ক্লাসের অন্যসব মেয়েরা যেখানে হাসি তামাসা, আড্ডা দিতে ব্যস্ত। মায়া সেখানে ক্যাম্পাসের এক পাশে গাছের নিচে বসে বই পড়ছে। এটা নিয়ে মায়ার বন্ধুরা সবাই অবাক। কারন কয়েকমাস আগেও মায়া এমন ছিলো না। সেও সবার মত আড্ডায় থাকতো। ক্লাস ফাকি দিয়ে ঘুরতে যেতো। ক্লাস শেষেও সন্ধার আগ পর্যন্ত সবাই ঘুরাঘুরি করতো। কিন্তু ইদানীং মায়া ক্লাস শেষ হলে একটুও দাঁড়ায় না, সোজা বাসায় চলে যায়। আগে মায়া তার বাসার পাশের নিলন্তী নামের মেয়েটিকে দেখতে পারতো না। মনে হতো মেয়েটি ক্ষেত, বোকা, গাইয়া টাইপের। আর এখন সেই নিলন্তী ই মায়ার সব থেকে ভালো বন্ধু।
ভার্সিটি থেকে ফিরে মায়া দিনের বাকি সময় টা এখন নিলন্তীর সাথেই কাটায়। এখন সন্ধ্যা হলেই মায়া বইন নিয়ে বসে। আর আগে সে এই সময় টা ভার্চুয়ালে কাটাতো। প্রতিদিন সন্ধায় নাস্তা না করলে তার হতো না। কিন্তু এখন শুধু লাল চা হলেই সে অনেক খুশি। আর আজকাল সে নিজেই চা বানিয়ে, বাবা মায়ের ঘরে দিয়ে আসে। তারপর বাকি টুকু নিজের আর বড় ভাইয়ের জন্য রেখে দেয়।
মায়ার বড় ভাই সিয়াম, প্রতিদিন রাত ৮ টার পরে সে বাসায় ফিরে। আগে মায়া এই নিয়ে কোন চিন্তা করতো না। কিন্তু ইদানীং সে অপেক্ষা করে কখন তার ভাই বাসায় ফিরবে। মায়ার এমন পরিবর্তনে সবাই অবাক হলেও ওই একটা ছেলে অবাক হয় না। রাতে বাসায় ফিরতে মায়া যখন সিয়ামের সামনে চায়ের কাপটা তুলে ধরে সিয়াম একটা মুচকি হাসি দিয়ে কাপটা হাতে নেয়। তারপর পকেট থেকে কিছু চকলেট বের করে মায়ার হাতে তুলে দেয়।
আগে চকলেট না পেলে মায়া সিয়াম এর সাথে রাগ করতো কিন্তু আজকাল চকলেট তার ভালো লাগে না। সে বার বার সিয়াম কে চকলেট নিয়ে আসতে না করে। কিন্তু সিয়াম তবুও নিয়ে আসে। সে জানে তার বোন এর চকলেট অনেক প্রিয়। মায়া তার ঘরে পড়তে ছিলো, দরজায় টোকা পরাতে সেদিকে তাকিয়ে দেখলো তার ভাই দাঁড়িয়ে আছে। মায়া মুচকি হেসে ভাইকে ভিতরে আসতে বললো। একটা চেয়ার টান দিয়ে সিয়াম মায়ার পাশে বসলো। সিয়ামের এমন আগমনে মায়া প্রশ্ন করলো।
-কিরে ভাইয়া, কিছু বলবি?
-কেনো? কিছু বলার না থাকলে আসা যাবে না?
-আমি কি সেটা বলছি নাকি? তুই তো এম্নিতে এই সময় আসিস না তাই বললাম।
-হুম তাতো কিছু বলবো ই। বলার জন্যই তো এসেছি।
মায়া মনে মনে ভাবলো, তবে কি ভাইয়া আমার বিয়ের ব্যপারে কথা বলতে এসেছে? অবশ্য আসবেই না কেন? পরিবারের যা অবস্থা একটা সদস্য কমলেই তো কত ভালো। মায়াকে চুপ থাকতে দেখে সিয়াম নিজেই বলতে লাগলো,
-“তোর কলেজ থেকে নাকি পিকনিকে যাচ্ছে? আমায় বলিস নি কেন? ”
-তুই কিভাবে জানলি?
-সেটা পরের কথা, আগে বল, আমায় বললি না কেন?
-আসলে আমার যেতে ইচ্ছে করছিলো না। তাই শুধু শুধু বলে কি লাভ।
-তাই না? তোর না ঘুরতে খুব ভালো লাগে? আমি কিছু বুঝি না নাকি? শোন আমি ফি জমা দিয়ে দিছি। সব গুছিয়ে রাখিস।
-কিন্তু ভাইয়া….
-কোন কিন্তু নেই, যা বলছি তাই কর। যা ঘুরে আয়।
মায়াকে আর কিছু বলতে না দিয়ে সিয়াম চলে গেলো। মায়ার চোখ দুটো ভিজে গেলো। সে ভেবেছিলো তার ভাইকে সে চিনে ফেলছে কিন্তু এখন বুঝছে চেনার বাকি আছে আরো। সিয়াম যাওয়ার পর মায়া আবার বই পড়তে বসলো। মায়ার ফোন তখন বেজে উঠলো । স্ক্রিনে আদিরা’র নাম ভেসে উঠলো মায়ার বান্ধুবি। ফোন রিসিভ করতেই আদিরা বললো,
-দোস্ত কিরে কই তুই?
-এই তো বাসায় কেন?
-একটু ম্যাসেঞ্জারে আয়, সবাই আছে আড্ডা দিবো গ্রুপে ।
-নারে ভাল লাগছে না। অনেক পড়া আছে। আর তাছাড়া এম্বি নেই।
আদিরা কে আর কিছু বলতে না দিয়ে মায়া ফোন কেটে দিলো। আবার বই পড়াতে মনযোগ দিলো। এক সময় মায়ার ফোনে কখন ও এম্বি শেষ হতো না। যখনই শেষ পর্যায়ে থাকতো মায়া সিয়াম কে বলতো। কিন্তু এখন আর বলে না। মায়ার বাবা একটা ছোট খাটো চাকরি করতো যা বেতন পেতো সেটা দিয়ে মায়াদের পরিবার অনেক ভালো ভাবেই চলতো।
কিন্তু মায়ার বাবা আরিফুল সাহেবের ডায়াবেটিস এতটাই বাড়তি যে এখন চাকরি করা তার জন্য কষ্টকর হয়ে গেছে। বিভিন্ন ওষুধ খেয়ে আরিফুল সাহেবর পায়ের রক্তের হরমোন নষ্ট হয়ে গেছে। সেই চিকিৎসা করতেই প্রায় লাখ খানেক টাকা শেষ। গ্রামের জমিজমা যা ছিলো তার অর্ধেক বিক্রি করা হয়ে গেছে।
এসব নিয়ে মায়া কখনই তেমন চিন্তা করেনি। কারন এত সবের ভিতরেও তার লেখা পড়া, হাত খরচ কিছুই বাদ ছিলো না। কিন্তু ইদানীং মায়ার খুব চিন্তা হয়। পরের দিন যথা সময়ে মায়া কলেজ চলে গেলো। দুই দিন পরে পিকনিকে যাবে সবাই। মায়া যাচ্ছে বলে ওর বন্ধুরাও অনেক খুশি। কে কি করবে এসব নিয়ে কথা বলছিলো। ক্লাসে শিক্ষক আসাতে সবাই চুপ হয়ে গেলো। ক্লাস চলাকালীন শিক্ষক বলতে লাগলেন।
-যেহেতু আমরা দুই দিন পরে পিকনিকে যাচ্ছি তো আজ পড়ানো বাদ রাখি কি বলো?? সবাই এক সাথে হ্যা বলে উঠলো।
-তবে আজ আমরা একটা ভিন্ন টপিক নিয়ে কথা বলবো (শিক্ষক)
-কি স্যার? (সবাই)
-আজকের টপিক “ভাই” তোমরা তোমাদের ভাই নিয়ে কিছু বলো। মানে কার ভাই কি করে, কার ভাইয়ের কি স্পেশালিটি? তোমাদের সাথে কেমন সম্পর্ক এই সব নিয়ে সবাই দুই লাইন করে বলো দেখি (শিক্ষক)
এরপর এক এক করে বলতে লাগলো। কারো ভাই ভালো গিটার বাজাতে পারে, কারো ভাই গান গায়, কারো ভাই ডাক্তার, কারো ভাই আর্টিস্ট। এরই মাঝে মায়ার পালা আসলো। সবাই উৎসুক জনতার মত মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তখন মায়া বললো, “আমার ভাই একজন ভালো অভিনেতা” তখন একটা ছেলে বললো “কোন ফিল্মের রে?” ক্লাসের সবাই হেসে উঠলো শুধু মাত্র শিক্ষক ছাড়া। শিক্ষক উৎসাহ নিয়ে মায়াকে জিজ্ঞেস করলো কেমন অভিনেতা?
মায়া বলতে লাগলো -” ভালো থাকার অভিনেতা। আমার ভাইয়া হাজার কষ্ট পেয়েও হাসতে জানে, পেটে ক্ষুদা নিয়েও না খেয়ে দিব্বি থাকতে পারে। শত আঘাত পেয়েও ভালো থাকার অভিনয় করতে পারে। আমার ভাইয়া ত্যাগ করতে জানে। এখানে তো অনেক ছাত্র-ছাত্রী আছে কয় জনের ভাই তাদের জন্য নিজের ক্যারিয়ার এর এক বছর ত্যাগ করতে পারবে? পারবে না, আর আমার ভাই আমার জন্য ওর সবটুকি সুখ বিসর্জন দিয়ে দিব্বি ভালো থাকার অভিনয় করে যাচ্ছে। এত এত দিবসের মাঝে যদি একটা ভাই দিবস থাকতো সবার আগে আমি পালন করতাম”।
মায়ার আরো কিছু বলতে ইচ্ছা করছে কিন্তু নিজের চোখের পানি সে আটকাতে পারলো না। মুখ দিয়ে আর কথা বের হচ্ছে না তার। নিজের ব্যাগ নিয়ে ক্লাস থেকে সে বের হয়ে গেলো। মাস খানেক আগের কথা, একদিন রাতে মায়া ওর ভাই আর মায়ের মধ্যকার কথা শুনতে পায়। কথাগুলো এমন ছিলো,
-দেখ সিয়াম মানছি মায়া তোর বোন কিন্তু এভাবে ওকে মাথায় তুলিস না বাবা।
-আহ মা, এভাবে বলো না তো, ওরে আবার এসব নিয়ে কিছু বলবে না।
-কিন্তু সংসারে এই অবস্থায় তুই ওর পিছনে এত টাকা খরচা কেন করিস বলতো? এই যে তুই এক বছএ লেখা পড়া বাদ দিলি ও কি কারন জিজ্ঞেস করছে? তোর বাবার এই অবস্থা ওর সে খেয়াল আছে? সারা দিন মোবাইল, আড্ডা, ঘুরাঘুরি, লেখাপড়ার ও নাম নেই।
-আহ মা, বলি এখন এসব করবে নাতো কবে করবে? তুমি বাদ দেও তো।
-বাদ দিবো কেন? তুই যে সারা দিন কষ্ট করিস সে খবর ও নেয়? সকাল বিকাল, রাত সারা দিন টিউশনি করাস। সংসার খরচ, নিজের লেখাপড়ার খরচ, ওর লেখাপড়ার খরচ, এগুলো কোথা থেকে আসে ওর কি জানার দরকার নেই?
-না নেই? ও আমার বোন। আমার প্রিন্সেস। ও কেন কষ্ট করবে হ্যা? তুমি কিন্তু ওরে এসব নিয়ে কিছু বলবে না বলে দিলাম। দেখবা একদিন আমার বনু অনেক বড় কিছু হবে। ”
সেদিন ও মায়া চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। সেদিন মায়া সব শুনে নিজেকে অনেক ধিক্কার দিয়েছিলো। আর নিজের কাছে নিজে ওয়াদা করেছিলো ওর ভাইয়ের মুখে ও হাসি ফুটাবে। ভাইয়ের স্বপ্ন সে পূরন করবেই।