মদনভস্ম: ০৬-১০. বিচিত্র একটা সংবাদ

মদনভস্ম: ০৬-১০. বিচিত্র একটা সংবাদ

০৬-১০. বিচিত্র একটা সংবাদ

তিনদিন পরে।

বিচিত্র একটা সংবাদ যেন সুসীমকে একেবারে বিমুঢ় করে দেয়।

সকালের দিকে সুসীম নীচে তার বসবার ঘরে একটা চেয়ারে বসে সেদিনকার দৈনিকটার উপর চোখ বুলাচ্ছিল, এমন সময় থানা-অফিসার সাধন দত্ত এসে ঘরে ঢুকলেন।

বসুন, মিঃ দত্ত! কোন খবর আছে নাকি?

আছে।

কি?

একটা বিশেষ ব্যাপারে আলোকসম্পাতের জন্যে আপনার কাছে আসতে হলো আমাকে সুসীমবাবু! সাধন দত্ত বললেন।

কি বলুন তো?

দুদিন ধরে খোঁজখবর নিয়ে যা জানতে পারলাম—

কি?

সুনন্দা দেবীর সঙ্গে গত বারো বছর ধরে তিনজন খুব ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন আপনারা–

তিনজন!

হ্যাঁ, প্রথম হচ্ছেন আপনি—

আমি? হ্যাঁ, তা আমি—মানে আমার সঙ্গে সুনন্দার—

কথাগুলো যেন কেমন এলোমেলো হয়ে যায় সুসীমের।

সাধন দত্ত বলেন, হ্যাঁ আপনি, ডাঃ মৃণাল সেন আর—

কিন্তু–

শুনুন, আরো একজন ছিল—

কে?

নীরেন সেন।

বিস্ময়ে যেন বোবা হয়ে যায় সুসীম, সাধন দত্তর মুখ থেকে নামটা উচ্চারিত হতেই।

.

সে, মৃণাল ও নীরেন একই বছরে বি. এস-সি. পাস করে। একই কলেজে পড়েছে তারা। তারপর মৃণাল গিয়ে ভর্তি হলো কারমাইকেল মেডিকেল কলেজে। সে এক বছর এম. এসসি পড়ে পড়া ছেড়ে বাপের কোলিয়ারীর বিজনেস দেখাশোনা করতে শুরু করে। কারণ হঠাৎ সেই সময় তার বাপের মৃত্যু হয়।

আর বর্ষায় এক ধনী টিম্বার-মার্চেন্ট কাকা ছিলেন নীরেনের—তার কাছেই সে চলে যায় ভাগ্যান্বেষণে ঐ সময়ই। সেও আজ প্রায় দশ বছর হতে চললো বৈকি। মনে পড়ে সুসীমের, গত দশ বছরে অবশ্য অনেকবার এসেছে নীরেন কলকাতায় এবং কখনো এক মাস, কখনো বা দুমাস থেকে গিয়েছে।

সেই নীরেনের সঙ্গে যে সুনন্দার কোন দিন কোন সূত্রে আলাপ ছিল, স্বপ্নেও তা জানতে পারে নি সুসীম। আর সুনন্দার সঙ্গে নীরেনের যদি আলাপই ছিল তো সেকথা কোন দিন তাদের ঘুণাক্ষরে জানতেই বা দেয় নি কেন সে? ব্যাপারটা রীতিমতো বিস্ময়েরই।

এ আপনি কি বলছেন মিঃ দত্ত, নীরেনের সঙ্গে সুনন্দার পরিচয় ছিল? কথাটা শেষ পর্যন্ত সুসীম না বলে পারে না।

মৃদু রহস্যপূর্ণ হাসি হেসে সুসীমের দিকে তাকিয়ে সাধন দত্ত বললেন, কেন, আপনি তো উভয়েরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আপনি ব্যাপারটা জানতেন না বলতে চান?

বিশ্বাস হয়তো করবেন না আপনি, তবে ব্যাপারটা আমি জানতাম না সত্যিই। আর মৃণালও যে জানে না, তাও আমি জোর করে বলতে পারি।

আপনার এখানে আসার আগে আমি ডাঃ সেনের ওখান হয়েই এসেছি। তিনিও আপনার মতই বললেন, তিনিও জানতেন না কিছু। তাতেই কিন্তু ব্যাপারটা আমার কাছে একটু দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে–

কিন্তু কথাটা আপনি জানলেন কি করে?

কতকগুলো চিঠি দেখে।

চিঠি!

হ্যাঁ। চিঠিগুলো গতকাল সুনন্দা দেবীর তিলজলার বাড়ির শোবার ঘর সার্চ করতে গিয়ে পেয়েছি। চিঠিগুলো অবিশ্যি সবই প্রেমপত্র বলা চলতে পারে।

প্রেমপত্র!

হ্যাঁ। চিঠিগুলো লিখেছেন ডাঃ সেন, আপনি ও নীরেনবাবু। তবে বেশীর ভাগ চিঠিই নীরেনবাবুর লেখা।

নীরেনের লেখা!

হ্যাঁ, বর্মার পোম থেকে লেখা চিঠি। আর সত্যি কথা বলতে কি, আপনাদের সবার চিঠিগুলো পড়ে নীরেনবাবুর চিঠিগুলোর মধ্যেই যেন বেশী ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত পেয়েছি।

চিঠিগুলো দেখতে পারি?

একজিবিট হিসাবে চিঠিগুলো আপাততঃ থানায় রয়েছে। মামলার সময় দেখতে পাবেন বৈকি, অবশ্য দেখতে চাইলে! কিন্তু যেজন্যে আমি বিশেষ করে এসেছি সেটা হচ্ছে, সুনন্দা চ্যাটার্জী যেদিন নিহত হয় তার ঠিক আগের দিনই কোন এক সময় সুনন্দা চ্যাটার্জীকে নীরেনবাবু একটা চিঠি লেখেন–

কি চিঠি?

সে চিঠিটার কপি আমার কাছে আছে। বলে পকেট থেকে একটা লেখা কাগজ বের করে সুসীমের হাতে তুলে দিলেন সাধন দত্ত।—দেখুন!

সংক্ষিপ্ত চিঠি।

সোনা,

কালকের ব্যাপারের জন্যে সত্যিই আমি দুঃখিত। বিশ্বাস কর, আমি ছাড়া তুমি এ দুনিয়ার আর কারো হবে এ আমার পক্ষে ভাবাও দুঃসাধ্য। আমি টেম্পার লুজ করেছিলাম একমাত্র সেই কারণেই। যাই হোক, তুমি যখন চেয়েছে তখন সেটা নিশ্চয়ই আমি ফিরিয়ে দেবো। কাল তো তুমি সুসীমের ওখানে আসছেই, কালই সেখানে দিয়ে দেবো। তোমার বাড়িতে গিয়েই দিয়ে আসতে পারতাম, কিন্তু তা পিরবো না—কারণ তোমার বাড়ির দরজায় আর কখনো এ জীবনে আমি পা দেবো না, আর আমার বাড়ির দরজাও তোমাকে মাড়াতে দেবো না।

ইতি তোমার—নী

চিঠিটা পড়তে পড়তে সুসীমের মনের মধ্যে একটা কথা উঁকি দেয়, তবে কি সেই কারণেই যেচে নিজে আমন্ত্রণ নিয়ে সুনন্দা তার বৌভাতের উৎসবে এসেছিল?

কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যায় সুসীম।

মিঃ নাগ!

যা! সাধন দত্তর ডাকে চমকে সুসীম তার দিকে তাকালো। চিঠিটা আপনার বন্ধু নীরেনবাবুর হাতের লেখা কিনা সেটা প্রমাণসাপেক্ষ। তবে তার অন্যান্য চিঠির সঙ্গে মিলিয়ে আমার তো ধারণা হয়েছে, একই হাতের লেখা—যদিচ হুবহু একেবারে মেলে নি। কিন্তু হাতের লেখার সঙ্গে হুবহু মিল হোক বা না-ই হোক, এ চিঠি যে নীরেনবাবুরই লেখা তার অকাট্য প্রমাণ কিন্তু আমি অন্যভাবেও পেয়েছি।

কি প্রমাণ?

প্রমাণ পেয়েছি, যেদিন চিঠিটা লেখেন নীরেনবাবু তার আগের দিন সন্ধ্যায় তিনি সুনন্দা চ্যাটার্জীর বাড়িতে গিয়েছিলেন।

তাতে কি হলো?

শুনুন, এখনো সব কথা শেষ হয় নি আমার। সেদিন দুজনার মধ্যে কোন কারণে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়, মিস্ চ্যাটার্জীর ঝি মনোরমা শুনেছে—

ঝগড়া হয়েছিল?

হ্যাঁ, আর সেই সময় ঝগড়া করে বের হয়ে আসবার মুখে নাকি নীরেনবাবু তাকে শাসিয়ে এসেছিলেন, সুনন্দা দেবীকে তিনি হত্যা করবেন!

সত্যি–সত্যি বলছেন?

সত্যিই বলছি—মনোরমা বলেছে।

হঠাৎ ঐ সময় সাধন দত্তর শেষ কথাটা যেন একটা অন্য উপলব্ধি জাগায় সুসীমের মনে। সে চমকে ওঠে এবং ব্যগ্রকণ্ঠে শুধায়, হোয়াট আর ইউ ড্রাইভিং এট মিঃ দত্ত!

এখনো বুঝতে পারছেন না? নীরেনবাবুই হত্যা করেছেন সেরাত্রে মিস চ্যাটার্জীকে!

না—দ্যাট কাণ্ট বি! ইপসিবল! ফ্যানাটিক!

না, ইপসিবল বা ফ্যানাটিক নয় সুসীমবাবু। গম্ভীর কণ্ঠে কথাটা বলে পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে রুমালটা সুসীমের সামনে মেলে ধরেন সাধন দত্ত, আরো প্রমাণ আছে—এই রুমালটা দেখুন, এই রুমালের কোণে সুতো দিয়ে লেখা N অর্থাৎ নীরেনের আদ্যাক্ষর–

কিন্তু—

এই রুমালটা আমি কোথায় পেয়েছি জানেন?

কোথায়?

সেরাত্রে আপনারই এই বাড়িতে। যে হলঘরে মিস্ চ্যাটার্জী নিহত হন, সেই হলঘরেরই সংলগ্ন বাথরুমের মধ্যে। আর–

আর?

রুমালটার মধ্যে ক্লোরোফরমের গন্ধ ছিল!

না না—এসব আপনি কি বলছেন মিঃ দত্ত! আর্ত ব্যাকুল কণ্ঠে যেন কথাগুলো বলতে গিয়ে সুসীম ভেঙে পড়ে।

যা বলছি, মিথ্যা একটি বর্ণও তার মধ্যে নেই। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, সেক্ষেত্রে নীরেনবাবুই সুনন্দা চ্যাটার্জীকে হত্যা করেছিলেন।

কি বলছেন আপনি? তাহলে কি আপনি নীরেনকে অ্যারেস্ট করছেন?

আপনি যদি আমি হতেন, তাই কি করতেন না! আচ্ছা আমি তাহলে আজকে উঠবো।

সাধন দত্ত উঠে দাঁড়ান।

মিঃ দত্ত!

সাধন দত্ত যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিলেন, সুসীমের ডাকে ঘুরে দাঁড়ালেন।

আপনি কি সত্যিই তাহলে বিশ্বাস করেন যে নীরেনই সুনন্দাকে হত্যা করেছে?

প্রত্যুত্তরে নিঃশব্দে মৃদু হাসলেন সাধন দত্ত শুধু।

কিন্তু–কিন্তু আপনার ভুলও তো হতে পারে মিঃ দত্ত!

ভুল?

হ্যাঁ–

না, ভুল আমার হয় নি। গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলেন সাধন দত্ত।

.

০৭.

কি যেন সেই কবিতাটা?

কিরীটীর প্রশ্নে কেমন যেন বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় তার মুখের দিকে, কবিতা!

হ্যাঁ, সেই যে—

In the same hour and hall
The fingers of a hand
Came forth against the wall,
And wrote as if on sand :
The fingers of a man;–
A solitary hand.

এ যেন ঠিক সেই ব্যালসেজারস্ ফিস্টের সলিটারি হ্যাণ্ডের মতোই সুনন্দা চ্যাটার্জীর মৃত্যুলিপি লেখা হয়ে গেল!

কথাগুলো বলে কিরীটী কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করতে লাগলো।

মৃণাল সেন কিন্তু ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে ওঠে।

নীরেনের গ্রেপ্তারের সংবাদটা সে জানতো না। সুসীম টেলিফোনে তাকে জানিয়েছিল এবং সেই সঙ্গে জানিয়েছিল নীরেনের সঙ্গে সুনন্দার প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠতার কথা, যদিচ সে আগেই কথাটা সাধন দত্তর মুখে শুনেছিল। সংবাদটা শুনে অবধি মৃণালও কম আশ্চর্য হয় নি। কারণ সেও সুসীমের মতোই প্রথম শুনলো যে সুনন্দার সঙ্গে নীরেনের একটা প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠতা ছিল!

নীরেন তাদের উভয়েরই বন্ধু, অথচ তারা এতদিন ঘুণাক্ষরেও দুজনের একজনও জানতে পারেনি যে সুনন্দার সঙ্গে তার এতটা ঘনিষ্ঠতা কখন কি ভাবে গড়ে উঠেছিল। ব্যাপারটা জানবার পর মৃণালের যেটা স্বভাবতই মনে হয়েছে সেটা হচ্ছে, নীরেন তাদের কাছ থেকে ব্যাপারটা গোপন করেছে।

কিন্তু কেন? ব্যাপারটা তাদের কাছে গোপন করবার মতো কি এমন কারণ থাকতে পারে নীরেনের?

সুনন্দার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথাটা যদি তারা জানতই, তাতে এমন কি এসে যেত! বিশেষ করে তাদের দুজনেরই সঙ্গে যখন সুনন্দার পরিচয় ছিল!

সে কি ভেবেছিল, সুনন্দার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারটা জানতে পারলে তারা খুশি হবে না? এই পর্যন্ত চিন্তা করেই মৃণাল নিজের কাছেই নিজে কেমন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

নীরেনকে সামনাসামনি পেলে হয়তো মৃণাল তাকে কথাটা স্পষ্টাস্পষ্টিই জিজ্ঞাসা করতো। কিন্তু সে অবকাশ সে পায় নি। তার কারণ সংবাদটা যখন সে সুসীমের কাছ থেকে জানতে। পারলো, তার আগেই নীরেনকে সাধন দত্ত গ্রেপ্তার করেছেন।

নাগালের বাইরে সে—হাজতে।

তবু চেষ্টা করেছিল মৃণাল সাধন দত্তর সঙ্গে দেখা করে নীরেনের সঙ্গে হাজতে দেখা করবার একটা অনুমতি পাওয়ার।

কিন্তু সাধন দত্ত রাজী হন নি।

অথচ সাধন দত্তর যুক্তি যাই হোক না কেন এবং সুনন্দাকে যে নীরেনই হত্যা করেছে সেসম্পর্কে যতই তিনি স্থিরনিশ্চিত হোন না কেন, মৃণাল কোনমতেই যেন মন থেকে ব্যাপারটা মেনে নিতে পারে নি—সাধন দত্তর যুক্তিটাকে গ্রহণ করতে পারে নি।

তা ছাড়া বন্ধু হিসাবেও নীরেনের এই দুর্দিনে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ানো তার কর্তব্য। এই কথাটা ভেবে মৃণাল যখন কোন দিক দিয়ে কোন পথ খুঁজে পাচ্ছিলো না, তখন হঠাৎ তার কিরীটীর কথা মনে পড়ে যায়।

কিরীটী রায়! একসময় তার সঙ্গে মৃণালের যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল।

তীক্ষ্ণ বুদ্ধি লোকটার। সে হয়তো তাকে এ সময় কোন একটা পথ দেখিয়ে দিতে পারে। শুধু কি পথ, কিরীটীর কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো একটা কথা মৃণালের মনে হয়, নীরেনের এই দুর্দিনে তাকে একমাত্র হয়ত ঐ কিরীটী রায়ই সাহায্য করতে পারে।

পুলিসের অসাধ্য কিছুই নেই।

একবার যখন তারা নীরেনকে সুনন্দার হত্যা-ব্যাপারে সন্দেহ করে গ্রেপ্তার করেছে, তখন সহজে তারা তাকে নিষ্কৃতি দেবে না।

বরং আপ্রাণ চেষ্টাই করবে তাকেই হত্যাকারী প্রমাণিত করতে।

আর তারা নীরেনের বন্ধু হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকবে!

না, তা উচিত নয়—কর্তব্যও নয়।

পরের দিনই সকালের দিকে মৃণাল কিরীটীর বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো।

কি ব্যাপার ডাক্তার? কিরীটী শুধায়।

বিশ্রী একটা বিপদে পড়ে এসেছি তোমার শরণাপন্ন হয়ে।

কি হলো?

সংক্ষেপে ঘটনা বিবৃত করে মৃণাল তখন।

কিরীটী সমস্ত ব্যাপারটা শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর এক সময় সোফা থেকে উঠে পায়চারি শুরু করে।

.

০৮.

সাধন দত্ত যাই বলুন না কেন কিরীটী, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না নীরেন সুনন্দাকে সেরাত্রে হত্যা করেছে!

কিন্তু তোমার বন্ধুর বিরুদ্ধে যে প্রমাণগুলো সাধন দত্ত হস্তগত করেছেন একটু আগেই তুমি বললে, সেগুলো তো একেবারে কিছু নয় বলে অস্বীকার করতে পারা যাচ্ছে না ডাক্তার–

কি এমন প্রমাণ? সেই চিঠি আর সুসীমের ঘরের বাথরুম থেকে কুড়িয়ে পাওয়া এক কোণে লাল সুতোয় এন লেখা রুমালটা তো! কিন্তু ঐ এন লেখা রুমালটা যে নীরেনেরই, তার প্রমাণ কি? সুসীমের বাড়িতে সেদিন নিমন্ত্রিত বহু লোকের সমাগম হয়েছিল, তাদের অনেকের নামেরই আদ্যাক্ষর খুঁজলে দেখা যাবে হয়ত এন!

শান্তকণ্ঠে কিরীটী পূর্ববৎ পায়চারি করতে করতেই বাধা দিয়ে বলে, তোমার যুক্তির যে সারবত্তা নেই তাও আমি বলছি না ডাক্তার–

তবে?

তুমি যেমন বলছে সেই লাল সুতোয় এন লেখা রুমালটা তোমার বন্ধু নীরেনবাবুর না হয়ে অন্য যাঁরা সে রাত্রে ওখানে উপস্থিত ছিলেন তাঁদেরও কারো হতে পারে, তেমনি অবিসংবাদিভাবে যে এটা তোমার বন্ধু নীরেনবাবুর নয় তারও কোন অকাট্য প্রমাণ তো তুমি দিতে পারছে না ডাক্তার!

না, তা পারছি না—তবে সে তো নীরেনকে জিজ্ঞাসা করলেই জানা যেতে পারে!

এ যে ছেলেমানুষের মত কথা বলছো!

মানে? ধর যদি নীরেনবাবু সত্যি কথা না বলেন—

বাঃ, কেন সে মিথ্যে না বলতে যাবে?

কেন যাবে, তাই না? যাবে, হয়ত কোন স্বার্থ থাকলে–

না, না—সত্যি বলছি কিঃটিী, নীরেন তাকে কিছুতেই হত্যা করতে পারে না—

আহা, সে তো পরের কথা! আপাততঃ রুমালটার কথাটাই ভাবা যাক না!

রুমালটার কথা আবার কি ভাববো?

কেন, তুমিই তো একটু আগে বললে, সাধনবাবু বলেছেন, রুমালটায় ক্লোরোফর্মের গন্ধ ছিল।

তা তো ছিল। কিন্তু–

কথা হচ্ছে, তাহলে কি ভাবে সুনন্দা দেবীকে হত্যা করা হয়েছে? ক্লোরোফর্ম দেবার পরে ফাঁস লাগিয়ে, না ক্লোরোফর্মের সাহায্য হত্যাকারী আদপেই নেয় নি? কেবলমাত্র কোন ব্যক্তিবিশেষের ওপর সুনন্দা দেবীর হত্যার সন্দেহটা আরোপ করবার জন্য ক্লোরোফর্ম মাখিয়ে হত্যাকারী ঐ রুমালটি বাথরুমে ফেলে রেখে গিয়েছিল–

মৃণালের মনে হয়, লোকটা কি আবোল-তাবোল বকছে! কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করে না।

কিন্তু যাক সে কথা, একটা কথার জবাব দিতে পারো ডাক্তার?

কি?

তোমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েও নীরেনবাবু সুনন্দার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথাটা তোমাদের দুবন্ধুর কাউকেই কেন এতদিন জানতে দেয় নি?

বললাম তো একটু আগে, ব্যাপারটা আমাদেরও কম আশ্চর্য, অভিভূত করে নি! কেন যে সে কথাটা গোপন করেছিল–

আচ্ছা এমনও তো হতে পারে—

কি?

তুমি ও সুসীমবাবু দুজনেই সুনন্দা দেবীকে ভালবাসতে—তাই তোমাদের বন্ধু হলেও সুনন্দার ব্যাপারটা তিনি তোমাদের কাছ থেকে গোপন করে গিয়েছেন?

মৃণাল চুপ করে থাকে।

জান তো, ভালবাসার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বন্ধুত্বের কোন মূল্য নেই! তা ছাড়া আরো একটা কথা–

কি?

সুনন্দা দেবীকে লেখা সেই অদ্ভুত চিঠিটা! বিশেষ করে সাধন দত্ত যখন জোর গলায় বলছেন, সে চিঠি নীরেবাবুরই হাতের লেখা!

হ্যাঁ বলেছেন বটে, তবে—

উঁহু, বেশ জটিল—আর আমার কি মনে হচ্ছে জান?

কি?

এর পশ্চাতে রয়েছে মদনের ফুলশর—

মদনের ফুলশর!

হুঁ। মনে করো কবির সেই অক্ষয় পংক্তি—পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছো এ কি সন্ন্যাসী!

তাহলে–

Love is jealous, love is selfish! অবিশ্যি এ-ও আমি সাধন দত্তর মত হলফ করে বলছি না যে তোমার বন্ধু নীরেনবাবুই তোমাদের বান্ধবী সুনন্দা দেবীর হত্যাকারী–

দেখো কিরীটী, ওসব আমি কিছু বুঝি না। আমি আবারও হলফ করে তোমাকে বলছি যে নীরেন নির্দোষ। আর সেটা তোমাকেই প্রমাণ করে দিতে হবে।

কিরীটী মৃদু হেসে বলে, বেশ বেশ, তাই হবে—

কথা দিচ্ছ তুমি?

কথা! বেশ, কথা দিলাম।

মৃণাল অতঃপর যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

কিন্তু একটা কথা ডাক্তার—

কি?

তোমার বন্ধু সুসীমবাবু, তাঁর—তারও কি বিশ্বাস নীরেনবাবু সত্যিই নির্দোষ?

নিশ্চয়ই।

বেশ। তবে কাল একবার তোমার বন্ধুর বাড়িটা আমি ঘুরে আসতে চাই।

বেশ তো, ইচ্ছা করলে তুমি অবিশ্যি আজ—এখুনি যেতে পারো। এখুনি তোমাকে আমি সেখানে নিয়ে যেতে পারি–

না, আজ নয়! কাল-কাল বেলা আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ তুমি এসো।

মৃণাল অতঃপর বিদায় নিল।

মৃণাল ঘর থেকে বের হয়ে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোনে সাধন দত্তকে ডাকল কিরীটী। কিরীটী।

কে?

সাধনবাবু, আমি কিরীটী রায়।

কি সৌভাগ্য! নমস্কার। কি খবর?

কি করছেন এখন? খুব ব্যস্ত নাকি?

না, না–বসে আড্ডা দিচ্ছি।

তাহলে একবার আসুন না গরীবের গৃহে। সুনন্দা চ্যাটার্জীর মার্ডার কেসটায় আমি একটু ইনটারেস্ট ছিলাম—

এখুনি—এখুনি আসছি!

.

আরো ঘণ্টাখানেক পরে। কিরীটীর ঘরেই সাধন দত্তও সে মুখোমুখি দুজনে বসে সুনন্দা চ্যাটার্জীর হত্যার ব্যাপারটা নিয়েই আলোচনা করছিল। সাধন দত্তর সঙ্গে বছর পাঁচেক পূর্বে ঘটনাচক্রে কিরীটীর আলাপ হয়। এবং সে ঘটনাটা হচ্ছে একটি জাল উইলের ব্যাপার। সেই সময়ই সাধন দত্তর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দেখে মুগ্ধ হয়েছিল কিরীটী।

তাই মৃণালের মুখে সাধন দত্ত নীরেন সেনকে সুনন্দার হত্যাব্যাপারে সন্দেহ করে গ্রেপ্তার করেছেন শুনে ব্যাপারটাকে আদৌ লঘুভাবে নিতে পারে নি সে। এবং এ-ও বুঝতে পেরেছিল কিরীটী, বিশেষ কোনো কারণ আছে বলেই সাধন দত্ত নীরেন সেনকে গ্রেপ্তার করেছেন।

সাধন দত্তর মুখে ই আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনাটা শোনবার পর কিরীটী বলে, কেবলমাত্র ঐ রুমাল ও চিঠিটার উপর নির্ভর করে যে আপনি নীরেনবাবুকে গ্রেপ্তার করেন নি, তা আমি জানি সাধনবাবু। তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম—

না মিঃ রায়, আপনি ঠিকই ধরেছেন। সুসীমবাবুকে বা মৃণালবাবুকে আমি বলি নি সব কিছু স্পষ্ট করে। একটু আগে আপনাকে যে মহিলাটির কথা বললাম, বিশাখা, মানে বিশাখা চৌধুরী, সেই মহিলাটি তার জবানবন্দীতে একটা কথা বলেছিলেন। অবিশ্যি সে রাত্রে নয়, পরের দিন সন্ধ্যায় তার ওখানে যখন গিয়েছিলাম—

কি বলেছিলেন তিনি?

রাত তখন সাড়ে দশটা হবে। যে বাথরুমের মধ্যে আমি সে-রাত্রে রুমালটা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম, সেই বাথরুমে প্রবেশ করবার আর একটা দরজা ছিল পিছনের বারান্দা দিয়ে। সেই দরজা দিয়ে বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে ফিরে আসেন বিশাখা চৌধুরী, বাথরুমে ঐ সময় নীরেন সেনকে পিছনে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।

কিন্তু–

শুনুন, আরো আছে। নীরেন পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকলেও ঐ সময় তার হাতে একটা শিশি দেখতে পেয়েছিলেন বিশাখা।

কিন্তু কথাটা তিনি তাঁর প্রথম দিনের জবানবন্দীতে আপনাকে প্রকাশ করেন নি কেন?

সে সময় ব্যাপারটার মধ্যে কোন গুরুত্ব খুঁজে পান নি বলেই সে রাত্রে আমাকে এ সম্পর্কে। কিছু বলতে নাকি তিনি ভুলে গিয়েছিলেন।

আচ্ছা সে-সময়, মানে যখন তিনি নীরেন সেনকে দেখতে পান তখন বাথরুমে কি আলো জ্বলছিল?

না, বাথরুম অন্ধকার ছিল। তবে—

কি?

হলঘরের আলোর খানিকটা অংশ বাথরুমের মধ্যে গিয়ে পড়ায় বাথরুমটার মধ্যে অস্পষ্ট একটা আলোছায়া ছিল। তারপর যা বলছিলাম, নীরেন সেন বাথরুম থেকে চলে যাবার পর বিশাখা গিয়ে বাথরুমে ঢুকেই নাকি ক্লোরোফর্মের গন্ধ পেয়েছিলেন।

হুঁ। আচ্ছা ঠিক রাত্রি কটায় যেন সুনন্দা চ্যাটার্জী মৃত আবিষ্কৃত হয়?

সোয়া এগারটা থেকে সাড়ে এগারটার মধ্যে।

বিশাখা চৌধুরী কি নীরেন সেনের পূর্বপরিচিত ছিলেন?

না।

ডাঃ সেন, সুসীম নাগ ও সুনন্দার সঙ্গে নিশ্চয়ই পরিচয় ছিল তার?

সুসীমের সঙ্গে ছিল, তবে এক কলেজে কাজ করলেও সুনন্দার সঙ্গে শুনেছি বিশাখার তেমন হৃদ্যতা বা ঘনিষ্ঠতা ছিল না।

বিশাখা চৌধুরীর বয়স কত হবে?

ত্রিশ-বত্রিশ হবে।

বিয়ে করেছেন?

না।

কি করেন ভদ্রমহিলা?

সুনন্দা চ্যাটার্জীর সঙ্গে একই কলেজে অধ্যাপকের কাজ করেন এই তো বললাম।

তা বিয়ে এখনো করেন নি কেন ভদ্রমহিলা? তিনিও কি ঐ তিনজনের একজনকে ভালোবাসতেন?

সে রকম কোন কিছু তো এখনো জানা যায় নি।

জানা কিন্তু উচিত ছিল। যাক্ বাথরুমের মধ্যে সেরাত্রে পিছন ফিরে স্বল্প আলোআঁধারিতে যে ব্যক্তি শিশি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি যে নীরেন সেনই, সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই তো আপনার বিশাখা চৌধুরীর?

না।

দৃষ্টিশক্তি খুব প্রখর বলতে হবে ভদ্রমহিলার। কিন্তু আমি ভাবছি—দৃষ্টিশক্তি যার এত প্রখর, তিনি ব্যাপারটা জেনেও সেরাত্রে আপনাকে বলেন কি কেন?

বললাম তো, ব্যাপারটায় প্রথমে উনি তত গুরুত্ব নাকি দেন নি।

কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে বিচার করতে গেলে তো দেওয়া উচিতই ছিল, তাই নয় কি মিঃ দত্ত?

তা অবিশ্যি ছিল।

চুরোটটা নিভে গিয়েছিল, সেটায় পুনরায় অগ্নিসংযোগ করে বার-দুই টান দিয়ে কিরীটী ইতিমধ্যে পায়চারি থামিয়ে যে চেয়ারটার উপর উপবেশন করেছিল সেটারই পিছনে হেলান দিয়ে যেন আরাম করে বসল গা ঢেলে দিয়ে।

সাধনবাবু, সকলের কথাই আপনি বললেন, কিন্তু সুসীম নাগের ভগ্নী সুধা দেবী ও সেদিন নিমন্ত্রিত হয়ে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে বিষ্ণু দে ভদ্রলোকটির কথা তো তেমন বিশেষ কিছু বললেন না!

কিরীটীর প্রশ্নে কতকটা যেন বিস্ময়ের সঙ্গেই তাকান সাধন দত্ত তার মুখের দিকে।

কিন্তু কিরীটীর সঙ্গে চোখাচোখি হলো না সাধন দত্তর। কারণ কিরীটী তখন হাত বাড়িয়ে সামান্য ঝুঁকে সম্মুখের ছোট গোল টেবিলটার উপরে রক্ষিত কাচের ছাইদানিটায় হাতের

অগ্নিদগ্ধ চুরোটের অগ্রভাগটা ঝাড়ছিল।

সুধা দেবী আর বিষ্ণু দে!

হ্যাঁ, হরপ্রসাদবাবু তার জবানবন্দীতে কি বলেন নি যে তার স্ত্রী সুধা দেবী তাঁর একমাত্র ভাইয়ের সুনন্দা চ্যাটার্জীর সঙ্গে প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠতা কোন দিনই তেমন প্রীতির চোখে দেখেন নি?

হ্যাঁ, তাই বলেছিলেন বটে।

তাহলে স্বভাবতই কি আমরা ধরে নিতে পারি না যে আমন্ত্রণ না করা সত্ত্বেও রবাহূতভাবে সুনন্দা চ্যাটার্জীর সেরাত্রের উৎসবে সুসীম নাগের বাড়িতে উপস্থিতিটা সুধা দেবীর কাছে প্রীতির ব্যাপার হয় নি? এবং সুধা দেবী একজন নারী–

কিন্তু–

কি জানেন সাধনবাবু, ঐদিনকার ব্যাপারে সুধা দেবী অবহেলার যোগ্য নন! আর বিষ্ণু দে ভদ্রলোকটি এবং তার জবানবন্দীও অবহেলার বস্তু নয়!

কিন্তু বিষ্ণু দে–

বিশাখা তার জবানবন্দীতে বলেছেন, সুনন্দা চ্যাটার্জীর মৃত্যুর ব্যাপারটা জানাজানি হবার আধঘণ্টাটাক আগে তিনি নাকি ঐ হলঘরে কাকে ডাকতে এসে সোফায় সুনন্দা চ্যাটার্জীর পাশে বসে একজন ভদ্রলোককে তার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছিলেন এবং সেই সময় ম্যাজিসিয়ান ভদ্রলোক তাসের ম্যাজিক দেখাচ্ছিলেন।

এবং বিষ্ণু দে-ও তার মিনিট পনেরো পরে হলঘরে এসে তাই দেখেছিলেন। অর্থাৎ তাহলে কি এই দাঁড়াচ্ছে না যে, বিষ্ণু দে ও বিশাখা চৌধুরী দুজনে ব্যাপারটা দেখেছেন?

হ্যাঁ।

কিন্তু বিশাখা তাঁর জবানবন্দীতে বলেছেন, সেই ম্যাজিসিয়ানের বেশভূষা, এমন কি তার কণ্ঠস্বরটা পর্যন্ত নাকি মৃণাল সেনের মতো!

তা তো বলেছেনই।

কিন্তু সেকথা কি বিষ্ণু দে বলেছেন?

না।

অথচ তার কাছ থেকেও ঐ একই ব্যাপারটা কি আমরা আশা করি না?

তিনি বলেছেন, তিনি নাকি ম্যাজিসিয়ানের কণ্ঠস্বর চিনতে পারেন নি।

মিথ্যে কথা।

কি বলছেন মিঃ রায়?

বললাম তো মিথ্যে কথা। A deliberate and intentional lie! বিষ্ণু, মৃণাল ও। সুসীমবাবু তিনজনেই মিথ্যা বলেছেন।

কিন্তু–

এর মধ্যে কোন কিন্তুই নেই, মিঃ দত্ত। নিমন্ত্রণ-বাড়িতে অত লোক তার ম্যাজিক দেখলো, তিনি প্রকাশ্যে সকলের চোখের সামনে হলঘরের মধ্যে ম্যাজিক দেখালেন, অথচ সুসীমবাবু আর মৃণাল তাঁকে দেখলেন না—আপনি কি আমাকে কথাটা বিশ্বাস করতে বলেন?

অবিশ্যি আপনি যা বলছেন—

যুক্তি ছাড়া কিরীটী রায় কথা বলে না।

তাহলে কি আপনার ধারণা নীরেন সেন হত্যাকারী নয়?

ধারণা আমার কিছুই নয়, আর কিছুই এই মুহূর্তে আমি বলছি না। It is too early to say anything! তবে এইটুকু আপনাকে বলতে পারি মিঃ দত্ত–

কি?

জবানবন্দীতে সেরাত্রে তিনজন মিথ্যা কথা বলেছে—

তিনজন!

হ্যাঁ।

কে কে?

সুসীম নাগ, ডাঃ মৃণাল সেন—

আর?

শ্ৰীমতী বিশাখা চৌধুরী।

.

০৯.

পরের দিন বেলা নটা নাগাদ কিরীটী ডাঃ মৃণাল সেনের সঙ্গে সুসীমের গৃহে উপস্থিত হলো।

সুসীম ঐ সময় তার নীচের হলঘরে বসে দরজা বন্ধ করে কতকগুলো পুরাতন চিঠি দেশলাই জ্বেলে একটার পর একটা পোড়াচ্ছিল একাকী।

ভৃত্য এসে দরজায় ধাক্কা দিতে সুসীম শুধায়, কে?

আজ্ঞে দাদাবাবু, আমি দীনু। মৃণালবাবু আর এক ভদ্রলোক এসেছেন, আপনাকে ডাকছেন মৃণালবাবু।

যা, এই ঘরে পাঠিয়ে দে।

যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি সুসীম পোড়া চিঠির ছাইগুলো একত্র করে বাইরে বাগানের মধ্যে ফেলে দেয় জানালাপথে। এবং তখনো যে চিঠিগুলো পোড়ানো বাকি ছিল, সেগুলো একটা বইয়ের আলমারির মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে দেয়।

চিঠিগুলো সুনন্দার।

দীর্ঘ বারো বৎসরের আলাপে অনেক চিঠিই লিখেছিল তাকে সুনন্দা। একটি চিঠিও সুনন্দার নষ্ট করে নি সুসীম এতদিন। সযত্নে বাণ্ডিল বেঁধে এতদিন রেখে দিয়েছিল সব চিঠি। কিন্তু আজ সকালে উঠেই কেন যেন মনে হয়েছিল সুসীমের, ওগুলোর প্রয়োজন আজ তার জীবনে ফুরিয়েছে। সুনন্দার স্মৃতি মন থেকে আজ তার মুছে ফেলাই উচিত। সুনন্দা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক আজ তার জীবন থেকে।

আজ থাক শুধু শ্রাবণী।

দরজায় ধাক্কা পড়লো।

সুসীম! মৃণালের গলা শোনা যায়।

সুসীম এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।

পরিচয় করিয়ে দিই—আমার বন্ধু সুসীম নাগ, আর সুসীম তুমি এঁকে কখনো না দেখলেও আমার মুখে এঁর কথা বহু শুনেছে—কিরীটী রায়!

দুজনে দুজনকে নমস্কার জানায়।

কিন্তু কিরীটীর নামটা শুনে সুসীমের ভ্রূ-দুটো যেন ঈষৎ কুঞ্চিত হয়।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সুসীম যেন মুখে একটা খুশির ভান এনে সাদর অভ্যর্থনা জানায়, বসুন, বসুন মিঃ রায়।

ঘরে ঢুকতেই কাগজ পোড়ার গন্ধটা কিরীটীর নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করেছিল। সে বলে, ঘরে একটা কাগজ পোড়ার গন্ধ পাচ্ছি যেন, মিঃ নাগ!

কাগজ পোড়ার?

হ্যাঁ। বলতে বলতে সহসা নীচু হয়ে ঘরের মেঝে থেকে একটুকরো পোড়া কালো কাগজ তুলে নেয় হাতে কিরীটী, কিছু পোড়াচ্ছিলেন নাকি?

হ্যাঁ-হ্যাঁ, কতকগুলো পুরাতন কাগজপত্র—

হুঁ, জঞ্জাল রেখে তো লাভ নেই!

মৃদুকণ্ঠে যেন কতকটা স্বগতোক্তির মতই কথাগুলো বলে কিরীটী।

কিছু বলছিলেন মিঃ রায়?

না, কিন্তু আপনার লাইব্রেরীতে বেশ ভাল কালেকশন আছে বলেই মনে হচ্ছে মিঃ নাগ!

হ্যাঁ, বাবার লাইব্রেরী এটা। বই পড়ার একটা নেশা ছিল বাবার।

সুসীম মৃদুকণ্ঠে বলে।

আচ্ছা মিঃ নাগ—

বলুন!

নীরেনবাবু মানে আপনাদের বন্ধু নীরেন সেন আপনাদের বান্ধবী সুনন্দা দেবীকে হত্যা করেছে বলে কি আপনার মনে হয়?

স্বাভাবিকভাবে মনে হয় না, তবে–

তবে?

নীরেন আমাদের সহপাঠী বন্ধু বটে, তবে তার সবটুকুই কি আমরা জানি, না সেটা সম্ভব!

তা তো বটেই।

মৃণালকেও আমি তাই বলছিলাম—

চলুন মিঃ নাগ, আপনার সেই হলঘর ও বাথরুমটা একবার আমি দেখতে চাই।

নিশ্চয়ই, চলুন!

.

প্রথমেই ওরা দোতলার সেই হলঘরে যায়।

হলঘরটির চারপাশে একবার দৃষ্টিপাত করে প্রথমেই প্রশ্ন করে কিরীটী, ঐ যে আলমারিগুলো দেখছি, সেরাত্রে কি ঐভাবেই আলমারিগুলো ছিল মিঃ নাগ?

হ্যাঁ।

ঐভাবেই বরাবর রয়েছে?

না, উৎসবের জন্য আলমারিগুলোকে ঘরের একধারে place করা হয়েছিল জায়গার জন্যে–

আলমারিগুলোর মধ্যে কি আছে?

অফিসের ফাইল, কাগজপত্র।

এটা তাহলে আপনার অফিস-ঘর হিসাবেই সাধারণতঃ ব্যবহৃত হয় বলুন।

হ্যাঁ।

কিরীটী লক্ষ্য করে দেখলো আলমারিগুলো স্টীলের।

কিরীটী অতঃপর আলমারিগুলোর পিছনে গিয়ে দেখলো, সেগুলো একেবারে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো নয়, আলমারি ও দেওয়ালের মাঝখানে বেশ কিছুটা জায়গার ব্যবধান আছে।

সেদিন এই হলঘরেই বোধ হয় নিমন্ত্রিতদের বসবার জায়গা হয়েছিল?

হ্যাঁ, কিছু সোফা আর চেয়ার পেতে বসবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

সেগুলো সরিয়ে ফেলেছেন মনে হচ্ছে!

হ্যাঁ, নীচের অফিস-ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সুসীম জবাব দেয়।

অতঃপর কিরীটী গিয়ে ইয়েল-লক চাবি দিয়ে দরজা খুলে হলঘরের সংলগ্ন বাথরুমের মধ্যে ঢুকলো। বাথরুমের ও ঘরের মধ্যবর্তী দরজার উপরার্ধে মোটা কাচ বসান।

সুসীম ও মৃণাল কিরীটীকে অনুসরণ করে।

বাথরুমটা নেহাৎ ছোট নয়। বেশ বড় সাইজের বাথরুম। কিরীটী লক্ষ্য করে, বাথরুমের মধ্যে বেসিনের ঠিক ওপরেই দেওয়ালে যে আয়নাটা রয়েছে সেটা একেবারে দরজাটার মুখোমুখি বসানো।

কিছুক্ষণ সেই আয়নাটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিরীটী। তারপর বাথরুমের দরজা দুটো পরীক্ষা করে। দুটো দরজাতেই ইয়েল-লক লাগানো।

মিঃ নাগ!

বলুন।

সেরাত্রে বাথরুমের দুটো দরজাই খোলা ছিল বোধ হয়?

হ্যাঁ, যদি কারো প্রয়োজন হয়—

তা তো বটেই। আচ্ছা মিঃ নাগ, আপনার বান্ধবী বিশাখা দেবী আপনার এ বাড়িতে পূর্বে কখন এসেছেন?

বহুবার।

আচ্ছা মনে পড়ে আপনার, বাথরুমটা কখনো তিনি ব্যবহার করেছেন কিনা?

তা বোধ হয় করেছে।

সুনন্দা চ্যাটার্জী?

সেও এসেছে এবং বাথরুমও সে ব্যবহার করেছে।

তাহলে দেখছি, এ বাথরুমটা কারোরই অপরিচিত ছিল না!

না, তা ছিল না।

কথা বলতে বলতে কিরীটী বাথরুমটার চারিদিকে ইতস্তত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল।

আবার একসময় কিরীটী বলে, মিঃ নাগ, সেরাত্রের পর এ কদিন এই বাথরুমটা কি ব্যবহৃত হয়েছে?

না মিঃ রায়, সেই দুর্ঘটনার পর এই হলঘরের দিকে কেউ আসে নি।

কিন্তু এই বাথরুমটাও কি ব্যবহৃত হয় নি?

না, বাইরে থেকে তালা দেওয়া ছিল। তা ছাড়া–

সুসীমের শেষের কথায় কিরীটী যেন একটু আগ্রহ সহকারেই ফিরে তাকালো সুসীমের দিকে।

সুসীম এবারে যেন ইতস্তত করেই বলে, সেই দুর্ঘটনার রাত্রের পর থেকে এদিকটায় বড় একটা কেউই আসে নি–

কেন?

আমি অবিশ্যি শুনি নি, তবে অনেকেই নাকি এদিকটায় রাত্রে কিসের শব্দ শুনেছে—

সহসা ঐ সময় কিরীটী এগিয়ে গিয়ে ঘরের কোণে মেঝে থেকে একটা কর্কশূন্য এক ড্রাম সাইজের হোমিওপ্যাথিক ঔষধের শিশি পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে সেই রুমালটা দিয়ে সন্তর্পণে চেপে ধরে তুলে নিল।

মৃণাল এগিয়ে আসে, বলে, কি?

একটা হোমিওপ্যাথিক ঔষধের শিশি। গায়ে দেখছি লেবেল আঁটা আছে—থুজা টু হাড়ে! শিশিটা দেখছি ফেটে গিয়েছে। এ বাড়িতে রিসেন্টলি কেউ থুজা ব্যবহার করেছিল বলে জানেন নাকি মিঃ নাগ?

হোমিওপ্যাথিক ঔষধ তো এ বাড়িতে কেউ ব্যবহার করে না মিঃ রায়!

তবে শিশিটা আপনার বাড়ির বাথরুমের মধ্যে এলো কি করে?

কি জানি! বলতে পারছি না তো!

কিরীটী এবারে মৃণালের মুখের দিকে ফিরে তাকালো, ডাক্তার, তোমার হোমিওপ্যাথিক সম্পর্কে কোন জ্ঞান আছে?

শুনে শুনে কিছু জানি। মৃণাল জবাব দেয়।

হোমিওপ্যাথিক শাস্ত্রে থুজার ইনডিকেশন কি জান? Undesirable and unwanted growth নাকি রিমুভ করা হয় থুজার সাহায্যে! মৃদু হেসে শিশিটা রুমাল সমেতই জড়িয়ে পকেটে রাখতে রাখতে কথাটা বলে কিরীটী।

তারপর পুনরায় কিরীটী সুসীমের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, এই বাথরুমের চাবি কার কাছে সেরাত্রে ছিল?

বললাম তো এইমাত্র আপনাকে মিঃ রায়, চাবি সেরাত্রে খুলেই রাখা হয়েছিল। তবে পাশেই ক্লোক্রমের ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে চাবিটা রেখে দিয়েছিলাম।

চাবিটা একবার নিয়ে আসুন তো!

এখুনি নিয়ে আসছি—সুসীম বাথরুমের অন্য দ্বারপথে বের হয়ে গেল।

সুসীম বাথরুম থেকে বের হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটী পার্শ্বেই দণ্ডায়মান মৃণালের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, ডাক্তার, তুমি এ ব্যাপারে কাউকে সন্দেহ কর?

মৃণাল একটু অন্যমনস্ক ছিল। তাই একটু চমকেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে শুধায়, কোন্ ব্যাপারে?

তোমাদের বান্ধবী সুনন্দা দেবীর হত্যার ব্যাপারে?

কাকে সন্দেহ করবো!

কাকে করবে তা বলি কি করে? তবে করো কিনা সেইটাই শুধু জিজ্ঞাসা করছি!

না।

অর্থাৎ সন্দেহ করতে পারো এমন কোন নাম মনে পড়ছে না, এই তো! বেশ আমি কয়েকটা নাম করি-ধর বিশাখা দেবী, শ্রাবণী দেবী, সুসীম, নীরেন–

কি বলছো কিরীটী, এরা—after all এরা কেন সুনন্দাকে হত্যা করতে যাবে!

তারপরেই যেন দুম্ করে কিরীটী বললে, কিন্তু তুমি?

আমি!

বিস্ময়ে বিস্ফারিত নয়নে তাকায় মৃণাল কিরীটীর মুখের দিকে।

হ্যাঁ তুমি—তুমিও তো পার তাকে হত্যা করতে!

কথাটা বেশ স্পষ্ট ও সহজকণ্ঠে কিরীটী বললেও, কৌতুকে যেন তার চোখের পাতা দুটো নাচছিল তখন।

আমি হত্যা করবো সুনন্দাকে!

কেন, অসম্ভব কি?

কি বলছো কিরীটী?

স্বাভাবিক হ্যাঁ, তাই বলছি!

স্বাভাবিক?

কিরীটী বলে, কি জান ডাক্তার, মানুষের অবচেতন মনের অন্ধকার গলিখুঁজিতে কখন যে কোন্ লিঙ্গা নখর বিস্তার করে, তা সে নিজেও টের পায় না। এই ধর না আমার কাছে তোমার আসাটা! কেন তুমি এসেছো আমার কাছে?

কেন—

এসেছো তুমি এ ব্যাপারে কাউকে সন্দেহ করেছে বলেই—

তার মানে?

মানে কি তুমি জান না?

কি বলতে চাও?

বলতে চাই—

কিন্তু কিরীটীর মুখের কথাটা শেষ হলো না, সুসীম এসে ঘরে ঢুকলো।

কি হলো মিঃ নাগ, চাবিটা পেলেন? কিরীটী শুধায়।

আশ্চর্য! চাবিটা তো ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারের মধ্যে পেলাম না মিঃ রায়!

পেলেন না?

না।

সেটা তাহলে বোধহয় খুনীর পকেটেই রয়ে গিয়েছে!

সুসীম বা মৃণাল কিরীটীর কথার কোন জবাবই যেন খুঁজে পায় না। কেবল দুজনে দুজনের মুখের দিকে নিঃশব্দে তাকায়।

কিন্তু এখানে আর নয় সুসীমবাবু, চলুন আপনার এই বাথরুমের পাশের ক্লোরুমটা একবার দেখবো।

চলুন।

.

ক্লোকরুমটাও নেহাৎ আকারে একেবারে ছোট নয়। তবে একটু লম্বা প্যাটার্নের। ক্লোমটার মধ্যে অবিশ্যি বেশী কিছু জিনিসপত্র ছিল না। একটা বড় সাইজের ড্রেসিং টেবিল, একটা আলমারি ও গোটাকয়েক স্টীলের কালো রংয়ের ট্রাঙ্ক এবং একটা আলনা।

ঘরের চারিদিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে কিরীটী শুধায়, এ ক্লোব্রুমটা যেন মনে হচ্ছে আজকাল আর ব্যবহার হচ্ছে না মিঃ নাগ!

না, বছর দুয়েক ধরে ওপরের হলঘরটায় অফিস করায় এটা আর ব্যবহার হয় না।

চাবি দেওয়াই থাকতো, না খোলাই থাকতো ঘরটা?

খোলাই থাকে।

খোলা থাকলেও ঘরটা নিয়মিত ঝাড়পোঁছ হয় বলে তো মনে হচ্ছে না?

তা বোধ হয় হয় না।

কিরীটী এবারে ড্রেসিং টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেল এবং তার দুপাশের দুটো টানা টেনে একের পর এক খুললো।

দুটো টানাই একেবারে খালি। টানার হ্যাণ্ডেলে ধুলো জমে ছিল, হাতে সেই ধুলো লাগে কিরীটীর। হাতের ধুলোটা অন্য পকেট থেকে আর একটা রুমাল বের করে মুছতে মুছতে কিরীটী বলে, এ ঘরটা আপনার অনেকদিন মনে হচ্ছে ঝাড়পোঁছ হয় না মিঃ নাগ!

এ ঘরটা তো ব্যবহার হয় না। তাই হয়তো চাকররা—

মনোযোগ দেয় না এ ঘরটায়। স্বাভাবিক। ঠিক আছে, চলুন এবারে বাইরে যাওয়া যাক।

.

কিরীটীকে নিয়ে সুসীম তার নীচের পারলারে বসালো।

একটু পরে হরপ্রসাদ ও তার স্ত্রী সুধাও এলেন।

দুচারটে মামুলি কথাবার্তার পর একসময় কিরীটী সকলকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে এক এক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলো।

প্রথমেই সুধা।

সুধাকে বলে, আচ্ছা সুধা দেবী, আপনার তো সুনন্দা চ্যাটার্জীর সঙ্গে পরিচয় ছিল?

হ্যাঁ।

কি ধরনের মেয়ে ছিল সে?

নসিয়েটিং! কখনো তাকে আমি স্ট্যাণ্ড করতে পারি নি।

কেন বলুন তো? তার স্বভাব-চরিত্র কি তেমন সুবিধার ছিল না?

তা জানি না, তবে এটা জানি, পুরুষকে নাচানোই ছিল তার স্বভাব। তার কোন–ইংরেজীতে যাকে বলে—প্রিন্সিপল চরিত্রে ছিল না।

আচ্ছা সুধা দেবী, সেরাত্রে কে একজন আমন্ত্রিতদের মধ্যে নানা ধরনের তাসের ম্যাজিক দেখাচ্ছিলেন, আপনি তাঁকে দেখেছিলেন?

না।

আর একটা কথা, আপনার দাদার বন্ধু ডাঃ সেন, নীরেন সেন আর বিষ্ণু দে—এঁদের সকলের সঙ্গেই বোধ হয় আপনার পরিচয় ছিল?

ছিল। তবে বেশী আলাপ যদি বলেন তো একমাত্র ডাঃ সেনের সঙ্গেই—

এঁদের তিনজনের মধ্যে কেউ তাসের ম্যাজিক জানেন কি?

কখনো শুনি নি তো!

আচ্ছা আপনি যেতে পারেন। সুসীমবাবু—আপনার দাদাকে এ ঘরে পাঠিয়ে দেন যদি!

দিচ্ছি।

সুধা বের হয়ে গেল ঘর থেকে।

.

সুসীম নাগ।

দেখুন সুসীমবাবু, কিরীটী বলে, আপনার ও মিস্ সুনন্দা চ্যাটার্জী সম্পর্কে সব কথাই শুনেছি ডাঃ সেনের কাছ থেকে। তাই সে-সব কথা নয়—অন্য কয়েকটা প্রশ্ন আপনাকে আমি করবো। আচ্ছা আপনার বন্ধুদের মধ্যে কাউকে কি আপনি সুনন্দা চ্যাটার্জীর মৃত্যুর ব্যাপারে সন্দেহ করেন?

না।

নীরেনবাবুকে?

না।

আচ্ছা সেই ম্যাজিসিয়ান সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?

ব্যাপারটা এখনো আমার কাছে রহস্যপূর্ণ।

কিন্তু there was somebody—এটা তো আপনি স্বীকার করবেনই।

অনেকেই যখন দেখেছে—

হুঁ। আচ্ছা সেরাত্রে শেষ কখন আপনার সুনন্দা চ্যাটার্জীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?

রাত পৌনে এগারটা হবে বোধ হয়।

কোথায় দেখা হয়েছিল?

হলঘরের সামনের বারান্দায়।

একস্যাক্টলি কোথায়?

ঐ দোতলার ক্লোরুমটার সামনে একা রেলিংয়ে হাত রেখে সে দাঁড়িয়ে ছিল।

কোন কথা হয়েছিল সে-সময় তার সঙ্গে আপনার?

হয়েছিল।

কি কথা?

বলেছিল ঘরের মধ্যে স্টাফি বোধ হওয়ায় সে ঐখানে খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে—

আর কোন কথা নয়?

না, তারপরই আমি নীচে চলে যাই।

যদি কিছু মনে না করেন তো একটা কথা জিজ্ঞাসা করতাম—

করুন!

সুনন্দা চ্যাটার্জীকে শেষ পর্যন্ত কেন আপনি বিয়ে করলেন না?

মুহূর্তকাল চুপ করে থাকে সুসীম, তারপর মৃদুকণ্ঠে বলে, আজ আর সে কথা আপনাকে বলতে আমার কোন বাধা নেই মিঃ রায়। দেহেই সে শুধু নারী ছিল, মনে ছিল সে এক বিচিত্র জীব। না নারী, না পুরুষ। অন্ধের মত আমি ছুটে বেড়িয়েছি তার পিছনে পিছনে—একটাআধটা দিন নয়, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর—তবু জানতে পারি নি তার আসল পরিচয়টা—চিনতে পারি নি তার আসল চেহারাটা। তবু-তবু আজ অস্বীকার করবো না আপনার কাছে মিঃ রায়, তাকে আমি ভালবাসতাম। জীবনে কাউকে আমি অমন করে বুঝি ভালবাসি নি–

শেষের দিকে গলাটা ধরে আসে সুসীমের। চোখের কোল দুটো ছলছল করে ওঠে। মানুষের জীবনটা সত্যিই কি বিচিত্র মিঃ রায়, সুসীম বলতে থাকে, নইলে দেখুন বারোটা বছর তো অপেক্ষা করেছিলাম ওকে নিয়েই ঘর বাঁধবো বলে–

আপনি তাকে ভুল বোঝেন নি তো মিঃ নাগ! কিরীটী বলে।

ভুল! না মিঃ রায়, ভুল বুঝি নি। আর ভুল বুঝি নি বলেই শ্রাবণীকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেছি। তার পরিচিতজনেরা সবাই জানতে এবং বলেছেও চিরদিন, ওর চোখে নাকি একটিমাত্র দৃষ্টিই আছে—ব্যঙ্গের দৃষ্টি। ও নাকি শুধু জানে ব্যঙ্গ করতেই। কিন্তু আমি জানি তা নয়, সেটা ওর বাইরের একটা খোলস ছিল মাত্র। আসলে ও ছিল ক্লীবনা পুরুষ, না নারী—আর সেইটাই যে মুহূর্তে জানতে পারলাম, সেই রাত্রেই সোজা ওর বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম শ্রাবণীর কাছে—তাকে প্রস্তাব জানিয়েছিলাম। তাই তো নীরেনের ব্যাপার যখন শুনলাম, প্রথমেই আমার মনে হয়েছিল নীরেন এত বড় ভুলটা করলো কি করে!

আচ্ছা মিঃ নাগ—

বলুন?

নীরেনবাবুর সঙ্গে সুনন্দা দেবীর ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারটা কি সত্যিই আপনি জানতেন না?

না।

কোন কারণে আপনার কোনরকম সন্দেহও হয় নি?

না। আচ্ছা আর একটা কথা, নীরেনবাবুকে তো আপনি এ ব্যাপারে সন্দেহ করেন না—কিন্তু আর কারো ওপরে কি আপনার সন্দেহ হয়?

না।

ডাঃ সেনকে?

য়্যাঁ! মৃণালকে? না।

আপনি তো নিশ্চয়ই চান যে সুনন্দা দেবীর হত্যাকারী ধরা পড়ুক!

চাই বৈকি।

আচ্ছা এবারে তাহলে আমি উঠবো মিঃ নাগ আজকের মতো—তবে আবার হয়তো। আমি আসবো—আবার হয়তো বিরক্ত করবো আপনাদের।

না, না—বিরক্তির কি আছে! যখনই প্রয়োজন হবে আসবেন—

ধন্যবাদ।

কিরীটী উঠে দাঁড়ালো।

.

১০.

গাড়িতে উঠে কিরীটী মৃণালকে সম্বোধন করে বলে, বিশাখা দেবী কোথায় থাকেন মৃণাল?

শ্যামবাজারে।

এখন গেলে তার সঙ্গে দেখা হতে পারে?

তা হয়তো হতে পারে, কারণ এখন তো তার গ্রীষ্মের ছুটি চলেছে!

কিরীটী হীরা সিংকে নির্দেশ দেয় শ্যামবাজারের দিকে গাড়ি চালাতে।

শ্যামবাজারে রামধন মিত্রের লেনে বিশাখা থাকে। মৃণালই হীরা সিংকে নির্দেশ দিয়ে নিয়ে এল বিশাখার বাড়িতে।

.

একটা দোতলা বাড়ির দোতলার তিনখানা ঘর নিয়ে বিশাখা থাকে।

ছোট সংসার। বিশাখা, তার বিধবা মা ও একটি বেকার জুয়াড়ী ভাই জগদীন্দ্র। বিশাখার চাকরির আয় থেকেই সংসার চলে।

বিশাখার সব কিছু পরিচয়ই কিরীটী মৃণালকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করে গাড়িতেই জেনে নেয়। বিশেষ করে যেটা সাধন দত্তও তাকে জানাতে পারেন নি।

ইন্টারমিডিয়েট পড়তে পড়তেই শোনা যায় বিশাখা নাকি কোন একজনকে রেজেস্ট্রী করে বিয়ে করেছিল। কিন্তু বিয়ে করলেও প্রকাশ্যে সেই স্বামীকে নিয়ে বিশাখা ঘর করে নি।

কিরীটী শুধিয়েছিল, কেন?

বিশাখার জীবনে সে এক চরম দুঃখের কাহিনী কিরীটী। কেবল দুঃখের কেন লজ্জারও। ব্যাপারটা একমাত্র আমি ছাড়া আর কেউ জানে না অনাত্মীয়ের মধ্যে। আর আপনার জনেদের মধ্যে একমাত্র জানেন ওর মা।

কিন্তু দুঃখের কাহিনী বলছো কেন ডাক্তার?

বিশাখার মুখেই শুনেছি, লোকটা শুধু পাষণ্ডই নয়, হৃদয়হীন নিষ্ঠুরও। আমি অবিশ্যি আলফ্রেডকে চোখে কখনো দেখি নি, নামটা শুনেছি।

লোকটার নাম আলফ্রেড বলছে–

হ্যাঁ, ক্রিশ্চান। শুনেছি, মাত্র একটা বছর নাকি স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল বিশাখার।

তারপর বুঝি ডিভোর্স হয়ে গেল?

না, ডিভোর্স আজ পর্যন্ত হয় নি।

কেন?

সেও এক দুর্বোধ্য ব্যাপার। কারণ জিজ্ঞাসা করেও জবাব পাই নি বিশাখার কাছ থেকে। যাই হোক, আলফ্রেডের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হবার পর বিশাখা ক্রমে এম. এ. পাস করে, তারপর অধ্যাপিকার চাকরি নেয়।

বিশাখা দেবীর বিবাহের ব্যাপারটা মিস্ চ্যাটার্জী জানতেন না?

যতদূর জানি জানতো না।

সুসীমবাবু—তোমার বন্ধুও না?

না।

মৃণালের অনুমান মিথ্যে হয় নি। বিশাখা বাড়িতেই ছিল।

মৃণালের মুখে কিরীটীর পরিচয় পেয়ে বিশাখা তাকে সমাদরে অভ্যর্থনা করে বসতে দিল। ছোটখাটো দেখতে এবং রোগা চেহারার শ্যামলা মেয়েটি প্রথম দর্শনেই যেন কিরীটীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। চোখে-মুখে একটা তীক্ষ্ণ বুদ্ধির দীপ্তি। বয়েস বিশাখার যাই হোক না কেন, কুড়ি-বাইশের বেশী বলে মনে হয় না। যে ঘরে কিরীটী ও মৃণালকে বিশাখা বসতে দিয়েছিল সে ঘরটিতে সামান্য আসবাবের মধ্যে যেন একটা পরিচ্ছন্ন রুচির বিকাশ।

বিশাখা বলে, চা নিয়ে আসি?

কিরীটী বাধা দেয়, না বিশাখা দেবী, এ সময় চায়ের জন্য আপনি ব্যস্ত হবেন না, বসুন। ডাক্তার সেন আমার পরিচয়টা আপনাকে দিল বটে, তবে এ সময় আমার এখানে আসার উদ্দেশ্যটা ব্যক্ত করলো না।

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে বিশাখা কিরীটীর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকালো।

আগের পর্ব :

০১-০৫. জবানবন্দী দিচ্ছিল সুসীম

পরের পর্ব :
১১-১৫. কিরীটী বোধহয় মুহূর্তের জন্য ভাবে
১৬-১৮. পঞ্চশরের কীর্তি

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত