আমার মা

আমার মা

যেবার আমি ক্লাস এইটে প্রথম হয়েছিলাম সেটা শুনে মা আমাকে কী যে দৌড়ানো!!! মা আমাকে মারবেই তো মারবেই।।তার একটাই অভিযোগ সবার ছেলেমেয়ে ৫০,,৬০,,২০ এমন হয়,, আমার ছেলের রোল কিনা এক হয়!!

ছোট বেলা থেকেই আমি খুব মেধাবী স্টুডেন্ট। মা জানত যে আমি পড়ালেখায় ভালো তবে কত রোল সেটা জানত না।সে আমার থেকে কখনো জিগ্যেস করে নি আর আমারও বলা হয়নি।সবার থেকে শুনে আমি পড়াশুনায় ভালো এটাই তার জন্য যথেষ্ট।। প্রতিবারই আমি ক্লাসে প্রথম হই, এ আমার জন্য উচ্ছ্বাসিত কোনো ব্যাপার নয় তবে এবারেরটা ভিন্ন কিছু কারণ একটা থানার আন্ডারে যতগুলো স্কুল আছে সব স্কুল মিলে এবার প্রথম নির্ধারণ করা হবে এবং সংবর্ধনা দেওয়া হবে। নিয়ম মতোই সব হয় আর এবারও আমি প্রথম হই সব স্কুলের শিক্ষার্থীদের টপকিয়ে।সে যে কী খুশি!! খুশি আর ধরে রাখতে না পেরে খুশির ঠেলায় দৌড়ে এসে মাকে সালাম করে জড়িয়ে ধরতে ধরতে মাকে বলি,,

: মা,,এবার আমি প্রথম হয়েছি।আমার রোল এক হয়েছে। এটা শুনা মাত্রই সে তার হাতে থাকা ঝাড়ু নিয়ে আমাকে দৌড়াতে থাকে।আমিও ভ্যাবাচেকা খেয়ে বোকার মতো দৌড়াতে থাকি।তার একটাই বক্তব্য,,

: সবার ছেলেমেয়ের রোল ৫০,,৬০ কিংবা তারও বেশি হয় আর তোর কিনা এক!! সারাবছর ধরে এই পড়ালেখা করেছিস!! আমি মায়ের কথাশুনে জোরে জোরে চিৎকার দিলাম,,

: ও চাচী,,চাচী,, কে কোথায় আছো,তাড়াতাড়ি এসো।।আমাকে মায়ের হাত থেকে বাচাঁও। কারণ আমি জানি এখন আমার আর রক্ষা নেই।কেউ না এলে এখন আমার আর রক্ষে নেই। এই ঝাটার বারিই আমার কপালে জুটবে।। অবশেষে চাচা, চাচী, আশেপাশের সবাই এলেন।আমি দৌড়ে ঘুরপাক খেতে খেতে সবাইকে বিষয়টা খুলে বললে তারা মাকে অনেক কষাটে বুঝালেন যে,, আমার রোলের আগে কারো রোল নেই।আর যার রোল যত কম সে ততটা মেধাবী।। আর অবশেষে আমিও হাফ ছেড়ে বাচঁলাম।

যেবার আমি এস.এস.সি পরীক্ষা দিই সেবার আমার আশেপাশের অনেক চাচাতো ভাইবোন পরীক্ষা দেয়।রেজাল্টের দিন দুপুরে আমার কোন চাচা যেন মাকে এসে বলে যে,, আমি জি.পি.এ ৫ পেয়েছি। এটা শুনে মার মন সেই খারাপ।আশেপাশের ভাইবোনেরা জি.পি.এ ২/৩ পেয়েছে কিন্তু আমি কিনা!! বিকেলে আমি বন্ধুদের সাথে হইহুল্লোর করে করে যখন বাড়ি ফিরি তখন মা আমাকে বলে,,

: বাবা,তুই তো পড়ালেখায় খুব ভালো,তবে এবার কোনো ৫ পেলি? আশেপাশের সবাই ২,৩ পেয়েছে তবে তুই কেনো এবার এমন করলি?? আমি মায়ের কথাশুনে হতবাক হয়ে যাই।মাকে বুঝাতে চেষ্টা করি যে আমার টাই সেরা।২,৩ এগুলো কম। তখন মা আমাকে বলে,,

:কেনো,, তবে যে সেবার তুই বললি ১ ই সেরা।তার উপর আর নেই??

হায় আল্লাহ্!!!আমার আর উপায় কী!?? সেবারও কোনোমতে সবাইকে ডেকে মাকে বুঝায়। এভাবে আস্তে আস্তে এইচ.এস.সি পাশ করি।স্যারদের সবার পরামর্শ আমি যেন বুয়েটে পরীক্ষা দিই।আমাকে তারা বড় কোনো ইন্জ্ঞিনিয়ার হিসেবে দেখতে চাই।আর এটা যখন মাকে বলি তখন মা বলে,,

: এই ইন্জ্ঞিনিয়ার ফিন্জ্ঞিনিয়ার হয়ে কী হবে? সহজে বুঝার জন্য মাকে বলি,,
:এই যে এত বড় বড় সেতু দেখছো এসব বানাবো ইন্জ্ঞিনিয়ার হয়ে। মা বলে,,
: কি??

তুই এত পড়াশুনা করে মিস্ত্রি হবি? দরকার নেই বাবা!! তার চেয়ে ভালো,,তোর বাবার কৃষিক্ষেত্রে কাজ করা।আর এত পড়াশুনা করে কি হবে বল!? এর থেকে ভালো, কাল থেকে তোর বাবার সাথে কৃষি কাজে যাস বাবা। মিস্ত্রীরা বছরে সবসময় কাজ পায় না।তাই তারা বারো মাস খেতেও পায় না।কিন্তু তুই যদি কৃষি ক্ষেতে কাজ করিস তবে তুই বারো মাস দুবেলা দুমুঠো শান্তিতে খেতে পারবি। মাকে বুঝানো বড় দায় হয়ে যায় তখন।মা আমাকে কখনো ঢাকা যেতে দিবেন না।তাই মাথা থেকে বুয়েট পড়ার ভূত ফেলে দিই।সিদ্ধান্ত নিই মেডিকেল পড়ার। মাকে বললে মা বলে,

: অনেক বড়লোকের ছেলেমেয়েরা ডাক্তারি পড়তে পারে।তুই কি পারবি বাবা!!?

সেদিন মার চোখে দেখিছিলাম এক সমুদ্র অনিশ্চত হতাশা। অবশেষে আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি মেডিকেলে চান্স পায়।প্রথমে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেলে চান্স পেলেও পরে মাইগ্রেশন করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে চলে আসি।কারণ,মা আমাকে এতো বড় ঢাকা শহরে একা ছাড়বে না।

আজ আমি ঢাকা শহরে নামকরা একজন ডাক্তার। গাড়ি বাড়ি কিছুরই অভাব নেই।ঢাকা শহরের মতো জায়গায় আজ আমার ৩টা ফ্লেট,যা আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি।বাড়ির প্রত্যেক সদস্যের জন্য আলাদা গাড়ি আর গ্রামের বাড়িতে মস্ত বড় দালানকোঠা। রোজ বৃহস্পতিবার-শুক্রবার গ্রামের বাড়ি যাই।মায়ের কবর জেয়ারত করি।এই দুইদিন গ্রামবাসীকে ফ্রি চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র কিনে দিই।গ্রামবাসীর জন্য একটা ফার্মেসী দিই। যার যা প্রয়োজন এখান হতে ফ্রিতে নিয়ে যাই।আমি চাই গ্রামের সকল মানুষের পাশে দাড়াঁতে। সেদিন এক বৃদ্ধ মানুষ, অানুমানিক চারকুড়ি হবে।এসে আমাকে বলে,

:বাবা,তোমার মা যদি তোমার এমন অবস্থা দেখতেন তবে বুঝি খুশিতে আরও কটা বছর বেশি বাচঁতেন।রোজ  আমাকে বলত,আমি মরে গেলে আমার ছেলেটার কী হবে,কে দেখবে,কে খাওয়াবে? মাসিক সকল খরচ চুকিয়ে কিছু টাকা তুলে রাখত হারিকেলের গ্লাস কিনবে বলে।কারণ,গ্লাসটা কবে ভেঙ্গে যায় বলা তো যায় না।কারণ,তুমি নাকি হারিকেল ছাড়া বাথরুমে যেতে পারতে না।বড্ড ভালোবাসত তোমায়।

কথাগুলো বলে তিনি তার চশমার আড়ালে জমে থাকা পানির বিন্দুগুলো মুছলেন। আমার এখনো মনে আছে,,অনেক বড় হয়েছি তাও একা একা কখনো বাথরুমে যেতে পারতাম না।মাকে ডাকতাম,আর মা হারিকেল জ্বালিয়ে আমাকে বাইরে নিতেন।হারিকেল নিয়ে আমি বাথরুমে যেতাম আর মা রাতের অন্ধকারে বাইরে দাড়িয়ে থাকত।মাঝে মাঝে খারাপ লাগত মাকে এভাবে ঘুমের মাঝখানে জাগিয়ে তুলে বাইরে আনতে তবে কিছু করার ছিলো না,আমি একা ভয় পায়,মাই ছিলো আমার সাহস। মাঝে মাঝে মাকে বলতাম,,

: মা,আমি যখন চাকরি করব তখন সবার আগে ঘরে একটা বাথরুম দিবো।আমাদের আর এভাবে কষ্ট করে রাতের অন্ধকারে দূরের ঐ বাথরুমে যেতে হবে না। আবার মাঝে মাঝে বলতাম,,

: আমি চাকরি করলে তোমাকে ঘরে নলকূপ এনে দিব।তোমাকে আর কষ্ট করে ঐ দূরের কল থেকে পানি আনতে হবে না।

আজ আমার সব আছে।ঘরে পানি,ঘরে বাথরুম,দামী দামী জিনিস,আসবাবপত্র,এসি সব সব।শুধু নেই আমার মা। আমার সকল পূর্ণতার মাঝেও আজ আমি শূন্য কেন জানি মনে হচ্ছে চারিদিক শুধু হাহাকার করছে।আমার অস্তিত্ব শুধু মাকে খুঁজছে।কেন আল্লাহ মাকে আর কিছুদিন আমার কাছে রাখল না? কেন? আজ সকল কিছু আমার কাছে অর্থহীন। সকল কিছুর বিনিময়েও কি আল্লাহ আমার কাছে আমার মাকে রাখতে পারতেন না? বেশ তো ছিলাম আগে।মা,মায়ের হাসি, আদর,বকুনি,মার সব যেন এখন শুধু স্মৃতি। সত্যিই,,মা যদি আমার এমন অবস্থা দেখত তবে বুঝি খুশিতে আরও কয়েকটা বছর বাচঁত…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত