নারীর লজ্জা

নারীর লজ্জা

পল্লবীর দ্বিতীয় সাময়িক পরিক্ষা চলছে। হঠাৎ ভীষণ পেট ব্যাথা অনুভব করছে। কিছু বোঝে উঠতে পারছে না কিসের ব্যাথা হচ্ছে। পরিক্ষা চলছে। লিখতে হাত কাঁপছে। পরিক্ষায় মনোযোগ নেই। হলে গার্ড দিচ্ছে হারুন স্যার। খুব রাগি স্বভাবী। এক কথার মানুষ তিনি। ক্লাসে কোরো অমনোযোগী পছন্দ করতেন না। পল্লবী খুব নাড়াচাড়া করছে। স্যারের নজর কারে পল্লবীর আচরণের দিকে।

-পল্লবী এরকম করছো কেনো? কমন পরেনি? পল্লবী কিছু বললো না।
-কি হলো কথা বলছো না কেনো? পরিক্ষা ভালো না লাগলে হল থেকে বেরিয়ে যেতে পারো! বেরিয়ে যাওয়ার কথা শোনে পল্লবী মৃদু স্বরে বললো-
~স্যার হঠাৎ পেট ব্যাথা করছে।
-এসব দোহায় দিয়ে লাভ নেই।

তোমার জন্য হলে থাকা কেউ লিখতে পারছে না। চাইনা তোমার জন্য কারো পরিক্ষা খারাপ হোক। কি করবে তোমার সিদ্ধান্ত। হয়তো ভালো ভাবে পরিক্ষা দিবে নয়তো ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাবে!

স্যারের এমন বিদঘুটে কথা শোনে পল্লবীর মন চুরমার হয়ে গেল। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। কেনো ব্যাথা হচ্ছে সেটাও বুঝতে পারছে না। পল্লবী ছিল খুব ভিতু টাইপের। স্যারের একটু চটা কথায় প্রায় কেঁদে দেয়ার মত অবস্থা হতো। হঠাৎ পল্লবীর মনে হচ্ছে নিচের অংশটাতে ভেজা অনুভব করছে। স্যারের থেকে অনুমিত নিয়ে ওয়াশরুমে গেল। দেখে পায়জামা জুড়ে রক্তের দাগ। রক্ত দেখে পল্লবী ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে। হঠাৎ রক্ত আসলো কোথা থেকে? কোথাও কাঁটার চিহ্ন নেই। আঘাতের দাগ নেই।

মনে মনে ভাবছে- ব্যাথা হলে রক্ত বের হওয়ার কথা না! আমার তো বের হচ্ছে। রক্ত মাখা পায়জামা নিয়ে তো স্যারের কাছে যাওয়া যাবে না। পড়নে ছিল স্কুলড্রেস। তবুও খাঁটো। ঢেকে রাখার উপায় নেই। কোনো ভাবে ঢেকে ঢুকে ক্লাসের দরজার সামনে দাঁডিয়ে আনমনা হয়ে বললো, “স্যার আমি পরিক্ষা দিতে পারবো না। পল্লবীর কথা শোনে স্যার অবাক হয়ে গেল। ভ্রু কুঁচকিয়ে বললো- এটা স্কুল। তোমার ইচ্ছে স্বাধীন যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে না। এদিকে পল্লবী ব্যাথায় জরস্বর হচ্ছে। যে মেয়েটি লিখতে গেলে হাত কাঁপছে। স্থির ভাবে বসে থাকতে পারছে না সে কিভাবে পরিক্ষা দিবে। স্যার অনুমিত না দিলেও বাসায় চলে গেল।

ব্যাথা নিয়ে বাড়িতে এলো। বারান্দায় চেয়ার দাঁড় করানো। চেয়ারের উপর কলম ছুড়ে মেরে রুমে ঢুকলো। পাশে থাকা বাবা কিছু জিজ্ঞেস করলেও উত্তর না দিয়ে রুমে ঢুকলো। যেমনটা অভদ্র মানুষের মত। বাবা চিৎকার দিয়ে বাড়ি মাথায় তুলছে। পুরুষের অল্প কথায় কিছু সময় হুংকার মনে হয়। মায়ের কাছে বলছে তোমার মেয়ে পরিক্ষা না দিয়ে চলে এলো কেনো? মা ভয় নিয়ে নিচু গলায় বললো- হয়তো ওর পরিক্ষা শেষ তাই চলে এসেছে। বাবা রাগান্বিত হয়ে বললো- পরিক্ষা শেষ তাইনা? পাশের বাড়ির হাসমত ভাইয়ের ছেলেও তো পরিক্ষা দিচ্ছে। কই ও তো এলো না। ওর যাতায়াত তো আমাদের বাড়ির উপর দিয়ে। তোমার মেয়েকে একটু বোঝাইও। মাথা নিচু করে মা পল্লবীর রুমে গেল। খাঁটের উপর শুয়ে শুয়ে কাঁন্না করছে।

– পল্লবী পরিক্ষা না দিয়ে চলে এসে শুয়ে শুয়ে কাঁন্না করস কেন? মায়ের আদুরে কথা শোনে কাঁন্নার শব্দ আরো গভীর হলো।
~ মা আমি শেষ। আর বাঁচবো না।
– এসব কি বকিস অলক্ষুণে কথা? কি হয়েছে বল।
~ মা রক্তে পায়জামা ভিজে গেছে। প্রচন্ড পেট ব্যাথা। ব্যাথায় পরিক্ষা দিতে না পেরে চলে এসেছি। পল্লবীর কথা শোনে মা মুচকি হাসি দিল। মায়ের হাসিতে ও রেগে আগুন। আমি ব্যাথায় কাতরাচ্ছি মা হাসছে।
~ মা, আমি মরে যাচ্ছি আর তুমি হাসছো?
– এমনি। মেয়েদের এরকম সমস্যা প্রতি মাসে হয়। কিচ্ছু হবে না তোর। তিন-চার দিন পর ঠিক হয়ে যাবে।

পল্লবী মনে মনে ভাবছে- আমার মনে হচ্ছে এক্ষণি মারা যাবো। মা বলছে তিন-চার দিন পর ঠিক হয়ে যাবে। তিন-চার দিন আগে আমার তো বেঁছে থাকতে হবে?

~ মা, প্রতি মাসে কি শুধু মেয়েদেরি হয়? ছেলেদের হয়না? মা হেসে হেসে বললো-
– না, শুধু মেয়েদের হয়। আমারো হয়।
~ আগে তো বলোনি।
– এসব কথা কাউকে বলতে হয় না।
~ এগুলোকে কি বলে মা?
– পিরিয়ড বলে। যখনি এগুলো হবে তখন প্যাড ব্যবহার করতে হয়।

মা এক দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে মায়ের রুমে গেল। কিছুক্ষন পর মায়ের ডাক শুনতে পেলাম। মায়ের কাছে গেলাম। আমার হাতে কিছু টাকা দিয়ে মা বললো- আবির যা তো পল্লবীর জন্য প্যাড নিয়ে আয়। পাশে থাকা বাবা মায়ের কথায় মিন মিন করে বলছে- লজ্জা সরমের মাথা খাইছো নাকি? ছেলের সামনে এগুলো কি বলতেছো? মা বিস্ময় হয়ে বললেন- ছেলে-মেয়েদের কাছে বলবো নাতো পাড়ার লোকের কাছে বলবো?

মায়ের কথামত বাজারে গেলাম। বোনের চিৎকারো ভালো লাগতো না। খুব কষ্ট হচ্ছিল। কি এসব? বোনটা কত কষ্ট করছে। এসব হওয়া কি খুব দরকার ছিল? ফার্মেসীতে ঢুকলাম। দোকানে প্রচুর ভীড় থাকায় মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে থাকা লাগবে। দাঁড়িয়ে থাকা ভালো লাগছে না। বার বার বোনের দেয়া চিৎকার ভেসে উঠছে। এমন সময় আমার পাশে এসে একটি মেয়ে দাঁড়ালো। কিছুটা ভীড় কমছে মেয়েটিও সামনে এগোচ্ছে। একটু সামনে যায় আবার পিছিয়ে আসে। মনে মনে সন্দেহ হচ্ছে আমার। মেয়েটি এরকম করছে কেন? ফার্মেসীতে কি কাজ? যাক, মেয়ের চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিলাম। বোনের জন্য প্যাড কিনলাম। এখনো দেখি দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি ওখানেই দাঁড়ানো। পিছনে ব্যাগ রাখা দু’হাত কোমরের উপর রেখে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে ভাবছি- হয়ত মেয়েটি লজ্জায় যেতে পারছে না। ততোক্ষনে কিছুটা আন্দাজ কর‍লাম মেয়েটির হয়তো পিরিয়ড হয়েছে কিন্তু লজ্জায় যেতে পারছে না। মেয়েটির সামনে গিয়ে বললাম-

– কিছু মনে না করলে একটু কথা বলতে পারি? মেয়েটি নম্রস্বরে বললো-
~ জ্বী বলেন।
– আপনার মত আমারো একটা বোন আছে।

আজকে তার প্রথম পিরিয়ড চলছে। তার জন্য প্যাড নিয়ে যাচ্ছি। কেমন যেন মনে হলো আপনার মাঝে কিছুটা চিন্তিত কাজ করছে। এটা রাখেন। আমার তাড়া আছে। (প্যাড হাতে দিয়ে বললাম) কিছুদিন পর-সকালে ঘুম ভাঙে বোনের হৈচৈ এ।

– ভাই কিছু টাকা লাগবে আমার।
~ এখন টাকা দিয়ে কি করবি?
– কাজ আছে দে।
~ কতটাকা লাগবে?
– পাঁচশো।
~ এতো টাকা দিয়ে কি করবি?
– কাজ আছে। দিবি কি-না তাই বল?

পল্লবীর হাতে পাঁচশো টাকা দিলাম। একদৌড়ে রুম থেকে চলে গেল। মানা করিনি। কারণ, জানি ও টাকা অপচয় করবে না। যা করবে নিজের জন্য না হয় অন্যের উপকারের জন্য। স্কুল থেকে বাড়ি আসলো। কখনো ওর ব্যাগ চেক করিনি। আজকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। দেখি অনেকটি প্যাড রাখা। ভীষণ চিন্তিত হলাম। হটাৎ এতো প্যাড দিয়ে কি করবে ও? কিছু বলিনি। যাক, টাকা দিয়ে ভালোই হয়েছে। অপচয় করেনি।

হঠাৎ শপিং করবে। রোজ রোজ ওর ঘ্যানঘ্যান শুনতে ভালোও লাগতো না। নিয়ে গেলাম শপিংয়ে। হাতে করে ইয়া বড় ব্যাগ নিল। বললাম এতো বড় ব্যাগ দিয়ে কি করবি? পল্লবী বললো- কাজ আছে, তুমি বুঝবে না। আর কিছু বললাম না। বাসে উঠলাম। পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক কলেজে পড়ুয়া পেয়ে। হঠাৎ পল্লবী আমাকে বলে- ভাইয়া, তুই দাঁড়িয়ে যা। মেয়েটিকে এখানে বসতে দে। কিছু না বলেই দাঁড়িয়ে গেলাম। মেয়েটিকে পল্লবী বসতে বললো। মেয়েটিও বসলো। খেয়াল করলাম পল্লবী ব্যাগ থেকে কি যেন বেড় করছে। দেখি প্যাড বেড় করে দিচ্ছে। আমাকে দেখে মেয়েটি লজ্জা পাচ্ছে। নিতে চাচ্ছে না। পল্লবী বললো-

– আপু, তুমি ভাইয়াকে দেখে লজ্জা পাচ্ছো? এসব কেনা ওর টাকায়। আর এসব কথা পরিবারের কারো কাছে লুকাতে নেই। মেয়েটি নিতে চাচ্ছে না। স্থির ভাবে বসে থাকতেও পারছে না। সামনে স্টেশন। পল্লবী বললো-

– আপু, সামনের স্টেশনে গাড়ি থামালে তুমি এটা ব্যবহার করবে। মেয়েটি নেমে গেল। যাওয়ার সময় পল্লবীকে বললো- লজ্জায় কাউকে কিছু বলতে পারিনি। এখন বুঝলাম, কিছু লজ্জা গোপন রেখে ক্ষতি ডেকে এনে লাভ নেই। মেয়েটি চলে গেলেন। আমরাও সামনের স্টেশনে নামলান। পল্লবীকে বেশ খুশি মনে হচ্ছে।

– হঠাৎ এতো খুশি? এরকম হাসি খুশি তোকে কখনো দেখিনি। কারণ কি?
~ ভাইয়া, তোর থেকে প্রতি মাসে পাঁচশো টাকা করে নিয়ে শুধু প্যাড কিনি।

স্কুলে থাকা সব মেয়েদেরকে এগুলো দেই। আমি চাইনা, আমার মত কেউ ওরকম পরিস্থিতির সম্মুখী হোক। কেউ অসহ্য যন্ত্রনা পাক। পল্লবীর কথার উত্তর দিতে পারিনি। বোনটাকে নিয়ে বুক ফুলিয়ে গর্ব করতে ইচ্ছে করছে। মনে মনে আল্লাহ’র কাছে বললাম- এরকম পল্লবী যেন প্রতিটা ঘরে ঘরে জন্ম নেই। যেখানে লজ্জার ভয়ে মেয়েরা কষ্ট চাঁপা দিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। আর সেখানে পল্লবী বুক ফুলিয়ে মানুষের সাহায্য করে যাচ্ছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত