ব্লু-প্রিন্ট: ০৬. ঘরে ফিরে আসতে সুব্রত শুধায়

ব্লু-প্রিন্ট: ০৬. ঘরে ফিরে আসতে সুব্রত শুধায়

০৬. ঘরে ফিরে আসতে সুব্রত শুধায়

ঘরে ফিরে আসতে সুব্রত শুধায়, দেবেশবাবু ফোন করেছিলেন কেন?

বুঝলাম না ঠিক। বললে গাড়ি পাঠাচ্ছে, কোথায় যেন যেতে হবে।

কোথায়?

তা তো কিছু বললো না।

দেবেশবাবু জানেন কেন তুই এখানে এসেছিস?

হ্যাঁ, বলেছি।

কিরীটীর পরনে একটা গরম পায়জামা, পাঞ্জাবি ও গায়ে শাল ছিল; সে তাড়াতাড়ি জামাকাপড় বদলে প্রস্তুত হয়ে নিল।

একটু পরেই গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকছে হেড-লাইট জ্বালিয়ে দেখা গেল। গাড়ির আলোটা জানালার বদ্ধ কঁচের শার্সির উপর দিয়ে ঘুরে গেল।

ঐ, গাড়ি বোধ হয় এসে গেল। চলি।

একজন নেপালী ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছিল। কালো রঙের ঝকঝকে একটা নিউ মডেলের মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি।

কিরীটী গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে দিল। গাড়িটা দেবেশের নয়, একবার মনেও হয়েছিল কথাটা; দেবেশ তার নিজের গাড়ি না পাঠিয়ে অন্য গাড়ি পাঠাল কেন? এ কার গাড়ি?

কিরীটী তখন অপরিচিত বাঁধানো মেটাল পথ ধরে নিঃশব্দ গতিতে এগিয়ে চলেছে।

কিরীটী মনে হয় একবার ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করে কোথায় সে যাচ্ছে? কিন্তু কি ভেবে কোন প্রশ্নই করল না।

প্রায় মিনিট পনেরো-কুড়ি বাদে কুতুবের কাছাকাছি নতুন যে পল্লী গড়ে উঠেছে, এখানে ওখানে সব নতুন বাড়ি হচ্ছে, সেই পল্লীর মধ্যে একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে গাড়িটা দাঁড়াল।

ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে দরজাটা খুলে দিল।

কিরীটী গাড়ি থেকে নামল।

নীচের তলায় আলো জ্বলছে।

এই কোঠি?

জী সাব—অন্দর যাইয়ে—

কিরীটী দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজার কাছাকাছি যেতেই দরজাটা খুলে গেল।

খোলা দরজার সামনে দামী সুট পরিহিত চব্বিশ-পঁচিশ বছরের এক যুবক দাঁড়িয়ে। যুবক তাকে অভ্যর্থনা জানাল : মিঃ রায়?

হ্যাঁ।

আসুন ভিতরে।

ঘরের মধ্যে পা দিল কিরীটী। আলোকিত কক্ষ—মূল্যবান রুচিসম্মত সোফা কাউচে ঘরটি চমৎকার করে সাজানো।

কেঝা যায় কোন ধনীর গৃহ।

মিঃ দাশ কোথায়?

উপরে চলুন।

কিরীটী যুবককে অনুসরণ করে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় গিয়ে একটা ঘরের বদ্ধ দরজার সামনে দাঁড়াল।

ভিতরে যান মিঃ রায়, মিঃ দাশ ভিতরেই আছেন।

একটু যেন কেমন ইতস্তত করে কিরীটী, কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য। কেন যেন মনে হয় কিরীটীর, হঠাৎ এভাবে দেবেশের একটা ফোন কল পেয়ে সোজা না এলেই ভাল হতো। কিন্তু চিন্তা করবারও আর তখন সময় নেই। কিরীটী দরজা ঠেলে ভিতরে পা দিল।

আলোকিত ঘরটা।

মাঝারি সাইজের এবং সে ঘরের মধ্যেও সব মূল্যবান আসবাবপত্র। কিন্তু ঘরে প্রবেশ করে কিরীটী কাউকে দেখতে পেল না।

ঘরটা খালি।

একটু যেন বিস্মিত হয়েই কিরীটী ঘরের চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করে।

আসুন মিঃ রায়–গুড ইভনিং।

ঘরের দক্ষিণ কোণ থেকে একটা ভারী পুরুষ-কণ্ঠ ভেসে এলো। এবং কিরীটীর মনে হলো কণ্ঠস্বরটা যেন তার পরিচিত। কিন্তু বক্তাকে ঘরের মধ্যে কোথাও দেখতে পেল না।

কিরীটী এদিক ওদিক তাকায়।

দক্ষিণ কোণে কেবল একটা ভারী পর্দা ঝুলছে। সেই পর্দা ঠেলেই এবারে যে লোকটি কক্ষের মধ্যে আবির্ভূত হলো তাকে দেখেই কিরীটী চিনতে পারে।

ট্রেনের সেই পরিচিত রঞ্জিৎ কাপুর।

গুড ইভনিং মিঃ রায়—চিনতে পারছেন?

কিরীটী প্রথমটায়—একটু হকচকিয়ে গেলেও ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। পরিস্থিতির সঙ্গে। মৃদু হেসে বললে, পারছি বৈকি!

নিশ্চয়ই, চিনতে পারবেন বৈকি। আপনি গুণী লোক। কিন্তু বসুন-দাঁড়িয়ে কেন?

বসতে হবে না—

সে কি! বসবেন না?

না। যে জন্য এভাবে ধরে নিয়ে এলেন আমাকে সেটা বরং তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন।

বলবো বলেই তো ডেকেছি। কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তো আর কথাবার্তা হতে পারে। আর সেটা শোভনও হবে না।

ইউ নীড নট ওরি, মিঃ কাপুর। আপনার কি বক্তব্য আছে বলে ফেলুন।

শুনবেন বৈকি এসেছেন যখন আপনাকে কৌশলে এখানে আমরা নিয়ে এসেছি বলবার জন্যেই তো—যা আমাদের

কথা বলে কি খুব কিছু একটা লাভ হবে মিঃ কাপুর, আপনাদের নেটওয়ার্কটা যখন আমি জানতে পেরেছি।

জেনে ফেলেছেন?

জেনেছি বৈকি। তাই বলছিলাম আপনার মত একজন কাট আউট অর্থাৎ দ্বিতীয় বা তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে কি আমার কিছু লাভ হবে। আপনি বরং আপনার বড় কর্তা স্টেশন চীফকে ডাকুন।

স্টেশন চীফকে ডাকবো?

হ্যাঁ, তাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না কি! যদি কিছু ডিল-এ আসতে হয় তা হলে স্বয়ং খোদ কর্তা বা স্টেশন চীফের সঙ্গেই কথাবার্তা বলা ভাল। তার সামান্য একজন এজেন্ট বা ইনফরমারের সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ কি? আমারও সময়ের মূল্য আছে।

আপনি আমার সঙ্গেই কথা বলতে পারেন।

রঞ্জিৎ কাপুরের গলার স্বরটা বেশ যেন গম্ভীর শোনাল।

বলতে পারি বলছেন?

হ্যাঁ।

বেশ, তবে বলুন আপনিই, আপনার কি বক্তব্য আছে?

আমার বক্তব্যটা তো আপনার অজানা নয়, মিঃ রায়।

আমাকে ভয় দেখিয়ে যে খুব একটা সুবিধা হবে না আশা করি সেটা অন্তত মিঃ কাপুর বুঝতে পেরেছেন?

রঞ্জিৎ কাপুর স্থিরদৃষ্টিতে কয়েকটা মুহূর্ত চেয়ে রইল কিরীটীর মুখের দিকে, তারপর বললে, বেশ, তাহলে ডিলেই আসা যাক। কত টাকা পেলে আপনি এ রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াবেন?

আপনাদের অফারটা শুনি?

দশ হাজার।

মাত্র!

পনেরো হাজার।

পনেরো হাজার!

বেশ, পঁচিশ হাজার। কেমন, ডিল ক্লোজড!

তার আগে আমি জানতে চাই, আমার বন্ধু দেবেশ দাশ কোথায়?

যে গাড়িতে আপনি এসেছেন এখানে সেই গাড়িতেই তাকে তার বাংলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতক্ষণে হয়ত তিনি বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছেন।

কেমন করে বিশ্বাস করবো আপনার কথা?

ঘরের কোণে ঐ যে ফোন আছে, ফোন করে দেখুন।

দ্যাট ইজ নট এ ব্যাড আইডিয়া! কিরীটী ফোনটার সামনে দাঁড়াল এবং দেবেশের নাম্বারের ডায়েল করল।

হ্যালো, কে।

দেবেশের বেয়ারা রামলালের গলা।

রামলাল, আমি কিরীটী—সাহেব বাড়িতে পৌঁছেছে?

এইমাত্র এলো একটা গাড়ি, দেখি বোধ হয় সাহেবেরই–

রঞ্জিৎ কাপুর ইতিমধ্যে যে কখন এসে পাশে দাঁড়িয়েছে কিরীটী তা বুঝতে পারেনি-সহসা রঞ্জিৎ কাপুর হাত দিয়ে টিপে ফোন কনেকশনটা অফ করে দিল এবং শান্তগলায় বললে, উহু, নো মোর মিঃ রায় বাজে কথা বাড়িতে ফিরে বলবেন। নাউ লেট আস ফিনিশ আওয়ার ডিল! টাকাটা আপনার একশত টাকার নোটে হলে চলবে তো?

টাকা তো আমি এখানে নেবো না মিঃ কাপুর—কিরীটী শান্তগলায় বললে।

এখানে নেবেন না! তবে কোথায়?

বুঝতেই পারছেন অতগুলো নগদ টাকা—

তবে কিভাবে কোথায় পেমেন্টটা করতে হবে বলুন?

কলকাতায়।

কিন্তু তা তো সম্ভব নয় সহসা ঘরের মধ্যে এক নারী কণ্ঠস্বর কিরীটীর কানে প্রবেশ করতেই কিরীটী ফিরে তাকাল–

একজন ভদ্রমহিলা।

বয়স চল্লিশের নীচে নয়।

দামী জর্জেটের শাড়ি পরিধানে—চোখে-মুখে উগ্র প্রসাধনের চিহ্ন। হাতে একটা কালো রংয়ের অ্যাট্যাচি কেস।

মিসেস খান্না?

রঞ্জিৎ কাপুরের প্রশ্নে মিসেস খান্না ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কাপুর, ইফ হি ইজ এগ্রিড টু আওয়ার টার্মস, এই কেসে টাকা আছে, ওঁকে গুনে নিতে বললা—আর কাল ভোরের প্লেনে ওঁর টিকিটও রেডি আছে কাশ্মীরে যাবার–

কাশ্মীর! কথাটা বললে কিরীটীই।

হ্যাঁ, কাশ্মীরে এখন সোজা যাবেন। দশদিন পর সেখান থেকে ফিরবেন। হোটেলে আপনার ঘর ঠিক করা আছে।

নট ব্যাড! কিন্তু এই ঠাণ্ডায় কাশ্মীর-অন্য কোথাও গেলে হতো না ম্যাডাম?

কিরীটীর ঐভাবে হঠাৎ ফোন-কল পেয়ে চলে যাওয়াটা সুব্রতর ঠিক ভাল লাগেনি। কিন্তু কিরীটীকে সেকথা বললে সে শুনবে না তাই তাকে বাধা দেয়নি। কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গে সেও বাইরে এসেছিল।

কিন্তু পোর্টিকোর আলোতে যখন দেখলো অপরিচিত ড্রাইভার ও অপরিচিত গাড়ি, সে কিরীটীকে বাধা দেবে ঠিক করেছিল কিন্তু সে কিছু বলবার আগেই ড্রাইভার দরজা খুলে দিতে কিরীটী গাড়িতে উঠে বসে, ড্রাইভার গাড়িটা ছেড়ে দেয়।

সুব্রতর মনের মধ্যে একটা সন্দেহ জাগে-কেমন যেন অস্থির হয়ে ওঠে সে আর কালবিলম্ব না করে ঘরে ঢুকে সুটকেস থেকে লোডেড পিস্তলটা পকেটে পুরে সোজা গেট দিয়ে বের হয়ে পড়ে।

ভাগ্য ভাল বলতে হবে, বেরুতেই একটা খালি ট্যাক্সি পেয়ে গেল।

সুবৰ্তর ট্যাক্সিতে উঠে সামনের দিকে চালাতে বলে ড্রাইভারকে। কিরীটীর গাড়ির নম্বরটা আগেই সে দেখে নিয়েছিল।

কিছুদূর যেতেই অগ্রবর্তী গাড়িটা সুব্রতর নজরে পড়ল।

ড্রাইভারকে সুব্রত অগ্রবর্তী গাড়িটাকে ফলো করতে বললে।

আগের পর্ব :

০১. নীল রুমাল হত্যা-রহস্যের
০২. কাপুর বুকপকেট থেকে একটা সিগারেট কেস বের করলেন
০৩. রাত প্রায় পৌনে দশটা
০৪. কিরীটী যখন গিয়ে দেবেশের ওখানে পৌঁছাল
০৫. আপনার সেক্রেটারীর মুখে শুনলাম

পরের পর্ব :

০৭. অগ্রবর্তী গাড়িটা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে
০৮. দুপুরে কিরীটী, সুব্রত ও দেবেশ বের হলো
০৯. পালাম এয়ারপোর্ট

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত