তুই একটা ছ্যাঁচড়া, তোকে ভালোবাসা’ই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ” চেঁচিয়ে কথাগুলো বললো নীরা। আমি তার কথায় কোনরূপ ভ্রূক্ষেপ না করে টাকা গুলো নিয়ে সোজা বাজারের দিকে হাঁটা ধরলাম। বাবার জন্য ঔষধ আনতে হবে। বুকের ব্যথাটা হটাৎ করে বেড়ে গেছে। প্রচন্ড অভাবে দিন যাচ্ছে। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে, একের পর এক চাকরির ইন্টারভিউ দিচ্ছি, আর রিজেক্ট হচ্ছি অভিজ্ঞতার অভাবে। এদিকে বাবাও শ্বাস কষ্টের রোগী। চার দিকে সর্ষেফুল দেখছি।
তার মধ্যে আবার এলাকার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটা আমার গার্লফ্রেন্ড। গ্রামের একটা ডিগ্রি কলেজের ১ম বর্ষে পড়ছে নীরা। খুবই রক্ষনশীল পরিবারের মেয়ে। বিকালে পাড়ার মাঠে ক্রিকেট খেলছিলাম। এমন সময় নীরার ছোট ভাই আবির এসে বললো আপু আপনাকে দেখা করতে বলেছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি নীরার সামনে। নিরবতা ভেঙে নীরা বললো,
” আজকে সন্ধ্যায় আমাকে দেখতে আসবে ” আমি হাসতে হাসতে বললাম, ” সুন্দর করে সাজুগুজু করবে, যাতে ছেলে পক্ষ তোমাকে টাকা বাড়িয়ে দেয় ” কারন নীরাকে যত টাকা দিবে সবই আমার পকেটে আসবে। আর কোন না কোন অজুহাতে নীরা বিয়ে ভাঙবেই। এ নিয়ে আমার তেমন চিন্তা করতে হয় না। প্রকৃত পক্ষে তার আগ্রহের কারনেই সর্ম্পকটা টিকে আছে। প্রচন্ড ভালোবাসে মেয়েটা আমাকে। আর আমি যে তাকে ভালোবাসি না তা কিন্তু নয়।
কৈশোর থেকে সদ্য যৌবনে পদার্পন কালে, এক ষোড়শী সুন্দরীর মায়ায় পড়েছিলাম। সে মায়া আজও কাটিয়ে ওঠতে পারি নি। আনুমানিক রাত আটটার দিকে নীরা ফোন দিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বললো, “এই কই তুমি?” “এইতো তোমাদের বাড়ির পাশে, শফিক চাচার দোকানে কেরাম খেলছি ” “এটা ছাড়া তো তোমার আর কোন কাজ থাকে না, জরুরী কথা আছে, তারাতারি পুকুরপাড়ে আসো ” আজকের চাঁদ টা একটু বেশী’ই আলো দিচ্ছে, পুকুরের ঢেউয়ের তালে তালে চাঁদ টাও ঢেউ খেলে যাচ্ছে। পুকুর পাড়েই দাঁড়িয়ে আছে নীরা, মনে হয় কোন এক অপ্সরী পথ হারিয়ে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নেমে এসেছে। বিষন্ন মনে তাকিয়ে আছে পুকুরের দিকে। মুখটা শুকনো শুকনো লাগছিলো। ” কি হলো, এত জরুরি তলব, কোন সমস্যা হয়েছে কি?” আমি জিঙ্গেস করলাম।
নীরা কিছু বলছে না, চুপ করে দাড়িয়ে আছে। আবারও জিজ্ঞেস করলাম, “কি হলো, কিছু বলছো না যে?” “এবার মনে হয় বিয়েটা আর আটকাতে পারবো না। ছেলে সরকারি চাকরী করে। ভালো পরিবারের ছেলে। সব ঠিক থাকলে আগামী মাসেই বিয়ে ” আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না, কি বলা উচিত তা ও জানি না।
“কিছু একটা করো, শামীম। আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে কল্পনাও করতে পারি না ” কথা বলার সময় নীরার কন্ঠটা ধরে আসছিলো। এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলেই কান্না করতে লাগলো। চাপা কান্না। কান্নার এক একটা শব্দ বুকের ভিতর হাতুড়ি পেটা করতে লাগলো। কথাগুলো বলেই উড়না দিয়ে মুখ ঢেকে নীরা আমার সামনে থেকে চলে গেলো। আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম। কি করবো কিছুই মাথায় ঢুকছিলো না।
মনের ভেতর বার বার প্রশ্ন আসতে লাগলো, তাহলে কি আমি নীরাকে হারিয়ে পেলবো..? না!! না!! এক কিছুতেই হতে পারে না!! ওকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। দিন গুলো কেমন জানি বদলে যেতে শুরু করলো, ঠিক মত খেতে পারছি না, ঘুমাতে পারছি না, খেলায়, আড্ডায় কিছুতেই মন বসছে না। প্রতিটা মূহুর্তে তার অস্তিত্ব টের পাচ্ছি। কেমন অগোছালো হয়ে যাচ্ছি। অবশ্য আগেও অগোছালো’ই ছিলাম, নীরার বকাবকিতে’ই একটু পরিপাটি হতে শিখেছিলাম। আর সে নীরাকে’ই হারিয়ে পেলেছি।
দু দিন পর নীরার বিয়ে, শাড়ীতে নীরাকে বেশ মানাতো। খুব যত্ন করে শাড়ী পরে, চোখে কাজল দিতো, নীরার ঐ কাজল কালো চোখের মায়া’ই পরেছিলাম। নীরার কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পরলাম টের’ই পেলাম না। নীরার ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙলো। ওপাশ থেকে নীরা বলে ওঠলো, ” কাল রাতে আমরা পালিয়ে বিয়ে করছি, এ ছাড়া এখন আর কোন পথ নেই। তুমি সব কিছু নিয়ে রেডি থাকো ” আমিও আগে পিছে না ভেবে, “হ্যাঁ ” বলে দিলাম। আমার কাছে জমানো কিছু টাকা ছিলো, এগুলো দিয়ে বিয়ের কাজ সেড়ে যাবে। আর নীরাও হয়তো খালি হাতে বের হবে না।
জমির কাকা’কে বলে দিলাম রাত চারটার দিকে তার নৌকা’টা দিয়ে যেন নদীর ঐ পাড়ে নামিয়ে দেয়। নীরা জমির কাকার নৌকায় অপেক্ষা করবে। এর জন্য জামিল ভাইকে অবশ্য কোন টাকা দিতে হয় না। লোকটা আমাকে বড্ড স্নেহ করে। খুবই মানবেতর জীবনযাপন করে। তবুও কোন অভিযোগ নেই সারাক্ষণ মুখে একটা হাসি লেগেই থাকে। মনে হয় যেন তার কোন দুঃখ নেই। কষ্ট নেই। অথচ কিছু দিন আগেই লোকটার পত্নী গত হয়েছে। সে দিন রাতে আর ঘুমাতে পারলাম না। একটা সিগারেট হাতে নিয়ে, না টেনেই জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছিলাম। আনুমানিক রাত ১২ঃ৩৯ হবে। সারা গ্রাম অঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন। দুজন মানব মানবী চির দিন এক সাথে থাকার প্রহর গুনছে।
এমন সময় পাশের ঘর থেকে মায়ের গগন বিধারী চিৎকার কানে আসলো। তাৎক্ষণিক ছুটে গেলাম। গিয়ে যা দেখলাম, আমি স্থির থাকতে পারলাম না। বাবা আর দুনিয়াতে নেই। বাবার লাশটা জড়িয়ে ধরে মা কাঁদছে। মায়ের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠেছে। বটের ছায়ার ন্যায় বাবা পরিবার’কে আগলে রেখেছিলো। আমি পরিবারের বড় ছেলে। বাবা বিয়োগের কষ্ট নিতে পারলাম না। সে রাতটা ছিলো দুর্বিসহ। ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সমষ্টি। সব কিছু মূর্হতেই উলট পালট হয়ে গেলো। চাপ নিতে পারলাম না।
অন্য দিকে নীরা হয়তো জমির কাকার নৌকায় আমার প্রতীক্ষায় বসে আছে। আর অপেক্ষার প্রহর গুনছে। শেষ রাতে মসজিদের মাইক থেকে মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ভেসে আসলো, ‘ একটি শোক সংবাদ’ নীরাও হয়তো এতক্ষণে জেনে গেছে। সে রাতে আর নীরা’কে নিয়ে পালানো হলো না। আছরের নামাজের পরে বাবার দাফন হলো বাড়ির পাশের গোরস্থানে। আমার কাঁদে বাবার লাশ। বাবার খাটিয়া নিয়ে গোরস্থানে যাচ্ছি। নীরা তখন বেয়ারার কাঁধে করে পালকি দিয়ে স্বামীর বাড়ি যাচ্ছে।
নীরাকে আর আপন করে পাওয়া হলো না৷ হলো না তার সাথে জ্যোৎস্না বিলাশ। হয়তো এ জনমে সে আমার ভাগ্যে ছিলো না। অন্যদিকে বাবা হারানোর ব্যথা সব মিলিয়ে সময় যেন থমকে দাঁড়ালো। নিজকে পৃথিবীর একমাত্র অসহায় মনে হলো। কিছু দিন পরই আমার চাকরী হলো। অথচ চাকরী না হওয়ার জন্যই নীরাকে হারাতে হলো। চাকরী সূত্রে শহরে চলে আসি মাকে নিয়ে। গ্রামে তেমন যাওয়া হয় না। অভ্যস্ত হয়ে গেছি বাস্তবতার সাথে। সময় বদলে যায়, কিন্তু অনুভূতিরা কখনও বদলায় না। মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়ায়, কারো মায়ায়, পাওয়ার প্রতীক্ষায়।
নীরাও হয়তো আমার কথা ভেবে দুফোঁটা চোখের জল বিসর্জন দেয় কোন এক নিস্তব্ধ রাতে কিংবা বিষন্ন সন্ধ্যায়।
দুজন আছি দুজনের ভাবনায়, অথচ যোজন যোজন দূরত্ব আমাদের মাঝে। এতক্ষণ লুকিয়ে লুকিয়ে স্যারের ডায়েরি’টা পড়ছিল, সামিয়া। স্যারের উপস্থিত টের পেয়ে ডায়েরি টা লুকিয়ে ফেললো। ক্লাসের ফাঁকে হটাৎ সামিয়া প্রশ্ন করে ওঠলো,” স্যার, নীরা আপুর সাথে কি পরে আর দেখা হইছিলো?” শামীম প্রশ্ন টা শুনে কিছুটা বিব্রত হয়ে, প্রসংঙ্গ এড়াতে পাল্টা প্রশ্ন করলো, “টাইট্রেশন কাকে বলে?”