে চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, কিসের একটা চাপা উত্তেজনা যেন সেই দুই চোখের দৃষ্টিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
তাই আমার মনে হয় বিশাখা দেবী!
চোখে চোখ রেখেই স্পষ্ট কণ্ঠে কিরীটী জবাবটা দিল।
অবিশ্যি আমি অস্বীকার করবো না মিঃ রায়, আপনি কেসটা হাতে নিয়েছেন জেনে আমি আনন্দিতই হয়েছি–
সত্যি আনন্দিত হয়েছেন?
নিশ্চয়ই, কারণ—বলতে বলতে থেমে যায় বিশাখা।
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে তাগিদ দেয়, কই, বললেন না কারণটা কি?
কারণ আমার ধারণা, পুলিসের সাধ্যও নেই ঐ দুর্বোধ্য ব্যাপারের কোন মীমাংসাতেই পোঁছানো!
কেন?
বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই ওদের কর্মদক্ষতা তো জানতে আর কারো বাকী নেই!
না, না—এ আপনি কি বলছেন বিশাখা দেবী? সাধনবাবু খুব কপিটেন্ট লোক—
তা হবেন হয়তো—
হবেন নয়, সত্যিই দেখবেন এ রহস্যের মীমাংসা তিনি করবেনই।
তাই বুঝি সর্বাগ্রে নীরেনবাবুকে অ্যারেস্ট করে বসে আছেন!
কান্নার স্বরে একটা যেন স্পষ্ট ব্যঙ্গ ঝরে পড়ে বিশাখার কণ্ঠ থেকে।
অ্যারেস্ট করবার কারণ আছে বলেই হয়ত তাঁকে অ্যারেস্ট করেছেন—
কি এমন অকাট্য প্রমাণ তার বিরুদ্ধে পেয়েছেন তিনি বলুন তো?
তা কেমন করে বলবো বলুন, তবে পেয়েছেন বৈকি নিশ্চয়ই কিছু!
কিছু পান নি। রামের অপরাধে শ্যামকে ধরতেই ওরা অভ্যস্ত।
বিশাখা দেবী, আমি দেখছি পুলিসের ওপরে আপনার তেমন আস্থা নেই। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না, এর চাইতেও অনেক জটিল ও দুর্বোধ্য ব্যাপারেরও তারা মীমাংসা করতে পারে ও করেছে, এমন নজিরের অভাব নেই! সে কথা যাক, অসময়ে এসে আপনাকে বেশী আটকে রেখে বিব্রত করবো না। গোটা তিন-চার প্রশ্নের জবাব কেবল আপনার কাছ থেকে চাই–
বলুন, সাধ্যমত আমি আপনাকে সাহায্য করতে চেষ্টা করবো।
বিশাখা দেবী, আপনি দুর্ঘটনার রাত্রে আপনার জবানবন্দীতে বলেছেন, দুর্ঘটনাটা প্রকাশ হওয়ার আধ ঘণ্টাটাক আগে আপনি নাকি হলঘরে কাকে ডাকতে এসে একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে সুনন্দা চ্যাটার্জীকে একটা সোফার ওপরে পাশাপাশি বসে কথাবার্তা বলতে দেখেছিলেন—
দেখেছিলাম।
কে সে ভদ্রলোক? তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন?
না। তাকে আমি পূর্বে কখনো দেখি নি।
কি রকম দেখতে?
রোগা, লম্বা এবং পরিধানে ধুতি-পাঞ্জাবি ছিল। আর–
আর? চোখে কালো কাচের চশমা ছিল।
হুঁ। আর একটা কথা, সে-রাত্রে হলের মধ্যে যিনি ম্যাজিক দেখাচ্ছিলেন, তাঁকে আপনি ও বিষ্ণুবাবু দুজনেই দেখেছিলেন—
বিষ্ণুবাবু দেখেছিলেন কিনা জানি না, তবে আমি দেখেছি!
যাক সে কথা, আপনি বলেছেন তার গলার স্বরটা নাকি অবিকল আমাদের ডাক্তারের গলার স্বরের মতো বলেই সে-রাত্রে আপনার মনে হয়েছিল!
মুহূর্তের জন্য কিরীটীর পার্শ্বে উপবিষ্ট মৃণালের দিকে তাকিয়ে বিশাখা বলে, হ্যাঁ বলেছিলাম।
যা বলেছেন আপনি, সে-সম্পর্কে আপনার কোনরকম মতদ্বৈধ নেই—You are sure!
তাই মনে হয়েছিল সে-সময়—
কিন্তু ভদ্রলোক দেখতে কি ডাক্তারের মতো ছিলেন?
সেই রকমই।
অতঃপর কয়েকটা মুহূর্তের জন্য একটা স্তব্ধতা।
বিশাখা দেবী, শুনেছি আপনি নিহত মিস্ চ্যাটার্জীর সঙ্গে একই কলেজে অধ্যাপনার কাজ করতেন—কথাটা কি সত্যি?
সত্যি।
কতদিন একত্রে একই কলেজে অধ্যাপনার কাজ করছেন আপনারা?
তা বছর চার হবে।
A prety long time—কি বলুন!
তাই।
আপনাদের উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ছিল নিশ্চয়ই?
না। তীক্ষ্ণকণ্ঠে জবাব দেয় বিশাখা।
ঘনিষ্ঠতা ছিল না, অথচ বলছেন একই কলেজে দুজনে আপনারা দীর্ঘ চার বছর ধরে—
তা করলেই বা!
না, তাই বলছিলাম—একই কলেজে দীর্ঘ চার বছর ধরে কাজ করেও আপনাদের পরস্পরের মধ্যে কোন ঘনিষ্ঠতা ছিল না-rather strange!
কেন, এতে strange হবার কি থাকতে পারে?
তা একটু মনে হয় বৈকি! কিরীটী বলে।
মনে হবার তো কোন কারণ নেই।
কিন্তু বিশাখা দেবী–
বিশাখা কিরীটীকে কথা শেষ করতে দিল না, সে বললে, আমি তাকে ঘৃণা করতাম—সমস্ত অন্তর দিয়ে ঘৃণা করতাম।
কণ্ঠস্বরে বিশাখার যেন একটা তিক্ত ঘৃণা আর অবরুদ্ধ আক্রোশ ঝরে পড়লো।
ঘৃণাই যে শুধু আপনি তাকে করতেন বিশাখা দেবী তাই নয়, মনে হচ্ছে আক্রোশও ছিল তার প্রতি আপনার একটা!
বিচিত্র নয়। যদি জানবার আপনার সৌভাগ্য হতো মিঃ রায়, কি নীচ মন আর কুৎসিত চরিত্র তার ছিল—she was not only a vamp, a filthy snake too! স্বাভাবিক ভাবে একজন মানুষ আর একজন মানুষের ঐ ধরণের বীভৎস মৃত্যুতে দুঃখ পায়, আমিও পেয়েছি তবু বলবো, she deserved it! Rather I should say, she has been rightly served!
কথাগুলো একটানা বলে অন্যদিকে মুখ ফেরালো বিশাখা।
মৃণাল বোধ হয় সহ্য করতে পারে না আর, কি যেন বলবার চেষ্টা করে, কিন্তু বিশাখা—তুমি–
একটা থাবা দিয়ে যেন সঙ্গে সঙ্গে মৃণালের বক্তব্য থামিয়ে দিল বিশাখা।
বললে, থাম থাম মৃণাল—তোমাদের ক বন্ধুর কাছে সে demi-goddess ছিল জানি। পুরুষ তোমরা, তাই তার সত্যিকারের বীভৎস চেহারাটা কখনো তোমাদের চোখে পড়ে নি—পড়লে বুঝতে how obscene and how filthy she was!
অকস্মাৎ ঐ সময় কিরীটী ধীর শান্ত কণ্ঠে কথা বলে ওঠে, বিশাখা দেবী, সুনন্দা চ্যাটার্জীর নিহত হওয়ার ব্যাপারে আপনি কি তাহলে কাউকে সন্দেহ করেন?
সন্দেহ!
হ্যাঁ।
সন্দেহের কথা যদি বলেন মিঃ রায় তো বলবো, সকলকেই আমি করি—এমন কি নিজেকে পর্যন্ত আমি সন্দেহ করি!
নিজেকেও আপনি সন্দেহ করেন?
নিশ্চয়ই। কারণ many a time I sincerely wished that I could kill her! কত সময় মনে হয়েছে তাকে আমি হত্যা করি—strangle her to death!
অবরুদ্ধ একটা উত্তেজনায় যেন হাঁপাতে থাকে বিশাখা।
সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটী আর কোন প্রশ্ন করে না বিশাখাকে। একটু সময় দেয় যেন।
.
বিশাখা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসেছিল।
বেশ কিছুক্ষণ একটা স্তব্ধতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হবার পর একসময় আবার মৃদুকণ্ঠে কিরীটী বলে, বিশাখা দেবী, আজ আর আপনাকে বিরক্ত করবো না বেশী। একটি মাত্র প্রশ্ন আপনাকে আমার আর করবার আছে।
বিশাখা ফিরে তাকালো কিরীটীর মুখের দিকে।
একটু আগে আপনি ডাক্তারকে বললেন, তোমাদের কবন্ধু বন্ধু বলতে কাকে কাকে আপনি exactly mean করছেন?
কেন, ওরা বিশেষ তিনজন—যারা ওদের বন্ধুমহলে Three Musketeers বলে পরিচিত।
Three Musketeers!
হ্যাঁ–মৃণাল, সুসীম আর নীরেন!
নীরেনবাবুকে তাহলে আপনি চিনতেন?
চিনতাম বৈকি।
Excuse me, আর একটি কথা—নীরেনবাবুর সঙ্গে যে সুনন্দা চ্যাটার্জীর পরিচয় ছিল, আপনি কি তা জানতেন?
কেন জানব না, খুব জানতাম!
তুমি জানতে বিশাখা? মৃণাল বিশাখার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করে।
জানতাম বৈকি। কেন, তুমি জানতে না?
না।
আশ্চর্য! সে বর্মা থেকে এলে তো তার বেশীর ভাগ সময় ওর বাড়িতেই কাটত। দুনিয়াসুদ্ধ সবাই ব্যাপারটা জানত, আর বলতে চাও তুমিই জানতে না—nonsense!
সত্যিই আমি জানতাম না, মৃণাল বলে, আর সুসীমও জানত না।
Another hypocrite-কাজে এক-মুখে আর!
কি বলছো বিশাখা?
হ্যাঁ, হ্যাঁ—another hypocrite হচ্ছে তোমাদের ঐ সুসীম নাগ!
চল হে ডাক্তার, এবারে ওঠা যাক। ওঁকে অনেকক্ষণ বিরক্ত করেছি। বলতে বলতে কিরীটী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
.
১২.
ঐদিনই সন্ধ্যাবেলা।
কিরীটীর বাড়িতে তার দোতলার বসবার ঘরে সাধন দত্ত আর কিরীটী দুটো চেয়ারে মুখোমুখি বসে সুনন্দা চ্যাটার্জীর হত্যা-ব্যাপার নিয়েই আলোচনা করছিলেন।
সাধন দত্ত বলছিলেন, সেদিন উৎসবের রাত্রের সেই ম্যাজিসিয়ান ভদ্রলোকের ব্যাপারটার কিছুতেই কোন সলুশনে যেন আমি আসতে পারছি না মিঃ রায়! ব্যাপারটা so mysterious–
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, মিস্টিরিয়াস!
নয়? একঘর নিমন্ত্রিতের মধ্যে লোকটা ম্যাজিক দেখিয়ে গেল, আর ব্যাপারটা বাড়ির লোকেদের কারোরই নজরে পড়ল না—এমন কি ডাঃ সেনেরও নয়!
নজরের কথা ছেড়ে দিন মিঃ দত্ত, তবে আপনি ব্যাপারটার মধ্যে যতখানি গুরুত্ব আরোপ করছেন, আমার মনে হয় তার কিছুই নয়—
তার মানে? কি আপনি বলতে চান মিঃ রায়?
আমার তো মনে হয় ব্যাপারটা নিছক একটা joke-কৌতুক ছাড়া কিছুই নয়।
কি বললেন, joke-কৌতুক!
হ্যাঁ, joke-বাংলা ভাষায় যাকে কৌতুক বলে।
তার মানে?
মানেটা খুবই সহজ। আমি বলতে চাই, there was no intention behind! সেদিনকার উৎসবের মধ্যে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যেই হয়ত কেউ ম্যাজিসিয়ান সেজে খানিকটা কৌতুক-বলতে পারেন নিছক খানিকটা আনন্দ সৃষ্টি করবারই চেষ্টা করেছিলেন মাত্র। যদিচ ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত সুনন্দা চ্যাটার্জীর আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে ঘোরালো হয়ে ওঠায় বেচারী ম্যাজিসিয়ান হয়তো শেষ পর্যন্ত আত্মগোপন করতে এক প্রকার বাধ্য হয়েছেন।
কিন্তু–
তবে এটুকু আপনাকে বলতে পারি মিঃ দত্ত, ব্যাপারটা নিতান্তই যাকে বলে কাকতালীয়। সুনন্দা চ্যাটার্জীর মৃত্যুর সঙ্গে সত্যিই আমার মনে হয় কোন যোগ নেই। কিন্তু সে কথা যাক, আপাততঃ সব কিছু শুনে সকলের সঙ্গে কথা বলে ও অকুস্থান ঘুরে যে কথাগুলো আপনাকে আমি বলতে চাই–
কি, বলুন?
বিশাখা বিবাহিত, সে কথাটা আপনি বোধ হয় জানেন না।
সে কি? তার তো জানি বিয়েই হয় নি?
না, সে বিবাহিত। তার স্বামী হচ্ছে একজন ভারতীয় ক্রিশ্চান—আলফ্রেড ঘোষ। ইস্টার্ন রেলওয়েতে চাকরি করে—গার্ড।
সত্যি বলছেন!
তাই তো শুনলাম।
বিবাহিত—তবু নিজেকে কুমারী বলে চালাচ্ছে। এ যে রীতিমত জটিল বলে মনে হচ্ছে!
সেই জটিলতার কারণটাই তো খুঁজে বের করতে হবে আপনাকে মিঃ দত্ত!
কিন্তু কেমন করে?
সে খুব শক্ত হবে না। আগে আপনি একটা খোঁজ নিন তো!
কিসের খোঁজ নেবো?
রেলওয়ে গার্ড মিঃ আলফ্রে ঘোষ সম্পর্কে details খবরাখবরটা যোগাড় করুন তো।
বেশ।
দ্বিতীয়তঃ, প্রোমে নীরেন সেন সম্পর্কে যাবতীয় সংবাদ আপনাকে সংগ্রহ করতে হবে।
করবো। আর কিছু?
না, আপাততঃ আর কিছু নয়। ঐ সংবাদগুলো আমাকে আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন। সংগ্রহ করে দিন।
বেশ, দেবো।
হ্যাঁ, আর আগে যা বলেছি—যাবার পথেই কিন্তু সে কাজটা সেরে যাবেন মিঃ দত্ত!
.
সাধন দত্ত বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছেন প্রায় ঘণ্টা-দুই পূর্বে।
কিরীটী সোফাটার উপরে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ছিল। ঘরের আলোটা সাধন দত্ত চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিভিয়ে দিয়েছিল কিরীটী। জংলী এসে অন্ধকার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ালো, কিন্তু ঘর অন্ধকার থাকায় ইতস্তত করে—ডাকবে কি ডাকবে না!
কিন্তু জংলীর পদশব্দ কিরীটীর শ্রুতিগোচর হয়েছিল, সে প্রশ্ন করে, কি রে জংলী?
একজন মেয়েছেলে দেখা করতে চায়।
কিরীটী মুহূর্তকাল যেন কি ভাবলো; তারপরে মৃদুকণ্ঠে বললে, ঘরের আলোটা জ্বেলে দিয়ে এ-ঘরেই পাঠিয়ে দে তাকে।
ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বেলে দিয়ে জংলী নীচে চলে গেল।
একটু পরেই পদশব্দ শোনা গেল ঘরের দরজার সামনে।
আসুন বিশাখা দেবী!
সত্যি, বিশাখাই ঘরে প্রবেশ করলো।
সর্বাঙ্গে একটা চাদর জড়ানো ছিল বিশাখার এবং সেই চাদরের সাহায্যেই মাথায় ঈষৎ অবগুণ্ঠন ভোলা ছিল।
বসুন বিশাখা দেবী!
বিশাখা কিরীটীর মুখোমুখি ছোট সোফাটার উপরে উপবেশন করলো।
জানতাম আপনি আসবেন, আপনার আগমন প্রতীক্ষ্ণই করছিলাম আমি এতক্ষণ।
আমি আসবো আপনি জানতেন!
জানতাম।
কথাটা বলে হঠাৎ যেন কিরীটী স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো।
বিশাখাও স্তব্ধ, কিরীটীও স্তব্ধ।
উভয়ের মধ্যখানে যেন একটা স্তব্ধতার পাষাণভার।
বেশ কিছুক্ষণ পরে বিশাখাই প্রথমে কথা বলে, কিরীটীবাবু!
বলুন?
এইমাত্র আপনি যা বললেন তা কি সত্যি?
কি সত্যি বিশাখা দেবী?
আমি যে এ-সময় আসবো আপনি জানতেন!
সত্যিই জানতাম বিশাখা দেবী। আর আপনি কেন এসেছেন তাও জানি।
জানেন?
জানি।
তারপর একটু থেমে কিরীটী বলে, থানা-অফিসার মিঃ দত্ত আপনার কাছে গিয়েছিলেন, তাই না?
হ্যাঁ, কিন্তু আশ্চর্য-আপনি জানলেন কি করে!
কারণ আমিই তাকে যেতে বলেছিলাম।
আপনি যেতে বলেছিলেন?
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন?
সে কথা যাক, আপনি বরং যা বলতে এসেছেন বলুন।
জবাবে বিশাখা অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ করেই থাকে।
কেবল নিঃশব্দে শাড়ির আঁচলের পাড়ের একটা অংশ টেনে টেনে সোজা করতে থাকে।
কই, বললেন না?
মিঃ রায়!
বলুন?
আচ্ছা সত্যিই কি আপনি মনে করেন—
কি?
মানে বলছিলাম, নীরেনের ফাঁসি হবে!
কাউকে কেউ হত্যা করলে, প্রচলিত আইনে সেই শাস্তিই তো তার প্রাপ্য—to be hanged by neck till death!
সহসা যেন আর্তকণ্ঠে একটা চাপা উদ্বেগ প্রকাশ পায়, না, না—তা হতে পারে না! আমি বলছি নীরেন নির্দোষ—সে হত্যা করে নি! আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়—
নির্দোষিতা তো তার এমনি প্রমাণিত হবে না বিশাখা দেবী, তার জন্য রীতিমত প্রমাণ চাই।
অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো বিশাখা কিরীটীর মুখের দিকে। উদ্বেগ আর আশঙ্কায় বিশাখার সমস্ত মুখখানা কেমন যেন করুণ মনে হয়।
বিহ্বল কণ্ঠে বিশাখা বলে, প্রমাণ!
হ্যাঁ, প্রমাণ। বিশাখা দেবী, নীরেনবাবুর যদি ফঁসিই হয়, তাতে আপনার কি? তিনি তো আপনার কেউই নন?
বিশাখার চোখের কোল দুটো ছলছল করে ওঠে।
উপরের পাটির দাঁত দিয়ে সে তার নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে।
কেউ নয়—সত্যিই তো, সে আমার কে? কেউ তো নয়! কথাগুলো যেন কতকটা আত্মগতভাবে বলে বিশাখা এবং দুচোখের কোল বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
তারপরই হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় সোফা থেকে বিশাখা, বলে, আমি যাই–
কিন্তু যেজন্য এসেছিলেন বিশাখা দেবী, কই সে-সম্বন্ধে তো কিছু বললেন না!
কিছু না মিঃ রায়, আমি—আমি যাই–
পা বাড়ায় বিশাখা ঘর থেকে বের হয়ে যাবার জন্যে।
দাঁড়ান বিশাখা দেবী, শুনুন!
ঘুরে দাঁড়ালো বিশাখা কিরীটীর সে-ডাকে।
নীরেনবাবু সম্পর্কে আপনি আমাকে যা বলতে এসেছিলেন, নির্ভয়ে এবং নিঃসঙ্কোচেই আপনি আমাকে তা বলে যেতে পারেন।
বিশাখা কেমন যেন অসহায় বোবাদৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
বসুন-বসুন ঐ সোফাটায়। বিশাখা বসে পড়লো।
আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, সব কথা যদি আপনি আমার কাছে অকপটে স্বীকার করেন তো নিশ্চয়ই তাকে আমি–
মিঃ রায়!
হ্যাঁ কথা দিচ্ছি, আমি তাকে নিশ্চয়ই ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচাবো।
পারবেন—সত্যি বলছেন পারবেন?
পারবো। কিন্তু তার আগে সব কথা আপনাকে আমার কাছে স্বীকার করতে হবে।
অকস্মাৎ দুহাতে মুখ ঢেকে যেন কান্নায় একেবারে ভেঙে পড়ে বিশাখা, জানি না—আমি কিছু জানি না–কিছু জানি না–
অতঃপর মুহূর্তকাল চুপ করে থেকে কিরীটী বললে, কিছু জানেন না?
না, না, না—
বেশ, আমার কয়েকটা প্রশ্নের সত্য জবাব দিন অন্তত! সেরাত্রে কাকে আপনি দেখেছিলেন সুসীমবাবুর বাড়ির হলঘরে সুনন্দা চ্যাটার্জীর পাশে বসে কথা বলতে? বলুন, জবাব দিন?
জানি না, জানি না—চিনতে পারি নি—তাকে আমি চিনতে পারি নি—
কিন্তু আমি বলছি আপনি জানেন এবং চিনতে পেরেছিলেন তাকে। বলুন সত্যি কিনা?
না, না—
নীরেনবাবু, তাই না!
না, না—
হ্যাঁ, তিনি নীরেনবাবুই। বলুন সত্যি কিনা?
অশ্রুভেজা চোখ তুলে তাকালো বিশাখা কিরীটীর মুখের দিকে।
আর একটা কথা, আপনার স্বামী আলফ্রেড ঘোষ এখন কোথায়?
জানি না—
জানেন। বলুন তিনি কোথায়? সে রাত্রে তিনি কলকাতায় ছিলেন, তাই না?
মাথা নিচু করলো বিশাখা।
আলফ্রেড ঘোষের সঙ্গে তো আপনার কোন সম্পর্কই নেই, সত্যি কিনা?
সত্যি।
কতদিন হলো আপনাদের separation হয়েছে?
ছবছর। তা এখনো ডিভোর্স হয় নি কেন? কারণটা কি?
কারণ কিছুই নেই—
নিশ্চয়ই আছে। কি কারণ বলুন?
বলতে পারবো না—আমি বলতে পারবো না! বলতে বলতে আবার দুহাতে মুখ ঢাকলো বিশাখা।
একটু থেমে কিরীটী বললে, আপনি না বললেও আমি তা ঠিক জানতে পারবো বিশাখা দেবী—
আমি—আমি যাই—
আসুন।
বিশাখা অতঃপর সোফা থেকে উঠে টলতে টলতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
একটু পরেই পাশের ঘর থেকে সাধন দত্ত এসে ঐ ঘরে ঢুকলেন।
আশ্চর্য দাওয়াই বাতলেছিলেন তো মিঃ রায়! দত্ত বলেন।
মৃদু হেসে কিরীটী বলে, আশ্চর্যের কিছুই নেই এতে মিঃ দত্ত—
আশ্চর্য নয়! কি বলেন, একেবারে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছে!
আসবেই তো—
আপনি জানতেন ও আসবে?
জানতাম। এ যে যাকে বলে প্রাণের টান! একটু চোখ খোলা থাকলে আপনিও ব্যাপারটা বুঝতে পারতেন মিঃ দত্ত।
কি বলছেন!
হ্যাঁ তাই, আজ সকালে ওর বাড়িতে গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে যে মুহূর্তে ওর হাতের আংটিটার প্রতি আমার নজর পড়েছিল—
আংটি!
হ্যাঁ, ওর ডান হাতের অনামিকায় যে নাম মিনা করা আছে—সে নামটা হচ্ছে নীরেন।
আশ্চর্য, আপনি তাও দেখেছেন?
ভাল করে চোখ মেলে সব না দেখলে বুঝবো কি করে?
কথাটা বলে উঠে গিয়ে কিরীটী ঘরের কোণে ফোন ডায়েল করতে শুরু করে এবং নিম্নকণ্ঠে কার সঙ্গে যেন ফোনে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে।
ফোনে কথা বলা শেষ করে কিরীটী পুনরায় এসে নিজের জায়গায় বসতেই সাধন দত্ত বলেন, বিশাখা দেবীর কথাবার্তা শুনে এবারে তো আপনি মানবেন নিশ্চয়ই যে, নীরেনবাবুই সেরাত্রে সুনন্দা চ্যাটার্জীকে হত্যা করেছিলেন গলায় সিল্ককর্ডের ফাঁস দিয়ে!
তা যদি বলেন তো বিশাখাই বা হত্যাকারিণী নয় কেন?
কি বললেন?
বলছিলাম বিশাখাও তো হত্যা করে থাকতে পারে সেরাত্রে সুনন্দা চ্যাটার্জীকে। কেবল বিশাখাই বা বলি কেন, সুসীমবাবু এবং আমাদের ডাঃ সেনও সেরাত্রে সুনন্দাকে হত্যা করে। থাকতে পারে।
কিরীটীর শেষের কথায় কেমন যেন বিস্ময়ে ফ্যালফ্যাল্ করে চেয়ে থাকেন সাধন দত্ত ওর মুখের দিকে।
সুনন্দার মৃত্যুটা অত্যন্ত জটিল মিঃ দত্ত এবং হত্যাটা পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকারী অত্যন্ত কৌশলে সেরাত্রে হত্যা করলেও হত্যা করবার জন্য সে পূর্ব হতেই প্রস্তুত করেছিল নিজেকে। তারপর একটু থেমে আবার বলে, না মিঃ দত্ত, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। সুনন্দাকে হত্যার উদ্দেশ্যটা যে সেরাত্রে হত্যাকারীর কি ছিল, সেটাই এখনো আমার কাছে স্পষ্ট হয় নি। যদি একটা ব্যাপারে কারো সাহায্য পেতাম—
কি?
সুনন্দার অতীত জীবনটা যদি জানতে পারতাম! কিন্তু মৃণাল সুসীমবাবু বা নীরেনবাবু–কেউই কিছু বলবে না আমি জানি!
কথাগুলো বলতে বলতে সহসা যেন কিরীটীর কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত হয়ে যায়, স্পষ্ট ও দৃঢ়কণ্ঠে সে বলে, কিন্তু বলতে তাদের হবেই একদিন-সব কথা বলতে তাদের হবেই!
আবার যেন সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর কণ্ঠস্বর ঝিমিয়ে আসে, কতকটা যেন আপন মনেই বলে, কিন্তু কেমন করে—কেমন করে–
ঢং ঢং ঢং। ঐ সময় দেওয়াল-ঘড়িতে রাত্রি এগারটা ঘোষিত হলো।
সাধন দত্ত বলেন, রাত এগারটা, আমি উঠলাম।
সাধন দত্ত উঠে পড়লেন।
কিরীটী তার ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিল।
সেরাত্রে দুর্ঘটনার স্থানে উপস্থিত যারা ছিল, তাদের মধ্যে বিশেষ দুটি লোকের সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়ানো এখনও তার বাকী আছে।
বিষ্ণু দে আর আলফ্রেড ঘোষ। ট্রাফিক্ সুপারিনটেনডেন্ট মিঃ এলিসকে একটু আগে সে আলফ্রেড-এর বিষয়ে কাল তাকে জানাবার জন্য ফোন করে দিয়েছে।
আর বিষ্ণু দে—সে বর্তমানে কলকাতায় নেই।
দুর্ঘটনার পরের দিনই সে ইন্সুরেন্স কোম্পানির একটা জরুরী কাজে দিল্লীতে গিয়েছে। জানা গিয়েছে, সে নাকি পরশু-তরশু ফিরছে।
কৃষ্ণা এসে ঘরে ঢুকলো।
কি হলো, আজ সারাটা রাত্রি পায়চারি করেই কাটাবে নাকি?
সুনন্দা চ্যাটার্জীর হত্যার ব্যাপারে একটা মীমাংসা আমি কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না কৃষ্ণা!
মেয়েদের মন—ও যদি এত সহজেই তুমি বুঝতে! চল, রাত দুটো বাজে—শোবে চল।
চমকে ওঠে কিরীটী স্ত্রীর কথায়, বলে, কি-কি বললে? মেয়েদের মন!
হ্যাঁ, হ্যাঁ–চল।
কিন্তু কৃষ্ণা, সুসীমবাবুর সেদিনকার সব কথাও তত তোমাকে আমি বলেছি সুনন্দা চ্যাটার্জী সম্পর্কে–
তোমার সুসীমবাবুর কথা আর বলল না, আস্ত একটি গর্দভ! নইলে এত বড় ভুলটা সে কি করে করলো?
ভুল!
নয়? সুনন্দা তাকেই জেনো ভালবাসত—
তাই যদি হবে তো—
তাকে বিয়ে করলো না কেন, এই তো? কিন্তু—
কিন্তু কি কৃষ্ণা!
কৃষ্ণা মৃদু হেসে বলে, কিন্তু এখন থাক! চল তো শোবে। ঘুমে আমার চোখ ভেঙে আসছে–চল!
১৩.
আরো দুদিন পরে।
ফ্রি স্কুল স্ট্রীটের একটা পুরাতন ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে এসে সাধন দত্ত আর কিরীটী তার গাড়ি থেকে নামলো।
রাত তখন প্রায় সোয়া এগারটা হবে। পাড়াটা ইতিমধ্যেই যেন নিঝুম হয়ে গিয়েছে।
পুরাতন চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি। একতলায় সব দোকান। দোকানের দরজা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। উপরে দোতলা, তিনতলা ও চারতলায় সর্বসমেত বারোটি ফ্ল্যাট।
ছোট ছোট ফ্ল্যাট। বেডরুম ও সিটিংরুম নিয়ে মাঝারি সাইজের দুখানা করে ঘর, বাথরুম, কিচেন আর সামনে এক চিলতে করে ব্যালকনি। মাঝখান দিয়ে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে বরাবর একতলা থেকে চারতলা শেষ হয়ে সেই চারতলার ছাত পর্যন্ত। নানা ধরনের ভাড়াটে এসে ভিড় করেছে ফ্ল্যাটগুলোতে। তবে বেশীর ভাগই সব ভারতীয় ক্রিশ্চান ও অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান।
রাত সোয়া এগারোটা হলেও সব ফ্ল্যাটের তখনো আলো নিভে যায় নি। হাসি গান ও বাজনার শব্দ শোনা যাচ্ছে কোন কোন ফ্ল্যাটে। অনেক দিনের পুরাতন বাড়ি, তার উপরে বোধ হয় অনেক বছর কোন সংস্কারও হয় নি।
বহু জায়গায় সিঁড়ির সিমেন্ট চটে ইট বের হয়ে পড়েছে। কাঠের রেলিংটায় যে কত ময়লা আর ধুলো, তেল আর ঘাম জমে জমে বিচিত্র এক রূপ নিয়েছে তা বলা দুঃসাধ্য! দেওয়ালের চুনকামের অবস্থাও তাই। বাড়িটার মধ্যে আলো বাতাস খুব বেশী খেলে বলেও মনে হয় না। একটা ভ্যাপসা সোঁদা সোঁদা গন্ধ সর্বত্র।
গেট খোলাই ছিল। কেবল এক পাশে একজন মুসলমান দারোয়ান খাটিয়ার উপর বসেছিল।
ওদের দেখে, বিশেষ করে সাধন দত্তর গায়ে পুলিসের ইউনিফর্ম তাকে যেন তটস্থ করে তোলে। সঙ্গে সঙ্গে খাটিয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে।
আলফ্রেড ঘোষ এই বাড়িতে থাকে? সাধন দত্তই প্রশ্ন করেন।
হ্যাঁ সাব, যাইয়ে না—তিনতল্লামে পাঁচ নম্বর ফ্ল্যাট।
সাব হ্যায়?
জী।
কিরীটী আর সাধন দত্ত সিঁড়ি দিয়ে উঠে যান।
উঠেই সোজা বাঁদিকে পাঁচ নম্বর ফ্ল্যাট। দরজার গায়ে কলিং বেল ছিল। কলিং বেলের বোতামটা টেপেন সাধন দত্ত।
একটু পরেই দরজাটা খুলে গেল। কিন্তু সম্পূর্ণ নয়—অর্ধেক খোলা দরজার ফাঁকে একটা কুৎসিত পুরুষের মুখ উঁকি দিল, হুস দ্যাট!
ভারী কর্কশ কণ্ঠস্বর।
মিঃ আলফ্রেড ঘোষ? সাধন দত্তই প্রশ্ন করেন।
ইয়েস!
মে আই কাম্ ইন্?
কিন্তু কি দরকার তোমার এত রাত্রে একজন ভদ্রলোকের কাছে, জানতে পারি কি অফিসার?
দরকার একটা আছে বৈকি মিঃ ঘোষ!
কয়েকটা মুহূর্ত ভ্ৰ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো সাধন দত্তর মুখের দিকে আলফ্রেড।
সিঁড়ির স্বল্প আলো-আঁধারে পুলিসের ইউনিফর্ম পরিহিত সাধন দত্তর মুখের দিকে তাকিয়ে বোধ হয় আলফ্রে কিছু ভাবে।
তার ঘরের দরজায় পুলিস সাধন দত্তর ঐ মুহূর্তে এসে আবির্ভূত হওয়ার ব্যাপারটা অভূতপূর্ব তো বটেই, আকস্মিকও!
এবং তাকে যে খানিকটা ধূর্ত শিকারী বিড়ালের মত সন্দেহযুক্ত করে তুলেছে, কিরীটী ঐ মুহূর্তে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে সে কথাটা বেশ বুঝতে পারে।
তবু ওরা দুজনেই অপেক্ষা করে।
কিরীটী আর সাধন দত্ত। কারণ কিরীটী বার বার করে আসবার সময় সাধন দত্তকে বলেছিল, আলফ্রেকে যেন কোনরকম হুমকি দিয়ে বা জোরজবরদস্তি করে আগে থাকতেই ভয় দেখানো না হয়।
যাই হোক, আলফ্রেড ব্যাপারটা কোন রকম অনুমান করতে পারুক আর নাই পারুক, ওদের ঘরে ঢুকতে না দেওয়া অসমীচীন ও যুক্তিযুক্ত হবে না বুঝতে পেরেই হয়ত দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে দরজা থেকে এক পাশে সরে দাঁড়াল এবং মৃদু কণ্ঠে চাপা বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠেই
অনিচ্ছাকৃত আহ্বান জানাল, কাম!
আগে সাধন দত্ত ও তার পশ্চাতে কিরীটী ঘরে প্রবেশ করলো।
সমস্ত ঘরটা যেন অগোছাল, অপরিচ্ছন্ন।
একধারে গোটাচারেক বহু পুরাতন জীর্ণ সোফা ও সামনে তার একটা গোল টেবিল, অন্যদিকে একটা পুরাতন হ্যাট-র্যাক ও একটা বহুকালের রংচটা অর্গান বোধ হয়।
দেওয়ালে খানকতক কুৎসিত ভঙ্গির ছবিওয়ালা ক্যালেণ্ডার ঝুলছে। ঘরের মধ্যে সর্বসমেত গোটা-দুই মাত্র জানালা। মলিন জীর্ণ নেটের পর্দা দেওয়া। দুটি দরজার একটি সদর, অন্যটি বোধহয় ওপাশের ঘরে প্রবেশের মধ্যবর্তী দরজা।
একটি জীর্ণ মলিন পিংক কালারের পর্দা ঝুলছে সেই দ্বারপথে। মেঝেতে জীর্ণ মলিন একটা কার্পেট বিস্তৃত।
সমস্ত ঘরটা জুড়ে একটা যেন ঘিঘিনে ভাব।
ঘর শুধু নয়, কিরীটী দেখছিল আলফ্রেড লোকটাও যেন অনুরূপ দেখতে।
বেঁটে গুণ্ডা প্যাটার্নের চেহারা লোকটার। মাথার চুল রুক্ষ, কাঁচায়-পাকায় মেশানো। মুখময় ছোট ছোট দাড়ি। বোধ হয় দিন-দুই ক্ষৌরি হয় নি লোকটার। তোবড়ানো গাল। টিয়াপাখীর ঠোঁটের মতো নাকটা যেন বেঁকে সামনের দিকে ঝুলে পড়েছে। রোমশ ভ্র। পরিধানে একটা স্ট্রাইপ দেওয়া স্লিপিং পায়জামা ও গায়ে জীর্ণ মলিন একটা ঝলঝলে অনুরূপ রাত্রিবাস।
বসতে পারি? সাধন দত্তই ইংরাজীতে শুধান।
বসুন।
পরিষ্কার বাংলায় জবাব দিল আলফ্রেড।
তুমি এখানে বুঝি একাই থাক মিঃ ঘোষ? সাধন দত্ত আবার প্রশ্ন করলেন।
সে খবরে তোমার কোন দরকার আছে কি অফিসার? এই আনআর্থলি আওয়ারে একজন নিরীহ ভদ্রলোকের বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটাতে এসেছো কেন সেইটুকুই সর্বাগ্রে জানালে বাধিত হবো।
নিশ্চয়ই। আমরা এসেছি একটা মার্ডার কেসের তদন্তের ব্যাপারে।
হোয়াট? কি বললে?
বললাম তো, একটা হত্যার তদন্তের ব্যাপারে—
কিন্তু–
দিন-দশেক পূর্বে ভবানীপুর অঞ্চলে একটা মার্ডার হয়, তুমি বোধ হয় সংবাদপত্রে পড়ে থাকবে মিঃ ঘোষ–
সংবাদপত্র আমি পড়ি না।
পড় না!
না।
কখনো পড়ো না?
না। যত সব মিথ্যা খবর—আর ট্রাস্ খবর!
ও। তা ভবানীপুরে দিন-দশেক আগে অধ্যাপিকা সুনন্দা চ্যাটার্জী নামে এক মহিলা নিহত হন, তাঁরই অর্থাৎ সেই কেসেরই তদন্তের ব্যাপারে এসেছি আমরা।
কয়েক মুহূর্ত অতঃপর ঘোষ যেন স্তব্ধ হয়ে থাকে।
তারপর মৃদু কণ্ঠে বলে, কিন্তু তুমি বলছো ভবানীপুর না কোথায় দিন দশেক আগে কে একজন মার্ডারড হয়েছে, তার জন্যে আমার কাছে আসবার তোমার কি প্রয়োজন হলো বুঝতে পারছি না তো!
তুমি অধ্যাপিকা সুনন্দা চ্যাটার্জীকে চিনতে না?
নো, নেভার! নেভার হার্ড দি নেম ইভেন্!
নামও শোন নি কখনো তার? প্রশ্ন করলো এবারে কিরীটীই।
সিওরলি নট! হু ইজ সী?
পরিচয় তো দিলাম একটু আগে! আবার কিরীটী বললে।
আমিও তো বললাম, জীবনে তার নামই আমি কখনো শুনি নি।
অথচ আমরা জানি, যেরাত্রে বকুলবাগান রোডে সুসীম নাগের বাড়িতে সুনন্দা চ্যাটার্জী নিহত হন, তুমি সেরাত্রে সেখানে উপস্থিত ছিলে!
আর ইউ ম্যাড? আই নেভার ইভেন্ হার্ড অফ দেম্! তাছাড়া কবে বললে, দশ দিন আগে?
হ্যাঁ, গত মোলই জুন—কিরীটী বলে।
লেট মি রিকলেক্ট! ইয়েস্ ইয়েস্, আই ওয়াজ অন ডিউটি দ্যাট নাইট!
ডিউটিতে ছিলে?
অফ্ কোর্স! ইয়েস—আই নাউ ডিসটিংকট্রলি রিমেম্বার—আই ওয়াজ অন্ ডিউটি দ্যাট নাইট!
কিন্তু আমি বলছি, ইউ ওয়্যার প্রেজেন্ট দেয়ার দ্যাট নাইট! গম্ভীর কণ্ঠে যেন কিরীটী প্রতিবাদ জানাল।
ননসেন্স! এনিথিং মোর হ্যাভ ইউ গট টু সে? ই নট, ডোন্ট ওয়েস্ট মাই টাইম! বাজ অফ—
শোন মিঃ আলফ্রেড ঘোষ, উপযুক্ত প্রমাণ আছে আমাদের কাছে যে সে রাত্রে তুমি সে বাড়িতে উপস্থিত ছিলে।
ড্যাম রট!
নো মিঃ ঘোষ, তোমার বৌ সাক্ষী দেবে—
হোয়াট? মাই ওয়াই?
কথাটা হঠাৎ শোনামাত্রই ইলেকট্রিক শক্ খাওয়ার মতই চমকে ওঠে বলে মনে হয় আলফ্রেড ঘোষ।
হ্যাঁ, তোমার স্ত্রী—বিশাখা ঘোষ।
হঠাৎ যেন কিরীটীর শেষের কথায় জোঁকের মুখে নুন পড়লো।
বিশাখা নামটা কিরীটীর মুখ থেকে উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই আলফ্রেডের মুখের চেহারাটা একেবারে সত্যি-সত্যিই কেমন যেন মুহূর্তে বদলে গেল।
কয়েকটা মুহূর্ত সে কোন কথাই অতঃপর বলতে পারে না।
তারপর একসময় আমতা আমতা করে বলে, বিশাখা!
হ্যাঁ বিশাখা ঘোষ, তোমার স্ত্রী। কঠিন কণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়।
কিন্তু ততক্ষণে আলফ্রেড নিজেকে সামলে নিয়েছে, হঠাৎ হো হো করে ঘর ফাটিয়ে হেসে ওঠে।
আমার ওয়াইফ! বিশাখা! ইয়েস, ওয়ান্স আপন এ টাইম দ্যাট বীচ্ ওয়াজ মাই ওয়াইফ– কিন্তু অনেক কাল আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে—
না। কঠিন কণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়, তোমাদের ডিভোর্স এখনও হয় নি।
কিরীটীর কথার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় দপ্ করে যেন হাসির শেষ রেশটুকুও নিভে গেল আলফ্রেডের মুখের উপর থেকে।
এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো মিঃ আলফ্রেড,ঘোষ, সব কিছু সংবাদ নিয়েই আমরা এসেছি তোমার কাছে!
হ্যাঁ, না—হয় নি বটে আজো ডিভোর্স, কিন্তু কিন্তু, তার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্কই নেই, তাকে আমি সম্পূর্ণ মুক্তি দিয়েছি।
মুক্তিই যদি দিয়ে থাক তো ডিভোর্স আজো তোমাদের হয় নি কেন?
হয় নি মানে হয় নি—এমনিই হয় নি!
তাই কি? না অন্য কোন গুরুতর কারণ আছে?
কারণ! কি কারণ?
যে হাঁস সোনার ডিম দেয়, তাকে যে হত্যা করা যায় না!
কি বললে?
বলছিলাম যে হাঁস সোনার ডিম দেয়, তাকে কি হত্যা করা যায়? মিঃ ঘোষ, মাইনে তো তুমি পাও তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ সব মিলিয়ে, তাই না?
হ্যাঁ। তাহলে লয়েডস্ ব্যাঙ্কে তোমার অ্যাকাউন্টে গত তিন বছরে চোদ্দ হাজার টাকা কোথা থেকে এলো?
সে—সে আমি, মানে—আই হ্যাভ আরনড দ্যাট মানি!
আরনড! বাট হাউ? কাম-কনফেস্ এভরিথিং! গোপন করার চেষ্টা করলে জেনো বিপদই ডেকে আনবে—
আমাকে—আমাকে, মানে-হ্যাঁ, আমাকে একজন টাকাটা দিয়েছে—
কে দিয়েছে? তোমার স্ত্রী নিশ্চয়?
হ্যাঁ।
ঠিক সেই সময় সাধন দত্ত বললেন, ইউ আর আণ্ডার অ্যারেস্ট মিঃ ঘোষ!
অ্যারেস্ট! বা হোয়াট্ ফর?
যথাসময়েই জানতে পারবে।
১৪.
আলফ্রেড ঘোষকে গ্রেপ্তার করবার পরের দিনের ঘটনা।
বিষ্ণু দে কলকাতায় ফিরে এলো।
মৃণাল সমস্ত ব্যাপারটাই জানত, তার মুখ থেকেই বিষ্ণু দে সব শুনলো। এবং এও সে শুনলো মৃণালের মুখেই যে, সুনন্দা চ্যাটার্জীর হত্যার ব্যাপারে কিরীটী তাদের সকলকেই নাকি সন্দেহ করেছে। এবং মৃণালকে কিরীটী বলে রেখেছে, বিষ্ণু দে কলকাতায় ফিরে এলেই তার সঙ্গে কিরীটী একবার দেখা করতে চায়।
বিষ্ণু দে বললে, কিন্তু আমি-আমি তার সঙ্গে দেখা করে কি করবো?
দেখা করা তোমার কর্তব্য। মৃণাল বলে।
কর্তব্য বলছো! শুধায় বিষ্ণু দে।
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন?
কারণ সেই দুর্ঘটনার রাত্রে আমরা সেখানে উপস্থিত ছিলাম—
কিন্তু আমরা ছাড়াও তো সে রাত্রে সেখানে আরো অনেকেই উপস্থিত ছিল।
তা অবিশ্যি ছিল, তবে আমরা তার অর্থাৎ সুনন্দার বিশেষ পরিচিত ছিলাম।
তাতে কি এমন অপরাধ হলো?
অপরাধ কিছু নয়—
তবে?
হয়তো আমাদের মত তোমাকেও তার কিছু জিজ্ঞাস্য থাকতে পারে। চলই না, একবার দেখা করে আসবে।
বলছো চল, কিন্তু সত্যি বলছি মৃণাল, ব্যাপারটা আমার কেন যেন আদপেই ভাল লাগছে!
স্পষ্ট একটা বিরক্তিই যেন বিষ্ণু দের কণ্ঠস্বরে প্রকাশ পায়।
ভাল লাগালাগির প্রশ্ন তো এখানে নয়, দেখা করাটা তোমার কর্তব্য।
বেশ, তাহলে সুসীমকেও ডেকে পাঠাও।
সুসীম!
হ্যাঁ, যেতে হয় একসঙ্গে তিনজনই যাবো–
মৃণাল উঠে গিয়ে ঘরের কোণে রক্ষিত ফোনের রিসিভারটা তুলে সুসীমের নম্বরে ডায়েল করতে যাবে, এমন সময় দরজার গোড়ায় সুসীমকে দেখা গেল।
এই যে মৃণাল, বিষ্ণু তোমরা দুজনেই আছে—এদিকে কাল রাত্রে একটা সাংঘাতিক ব্যাপার–
আবার সাংঘাতিক ব্যাপার কি হলো? মৃণাল শুধায়।
কাল রাত্রে বিশাখার life-এর ওপরে নাকি একটা attemept হয়েছিল–
সে কি!
দুজনেই সুসীমের কথায় চমকে ওঠে।
হ্যাঁ। But thank God, she has narrowly escaped! একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছে—
কিন্তু ব্যাপারটা কি একটু খুলে বলবে? অধীর কণ্ঠে মৃণালই প্রশ্ন করে।
ঘুমন্ত অবস্থায় তার গলাতে ফাঁস দিয়ে—
ফাঁস! অর্ধস্ফুট একটা চিৎকার করে ওঠে যেন বিষ্ণু দে।
হ্যাঁ, ফাঁস পরানো হয়েছিল। তবে হঠাৎ বিশাখার ঘুম ভেঙে যাওয়ায় আততায়ীকে ধাক্কা দিয়ে সে ফেলে দেয়—
বল কি সুসীম, how horrible! যা বলছে সত্যি? বিষ্ণু শুধায়।
সত্যি।
তারপর? মৃণাল শুধায়।
তারপর আর কি, হত্যাকারী উধাও হয়ে যায়!
দেখেছিল—মানে দেখতে পেয়েছিল বিশাখা হত্যাকারীকে?
না। ঘরের আলো নেভানো ছিল—
মৃণালই এতক্ষণ কথা বলে যাচ্ছিল। বিস্ময়ে হতভম্ব বিষ্ণু নিঃশব্দে শুনছিল, এবারে বিষ্ণু প্রশ্ন করলো, কিন্তু তুমি—তুমি সে কথা জানলে কি করে সুসীম?
আমি?
হ্যাঁ।
আমি বিশাখার বাড়িতে গিয়েছিলাম আজ সকালে, দেখি বেচারা আকস্মিক ঘটনায় আর ভয়ে একেবারে যেন সিঁটিয়ে রয়েছে।
তা তো হবারই কথা। মৃণাল সহানুভূতির সঙ্গে জবাব দেয়।
কিন্তু আমি তো মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না মৃণাল, বিশাখার উপরে আবার হত্যার attempt হলো কেন!
মৃণাল সহসা যেন কোন জবাব দিতে পারে না। সুসীম, মৃণাল ও বিষ্ণু অতঃপর তিনজনই যেন কেমন মুহ্যমানের মত বসে থাকে।
একটু আগে যে মৃণাল ও বিষ্ণু কিরীটীর ওখানে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল, ঐ মুহূর্তে যেন সে কথাটাও তারা বিস্মৃত হয়।
একে তো সুনন্দার সেরাত্রে আকস্মিক হত্যার ব্যাপারটাই সকলকে কেমন স্তম্ভিত বিমূঢ় করে দিয়েছে, তার ওপর এই নতুন দুঃসংবাদ। ভেবে পায় না যেন ওরা, হঠাৎ বিশাখার ওপরই বা আবার কেন অটেমপ্ট নেওয়া হলো!
আর কেই বা নিল? তবে কি এও সুনন্দার হত্যাকারীরই কাজ? কিন্তু কেন?
সুনন্দাকেই বা কেন হত্যা করা হলো, আবার বিশাখার উপরেই বা গতরাত্রে হত্যার প্রচেষ্টা হলো কেন?
ঘটনাপ্রবাহ কোথায় চলেছে?
.
সত্যি, ব্যাপারটা শুধু আকস্মিকই নয়—রীতিমত একটা চিন্তারও বৈকি।
পনের দিনও হয় নি, মৃত্যু তাদের একজনকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে, এবং সেই দুশ্চিন্তা আর আশঙ্কা এখনো যেন একটা দুঃস্বপ্নের মতো তাদের ঘিরে রয়েছে। ইতিমধ্যেই আবার মৃত্যুর কালো ছায়া তাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল।
কেন–কেন এ মৃত্যুর পদসঞ্চার!
বিষ্ণু দে আর মৃণাল সেন দুজনকেই যেন স্তব্ধ বিমূঢ় করে দিয়েছে সুসীমের দেওয়া সংবাদটা। হত্যাকারী তাদের মধ্যে থেকে একজনকে হত্যা করে নিশ্চিন্ত হয় নি, আবার সে তার মৃত্যুস হাতে রাত্রির অন্ধকারে অলক্ষ্যে আর একজনের পশ্চাতে এসে গতরাত্রে দাঁড়িয়েছিল!
নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে সুসীমই আবার কথা বলে, শ্রাবণী ভয়ানক ভয় পেয়ে গিয়েছে সংবাদটা শুনে। সে আর এক মুহূর্ত কলকাতায় থাকতে চায় না। শিলং-এ তার এক মাসী আছেন, ভাবছি কালই তাকে পাঠিয়ে দেবো সেখানে। যাক্, কিছুদিন সেখানে গিয়েই না হয় থেকে আসুক।
মৃণাল বলে, সেই ভাল, তাকে সেখানেই পাঠিয়ে দাও সুসীম।
সেই ব্যবস্থাই করছি।
কিন্তু কিরীটী রায়কে সর্বাগ্রে গতরাত্রের সংবাদটা দেওয়া প্রয়োজন। মৃণাল বলে।
ঠিক বলেছো মৃণাল।
এক কাজ করলে হয় না! মৃণাল সুসীমের মুখের দিকে চেয়ে শুধায়।
কি?
ফোন করে এখানেই একবার কিরীটী রায়কে আসতে বললে হয় না!
সেই ভালো, তাই বরং ফোন করে দাও। সুসীম সায় দেয়।
মৃণাল উঠে পড়লো কিরীটীকে ফোন করতে।
১৫.
বিষ্ণু দের মনটা অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল। মনের মধ্যে উৎসবের সেই রাতটার কথাই বার বার যেন ভেসে উঠছিল।
উৎসবের আনন্দের মধ্যে সুনন্দার আকস্মিক মৃত্যুটা এবং সমস্ত ঘটনার নাটকীয় বীভৎসতাটা আজো সে যেন ভুলতে পারছে না।
দিল্লীতে তার যাবার কথা ছিল আরো কয়েকদিন পরে, কিন্তু এক মুহূর্তও সে যেন আর টিকতে পারছিল না কলকাতা শহরে।
পরের দিনই তাই সে কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
কিন্তু দিল্লীতে গিয়েও স্বস্তি পায় নি এক মুহূর্ত বিষ্ণু।
সর্বক্ষণ যেন সেই দুঃস্বপ্নটা জাগরণে ও নিদ্রায় তাকে তাড়া করে নিয়ে ফিরেছে। সুনন্দার সঙ্গে পরিচয় ছিল বটে বিষ্ণুর, কিন্তু সসীম বা মৃণালের মতো ঘনিষ্ঠতা ছিল না। নিঃসন্দেহে ভাল লাগতো সুনন্দাকে বিষ্ণুর, কারণ সুনন্দার ছিল একটা বিচিত্র আকর্ষণ। যে আকর্ষণকে বিষ্ণু দে কেন, অনেকেই কাটিয়ে উঠতে পারে নি। সে-ও কাটিয়ে উঠতে পারে নি। সুনন্দাকে মনে মনে হয়তো কিছুটা ভালবেসেছিল বিষ্ণু—তাই সে সুনন্দার নিষ্ঠুর মৃত্যুতে আঘাত পেয়েছিল মনে।
দিল্লীতে বসে কয়েকদিন ধরে বিষ্ণু অনেক ভেবেছে, কে সুনন্দাকে অমন করে হত্যা করলো! কিন্তু ভেবে-ভেবেও কোন কূলকিনারা পায় নি ব্যাপারটার।
মৃণাল ঘরে ফিরে এসে বললে, কিরীটী এখুনি আসছে।
তার পরের আধঘণ্টা সময় যেন ওদের একটা বিচিত্র স্তব্ধতার মধ্যে অতিবাহিত হয়।
সকলের মধ্যেই একটা বিশেষ উত্তেজনা যেন পরিলক্ষিত হয়, অথচ কেউ কিছু বলছে না। মধ্যে মধ্যে এ ওর মুখের দিকে তাকায়। কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করে তিনজনই।
প্রত্যেকেই যেন ভাবছে তখন।
মৃণালও ভাবছিল সুনন্দার কথাটাই। এবং গত কদিন ধরে সর্বক্ষণই প্রায় সে ভাবছিল বুঝি সুনন্দার কথাটা।
সুনন্দার মৃত্যুর ব্যাপারটা সত্যিই তাকে যেন বিস্ময়াবিভূত করে দিয়েছে।
কিরীটী স্পষ্টাস্পষ্টি তাকে মুখে কিছু না বললেও তার হাবভাব কথাবার্তা সব কিছুর মধ্যেই যেন মৃণালের মনে হয়েছে, কিরীটী তাদের কবন্ধুকে কেমন একটু সন্দিগ্ধভাবেই দেখতে শুরু করেছে।
সত্যিই তো–সন্দেহ হবারই তো কথা!
তাদের সকলের সঙ্গেই যখন ছিল সুনন্দার এতদিনকার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ও পরিচয়, তখন কতকটা স্বাভাবিকভাবেই তো তাদের উপরে সন্দেহ এসে পড়তে পারে।
তারপর নীরেনের ব্যাপারটা।
নীরেন তাদের এমন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল, অথচ তারা কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে নি কখন ইতিমধ্যে তার ও সুনন্দার মধ্যে পরিচয় ঘটলো এবং সেই পরিচয় ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হলো। এবং সুনন্দার আকস্মিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে, সুনন্দার ঘরের টেবিলের টানার মধ্যে নীরেনের চিঠিগুলো ঐভাবে আবিষ্কৃত না হলে হয়তো ব্যাপারটা আজও ওরা জানতে পারতো কিনা সন্দেহ।
বিশাখা অবিশ্যি ওদের ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারটা জানত, কিন্তু কই বিশাখাও তো এতদিন ওদের কিছু জানতে দেয় নি! বিশাখারই বা ব্যাপারটা গোপন করার কি কারণ থাকতে পারে? যতদূর মনে হয়, বিশাখা হয়তো ইচ্ছা করেই ব্যাপারটা গোপন করে গিয়েছে!
কিন্তু কেন? বিশেষ করে বিশাখা যখন অমন তীব্রভাবে সুনন্দাকে ঘৃণা করতো!
আশ্চর্য বিশাখার সুনন্দার প্রতি এতটা ঘৃণার ব্যাপারটাও এতদিন জানত না মৃণাল!
কখন কোন প্রসঙ্গেই কথাটা সে ইতিপূর্বে প্রকাশ করে নি!
সেদিন বিশাখার মুখে আচমকা কথাগুলো শুনে মৃণালের তাই বুঝি বিস্ময়ের অবধি ছিল। সে যেন চমকে উঠেছিল বিশাখার মুখে কথাগুলো শুনে। কিন্তু কেন যে এই তীব্র ঘৃণা, সেটাই এখন পর্যন্ত ভেবে কিছু পায় নি মৃণাল।
কি এমন কারণ থাকতে পারে বিশাখার সুনন্দার প্রতি ঐ তীব্র ঘৃণার? তবে কি বিশাখাও মনে মনে নীরেনকেই ভালবাসত?
ব্যাপারটা যেন সব কিছু কেমন জট পাকিয়ে তোলে।
এতদিন জেনে এসেছে সুনন্দার মৃত্যুর পূর্বে পর্যন্ত সুনন্দা সুসীমকেই সর্বাপেক্ষা বেশী ভালবাসত, অথচ এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা আসলে তা নয়।
সুনন্দা ভালবাসত সব চাইতে বেশী নীরেনকেই। আবার এতদিন মনে হয়েছে মৃণালের, বিশাখা বুঝি এসব ভালবাসাবাসির মধ্যে আদৌ ছিল না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তা নয়, বিশাখাও বোধ হয় নীরেনকেই ভালবাসত।
কিন্তু নীরেন–নীরেন কি সে কথা জানত? চকিতে ঐ সময় একটা চিন্তা মৃণালের মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে যায়। তবে কি সুনন্দার ঐ নিষ্ঠুর হত্যার মূলে ছিল ভয়াবহ একটা কুটিল হিংসা!
শিউরে ওঠে যেন মৃণাল কথাটা মনে হতেই।
তবে—তবে কি বিশাখাই হত্যা করেছে সুনন্দাকে?
সুসীমের মনের মধ্যেও বিচিত্র চিন্তা তরঙ্গ তুলে যাচ্ছিল।
মনে হচ্ছিল তার, এর চাইতে শেষ পর্যন্ত বিয়েটা না করলেই বোধ হয় ভালো হতো।
শ্রাবণীকে বিয়ে করে সুনন্দাকে সে জব্দ করতে চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সুনন্দা মরে এখন মনে হচ্ছে সে-ই বেশী জব্দ হয়েছে। জীবনটাকে যেন আরো বিষময় করে তুলেছে তার স্ত্রী শ্রাবণী।
সে-রাত্রি থেকে শ্রাবণীর যেন অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটেছে। গতরাত্রে তো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শেষ পর্যন্ত রীতিমত একটা ঝগড়াই হয়ে গিয়েছে। শ্রাবণীর নাকি সারাটা রাত ঘুম হয় না। সর্বক্ষণ মনে হয় এক অশরীরী নারী যেন তার আশেপাশে ঘুরছে।
শ্রাবণী বলে, পারছি না—এখানে আর এক মুহূর্তও আমি টিকতে পারছি না। আমাকে তুমি এখান থেকে যেতে দাও, নচেৎ নিশ্চয়ই আমি পাগল হয়ে যাবো!
শ্রাবণীর ঈদৃশ আচরণে শেষ পর্যন্ত সুসীমের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল।
সুসীম বেশ একটু কড়াভাবেই বলেছিল, এটা তোমার সত্যিই কি একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে না শ্রাবণী।
কি বলতে চাও তুমি? স্পষ্ট তীক্ষ্ণকণ্ঠে প্রশ্নটা করে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়েছিল শ্রাবণী।
তা নয় তো কি! এতগুলো লোক আমরা এ বাড়িতে রয়েছি, একা তুমিই কেবল টিকতে পারছো না! কিন্তু কেন বলতে পারো? আর এ সময় হঠাৎ দুম করে তুমি চলে গেলে লোকেই বা ভাববে কি?
এর মধ্যে লোকের ভাবাভাবির কি থাকতে পারে শুনি?
থাকতে পারে বৈকি। তাছাড়া আমি বলেছিই তো, দুটো দিন সবুর কর, আমি নিজে গিয়ে তোমাকে শিলং-এ রেখে আসবো।
না, আমাকে তুমি ছেড়ে দাও।
দুটো দিনও তুমি অপেক্ষা করতে পারবে না?
না, না—
সত্যি আমি আশ্চর্য হচ্ছি শ্রাবণী, আমার মনের এই অবস্থা—
মনের এ অবস্থা যে তোমার হবে সে তো তুমি জানতেই।
কি বললে?
ঠিকই বলছি। ভুলতে যদি তাকে পারবেই না জানতে, তবে কেন আমাকে নিয়ে ছেলেখেলা করতে গিয়েছিলে বলতে পার?
শ্রাবণী!
হ্যাঁ, হ্যাঁ– কার কাছে তুমি কি ঢাকা দিতে চাইছো? এ নাটক সৃষ্টি করবার আমাকে নিয়ে তো কোন প্রয়োজনই ছিল না!
তুমি থামবে শ্রাবণী?
তিক্ত একটা চাপা তিরস্কারের মতই যেন কথাটা বলে ওঠে সুসীম।
কি, চোখ রাঙাচ্ছ—কিন্তু সে সুযোগ আমি তোমাকে দেব না। শোন, কালই আমি চলে যাচ্ছি–
ঠিক আছে, যেও।
রাগ করেই অতঃপর সুসীম ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল। এবং বাকী রাতটা সে পথে পথেই ঘুরে বেড়িয়েছে উদ্ভ্রান্তের মত।
সকালে গৃহে ফিরেই টের পেয়েছে সুসীম, আজই চলে যাবে শ্রাবণী। সব কিছুর তোড়জোড় সে দেখে এসেছে। ওকে গৃহে ফিরতে দেখে ওর বোন সুধা ঘরে এসে ঢুকল। মাথার চুল রুক্ষ, ক্লান্ত বিপর্যস্ত চেহারা সুসীমের।
দাদা!
কি?
সারারাত কাল কোথায় ছিলে?
সুসীম কোন জবাব দেয় না বোনের প্রশ্নের।
তোমরা কি শুরু করেছে জানি না! এদিকে বৌদি দেখছি সব গোছগাছ করে ফেলেছে আজই রাত্রে সে নাকি শিলং-এ তার মাসীর ওখানে যাচ্ছে!
ভুল হয়ে গিয়েছে সুধা, জীবনে বোধ হয় এত বড় ভুল আর হয় নি আমার। আর ভুল যখন হয়েছেই, তার প্রায়শ্চিত্ত আমাকে করতে হবে বৈকি।
বৌদি আর ফিরবে না শুনলাম দাদা!
আমি জানি—
তুমি জান?
হ্যাঁ, জানি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে সুধা। ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
তারপর এক সময় মৃদুকণ্ঠে আবার ডাকে, দাদা!
কি?
কি হয়েছে আমাকে বলবে?
আমাকে বিরক্ত করিস না সুধা, আমাকে একটু একা থাকতে দে।
সুধা বের হয়ে যায় ঘর থেকে।
কিন্তু সুসীমও ঘরে থাকতে পারে না। সে-ও বের হয়ে পড়েছিল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।
আগের পর্ব :
০১-০৫. জবানবন্দী দিচ্ছিল সুসীম
০৬-১০. বিচিত্র একটা সংবাদ
পরের পর্ব :
১৬-১৮. পঞ্চশরের কীর্তি