ব্লু-প্রিন্ট: ০২. কাপুর বুকপকেট থেকে একটা সিগারেট কেস বের করলেন

ব্লু-প্রিন্ট: ০২. কাপুর বুকপকেট থেকে একটা সিগারেট কেস বের করলেন

০২. কাপুর বুকপকেট থেকে একটা সিগারেট কেস বের করলেন

কাপুর বুকপকেট থেকে একটা সিগারেট কেস বের করলেন, তারপর নিজে একটা সিগারেট নিয়ে কেসটা সুব্রতর দিকে এগিয়ে ধরলেন, সিগ্রেট–

নো, থ্যাংকস।

হোয়াট অ্যাবাউট ইউ? কাপুর কেসটা এবারে কিরীটীর দিকে এগিয়ে ধরলেন।

নো, থ্যাংকস।

আপনার চলে না?

চলে, তবে সিগার—বলে কিরীটী পকেট থেকে একটা চামড়ার সিগার কেস বের করে তা থেকে একটা সিগার নিয়ে অগ্নিসংযোগ করতে উদ্যত হলো। তখন সে তার গ্লাসে ওষ্ঠ স্পর্শ করেনি।

ভদ্রমহিলা কিন্তু একই ভাবে তার হাতের ম্যাগাজিনটা পড়ে চলেছিলেন। এতক্ষণ ওদের দিকে তাকানওনি।

হঠাৎ কিরীটী ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বললে, আমরা আপনার কোন অসুবিধা করছি না তো?

ভদ্রমহিলা চোখ তুললেন—চোখে-মুখে একটা চাপা হাসির বিদ্যুৎ যেন। না, না–ক্যারি অন!

পরিষ্কার শুদ্ধ ইংরাজী ও বাংলা উচ্চারণ।

বাংলা শুনেই কিরীটীর মনে হলো ভদ্রমহিলা বাঙালী।

তাছাড়া ওসবে আমি খুবই অভ্যস্ত—আবার হাসলেন ভদ্রমহিলা।

হঠাৎ সুব্রতর কি হলো, বললে, কিন্তু কেমন যেন বিশ্রী লাগছে–

না, না তাতে কি হয়েছে? আপনাদের কিন্তুর কোন প্রয়োজন নেই—আমাদের ঐ কাপুর সাহেবটির জন্য আমরা ও-ব্যাপারে রীতিমত অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি—স্মিতকণ্ঠে কথাগুলো বললেন ভদ্রমহিলা; কিন্তু চোখে-মুখে তার সেই চাপা হাসির বিদ্যুৎ খেলছিল।

ইয়েস—শকুন্তলা ইজ কোয়ায়েট হ্যাভিচুয়েটেড! কোন উন্নাসিকতা নেই-হাজার হলেও এ যুগের তরুণী তো। হাসতে হাসতে বললেন মিঃ কাপুর।

একটু কটাক্ষ হেনে শকুন্তলা বললেন, এ যুগের তরুণীদের যেন একেবারে সব আদিঅন্ত জেনে ফেলেছেন মশাই

পরিষ্কার বাংলা পরিষ্কার উচ্চারণ শকুন্তলার।

কিরীটী বললে সকৌতুকে, আপনি তো চমৎকার বাংলা বলেন।

মানে! বাংলা বলবো না কেন? আমি তো বাঙালী—

হ্যাঁ মশাই—মিঃ কাপুর সঙ্গে সঙ্গে বললেন, একেবারে সেন্ট পারসেন্ট বাঙালী–

আপনি—

হ্যাঁ, ওর ভগ্নীটিও তাই—বাঙালী মেয়েই বিয়ে করেছি।

তাই বলুন! কিরীটী বলে।

কিরীটী মৃদুহেসে বলে, তাহলেও খারাপ লাগছে মিঃ কাপুর, আমরা ড্রিঙ্ক করছি আর উনি চুপচাপ বসে আছেন—-মিস–

আমার নাম শকুন্তলা চ্যাটার্জী। শকুন্তলা বললেন, আমার ফ্লাক্সে গরম কফি আছে, আমি বরং কফি খাচ্ছি—বলতে বলতে শকুন্তলা ফ্লাক্সটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিলেন।

ক্রমশ চারজনের মধ্যে বেশ গল্প জমে ওঠে।

হঠাৎ একসময় শকুন্তলা কথার মধ্যে বলে উঠলেন, আচ্ছা ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড মিঃ রায়—আপনি কি এসময় সত্যি সত্যিই স্রেফ বেড়াতেই যাচ্ছেন দিল্লীতে?

কেন বলুন তো? একটু কৌতুকের দৃষ্টিতেই যেন তাকাল প্রশ্নটা করে কিরীটী শকুন্তলার মুখের দিকে।

কারণটা ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারছি না।

কেন? বিশ্বাস করতে পারছেন না কেন?

আপনার মত লোক বিনা প্রয়োজনে এই প্রচণ্ড শীতে দিল্লীতে চলেছেন–

আমার মত লোক? আপনি আমাকে চেনেন নাকি? কিরীটী তাকাল কথাটা বলে শকুন্তলার মুখের দিকে। তার দুচোখে শাণিত দৃষ্টি–

আপনাকে কে চেনে না বলুন—কিরীটী রায়কে চেনে না—তারপরই একটু থেমে মৃদু হেসে শকুন্তলা বললেন, দেখেই আপনাকে আমি চিনেছিলাম—

কিরীটী প্রত্যুত্তরে নিঃশব্দে মৃদু হাসলো।

কিন্তু সত্যি বলুন না কেন এসময় দিল্লী যাচ্ছেন?

অনুমান করুন না।

কেমন করে অনুমান করবো?

কেন, পারেন না?

হঠাৎ যেন একটু থতমত খেয়েই শকুন্তলা কিরীটীর মুখের দিকে মুহূর্তের জন্য তাকালেন, তারপর মৃদু হেসে বললেন, পারছি না।

থট-রিডিং করুন।

ও বিদ্যে আমার জানা নেই, আপনার আছে নাকি? সকৌতুকে তাকালেন শকুন্তলা কিরীটীর মুখের দিকে। তার দুই চোখে সেই চাপা হাসির বিদ্যুৎ যেন ঝিলিক হানছে। বলুন তো আমি এই মুহূর্তে কি ভাবছি? শকুন্তলা প্রশ্ন করেন।

আপনি ভাবছেন—

বলুন! বলুন না? গলায় শকুন্তলার আবদারের সুর যেন একটা।

সুব্রত ও রঞ্জিত কাপুর কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে আছে তাদের আলোচনা ভুলে। কাপুর না বুঝতে পারলেও সুব্রত যেন স্পষ্ট দেখতে পায় কিরীটীর দুচোখের তারায় কেবল কৌতুকই নেই—সেই কৌতুকের পিছনে ঝিলিক দিচ্ছে আরো একটা কিছু।

আপনি ঠিক এই মুহূর্তে ভাবছেন—

ইয়েস! বলুন!

যে কাজের জন্য আপনি চলেছেন তা খুব সহজ হবে না—তাই নয় কি?

খিলখিল করে হেসে উঠলেন শকুন্তলা কামরার মধ্যে যেন হাসিটা মিষ্টি জলতরঙ্গের মত ছড়িয়ে পড়ল। শকুন্তলা বললেন, ভুল–

ভুল!

হ্যাঁ, কারণ কোন কাজের জন্যই আমি—

তবে এ সময় আপনি দিল্লী চলেছেন কেন?

দিল্লী? কে বললে? আমি তো কানপুর চলেছি।

যাচ্ছিলেন দিল্লী, তবে আপাতত ভাবছেন কানপুরেই ব্রেক-জার্নি করবেন।

ব্রেক-জার্নী করবো কানপুরে?

হ্যাঁ।

শকুন্তলা আবার পূর্বের মত হেসে উঠলেন। বললেন, কানপুরেই যাচ্ছি—আমার দিল্লী যাবার আপাতত কোন প্রোগ্রামই নেই।

মোস্ট ডিপ্লোমেটিক—

কি বললেন?

কিছু না—তবে এটা জানি—

কি জানেন? দিল্লীতে আবার আমাদের দেখা হবে।

তা যদি হয় মিঃ রায় সত্যিই খুব খুশী হব।

আমিও। কিরীটী হাসতে হাসতে বললে।

ট্রেনের গতি বাইরে মন্দীভূত হয়ে আসছিল ইতিমধ্যে।

সহসা কিরীটী প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল। বললে, সুব্রত, বোধ হয় বর্ধমানে এসে গেল গাড়ি!

সত্যি বর্ধমান। স্টেশন ইয়ার্ডের আলো চলমান গাড়ির জানলা-পথে সকলের চোখে পড়ে। গাড়ির গতি আরো মন্দীভূত হয়ে আসছে।

কিরীটী উঠে দাঁড়াল। চল্ সুব্রত–

কাপুর জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় চললেন মিঃ রায়?

ডাইনিং সেলুনে যাচ্ছি-যাবেন নাকি?

হ্যাঁ, যাবো বৈকি—আপনারা এখোন আমরা আসছি।

গাড়ি ধীরে ধীরে আলোকিত প্ল্যাটফরমে ইন করছে।

কিরীটী আর সুব্রত কামরা থেকে বের হয়ে গেল।

ডাইনিং সেলুনে বেজায় ভিড়।

টেবিলে টেবিলে যাত্রীরা সব বসে কেউ খাচ্ছে, কারো খাওয়া শেষ, এবারে উঠবে। কাঁটা-চামচের ঠুংঠাং শব্দ-বহু কষ্ঠের মৃদু গুঞ্জন আর সিগারেটের ধোঁয়া। অনেকেই হাওড়া থেকে ডাইনিং সেলুনে উঠেছিল–তারা উঠে পড়ে।

কোণের একটা টেবিলে দুজনে গিয়ে বসল।

বসতে বসতে সুব্রত বলে, কৃষ্ণাও টিফিন-ক্যারিয়ারে প্রচুর খাবার দিয়ে দিয়েছে। তবে আবার এখানে এলি কেন?

কিরীটী যেন কি ভাবছিল, সুব্রতর প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না।

খাবারগুলো—

নষ্ট হবে না, কাল খাওয়া যাবে। কিরীটী বললে।

বেয়ারা এসে দাঁড়াল অর্ডার নেবার জন্য।

সুব্রত বললে, কি অর্ডার দেবো বল?

যা খুশি দে না–

সুব্রতই তখন মেনু দেখে খানার অর্ডার দিল। বেয়ারা চলে গেল। কিরীটী কাঁচের জানলাপথে বাইরের আলোকিত প্ল্যাটফর্মের দিকে চেয়ে থাকে।

তুই যেন কিছু ভাবছিস মনে হচ্ছে কিরীটী।

তোকে একটা কাজ করতে হবে সুব্রত—

কি, বল্।

কানপুরে তোকে ব্রেক-জার্নি করতে হবে।

সুব্রত চমকে যেন কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।

ওরা কোথায় যায়, কোথায় ওঠে তোকে জানতে হবে, তারপর আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয়—পরের ট্রেনেই হয়ত ওরা দিল্লী যাবে—ওদের তুই ফলো করবি।

করবো—কিন্তু—

দিল্লীতে গিয়েও তুই ওদের ফলো করে ওরা কোথায় ওঠে জানবি, তারপর–

তোর সঙ্গে কোথায় কনটাক্ট করব?

দেবেশের ওখানে—ওকে আমি বলে রাখবো।

ঠিক আছে।

কিন্তু খুব সাবধান, মীনাক্ষী অত্যন্ত ধূর্ত ও সজাগ।

মীনাক্ষী!

ওর আসল নাম শকুন্তলা নয়, মীনাক্ষী—

কি করে জানলি?

ওর হাতের মীনা করা আংটিটা বাঁ হাতের অনামিকায় লক্ষ্য করলে দেখতে পেতিস।

সুব্রত কোন কথা বলে না।

কিরীটী একটু হেসে বলে, ও বুঝতে পারেনি কিন্তু আমি ওকে গাড়ির কামরায় দেখেই চিনেছিলাম–আই মেট হার বিফোর।

কোথায়?

দিল্লীতে।

দিল্লীতে!

হ্যাঁ, মিঃ সিংয়ের সঙ্গে গতবার যখন দিল্লীতে যাই–আমেরিকান কনসুলেটে একটা ককটেইল পার্টিতে ওকে দেখেছি?

সত্যি? হ্যাঁ, তাছাড়া—

কিন্তু কিরীটীর আর কথা বলা হলো না। বেয়ারা ঐ সময় খানা নিয়ে এলো।

ট্রেন ততক্ষণে আবার চলতে শুরু করেছে।

আগের পর্ব :

০১. নীল রুমাল হত্যা-রহস্যের

পরের পর্ব :

০৩. রাত প্রায় পৌনে দশটা
০৪. কিরীটী যখন গিয়ে দেবেশের ওখানে পৌঁছাল
০৫. আপনার সেক্রেটারীর মুখে শুনলাম
০৬. ঘরে ফিরে আসতে সুব্রত শুধায়
০৭. অগ্রবর্তী গাড়িটা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে
০৮. দুপুরে কিরীটী, সুব্রত ও দেবেশ বের হলো
০৯. পালাম এয়ারপোর্ট

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত