বরমশাই আজ বেশ মুডে আছেন। রাতের খাবার শেষে রান্নাঘর গুছিয়ে এসে দেখি, তিনি ওয়ারড্রবে কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে গুনগুন করে গান গাইছেন। খেয়াল করে দেখলাম, গোসলে ঢুকে তিনি যখন উচ্চাঙ্গসংগীত ধরেন তখন তার গলাটা খুব বেসুরো শুনায়। কিন্তু গুনগুন করার সময় আবার এতটা বেমানান লাগে না। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
– কি খুঁজছেন? গুনগুন থামিয়ে স্থান পরিবর্তন না করে বরমশাই পালটা প্রশ্ন করলেন,
– আমার ব্লু কালারের আয়রন করা টি-শার্টটা কোথায় রেখেছো বলো তো? খুঁজেই পাচ্ছি না। ভ্রু কুঁচকে ফেললাম আমি।
– এই সময়ে আয়রন করা টি-শার্ট দিয়ে কি করবেন? এবার তিনি পেছনে ফিরলেন। তারপর আমার দিকে এগিয়ে এসে চোখেমুখে রোমান্টিক ভঙ্গী এনে বললেন,
– লং ড্রাইভে যাবো। সন্দেহের দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলাম তার দিকে।
– কার সাথে?
– আমার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর সাথে।
সাথে সাথে আমি তার কপালে হাত দিয়ে দেখে নিলাম, জ্বরটর এসেছে কিনা! না, টেম্পারেচার নরমাল। আমাকে আর বাড়তি কিছু ভাবার সুযোগ না দিয়ে বরমশাই তার দু’হাত দিয়ে আমার কাঁধ জড়িয়ে বললেন,
– শুনো, সেদিন রিক্সার মধ্যে তোমার গা থেকে ব্লেজার খুলে নিয়ে আমি একেবারেই ঠিক করিনি কাজটা। সেজন্য কয়েকদিন আবার তোমাকে কাশিতেও ভুগতে হয়েছে। তাই আমি ঠিক করেছি, এই অন্যায়ের শাস্তিস্বরূপ আজ আমি তোমাকে নিয়ে বাইকে করে লং ড্রাইভে যাবো।
– আচ্ছা!
– হুম। এখন যাও, ঝটপট রেডি হয়ে নাও। আর শুনো, শাড়ি বা সেলোয়ার কামিজ না পরে, অন্যকিছু পরতে পারো। জিন্স,টি-শার্ট টাইপের। রাতের বেলায়ই তো, কে আর দেখবে!
বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে গেল আমার। লং ড্রাইভ পর্যন্ত তাও ঠিক ছিল। কিন্তু জিন্স,টি-শার্টের ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না। যে মানুষটা ঘরের মধ্যে সারাক্ষণ নতুন বউ বলে শাড়ি পরে থাকতে বলে, সেই মানুষটা কিনা বলছে জিন্স,টি-শার্ট পরার কথা! খানিকটা ধাতস্ত হয়ে চিন্তিত স্বরে বললাম,
– কিন্তু উপরে শীতের কাপড় কি পরবো? মাঝেমধ্যে পরার জন্য বাসা থেকে ওয়েস্টার্ন কিছু ড্রেস নিয়ে এসেছিলাম ঠিকই কিন্তু শীতের কোনো জ্যাকেট বা অন্যকিছু তো আনিনি।
– কোনো ব্যাপার না। আমার এ্যশ কালারের হুডিটা আছে না? ওটা তুমি পরো আর ব্ল্যাক কালারেরটা আমি পরে নিবো। খুশিতে গদগদ হয়ে আমি মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালাম।
– যাও, আর দেরী করো না। তার আগে আমার টি-শার্টটা খুঁজে দাও।
এই কয়েকদিনে যা বুঝলাম, মানুষটা এমনই। কখন কি ভূত চাপে মাথায়, বুঝার কোনো উপায় নেই। এই যেমন- সেদিন বাজার শেখার ভূত চেপেছিলো মাথায়। কিন্তু যখন বুঝতে পারলেন যে, ভাল বাজার করতে পারার পূর্বশর্ত হচ্ছে সকাল সকাল বাজারে যাওয়া, তখনই তিনি হুশ ফিরে পেলেন। এমনও হয়: কখনো কোনো ভুল বা অন্যায় করলে, তৎক্ষণাৎ তা না বুঝলেও, কিছুদিন পর গিয়ে ঠিকই বুঝতে পারেন। তখন নিজের শাস্তিও নিজেই ঠিক করে নেন। যার প্রমাণ খানিকক্ষণ আগেই দেখা গেল।
দুজনে ফিটফাট হয়ে বাইকে উঠে বসলাম। বরমশাই বাইক স্টার্ট দিতেই ইচ্ছে করে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। যেটাকে তিনি ভাবলেন ভয় পাওয়া। আমি নিজে প্রেমিকা হতে পারলেও তাকে এখনো প্রেমিক হতে শেখাতে পারলাম না, আফসোস! ফাঁকা রাস্তা পেয়ে বরমশাই বাইকের স্পীড বাড়িয়ে দিলেন। অদ্ভুত রকমের এক ভালো লাগা কাজ করছে এই মুহূর্তে। বাইকে চড়ে ভালবাসার মানুষটার পেছনে বসে রাতের ঢাকা ঘুরে বেড়াবো, এ আমার কতদিনের লালিত স্বপ্ন ছিল। আজ তা পূরণ হচ্ছে। ভাবতেই আনন্দে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছি আমি।এই মানুষটাকে বিয়ে করার সময় কখনো কল্পনাও করিনি, তার সাথে কাটানো এমন কিছু সুখের স্মৃতি ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চিত থাকবে। আমার পরণের হুডিটাতে বরমশাইয়ের গায়ের গন্ধ লেগে আছে, যে গন্ধে তীব্র নেশা অনুভব করতে পারছি ক্ষণে ক্ষণে। হঠাৎ বাইক ব্রেক করলে ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম আমি। ঘোর কাটতেই দেখতে পেলাম, আমাদের বাইকের কাছে তিনজন পুলিশ এগিয়ে আসছেন। আমি অবাক হয়ে তাদেরকে দেখতে লাগলাম। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। খানিকবাদে একজন পুলিশ এসে বাইকের পাশে দাঁড়িয়ে বরমশাইকে জিজ্ঞেস করলেন,
– এত হাই স্পীডে বাইক চালাচ্ছিলেন কেন? প্রতিউত্তরে বরমশাই তার সবক’টা দাঁত বের করে প্রশস্ত হেসে বললেন,
– স্যরি। আসলে পেছনে সুন্দরী কোনো রমণী বসে থাকলে কারোরই হুশ থাকে না, আমারও ছিল না। অপর দু’জন পুলিশ পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। একজন বললেন,
– গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে এতরাতে ঘুরতে বের হওয়া, সাহস তো কম না! সাথে সাথে প্রতিবাদ জানালেন বরমশাই।
– আরে না না, ও আমার গার্লফ্রেন্ড না, সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী। বিশ্বাস না হলে বাসায় চলুন, আমাদের বেডরুমে ফুলশয্যার রাতের ফুলের স্মেল এখনো রয়ে গেছে।
– লাইসেন্স দেখান দেখি। বরমশাই বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গীতে বললেন,
– ওটাও বেডরুমেই আছে, গেলেই পাবেন।
একথা শোনার পর আমি আঁৎকে উঠলাম। মনে মনে দু’আ ইউনুছ পড়তে লাগলাম অসংখ্যবার। একঘণ্টা হতে চলেছে থানায় বসে আছি। অথচ আমার সাথের মানুষটার কোনোরকম চিন্তা-চেতনা নেই। তিনি মনের সুখে চোখ বুলিয়ে থানার চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছেন। এদিকে মশার কামড়ে আমার জান যায় যায় অবস্থা। কোথায় ভেবেছিলাম, আজকের রাতটা কত রোমান্টিক মুডে কাটাবো, তা না, কাটাতে হচ্ছে হরর মুডে। উফফ, কোন কুক্ষণে যে আমি এই মানুষটার সাথে লং ড্রাইভে বেরিয়েছিলাম! একপর্যায়ে আর সহ্য করতে না পেরে যতটা সম্ভব ঠাণ্ডা মাথায় বরমশাইকে জিজ্ঞেস করলাম,
– সারারাত কি এখানেই থাকবো? কোনো ব্যবস্থা করবেন না? ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে তিনি উত্তর দিলেন,
– আমার এক মামা আছেন, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কিন্তু কোন পোস্টে আছেন খেয়াল নেই। তাকে ফোন করলেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
– তো দেরী করছেন কেন? ফোন করুন।
– পাগল নাকি! ফোন করলে তিনি যদি জিজ্ঞেস করেন, এত রাতে বউকে নিয়ে কেন বের হয়েছিলাম। তখন কি উত্তর দিবো? আমি আর মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলাম না। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
– তাই বলে আমরা এভাবে সারারাত এখানে বসে থাকতে পারি না। ফোনটা করুন।
– আরো একটা সমস্যা আছে,
ফোন করলে মামা যদি এখানে এসে উপস্থিত হোন, তারপর যদি তোমাকে এই অবস্থায় দেখে ফেলেন? আফটার অল তুমি নতুন বউ তো বলো? আমার যদি এখন দেয়ালে বারি দিয়ে মাথা ফাটানোর সুযোগ থাকতো তাহলে আমি নিজের মাথাটা কোনোরকম ভাবনাচিন্তা ছাড়াই ফাটিয়ে ফেলতাম। শেষমেশ আমি কাঁদো কাঁদো সুরে মিনতি করলাম বরমশাইকে,
– প্লিজ, ফোনটা করুন। জীবনে আর কিচ্ছু চাইবো না আপনার কাছে।
আমার মিনতি দেখে তার বোধহয় মায়া হল। পকেট হাতড়ে মোবাইল খুঁজতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝে গেলাম, তিনি সাথে করে শুধু লাইসেন্স না, মোবাইল আনতেও ভুলে গেছেন। কোনো উপায় না পেয়ে থানার ও.সি কে রিকোয়েস্ট করে তার মোবাইল থেকে বরমশাইয়ের সেই মামার কাছে ফোন করলাম। অবশেষে সেই মামার সাহায্যে আল্লাহ্র অশেষ রহমতে সেই যাত্রায় বেঁচে যেতে পারলাম আমরা। এই ঘটনার পর আমার হানিমুনের শখও মিটে গেছে। কেন সেটা আপনারাই বুঝে নিন।