একজোড়া কানের দুল

একজোড়া কানের দুল

সন্ধ্যায় ঘরে ফিরছিলাম। দাঁড়িয়ে আছি কসমেটিকের দোকানের সামনে। আজ আমার বউয়ের জন্মদিন। এই ঢাকা শহরে কাকের সাথে ঝগড়া করে বেঁচে আছি। আমরা দুজনেই কেন যেন জোড় করেই দিনটার কথা ভুলে থাকতে চাই। ভুলে থাকতে গিয়েই ভুল করতে থাকি একের পর এক। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে ও আমার পা ছুঁয়ে সালাম করে। ওর মাথায় হাত রেখে ওকে একটু কাছে টানি। যেভাবে পুইশাককে গাছে বাইয়ে দেওয়া হয় বউও সেভাবে আমায় জড়িয়ে ধরে থাকলো। ছাড়তে ইচ্ছে করছিলো না। কেমন একটু সংকোচে দুজন আলাদা হয়ে গেলাম। বউয়ের কপালে চুমু দিয়ে অফিসের দিকে পা বাড়ালাম।

অফিসে বসে বার বার বউয়ের কথা মনে হচ্ছে। সামান্য একটা চাকরি করি আমি। তেমন কিছুই দিতে পারিনি আজো বউকে। একটা মেয়ের কত সখ আহ্লাদ থাকে। অথচ ও কোনদিন মুখ ফুটে কিছুই চায়নি। জানে চাইলে যে দিতে পারবোনা। দিলেও মাসের শেষে অনেক টানাটানিতে পরে যাবো। কিন্তু এই মাসে মাঝখানেই টানাটানিতে পরে গেলাম। আজ মাসের ২৪ তারিখ। বউয়ের জন্মদিন। হাতে গাড়ি ভাড়া ছাড়া বাড়তি পয়সা নেই। ইসস! বউয়ের জন্মদিন যদি মাসের শুরুতে হতো তাহলে ওকে একটা শাড়ী কিনে দিতে পারতাম।

কসমেটিকের দোকানে এক জোড়া দুলের সামনে চোখ সেঁটে আছে। পুনা অনেক আগে খুব সংকোচে একবার বলেছিল, “আমাকে এক জোড়া দুল কিনে দিবা।” সেদিন বলেছিলাম সামনের মাসে মাইনে পেলেই কিনে দিবো। অনেক মাস পেড়িয়ে গেছে। আজো কিনে দেওয়া হয়নি। বউ ও চায়নি আর। হয়তো ভুলেই গেছে।

ইদ্রিস সাহেব থেকে হাজার টাকা ধার নিয়ে অফিস থেকে বেরুলাম। উদ্দেশ্য বাসা। জ্যামের মধ্যে বাসে বসে আছি। কিছু পিচ্চি মেয়ে দেখি বেলি ফুলের মালা বিক্রি করছে। পাঁচ গাছি মালা কিনলাম। পুনা বেলি ফুল খুব পছন্দ করে। ওর খুব সখ একদিন যদি আমাদের বাড়ি হয় অনেক বড় বেলি ফুলের বাগান করবে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, যখন বেলি ফুলের সিজন শেষ হয়ে যাবে কি করবে? বউয়ের সরল জবাব, “তখন অপেক্ষা করবো ফুল ফোটার জন্য।” বাস থেকে নামার সময় হঠাৎ একটা মালা ছিঁড়ে যায়। সাথে সাথে মালা থেকে ফুল গুলো ছাড়িয়ে নিয়ে শার্টের পকেটে রেখে দিলাম। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখ চলে গেল একটা কসমেটিকের দোকানের সামনে।

“ভাই এই দুলটা কত?” “সাড়ে সাত’শো টাকা।” বলেই দোকানদার দুলটা নামিয়ে দিল। হাতে নিতেই কেন যেন খুব পছন্দ হয়ে গেল। মনে হল বউ খুব পছন্দ করবে। পছন্দের জিনিস আমি দরদাম করিনা। দাম চুকিয়ে বাসার দিকে রওনা হলাম। সারাদিন বউ আমার একা একা থাকে। এই সময়টার জন্য ও খুব অপেক্ষায় থাকে কখন আসবো আমি। দ্রুত পা লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি।

দরজার কড়া নাড়তেই পুনা দরজা খুলে দিলো। পাগলীটা মনে হয় দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো। ওর পছন্দের হলুদ শাড়িটা পরেছে আজ। ঠোঁটের হালকা লিপ্সটিকের ফাঁকে এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হাসিটা কতোনা স্নিগ্ধতায় ফুটে আছে। বুকে পেন্ডুলামের মতো হৃৎপিন্ডটা দুলছে। জানি না কতখানি পূন্যের কাজ করলে পুনার মতো ভাল মানুষ কে বউ করে পাওয়া যায়।

“এই কি হলো ঘরে ঢুকো না।” বউয়ের কন্ঠ শুনে ঘোর আরো বাড়লো। আমার শোনা পৃথিবীর সেরা সিম্ফনি। বউয়ের কন্ঠে আমি বুঝতে পারি স্বর্গের ঝর্ণাধারার শব্দ কেমন। বউ হাত ধরে ঘরে ঢুকালো। দরজা বন্ধ করতেই জড়িয়ে ধরলো। শক্ত করে ধরে আছি বউকে। পিঠে হাত রেখে আরো নিবিড় করে আঁকড়ে ধরলাম। বউ কেঁপে কেঁপে উঠছে। কতক্ষণ এভাবে ওকে জড়িয়ে ধরেছিলাম জানিনা।

গোসল করে বের হয়ে দেখি পুনা বেলি ফুলের মালা খোঁপায় পরেছে। হাতেও ব্রেসলেটের মতো এক গাছি মালা জড়িয়ে আছে। আমি গোসল করতে করতেই ও পাটি বিছিয়ে ফ্লোরে খাবার সাজিয়েছে। ঘরে তেমন বাজার ছিলোনা। কিন্তু আমার পছন্দের বিরিয়ানি রেঁধেছে। ওর অল্প অল্প করে জমানো টাকা আজো খরচ হয়ে গেল। খেতে বসার আগে দুলটা ওকে দিলাম। একরাশ মুগ্ধতায় দুলটা হাতে নিয়ে চেয়ে আছে। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে অভিমানি স্বরে বলল, “কে বলেছে শুধু শুধু এতো টাকা নষ্ট করতে।“

আমি শুধু হাসলাম। বউ দুলটা বিছানার উপরে রেখে খেতে বসলো। আড় চোখে বার বার ওর দৃষ্টি বিছানার দিকে চলে যাচ্ছে। একটু একটু কি ভিজে উঠছে ওর চোখের কোলটা। বউয়ের এই আনন্দটুকু যেকোন হ্যাসবেন্ডের কাছে দুনিয়ার সেরা সুখ।

রাতে ঘুমুতে যাওয়ার সময় দেখি ছিঁড়ে যাওয়া মালার ফুল গুলো বালিশের উপরে ছড়ানো। মনে পরে গেলো বাসর রাতের কথা। আহ, কি পাগলী যে ছিলো পুনা। যাক সে কথা। কিছুক্ষণ মুখোমুখি শুয়ে গল্প করলাম। সারাদিনের অফিসের ধকল; কখন যে স্বর্গের ঝর্ণাধারার শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেছি টের পাইনি। জানি না আমার মতো ভাগ্য ক’জনের হয়, পুনার মতো এতো ভাল একজন মানুষের ছোঁয়ায় থাকতে পারে।

হঠাৎ ঘুম ভাংতেই শুনি কাচের চুড়ির টুংটাং শব্দ। দেখি বউ দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালে ঝুলানো সস্তা আয়নাটার সামনে। লাইটের আলোতে যেন আমার ঘুম না ভাংগে এই জন্য পুনা মোমবাতি জ্বালিয়েছে। মোমের আলোয় কানের দুল গুলো মাথা এপাশ ওপাশ করে দেখছে। এতো দূর থেকেও বুঝতে পারছি আনন্দে কাঁদছে আমার পাগলীটা। পুরুষ মানুষের চোখের জল বড়ই বিচ্ছিরী ব্যাপার। তবুও আমার দু’চোখে অশ্রুর বান লাগলো। একজোড়া! সামান্য একজোড়া কানের দুল আমার বউকে এতো খুশি করলো।

আমি তো বউকে ভাল একটা শাড়ী কিনে দেওয়ারও সামর্থ রাখিনা। অথচ সামান্য একজোড়া কানের দুল আমার বউকে এতো খুশি করে দিলো। ইচ্ছা হচ্ছিলো পুরো দুনিয়াটা বউয়ের কাছে এনে দিতে।

মোমবাতির আলোয় বউকে বারবার দেবী মনে হচ্ছিলো। মুখ দিয়ে নিজের অজান্তেই ডেকেও ফেললাম আস্তে করে- দেবী। বউ শুনতে পেয়ে তাড়াহুড়া করে মোমবাতির রোমান্টিক আলোটা নিভিয়ে আমার পাশে এসে শুয়ে গেলো।

তখনো ওর ঘন নিঃশ্বাস টের পাচ্ছিলাম। হঠাৎ পুনা আমার মুখের কাছে মাথা এনে গালে চুমু খেল। ওর কানের দুলের স্পর্শ পরলো আমার গলার কাছে। কেঁপে কেঁপে উঠলাম। বউ শক্ত করে আমায় পেছন থেকেই বুকে জড়িয়ে ধরলো। এর চেয়ে শান্তির আশ্রয় আর কিছু আছে বলে আমার জানা নাই।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত