“এই ভাবে কেউ ভাত রান্না করে??? সব তো মাড় বানিয়ে ফেলেছো! তার চেয়ে মাড়ই খেতে দিতে?” রাগান্বিত স্বরে আরাফের চিৎকার শুনে আধশোয়া থেকে একরকম লাফিয়ে উঠলো মা! দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে দেখেন, ভয়ে জড়োসড়ো করে দাঁড়িয়ে মাইশা! আর আরাফ রাগে গজগজ করছে খাবার টেবিলে বসে। মা এসে কাঁধে হাত রাখলেন আরাফের, একটু শান্ত হলেও যেই না অভিযোগ করতে যাবে ওমনি মা বললেন, “ভাত তো আমি রান্না করেছি। তুই ওর সাথে চিৎকার করছিস কেনো?” এইবার আর আরাফের মুখে কোনো কথা নেই, নিশ্চুপ হয়ে কোনো রকম খেয়ে উঠে চলে গেলো ওর ঘরে। মাইশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মা জিজ্ঞেস করলেন,
“তুই চুপ করে ছিলি কেন মা! রান্না তো আমি করেছি এটা বলিসনি কেনো?”
“তাতে কি মা! একটু রাগারাগি না করলে কি আর ভালবাসা দেখা হয়!”
“পাগলী মেয়ে! চল খেয়ে নে আমিও খাবো”
“হুম”
মাত্র মাস পাঁচেক হলো আরাফ আর মাইশার বিয়ে হয়েছে। বিয়েটাও হয়েছে ওদের ইচ্ছেতে, দুজন চার বছরের ভালবাসায় আবদ্ধ ছিল কিনা। কিন্তু বিয়ের আগে আরাফের যে ভালবাসা খুনসুটি ছিল এখন বিয়ের পরে সেগুলোর কমতি অনুভব করছে মাইশা! কিন্তু তাও কোনো রকম অভিযোগ নেই ওর আরাফের প্রতি কারণ মানিয়ে নেয়ার দৌড়ে মাইশা অনেকটা এগিয়ে রাত আনুমানিক বারোটা বেজে সাতচল্লিশ, মাইশা তাকিয়ে আছে দেয়ালে টাঙানো ধুসর রঙের ঘড়িটার পাণে। এইতো সেদিন ঘড়িটা কিনে এনেছিল আরাফের সাথে কিন্তু এখন আরাফ ঘুমিয়ে গেছে আরও অনেক সময় আগেই কিন্তু জেগে আছে ঘড়িটা। কিছু সময় বাদে যখন ঘন্টার কাটা ১টার ঘরে এসে থামলো তখন ঘড়ি বেজে উঠে জানান দিচ্ছে যে রাত ১টা বেজেছে। হঠাৎ করে মাইশার মনে হলো অন্ধকার ঘরে কে যেনো হাঁটছে! পাশে তাকিয়ে দেখে আরাফ নেই। তার মানে আরাফই উঠেছে হয়তো কিন্তু মাইশাকে জেগে থাকতে দেখেও কিছু না বলে গেলো!
বুকের ভিতর কেমন চিন চিনে ব্যথা অনুভব করছে, কিন্তু বুকে হাত না দিয়ে হাত দিলো গালে! কেন যেনো চোখটা ভিজে অশ্রু গড়িয়ে পরছে মাইশার গাল বেয়ে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছেড়ে কম্বল গায়ে মুড়িয়ে শুয়ে পরে মাইশা। পৌষ শেষ হয়ে এখন মাঘ চলছে কিন্তু ছোট বেলার সেই শীতের ছোয়া নেই। নেই সে ভোরের ঘন কুয়াশা, মাঝে মধ্যে তো শীত লাগেই না আজকাল তবে দুদিন ধরে হালকা শীতের ছোয়া বইছে গতরে। ঘরে কারো হাঁটা অনুভব হচ্ছে মাইশার কিন্তু যতই হাঁটাহাঁটি অনুভব হয় ততই মাইশার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ায়! আরাফ এতোক্ষন ঘুমিয়ে ছিল তাও এতটা কষ্ট হয়নি ওর কারণ ঘুমিয়ে গেলে তাও মনকে বুঝ দেয়া যায় কিন্তু জেগে থাকার পরেও কিভাবে ভুলে গেলো যে আজ মাইশার জন্মদিন!
আরাফের জন্মদিনের পরিকল্পনা মেয়েটার মাথায় ঘুরতে থাকে একবছর আগে থেকে। কি করবে কি দিবে কি খাওয়াবে এসব ভেবে তো ঘুমই হয়না আরাফের জন্মদিনের দুদিন আগে থেকে। অপ্রাপ্তির বোঝা অনেক কিন্তু তাও মাইশা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে এই বোঝা কমাতে কিন্তু তা কি আর এমনি এমনি কমে! মাঝে মধ্যে অন্যঘর থেকে মাইশা শুনতে পায় আরাফ ফোনে কার সাথে যেনো কথা বলে! কিন্তু মাইশা ঘরে ঢুকলেই ফোনটা রেখে দেয় আরাফ ঘুম ভেঙেছে মাইশার, সকাল হয়ে গেছে ততক্ষণে। চোখ মেলতেই কেমন ভয় পেয়ে গেলো মাইশা! অস্ফুটস্বরে মুখ থেকে বের হলো, “একি! কোথায় আমি!” চারিদিক লাভ বেলুন আর ফুল দিয়ে সাজানো একটা ঘর। চারিদিকে হৈ-হুল্লোড় শোনা যাচ্ছে, তবে এতো সাজসজ্জার মাঝেও ধুসর ঘড়িটার দিকে চোখ পরতেই কিছুটা অভয় পায় মাইশা।
ও ঘর থেকে বাবা-মায়ের কন্ঠস্বর ভেসে আসছে। অবাক হয়ে ভাবছে মাইশা, “তবে কি আব্বু আম্মু এসেছে এই সকাল বেলায়! অথচ আমাকে একটু জানালোও না তারা” বয়স তো আর কম হয়নি, তাই সারপ্রাইজটা বেশ ভালভাবেই আন্দাজ করতে পেরেছে মাইশা। কার যেনো ঘরে আসার শব্দ আসছে, নিশ্চয়ই আরাফ হবে। চটপট আবার কম্বল গায়ে জড়িয়ে আগের ন্যায় শুয়ে পরলো চাপটি মেরে ঘরে ঢুকে কি যেনো নিয়ে চলে যাচ্ছে আরাফ কিন্তু যাওয়ার আগে একবার তাকালো মাইশার পাণে। কাছে এসে কিছুসময় তাকিয়ে থেকে কি যেনো দেখছে, মিটিমিটি করছে মাইশার চোখ। ঠোঁটে আর কপালে ভালবাসা এঁটে দিয়ে ফের প্রস্থান করতে যাবে ওমনি আরাফের গেঞ্জি ধরে টান দিয়ে গভীর ভালবাসায় হারিয়ে গেলো মাইশা! ততক্ষণে আরাফের চোখ দুটি ছানাবড়া বণে গিয়েছে মাইশার কানের কাছে মুখ নিয়ে আরাফ বিড়বিড় করে বললো,
“শুভ জন্মদিন প্রিয়। বাহিরে এসে দেখো তোমার জন্য কি রয়েছে”
“কিছু লাগবে না, তোমাকে পেলেই চলবে আমার”
“হ্যাঁ সেটাও দিবো তবে এখন নয় রাতে…”
“যাহ! লাগবে না”
হাত ধরে টেনে তুললো মাইশাকে আর বিছানা থেকে পা ফেলতেই বেশ হতবাক মাইশা! সারা ঘরে ছিটিয়ে আছে গোলাপের পাপরি ঘর থেকে বের হতেই চার বাবা-মা আর ননদের মুখ থেকে শুভ জন্মদিন শোনা, নিকটতম আত্নীয়দের কাছ থেকে শুভ জন্মদিন শোনা, তারপর একে একে উপহার সমগ্র হাতে নেয়া। জন্মদিনের সকালটা এতো ভালভাবে শুরু হবে তা কখনোই ভাবেনি মাইশা। সব কিছু যেনো কেমন স্বপ্ন মনে হচ্ছে আর হঠাৎই আরাফ হাতে চিমটি কেটে চোখ মেরে দিলো। আরাফের চোখে তাকিয়ে, মানুষটা মনের কথা যে কিভাবে বুঝে ফেলে তাই ভেবে পায় না মাইশা…