রূপা

রূপা

রূপা ভাবী কলা গাছের ভেলার উপর কাঠের পিঁড়িতে কাপড় ধোয়ার জন্য বসল। আমি ছোট নৌকা বেঁয়ে যাচ্ছি বড়শি দিয়ে মাছ ধরার জন্য। আমাকে দেখে রূপা ভাবী আঁচলে চোখ মুছল। দুধে আলতা গায়ের রং। দেখলে মনে হয় এখনো হয়তো বিয়ে হয়নি। বাইশ কিংবা তেইশ হবে বয়স।

-শাওন ভাই, আপনার সাথে সেই ফকির ব্যাটার দেখা হয়েছে? আমি মুচকি হাসি দিয়ে নিজের ক্ষুদ্র ভুল ঢাকার চেষ্টা করলাম। আসলে আমি গঞ্জে যাইনি গত দুইদিন। মাছ যা পেয়েছি তা খাওয়ার জন্যই রেখে দিয়েছিলাম।

-না ভাবী। আমি গঞ্জে যাইনি। দেখি আজ কেমন মাছ পাই। কাল সকালে যেতে পারি। ফকির ব্যাটার সাথে দেখা হওয়া মাত্র আমি তোমার জন্য একটা সূতা নিয়ে আসব।

ভাবী কাপড় রেখে দুই হাত উপরে তুলে দোয়া করলেন, “আল্লাহ, শাওন ভাই যেন আজ অনেক মাছ পায়।”
হাত উপরে তুলতে মাথা থেকে আঁচল গড়িয়ে পড়ল। ভাবী লজ্জারাঙ্গা হয়ে কাপড় মাথায় দিয়ে মুচকি হাসি দিল। আমি নৌকা বেঁয়ে চললাম পূর্ব পাড়ার দিকে।

রূপা ভাবী এই গ্রামে বউ হয়ে এসেছে সাড়ে চার বছর। তার এখনো কোনো সন্তানাদি হয়নি। এই নিয়ে সুমন দু’দিন পরপরই ঝগড়া করে ভাবীকে বাবার বাড়ি চলে যেতে বলে। ভাবী বাবার বাড়ি যায় না ভয়ে। তার ধারণা সে যদি বাবার বাড়ি যায়, সুমন তাকে তালাক দিয়ে নতুন বউ ঘরে তুলবে। গতমাসে ভাবীর এক চাচা নজরপুর বাজারে এসে মতি মিঞার কাছে খবর দিয়ে গেল, ভাবীর বড় ভাইয়ের মেয়ে অনেক অসুস্থ। ভাবী তবুও বাবার বাড়ি যায়নি। তার আগে সংসার ঠিক রাখতে হবে। দিনরাত কান্নাকাটি করে আল্লাহর কাছে একটি সন্তানের জন্য। যার সাথে দেখা হয় তাকেই দোয়া করতে বলে। হাতে আর গলায় ডজনখানেক তাবিজ বাঁধা আছে। সদরে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছে গোপনে। সুমন ভাই ডাক্তার বিশ্বাস করে না। তার ধারণা ডাক্তার হলো কসাই। রোগ না হলেও বড় বড় রোগের নাম বলে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়। সদর হাসপাতালের গাইনী ডাক্তার ভাবীকে বলেছে,আপনার কোনো সমস্যা নেই। আপনার স্বামীকে একবার পরীক্ষা করলে ভালো হতো। ভাবী শুধু একদিন সুমন ভাইকে বলেছিল, চলো আমরা দু’জনেই ডাক্তার দেখাই। দেখি কারো কোনো সমস্যা আছে নাকি।

সুমন ভাই সেদিন ভাবীকে মারধোর করে বলেছিল, “তুই আজই তোর বাবার বাড়ি চলে যা। আমি আরেকটা বিয়ে করে আনব। সন্তান হলে তোকে খবর দেব। তখন বুঝবি কার সমস্যা। আমার চৌদ্দ গুষ্টির মধ্যে কারো কোনো সমস্যা নেই। সবার সাত আটটি করে সন্তান।”

ভাবী সেদিন থেকে আর ডাক্তার দেখানোর কথা বলে না। এই ফকির সেই ফকিরের কাছ থেকে তাবিজ কবজ নিয়ে গলায় আর হাতে দেয়। কারো উছিলায় যদি আল্লাহ একটু দয়া করে। চারদিন আগে রহিমা চাচির কাছে ভাবী শুনল, চাচা নাকি গঞ্জে এক ফকির দেখেছে। তার কাছ থেকে দশ টাকা দিয়ে একটি সূতা কিনে এক নিঃশ্বাসে হাতে বাঁধলে নাকি মনের আশা পূরণ হয়। সেইটা শুনেই ভাবী তিনদিন ধরে আমার কাছে জানতে চায় সেই ফকিরের সাথে দেখা হলো নাকি?

চারটা বড়শি চারদিকে ফেলে রেখেছি। একটা ঠোকর দেয়ারও নাম নেই। বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে হলে চন্ডিদাশের মত ধৈর্য্য থাকতে হয়। চন্ডিদাশ রজকিনীর জন্য বারো বছর বড়শি পেতে বসেছিল। আমার তো বারো মিনিটও হয়নি। তবে আমার কোনো রজকিনী নেই। আমার অপেক্ষা শুধুই মাছের জন্য। বন্যার পানি নেমে যাবার পরও আরো দিন বিশেক অপেক্ষা করতে হবে। তারপর ধানের চারা লাগাতে হবে। আশ্বিনের মাঝামাঝিতে লাগালে অগ্রাহায়নের শেষে ধান ঘরে উঠবে। ধানের এখন নতুন নাম হয়েছে, আটাশ নাকি ঊনত্রিশ যেন। এই ধান খুব দ্রুত ঘরে তোলা যায়। সে পর্যন্ত নুন,পান্তা আর পাতলা ডাল খেয়েই দিন কাটাতে হবে। আমি অত কৃপণ না। মাছ ধরি আমি। আমিই যদি খেতে না পারি সব বিক্রি করে দিয়ে লাভ কী? তাই তো গত দু’দিন গঞ্জে যাইনি মাছ বিক্রি করতে। আজ দেখি মাছ পাই কেমন। রাতে ধরব লাইট মেরে। সকালে যাব গঞ্জে। রূপা ভাবী দোয়া করে দিয়েছে, যেন আমি অনেক মাছ পাই আজ।

সন্ধায় চৌকির খুঁটির নিচে আরো একটি করে ইট দিলাম। মনে হচ্ছে পানি নামার আগে শেষবারের মত আরেকটু বাড়তে পারে। পাঠকাঠি দিয়ে রেখেছিলাম পানিতে দু’দিন আগে। দেখার জন্য পানি কমে নাকি বাড়ে। আজ বাড়তির দিকে। মা’কে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে নিজেকে বুদ্ধিমান লাগছে। বাবা মারা যাবার পর আমাকে নিয়ে মা অনেক কষ্ট করেছেন। লোকজন জমিতে ফসল ফলিয়ে তিন ভাগের এক ভাগ দিত। এখন তো আমিই ফসল করি। মা’কে শেষ বয়সে আর কষ্ট দিতে চাইনি বলেই মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। বন্যার পানি কমে গেলে নিয়ে আসব। মামা আমাকেও যেতে বলেছিল। কিন্তু আমি যাইনি। মামার স্বভাবে একটু দোষ আছে। খাওয়াবে, পরাবে কিন্তু আবার সেটা বারবার বলবে, আমি খাওয়াইছি আমি পরাইছি। আমার এসব শুনতে ভালো লাগে না। মামা তার বোনকে খাওয়াক। আমি এই বন্যার মাঝেও ভালো আছি। ঘরটা শুধু একটু পুরাতন। এবার অগ্রাহায়নের ফসল ঘরে তুলেই বড় একটি ঘর তুলব। জোনাকি আশায় আছে, আমি তাকে নতুন ঘরে বউ করে আনব।

জোনাকি আমার বড় খালার মেয়ে। শ্রীনগরে তাদের বাড়ি। তাদের এলাকায় বন্যার পানি বাড়ি উঠেনি। আমাদের নজরপুর ইউনিয়নের গ্রামগুলো একটু নিচু। একটু ভারী বৃষ্টি হলেই চারিদিকে নদীর মত মনে হয়। খালু আমাকে দুই চোখে দেখতে পারে না জোনাকি কে ভালোবাসার অপরাধে। খালু মনে করেন নীকট আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে হলে পরবর্তীতে ছেলে মেয়ে হবে প্রতিবন্ধী। খালা আমাকে খুব আদর করেন। আমাকে নিয়ে অসংখ্যবার খালুর সাথে ঝগড়াও করেছেন। বাবার বাড়ি অর্থাৎ আমার নানার বাড়ি চলেও যেতে চেয়েছেন। খালু এই বয়সে মানসম্মান যাবে ভেবে প্রতিবারই ঝগড়ায় খালাকে জিতিয়ে দিয়েছেন। খালা বলেছে, “আমার বোনের ছেলের কাছেই আমার মেয়েকে বিয়ে দেব। শাওন শুধু ঘরটা বানিয়ে ফেলুক। আমিও রাজী আমার মেয়েও রাজী। তুমি একা জোর করে কিছু করতে পারবে না।”

খালু রাগে ফোঁস ফোঁস করে শুধু বলত, আমি কী করতে পারি তা সময়ই বলে দিবে। গঞ্জে মাছ বিক্রি করেছি একশত নব্বই টাকা। গত এক সপ্তাহের তুলনায় আজকে একটু বেশিই বিক্রি করেছি। রূপা ভাবী গতকাল দোয়া করেছিল, যেন মাছ বেশি পাই। টাকা পকেটে নিয়েই সেই ফকির বাবাকে খুঁজছি। ভাবীর জন্য একটা সূতা কিনে নিয়ে যেতে হবে। ভাবীর এত মায়াবী চেহারা দিয়েও শ্বশুর বাড়ির মন পায় না একটি সন্তানের জন্য। প্রতিবেশী সুমন ভাইয়ের সাথে বিয়ে না হয়ে যদি রূপা ভাবীর আমার সাথে বিয়ে হতো কত আদরেই না রাখতাম। ফুলকে অযত্ন আর অবহেলা করতে হয় না।

রূপা ভাবী তেমন একটি ফুল। ফুটন্ত লাল গোলাপ। যে লোককে খুঁজে পেয়েছি তাকে দেখে লাল বয়াতী মনে হল। সারা শরীরে লাল পোশাক। কাঁধে একটি লাল শালু। এমনকি তার জট পাকানো চুলেও ছোট ছোট লাল ফিতে লাল চুমকিতে ভরপুর। হাতে একটি অদ্ভুত জিনিস। চিকন বাঁশ চিঁড়ে এই অদ্ভুত জিনিসটি তৈরী করা হয়েছে। তাতে অসংখ্য চিকন দড়ি টানানো। সেই দড়িতে ঝুলছে হরেক রকমের লাল সূতা, রাবারের চুড়ি, ঝিনুক যা কড়ি নামে চিনি। তাছাড়াও আছে ছোট ছোট ঝুনঝুনি। বাচ্চাদের কোমরে এই ঝুনঝুনি ব্যবহার করা হয়। তিনি আমার কাছ থেকে সূতার দাম রাখলেন পাঁচ টাকা। তাই একটি ঝুনঝুনিও কিনে নিলাম পাঁচ টাকায়। রূপা ভাবীর হাতে দিয়ে বলব এই নাও সূতা বাঁধো, ফকির বাবার দেয়া সূতা। আর বাচ্চা হলেই তার কোমরে এই ঝুনঝুনি বেঁধে দিবা। আমি জানি রূপা ভাবী আনন্দে কেঁদে দিবে।

শ্রীনগরের কাওছারের সাথে দেখা হয়ে গেল। সে আমার ঘনিষ্ট একজন। পরিচয়টা ছোটবেলা থেকেই। যতবার খালা বাড়ি গিয়েছি কখনো তার সাথে দেখা না করে আসিনি। খালাদের বাড়ি গেলে সেই ছোটকাল থেকে কাওছার ছিল আমার সঙ্গী ও খেলার সাথী। হাইস্কুলে পড়ার সময় গাছ থেকে পড়ে তার হাত ভেঙ্গে যায়। সদরে নিয়ে চিকিৎসা করানোর মত ইচ্ছে বা সামর্থ্য কোনোটাই ছিল না কাওছারদের। এখনো তার বা হাতটি কেমন বাঁকা হয়ে আছে। আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি অনেক চেষ্টা করেছি তোর সাথে দেখা করার জন্য। এসে দেখি তোদের এলাকায় পানি। আমার তো নৌকা, ভেলা কিছু নেই। তাই যেতে পারিনি। ঐদিকে বড় অঘটন ঘটে গেছে তোর খালার বাড়িতে। কেউ কি তোকে কিছু বলেছে? কিছু জানিস?” আমার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠে। কাওছারকে নিয়ে গঞ্জ ছেড়ে ফাঁকা রাস্তায় এলাম। বল কাওছার, কী হয়েছে?

-তুই দেখছি কিছুই জানিস না। একটু শক্ত কর মনটাকে। তুই তো মাস খানেক হল তোর খালার বাড়ি যাস না। তোদের এলাকায় বন্যার পানি সেটা না হয় বুঝলাম, তোর খালাদের এলাকায় তো পানি নেই।
-কী হয়েছে সেটা বল না।
-জোনাকির বিয়ে হয়ে গেছে।
-যা, এতদিন পর দেখা হয়েছে বলে এভাবে মজা নিস না।
-মজা না, আমি সত্যি বলছি শাওন।

আমি দাঁড়ানো থেকে বসে পড়লাম। জোনাকির বিয়ে হয়ে গেল অথচ আমি জানব না কেন? আমাদের বাড়ি তো অন্তত দাওয়াত দেয়ার কথা। কাওছার আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, দেখতে এসেছিল জোনাকিকে চারদিন আগে। তোর খালু বিয়ে দিয়ে দিল। তোর খালা চায়নি বিয়ে দিতে। তোর খালা রাগ করে ঝগড়া লেগে তোর নানার বাড়ি চলে গেছে। জোনাকির কিছু করার ছিল না। এই যুগে এসেও তোর কাছে ফোন নেই। যদিও আমার কাছেও নেই। ফোন থাকলেও অবশ্য খবরটা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বাড়ি গিয়ে নৌকা থেকে ঘরে যাইনি। নৌকায় বসে গাছে হেলান দিয়ে বসে আছি। আমার চোখ ভরে পানি এল। সেই পানি দেখার মত কেউ নেই। চারিদিকে বন্যার এত পানি, আমার চোখের পানি দেখার সময় কোথায় মানুষের? ১৯৮৮ আর ১৯৯৮ এর পর এবারের ২০০৪ সালের বন্যা বড় আঁকার ধারণ করেছে। আমার চোখেও বন্যার অবনতি হচ্ছে। গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। চোখের পানি বন্যার ঘোলা পানিতে একাকার।

-শাওন ভাই, তুমি না গঞ্জে গিয়েছিলে? দেখা হয়েছে ফকিরের সাথে?

রূপা ভাবী কলস নিয়ে ভেলায় চড়ে পানি আনতে যাচ্ছে বড় বাড়ি। আমার দিকে তাকিয়ে আছে ভালো কিছু শোনার জন্য। তার জন্য ভালো খবর আছে আমার কাছে। আমি ছোট পুঁটলি বের করলাম নৌকা থেকে। ভিতর থেকে বের করলাম সূতা আর ঝুনঝুনি। রূপা ভাবী আনন্দে আত্মহারা। কলার ভেলা নিয়ে এল আমার কাছে। সূতাটি নিয়ে দুই চোখ স্পর্শ করিয়ে তিনবার চুমো খেল। আমার দিকে তাকাতে পারছে না, তার চোখ ছলছল। আমি ঝুনঝুনিটি এগিয়ে দিয়ে বললাম, “তোমার ছেলে মেয়ে হলে কোমরে এই ঝুনঝুনি বেঁধে দিবা। যেন কয়েক ঘর পর্যন্ত শুনলেই বুঝতে পারে এটা রূপা ভাবীর সন্তান।”

এবার আর রূপা ভাবী কান্না থামাতে পারলেন না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। আমি নৌকা ঘুরিয়ে ঘরের দরজায় চলে এলাম। রূপা ভাবীও কাঁদুক আমার মতো। তবে আমি তো কাঁদি হারানোর দুঃখে সে কাঁদবে কিছু পাওয়ার আশায়।
কার্তিক মাসে পানির টান পড়েছে। অনেকেই বলছে, পানি এবার বুড়ো হয়েছে। পানির যৌবন ফুরিয়ে পাকা রং ধরেছে। এবার তার যাওয়ার পালা। সেই কার্তিকের এক সন্ধায় আমাদের গ্রামে এক অঘটন ঘটে গেল। সুমন রূপা ভাবীকে তালাক দিলেন। রূপা ভাবি ঝগড়া লেগে বললেন, আমি সদর থেকে পরীক্ষা করেছি। আমার কোনো সমস্যা নেই। তোমার সমস্যা, তুমি চিকিৎসা করাও। তোমার দোষ আমার উপর গছিয়ে দাও কেন?

সুমনকে না জানিয়ে সদরে গিয়ে পরীক্ষা করানোর অপরাধে রূপা ভাবীকে তালাক দিয়ে দিল। রাত অবধি সময় দেয়া হল। সন্ধা পেরিয়ে গেছে, এখন যাবে কিভাবে? সুমন রূপা ভাবীকে সকালে বাবার বাড়ি চলে যেতে বলল। সে কাগজগুলো পাঠিয়ে দেবে। রাতটা যে রূপা ভাবীকে এই বাড়িতে থাকতে দিয়েছে সেজন্য সুমন নিজেকে বড় মনের মানুষ হিসেবে গর্ব করছে। তালাক হবার পর একজন আরেকজনের মুখ দেখাও পাপ। তাই সুমন আজ ঘরেই থাকবে, রূপা রাত কাটাবে কলা গাছের ভেলায়। সকালে সুমনের ঘুম ভাঙ্গার আগেই রূপাকে চলে যেতে হবে।
রাতে জাল থেকে মাছ আনতে গিয়েছিলাম।

এখন পানির টান লেগেছে। জালে অনেক মাছ লেগে থাকে। এভাবে প্রতিদিন মাছ পেলে বন্যার পানি না কমলেও আমার আপত্তি থাকার কথা নয়। এখন আর ঘর বানানোর তাড়া নেই আমার। সেই ঘরে থাকার জন্য জোনাকি নেই। জোনাকি এখন অন্যের ঘরে। পানি আরেকটু কমলে মা’কে নিয়ে আসব। মা সদরে মামার বাড়িতে থাকায় হয়তো জানে না খালা রাগ করে তারই বাবার বাড়ি গিয়ে বসে আছে।
লাইট মেরে বাড়ি ফিরছি ব্যাগ ভর্তি মাছ নিয়ে। সকালে গঞ্জে যাব বিক্রি করতে। লাইটের আলোতে কিছু একটা দেখে চমকে উঠলাম। ভালোভাবে দেখার জন্য আবারো লাইট মারলাম। ঘটনা সত্যি। ভেলায় দাঁড়িয়ে রূপা গাছে ওড়না বাঁধছে। বড় একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে মেয়েটা। সকালেই নৌকা ভর্তি পুলিশ আসবে। আমি দ্রুত বৈঠা মারলাম।

-ভাবী কী করছ তুমি। থামো বলছি।
-শাওন ভাই তোমার পায়ে ধরি বাঁধা দিও না। তুমি বাড়ি যাও।

ওড়না বাঁধা শেষ। এখন শুধু গলায় পেঁচিয়ে ঝুলে পড়া বাকি। ঘরে ফাঁসি নিলে পায়ের নিচ থেকে টোল বা চেয়ার সরিয়ে ঝুলে পড়তে হয়। এখানে রূপা ভেলা সরিয়ে দিয়ে ঝুলে পড়বে। আমি নৌকায় থেকে গাছের ডালের ওড়না খোলা শুরু করলাম। ওড়নার আরেক মাথা রূপার গলায়। রূপা আমাকে ধাক্কা দিল। আমি নৌকায় পড়ে গেলাম। ঝাঁকি খেয়ে নৌকায় কিছু পানি উঠে গেল। আমি আবার উঠে রূপাকে চড় দিলাম। দিনের বেলা হলে দেখতে পেতাম ফর্সা গালে আমার চড়ের দাগ হয়ে গেছে। রূপা চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওড়না খোলে দিলাম।

-কার কাছে যাব আমি? বাবা মা মারা গেছে আমার কবেই। ভাইয়ের সংসারে ভাবীর জ্বালাতনের জন্য বিয়ের পর শুধু একবার গিয়েছি। আজ থেকে এই বাড়িও আমার জন্য নিষেধ হয়ে গেল। আমার তো যাওয়ার জায়গা নেই শাওন ভাই। আমার উপরে যাওয়া ছাড়া আর জায়গা নেই।

-আমার ছোট ভাঙ্গা ঘরে থাকবা? পানি নেমে গেলে তোমাকে বড় ঘর বানিয়ে দেব।

কথাটুকু বলে অন্যদিকে তাকিয়ে আছি। লাইট একনাগারে জ্বলে আছে। কারো মুখে কথা নেই। রূপা বলল, সবার ঘরে যাওয়া যায় না। সমাজের স্বীকৃতি লাগে। আমি নৌকা থেকে ভেলায় পা বিছিয়ে দিলাম। নৌকা একপাশে কাত হয়ে আছে। রূপার হাত টেনে নিয়ে বললাম, উপরে যাওয়ার চেয়ে আমার ঘরে যাওয়া ভালো। আমি দেব তোমাকে স্বীকৃতি। আমার বউ হবে? লাল টুকটুকে বউ।

-আমি বুঝতে পারছি না শাওন ভাই আমার কী করা উচিত। আমি দয়ার পাত্রী হয়ে কেন থাকব?
-আর ভাই বলবে না, শুধু শাওন। আর দয়া নয়, ভালোবাসা দিয়েই রাখব।

রূপা আবার কাঁদছে। তবে এবারের কান্নায় শব্দ নেই। চোখ বেঁয়ে পানি নামছে বন্যার পানিতে মিশার জন্য। বন্যার পানিরে, রূপার চোখের পানি চিরদিনের জন্য ভাসিয়ে নে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত