সুপুরুষ

সুপুরুষ

আমার নাম বিথী। আগামী শুক্রবার আমার বিয়ে। বিয়ে হচ্ছে আমেরিকা প্রবাসী মামাতো ভাই রিন্টুর সাথে। রিন্টু দেখতে সুদর্শন। লম্বায় প্রায় ছ’ফুটের মত। গায়ের রঙ স্যামলা হলেও তার চোখের দিকে তাকালে নেশা ধরে। যে নেশায় আমার বড় বোন মিতু তার সবচে বড় সর্বনাস করেছিল। মিতু আপু না করলে হয়ত আমি করতাম। আমিও মনে মনে পছন্দ করতাম তাকে।

মিতু আপু তখন ক্লাস টেনে পড়ে, আমি পড়ি ক্লাস এইটে। রিন্টু ভাইয়া তখন সেকেন্ড ইয়ারে। রিন্টু ভাইয়া প্রায়ই আসতো আমাদের বাড়ি। আসলেই সারাদিন ফুসুরফুসুর করতো মিতু আপুর সাথে। আমার খারাপ লাগতো। আমিও চাইতাম রিন্টু ভাইয়ার কাছাকাছি থাকতে, কথা বলতে। চোখের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখতে।

রিন্টু ভাইয়া যেদিন আসতো মিতু আপা স্কুলেও যেত না। আমাকে একা একা স্কুলে যেতে হতো। মা বলতো মিতুর নাকি মাথা ব্যথা তুই আজ একাই যা।

বাবার বাজারে দোকান আছে তিনি সকালেই দোকানে চলে যেতেন। মা রিন্টু ভাইয়াকে নিজের ছেলের মত ভালবাসতেন। আপার সাথে সারাদিন ফুসুরফুসুর তাই তাঁর চোখে সন্দেহ জাগাতে পারেনি কোন দিন। কিন্তু আমি ব্যপারটা সহ্য করতে পারতাম না। আমি আর মিতু আপা একই রুমে থাকতাম, পড়তাম। আমি যখন বাড়ি থাকতাম কোন না কোন অজুহাত দেখিয়ে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা ছিল দু’জনেরই। বলতো এখন পড়া লাগবে না, যাও খেলো গিয়ে অথবা পাঁচ টাকা দশ টাকা দিয়ে দোকানে পাঠিয়ে দিত।

একদিন আমাদের স্কুলের মুহিত স্যার হঠাৎ ক্লাস করার সময় স্টোক করে মারা যাওয়ায় স্কুল তখনই ছুটি হয়ে যায়। আমি বাড়ি আসি চলে। আমি স্কুল থেকে ফিরেই মায়ের রুমে আগে যাই সব সময়ই যাই। আজও গেলাম। মা ঘুমাচ্ছে। আমাদের রুমে গিয়ে যা দেখি তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমাকে দেখে দুজনেই হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। আপু তড়িঘড়ি বিছানার চাদর জড়িয়ে নেয় গায়ে আর রিন্টু ভাইয়া উলঙ্গ অবস্থায় আমার পা জড়িয়ে ধরে বলে ‘বিথী প্লীজ কাওকে কিছু বলিস না। এই তোকে ছুয়ে কসম কাটলাম এমনটা আর জীবিনেও করবো না। আমি বেড়িয়ে যাই ঘর থেকে। গোসলখানায় গিয়ে কান্না করি অনেকক্ষণ।

সেদিন আমি আমার কথা রেখেছিলাম কিন্তু রিন্টু ভাই তার কথা রাখেন নি। পাশের গ্রামে বাড়ি থাকায় উনার প্রেমিক পুরুষ হয়ে উঠার সুনাম কানে আসতো হরহামেশাই। শেষ যে খবরটা কানে এসেছিল তা আমার বান্ধাবী কেয়া রিন্টুর ভাইয়ের চোখের নেশায় হাসপাতাল পর্যন্ত গিয়েছিল ভ্রূণমোচন করানোর জন্য। উনার প্রতি দিন দিন ঘৃণা বাড়তেই থাকে আমার।

ঘটনার পর অনেক দিন রিন্টু ভাই আমাদের বাড়িতে না আসলেও আপুর বিয়ের পর আবার আসা যাওয়া শুরু করেন। আমি বুঝতে পারি রিন্টু ভাই কি চাচ্ছেন। নিজেকে সামলে রাখার যথেষ্ট ক্ষমতা আমার ছিল। কিন্তু আমেরিকা গিয়েও আমার উপর তার নজর রয়ে গেছে এটা ভেবে অবাক লাগছে। আমার কাছে এতো বড় লজ্জা পাওয়ার পরও আমাকে বিয়ে করার কথা চিন্তা মাথায় আসলো কিভাবে। বুঝলাম এই লোকটার লজ্জা সরম বলতে কিছু নাই।

মামা মামী আমার মাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে দেরি মা রাজি হতে দেরি করেন নাই। বাড়িতে এসে আমাকে বলার সাথে সাথে আমি মানা করে দিয়েছি। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। জগতে মেয়ে মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন দাম আছে নাকি? মা বললো ‘তোরা আমার তিন তিনটা মাইয়া, কোন পোলা নাই। রিন্টু আমার পোলার মত। দেখিস না কত খেয়াল রাখে? আমেরিকা থেকে কত কিছু পাঠায়? রাগে মাকে আর কিছু বললাম না। আব্বাকে বললাম ‘আব্বা আমি এই বিয়ে করতে পারবো না। আব্বা বললো ‘তোর মাথা খারাপ হইলো নাকি? আমিতো তোকে মিতুর থেকে বুদ্ধিমতী ভাবতাম।

আমি আপুকে বললাম। কথাটা শুনে আপু শুধু চুপ করে রইলো কিছুই বলতে পারলো না। দুলাভাইকে বললাম। দুলাভাই বললো ‘সিহাবের চাকরী বাকরি কিছু থাকলে আমি সাহস দিতাম কিন্তু সে ছেলে তো বেকার। তাছাড়া সিহাবের চেয়ে রিন্টু অধিক সুপুরুষ। আমি বললাম ‘ভাইয়া সিহাব লাগবে না একটা কানা, লুলা, রিক্সাওয়ালা যাকে বলবা তাকেই বিয়ে করবো কিন্তু রিন্টু ভাইয়াকে বিয়ে করতে পারবো না। দুলাভাই নয় ছয় বুঝালো, আমার কথা বুঝলো না।

সিহাবের সাথে সম্পর্ক আমার চার বছরের কিন্তু সে একদিন আমার হাতও ধরতে চায়নি। একদিন আমি ওর হাত ধরে আমার হাতে নিয়ে ছিলাম। চোরের মত চারদিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিলো যেন আমি তাকে রেপ করতে চাচ্ছিলাম। মনে মনে বললাম আসলেই দুলাভাই সিহাব রিন্টু থেকে সুপুরুষ না। রিন্টু যদি সুপুরুষ হয় সিহাব তবে মহা পুরুষ।

কোন উপায় না দেখে সিহাবকে বললাম চলো আমরা পালিয়ে বিয়ে করে ফেলি। এই বিয়ে আমি ঠেকাতে পারবো না। সিহাব বললো ‘পাগলি বিয়ে কি মানুষের ইচ্ছায় হয়, বিয়ে হয় আল্লাহ তালার ইচ্ছায়। আমার ভাগ্যে তুমি থাকলে কেউ ঠেকাতে পারবে না। আমার খুব রাগ ধরেছিল সিহাবের উপর। আমি বললাম ‘দেখো সিহাব জীবনের কিছু কিছু হিসাব মনে হয় নিজেদেরই করতে হয়। আমার মনে হয় প্রেম করার পর আল্লাহ রাগ করে এই দায়িত্বটা প্রেমিক প্রেমিকার উপর ছেড়ে দেন। সিহাব বলেছিল এসব বললে পাপ হবে বিথী। তাছাড়া এখন এই অবস্থায় আমি বিয়ে করি কি করে বলো?’

আমি বলেছিলাম আমি সবচে বড় পাপ করেছি তোমার মত হাবলারে ভালবেসে। বলেই আমি চলে আসি। আমার যতটা না কান্না পাচ্ছিলো তারচে বেশি হচ্ছিলো রাগ এই কয়দিন তাই কোন যোগাযোগই করি নাই। মোবাইল রেখেছি বন্ধ করে। আমার কপালে সিহাব মহা পুরুষ নাই। আমার কপালে জুটবে রিন্টু সুপুরুষ। মহা বদমাশ রিন্টু সুপুরুষ।

কারও কাছে পাত্তা না পেয়ে ভাবলাম নিজেকেই কিছু করতে হবে। আত্মহত্যা করবো তবুও রিন্টু সুপুরুষকে করবো না। ব্যস। গত পরশু রিন্টু ভাই এসেছিল আমাদের বাড়ি। চেহারায় সেই সুপুরুষ ভাবটা নাই। রোগা হয়ে গেছে। চোখের দিকে তাকিয়ে দেখা হয়নি সেই আগের মত নেশা ধরানো ক্ষমতাটা আছে কিনা। তবে উনাকে দেখার পর একটা বুদ্ধি আসে মাথায়।

আমি দুলাভাইকে বললাম ‘ভাইয়া আমি বিয়েতে রাজি তবে একটা শর্ত আছে। দুলাভাই বললো ‘তোর হাজার শর্ত কবুল। আমি বললাম আমেরিকা ফ্রী সেক্সের দেশ। আমি রিস্ক নিতে চাই না। যে দেশে ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা সেখানে রোগ বালাই থাকলেই পারে। আমি চাই তুমি তোমার হাসপাতালে রিন্টুর এইচ আই ভি ভাইরাস পরীক্ষা করবা। যদি নেগেটিভ হয় আমি রাজি। দুলাভাই আমার কথা শুনে প্রথমে আপত্তি করলেও পরে রাজি হয়।

আমার ধারণা মামা মামি যখন জানবে আমি এই কাজ করিয়েছি উনারা রেগে গিয়ে বিয়ে ভেঙে দিবেন। যে আদরের একমাত্র ছেলে তাদের। অন্যথায় অন্য চিন্তা করা যাবে। আত্মহত্যার অপশনটাতো হাতে থাকলোই। আজ সকালে দুলাভাই রিন্টু ভাইকে নিয়ে গেছেন তার হাসপাতাল ঘুরে দেখাবেন। আমি জানি দুলাভাই যেভাবেই হোক কাজটা করবেন।

আমি মায়ের মোবাইল নিয়ে বসে দুলাভাইয়ের ফোনের অপেক্ষায় আছি। তখনই মা ডাকলো বললো ‘বিথী তোকে একটা ছেলে খুজতে এসেছে বেড়িয়ে দেখ।’ আমি বেড়িয়ে দেখি উঠানে সিহাব দাঁড়িয়ে আছে। আমি তো অবাক। এই ছেলের এতো সাহস আসলো কোত্থেকে? আমি বললাম ‘ভিতরে আসো’ আর মাকে বললাম ‘মা সেতুকে বলো দু’কাপ চা দিতে।

সিহাবকে দেখে যতটা না অবাক হয়েছি তারচে বেশি অবাক হয়েছি তার প্রথম কথা শুনে ‘এক্ষুনি চল আমার সাথে, আমরা বিয়ে করবো’। আমি বললাম পাপ হবে। আল্লাহ তায়ালার কাজ আমরা কেন করতে যাবো? সিহাব আমার হাত ধরে টেনে বুকে নিয়ে বললো ‘হোক পাপ। আমি জাহান্নামেও একা থাকতে পারবো না। তুমি মোবাইল বন্ধ করে আমাকে আধা জাহান্নাম দেখিয়েই দিয়েছো।

আমি যখন সিহাবের বুকের সাথে লেপ্টে আছি সিহাব বললো ‘ও খোদারে খোদা! মাইয়া মানুষরে বুকে জড়াইয়া ধরলে এতো আরাম! এতো আরাম তো বিরিয়ানি খাইলেই লাগেনা, এতো আরাম তো এসির বাতাশেও লাগে না। সিহাবের কথা শুনে আমি হাসবো না কাদবো বুজতে পারছি না। সিহাব আরো জোরে তার বুকে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি বললাম ‘ছাড়ো ছাড়ো সেতু এক্ষুনি চা নিয়ে চলে আসবে। সিহাব আমাকে ছেড়ে হাত ধরে টেনে ঘর থেকে বেড়িয় যেতে যেতে বললো ‘চলো এক্ষুনি বিয়ে করবো। চা পরে খাবো। আরে বাবারে বাবা এতো মজা জানলে আরো কতো আগেই বিয়া কইরা ফেলতাম!

আমি সিহাবের সাথে বেড়িয়ে যাবো এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠলো। দুলাভাইয়ের ফোন। দুলাভাই বললো ‘ছোট গিন্নি তোমায় বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। তোমার ধারণাই ঠিক। রিন্টু এইচ আই ভি পজেটিভ। খুশিতে আমার চোখে পানি চলে আসলো। আমি রিন্টু ভাইয়ের শরীরে বাধানো রোগটার কারণে খুশি না, আমি খুশি আমি বেঁচে গেছি এই ভেবে। আমি খুশি সিহাবকে একা জাহান্নামে যেতে হবে না এই ভেবে।

সিহাবকে বললাম। তোমাকে স্যালুট বস। আসলেই বিয়ে আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ছাড়া হয় না। বলেই আমি সিহাবকে জড়িয়ে ধরতে যাবো সিহাব বললো ‘থামো। আমি আমার ভিতর শয়তানের উপস্থিতি টের পাচ্ছি। বিয়ের আগে আর কোন জড়াজড়ি নাই। যত আরামই থাক। আমার মেজাজটা খারাপ হয়েও সাথে সাথে ভাল হয়ে গেল। মনে মনে আবার একটা স্যালুট দিলাম। মুখে বললাম ‘ইয়েস বস’ ‘চলো মায়ের সাথে তোমাকে নতুন ভাবে পরিচয় করিয়ে দেই।
যাচ্ছি মাকে দুইটা সংবাদ দিতে। একটা তার জন্য দুঃখের সংবাদ একটা আমার আমার জন্য সুখের সংবাদ। কোনটা আগে দিব বুঝতে পারছি না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত