আমার স্ত্রী মরিয়ম দেখতে অনেকের কাছেই অ’সুন্দর। তাতে কী? আমার কাছে সে বিশ্ব সুন্দরী। সখ করে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে চাইলে যাবে না। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে, কোথাও যেতে ইচ্ছে হয়না। ব্যাপারটা খুব ভাবিয়ে তুলে রীতিমত। অবাক হই ওর কথা শোনে। বাসায় একা একা নীরব মনে থাকে।
কিছুদিন আগে বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যাবো। রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে আছি দু’জনে। মরিয়মের দিকে মুখ করে তাকিয়ে বলি, “মরিয়ম, বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যেতে চাই। যদি তুমি অনুমতি দাও!” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার ডান হাতের উপর ওর নরম হাত’টা রেখে বললো, “কখনো শুনেছো স্ত্রীর থেকে স্বামী অনুমতি নিয়ে কিছু করে?” আমি ওর কথার উত্তর না দিয়ে ওকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, “তুমি কখনো শুনেছো স্ত্রীর থেকে অনুমতি নিয়ে স্বামী কিছু করতে চায়? চাইনা তো, কিন্তু আমি কিছু করার আগে তোমার সাথেই পরামর্শ করি।” মরিয়ম কিছু বললো না, মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। চুপচাপ থেকে কিছুক্ষণ পর মুচকি হেসে বললো, “কোথায় যাবে? সাথে আমিও যাবো।”
কথায় আছে কিছু সময় নিজের কানটাকেও অবিশ্বাস করতে হয়। স্পষ্ট শোনতে পেলাম, তবুও খুশিতে আত্মহারা হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম, ” সত্যি-ই যাবে?” মুচকি হাসা দু’ঠোঁট মুহূর্তেই ম্লান হয়ে যায়। পুরো মুখ ফ্যাকাসে করে বললো, “আমার কি আর সেই আহ্লাদ কখনো পূরন হবে? আপনি যান। সময় হলে নিজে থেকেই আপনাকে বলবো।” যতটুকু উৎফুল্ল হয়েছিলাম, তার চেয়ে বেশি মন খারাপ হলো। যাবার আনন্দটা আর আসছে না। আমি নরম স্বরে বললাম, “এস পি পার্কে যেতে চেয়েছি, তবে এখন আর ইচ্ছে নাই।” পরক্ষণেই হাতের উপর থেকে ওর নরম হাত’টা সরিয়ে আমার গালে আলতো ভাবে স্পর্শ করে বললো, “রাগ করেছো তাইনা? কোনো একদিন নিশ্চিত তোমার মুখে হাসি ফুটাবো।”
এস পি পার্কের পুকুর ঘেষে সিঁড়ির উপরে বসে সব বন্ধু মিলে চটপটি খাচ্ছি। হঠাৎ রুদ্র চটপটি মুখে দিয়ে বললো, “আবির তোর বউ’কে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে পারিস না? সারাক্ষণ মেয়েটি চার দেয়ালে বদ্ধ ঘরে কিভাবে থাকে? একটু ভেবে দেখ!” আমি বললাম, “রুদ্র, তোর ধারণা আমি মরিয়মকে কোথাও নিয়ে যাইনা তাইনা? ব্যাপারটা ভিন্ন। নিজ ইচ্ছেতেই বারণ করে। এখানেও আসতে বলেছি কয়েকবার। কিন্তু কে শোনে কার কথা।” রুদ্রর সাথে কথা বলার সময় কে যেনো কয়েকবার ফোন করেছিল। মোবাইল বের করে দেখি মরিয়মের ফোন। ও কি বলবে সেটা জানি। তাই মোবাইলটা আবার পকেটে রেখে দেই।
রাত নয়’টা, বাসার আঙ্গিনায় পা রাখতেই ফোন কেঁপে ওঠলো। আসার পথে কয়েকবার ফোন দিয়েছিল। সম্ভবত এখনো ওর ফোন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঠকঠক আওয়াজ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে চৌকাঠ আলগিয়ে দাঁড়ালো। মরিয়ম সব মেয়ের মতো সাজুগুজু করে না। যেদিন কোথাও বেড়াতে বা কাজ শেষ করে বাসায় আসি তখন আমাকে খুশি করতে সেজে বিশ্ব সুন্দরী হয়। মরিয়মের দিকে তাকিয়ে এক চিলতে হাসি দিয়ে বললাম, “আজ বিশ্ব সুন্দরী সাজলে হঠাৎ?” উত্তরে কিছু বললো না। হাত টেনে চৌকির উপর বসালো। আমিও পা ঝুলিয়ে বসলাম। ইয়া বড় এক ঘুমটা দিয়ে বললো, “আমি কি তোমার কাছে সত্যিই বিশ্ব সুন্দরী? নাকি আবার রাস্তার মেয়েদের লোভে পড়ো? মরিয়মের আচল টেনে আমার পাশে বসালাম। বললাম, “ঘরে বিশ্ব সুন্দরী রেখে বাহিরের মেয়ের লোভে পড়বো কেনো? সব তৃষ্ণা তোমার মাঝে সীমাবদ্ধ।” হাতে থেকে আচল ছিনিয়ে মিয়ে মুখ লুকিয়ে বললো, “আমিও বেড়াতে যাবো, এভাবে একা বাসায় ভালো লাগে না।”
প্রথমত বিশ্বাস হওয়ার চেয়ে অবিশ্বাস হলো। কয়েকবার জিজ্ঞেস করলাম। প্রতিবারই যাবে বলে স্বীকার করে। মরিয়মের শাড়ীর আচল আমার বাম হাতে পেছিয়ে বললাম, “যেখানে যেতে চাও সেখানেই নিয়ে যাবো। কোথায় যাবে বলো?” মনে তৃপ্ততা নিয়ে বললো, “যমুনা সেতু যাবো। দেখিনি কখনো। কিন্তু একটা সর্ত আছে।” স্তব্দ হলাম শর্ত শোনে। ম্লান স্বরে বললাম, “যে শর্ত দাও সব মেনে নিবো। তবুও আজ মানা করতে পারবে না।” মরিয়ম বললো, “বোরকার সাথে নিকাব পরবো না। আকাশে হেসে খেলে বেড়াবো।” মনে মনে ভাবলাম, আত্মীয় বাড়ি গেলে নিকাব ছাড়া যাবে না, কিন্তু হঠাৎ নিকাব পরবে না! অবাক হই খুব। তবুও হাসি মুখে মেনে নেই।
কয়েকদিন পর দুপুরের খাবার খেয়ে দু’জনে চৌকিতে পা ঝুলিয়ে বসে বসে গল্প করতেছি। মরিয়মকে বললাম, “পরিপাটি হয়ে নাও, আজ নিয়ে যাবো।” যেখানে খুশি হওয়ার কথা, সেখানে মুখে হাসি নাই। জোর করে হাসছে বুঝতে পারলাম। কিছু বললো না, উঠে পরিপাটি হতে গেল। এদিকে আমিও প্যান্ট শার্ট পরে নিলাম। যাবার পাঁচ মিনিট পরই ফিরে এলো। “একি, তুমি সাজলে না? যেটা পরেছিলে সেটার উপরে শুধু বোরকা পরলে। মুখে লাগাবে না কিছু?” ওর মাঝে অস্থিরতা ভাব। কিন্তু কিসের অস্থিরতা ভাব সেটা জানতে পারিনি। আবার বললাম, “একটু হেসে বাড়ি থেকে বের হবে না? একটু হাসো!” ও জোর করে হেসে বললো, “খুব ভয় লাগছে আমার।” ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, “ভয়! কিসের ভয়?”
যাতায়াত অবস্থায় মরিয়মের মুখে বিষন্নতার মেঘ ভেসে ছিল। এখন দু’জনে হাতে হাত রেখে হাঁটছি, তবুও তৃপ্তি পাচ্ছি না। হাঁটতে হাঁটতে সেতুর নিচে যমুনার তীরে ঘাসের উপর দুজন বসলাম। বেশ স্বাচ্ছন্দ্য পরিবেশ। চারিদিকে নানান রকমের মানুষ বসা। আমাদের পাশেই মরিয়মের সমবয়সী দু’জন মহিলা বসে বসে হাসছে। হঠাৎ দু’জন দু’জনাকে বললো, “দেখো শেলী ভাবী, মেয়েটির জীবনটা শেষ। তেমন মিলে নাই ওদের সাথে।” আমি হতভম্ব হলাম। মনে হলো আমি যেন সদ্য আকাশ থেকে ছিটকে পড়লাম। পাশের মহিলা বললো, “কালোর সাথে ফর্সা কখনোই যায়না। মেয়েটা দেখতে কি সুন্দর আর ছেলেটার দিকে দেখো! গা ঘিনঘিন করছে দেখেই।” হঠাৎ-ই খেয়াল করলাম আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।
চোখ বেয়ে পানি ফোঁটা ফোঁটা গরিয়ে পড়বে পরক্ষণেই মরিয়ম ওর কাঁধে আমার মাথা রেখে বললো, “দেখো, পানির ঢেউ একে অন্যকে ছুঁয়ে দিতে পিছু নিচ্ছে।” কিছু বলার ছিল না আমার। মরিয়ম নিচু স্বরে বললো, “এর জন্যই আমি তোমার সাথে কোথাও যেতে চাইনা। তুমি অনেক কষ্ট পাবে। আর সেই কষ্টটা ভুলাতে তোমার জন্য রোজ রাতে বিশ্ব সুন্দরী সাজতে হয়। হয়তো তোমার মনে স্বংশয়, রাগ, ক্ষোভ জমানো। কিন্তু কোথাও যেতে চাইনা তোমার হাসিটা হারাবো বলে। ভালোবাসি আবির।” মরিয়মের ঘারে মাথা রেখে বললাম, “পানির ঢেউ একে অন্যকে ছুঁয়ে দিবে একদিন ঠিকই। ঢেউ হয়েই থেকো আমার মাঝে।