বড় আপা

বড় আপা

দুলাভাই আমার ওড়না ধরে টান দিতেই বড় আপা ঘরে ঢুকেই আমাকে কষে একটা চড় বসিয়ে শক্তগলায় বললেন , নির্লজ্জ মেয়ে !তোকে কতদিন বারণ করেছি আমার বাড়িতে না আসতে ? বলি কথা কানে যায় না ? গায়ের এত যখন কামড় তখন বিয়ে করে নিলেই পারিস । আমার বাড়িতে কেনো আসিস তুই ? আবার যদি কখনো আমার বাড়ি আসিস তাহলে আমার মরা মুখ দেখবি এই বলে দিলাম ।’ কথা গুলো বলেই বড় আপা আমার হাত ধরে ঘর থেকে ধাক্কা দেওয়ার মত বের করে দিলো । বড় আপার কথাগুলো কানে ঝিঁ ঝিঁ পোকার মত বাজছে। যে আপা আমার পক্ষ নিয়েছিল বলে বাবার হাতে মার খেয়েছে আজ সে আমাকে এত বাজে বাজে কথা বলল কেমন করে ! আমার গায়ে হাত অবধী তুলল ! সত্য কথা বলতে আমার দোষটা কোথায় ছিল?

দুলাভাই চা চেয়েছিল বলে আমি তাকে চা দিতে গিয়েছিলাম কিন্তু তিনি যে আমার সাথে এমন অপ্রিতিকর ঘটনা ঘটাবেন তা ভাবতেও পারিনি। বড় ভাইয়ের মত যাকে সম্মান করি সে আমার দিকে কামনার হাত বাড়ালো এটা ভাবতেই গা গুলিয়ে এলো । তার উপর বড় আপা এমন ধারা কথা বলল যার মানে বুঝতে পারলাম না । বড় আপা আট মাসের গর্ভবতী । আমি তার দেখাশোনা করার জন্যই এখানে এসেছিলাম । বড় আপার বড় ছেলেটা এবার সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে । একটা মেয়ের আশায় আবার নতুন অতিথির আগমন হতে চলেছে ।

বড় আপার যখন আঠারো বছর বয়স তখন পঁয়ত্রিশ বছরের প্রবাসীর সাথে বড় আপার বিয়ে হয় । বিয়েতে বড় আপা একদমই রাজি ছিল না । খুব মেধাবী ছিল বড় আপা । এস এস সি পেরিয়ে ইন্টারে পা রাখতেই বাবার এই সিদ্ধান্তে বড় আপার স্বপ্ন মাটিতে মিশে যায় । অবশ্য বড় আপার স্বপ্ন , ভালো লাগা , মন্দ লাগা এগুলো বাবা কখনো গুরুত্বই দেন নি । বাবার প্রথম সন্তান মেয়ে ছিল কি না তাই ! ছেলের আশা করে মেয়ে হওয়ায় বাবা মর্মাহত হয়ে পরেন । তাই বড় আপাকে কখনো ভালো ভাবে গুরুত্ব দেন নি । আমাদের সমাজে এরকম হাজারো বড় আপা আছে যাদের পরিবারে বড় হওয়াটায় একটা অভিশাপ । বড় আপারও তাই হলো । স্বপ্ন ভেঙে বয়স্ক একজনকে বিয়ে করে সংসারে পা দিলেন ।

বিয়ের ছয়মাসের মাথায় বড় আপা প্রথম আমাদের বাড়ি আসে । এর মাঝে আমাদের বাড়ি থেকেও কেউ খোঁজ নিতে যায়নি। তখন আমিও সবে নবম শ্রেনীতে উঠেছি । বড় আপাকে পেয়ে আমি আনন্দিত হলেও বাবা মায়ের তেমন পরিবর্তন দেখতে পাইনি আমি । বড় আপাও হয়ত বুঝেছিল তাই একদিন পরেই সে চলে যায় । পরে জানতে পেরেছিলাম বড় আপা সেদিন নিজের সংসার ছেড়ে এসেছিল । কারন দুলাভাইয়ের চরিত্রে সমস্যা । নারী সঙ্গ ছিল। প্রবাসে থাকাকালীন বাজে যায়গায় যাওয়ার অভ্যাস ছিল যা বিয়ের পরও অব্যাহত থেকে যায়। বড় আপার তখনকার অবস্থা আমার বোঝার ক্ষমতা না থাকলেও পরে বুঝেছিলাম কিন্তু কিছু করতে পারিনি । আমিও তো মেয়ে!

তারপর থেকে বড় আপা আর আমাদের বাড়ি আসত না । আমিই প্রায়ই যেতাম । দুলাভাইয়ের সাথে যথেষ্ট পর্দায় থাকার চেষ্টা করতাম । বড় আপা আগেই বলেছিল , সাবধানে থাকিস । আর পারলে আমার বাড়ি আসিস না । আমি সেদিন হেসে বলেছিলাম , কেনো রে বড় আপা ! আমি কি তোর বুড়া বর় কে কেড়ে নিবো নাকি ! তবুও আসতাম । বড় আপা তো ! মায়ের থেকেও বেশি ছিল আমার জীবনে । তাই বড় আপার এই সময়ে পাশে থাকতে চেয়েছিলাম ।

তবে আজ যা হলো তার উপর এই বাড়িতে আর নয় । সব গুছিয়ে বড় আপাকে শেষ বারের জন্য বলতে ওর ঘরের কাছে যেতেই যা শুনলাম তাতে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল । দুলাভাইয়ের নজর আমার উপর পরেছিল জন্যই আপু আমাকে ওর বাড়ি আসচে বারণ করেছিল । দুলাভাই নিজেই নাকি বড় আপাকে বলেছে , তোমার বোনটা ভালোই নাদসুনুদুস হচ্ছে । বলি একদিন আমার কাছে দিলেও তো পারো । ছিঃছিঃ ! যাকে এত শ্রদ্ধা করলাম সেই এমন প্রতিদান দিলো? বড় আপা দুলাভাইয়ের কলার ধরে এসব বলছে আর পাগলের মত কাঁদছে । এই প্রথম আমাকে মায়ের মত বোন আমাকে মেরেছে। ওর মধ্যে কি চলছে আমি তো বুঝতে পারছি। ভাবতে অবাক লাগছে এই অমানুষটার সাথে বড় আপা এতগুলো বছর সংসার করে যাচ্ছে কিভাবে ! আর করবেই না কেনো , কে আছে বড় আপার? পরিবার থাকতেই তো নেই ! আজ বড় আপা মেয়ে বলে এমন ?

বড় আপাকে সেদিন কিছু না বলেই বেড়িয়ে আসি । বড় আপার কান্না আমার সহ্য করা সম্ভব ছিল না। দুই মাস পর বড় আপার একটা ফুটফুটে মেয়ে হলো । হাসপাতালে দেখতে গেলাম । মেয়েটা যেন বড় আপার কপি । সেদিন বড় আপা আমাকে জড়িয়ে সে কি কান্না ! পাগলের মত আমার মুখে হাত বুলিয়ে বলছিল ,তোর খুব লেগেছিল তাই না রে? মাফ করে দিস আমাকে । আমি বোন হয়ে তোর গায়ে তুলে ভুল করেছি রে । সে কি কান্না বড় আপার।
বড় আপাকে শক্ত করে ধরে বললাম ,ওই অমানুষটার সাথে কেমন করে চলো ? ছেড়ে দাওনি কেনো বড়আপা ? ঘৃনা আসে না তার প্রতি ?

বড় আপা আমাকে আঁকড়ে ধরে বলল , আমি ওই অমানুষটাকে ছাড়তে পারি কিন্তু আমার সন্তানকে কি করে ছাড়ব বলতে পারিস? আমি আমার নাড়ি ছেড়া সন্তানদের মা হারা করতে পারব না রে । ছোট থেকে বাবা মায়ের আদর তেমন পাইনি। এখন আমিও যদি এদের ছেড়ে দেই তবে এরাও যে শেষ হয়ে যাবে । আর আমি এদের ছেড়ে যাবোই বা কোথায় বল না রে? বড় আপা আমার বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে কাঁদছে। আমি বড় আপাকে ধরে ভাবছি , আপারে তুই কেন আমার মা হয়ে আসলি না রে । কেনো আমি তোর গর্ভে জন্ম নিলাম না । কেনো তোর নাড়ির বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারলাম না রে বড় আপা!

বড় আপার মেয়ে জন্মের মাত্র তিনমাস পর আমার বিয়ে হলো । বিয়েটা দিলো বড় আপা নিজে । এতেও মা বাবার কোনো দায়িত্ব নেই ।দুটোই মেয়ে , কোনো ছেলে নেই এতেই তারা সারাজীবন শোকাহত থাকলেন । আমি চাকরী করে তাদের হাতে টাকা তুলে দিতে গিয়ে যে বিয়ের বয়স পার করে দিয়েছি সেটাও তারা খেয়াল করেননি ।
বিয়েটা হলো বড় আপার ইন্টারের এক ফ্রেন্ডের ছোট ভাইয়ের সাথে । বড় আপার সাথে হঠাৎই দেখা হলে আমার কথা বলতেই বন্ধু তার ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যায় । কারনটা অবশ্য পরে জেনেছিলাম । সেই বন্ধুটি বড় আপাকে পছন্দ করেছিল তবে বলার আগেই বড় আপার বিয়ে হয়ে যায়। যদিও সে বিয়ে করে এখন সংসারী । দেশের বাইরে থাকেন । আমাকেও বিয়ের পর দেশের বাইরে নিয়ে যাবেন এটা শোনার পর বড় আপা যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল । আমি জেনেছি বিয়ের পর ।

যেদিন দেশের বাইরে পা রাখার জন্য বের হলাম সেদিন বড় আপার অসহায় মুখেও প্রাপ্তির হাসি দেখেছিলাম । আমার বিদায় বেলায় সে এক ফোটা চোখের পানি ফেলেনি । আমি সেদিন চিৎকার করে কেঁদেছিলাম । বড় আপা বলেছিল , ধুর পাগলী । আবার তো দেখা হবে । এমন কেউ কাঁদে । নিজের আর সংসারের খেয়াল রাখিস । যার হাতে দিলাম সে তোকে সুখেই রাখবে । তোর বড় আপার পক্ষ থেকে তোকে দেওয়া সবচেয়ে দামী উপহার এটা ।

দামী উপহারটা সত্যিই অনেক দামী । বড় আপা আমাকে জীবনের সেরা উপহারটা দিয়েছেন । দেশের বাইরে আসার পর বড় আপার সাথে এক দুইদিন পর পরই কথা হত । মেয়ে হওয়ার পর থেকে নাকি দুলাভাই অনেক পাল্টে গেছে । বড় আপাকেও যত্ন করে । আমার বিবাহিত জীবনও ভালোভাবে যাচ্ছিল । তবে বেশি সুখ নাকি কপালে সহ্য হয়না ।

দুই বছরের মাথায় ,একদিন ভোরে দেশ থেকে মেসেজ আসল , বড় আপা ঘুমের মধ্যেই আমাকে রেখে না ফেরার দেশে চলে গেছে । সেই মূহূর্তে বড় আপার ওই নিঃপাপ ঘুমন্ত মুখটা চোখে ভাসছিল । আমার বড় আপা কত কষ্ট নিয়ে নিরবভাবে চল গেল । একটু সুখের দেখা পেলো কি পেলো না আর এখনি সে এমন জায়গায় চলে গেল যে আর কোনোদিন আসবে না । বড় আপা তুই বড় মিথ্যেবাদী । তুই বলেছিলি আবার দেখা হবে । সত্যিই কি আর দেখা হবে রে বড় আপা !!!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত