সর্প

সর্প

আবু সালেহ সাহেবের ঘুম ভেঙে গেল দুঃস্বপ্ন দেখে। এরকম দুঃস্বপ্ন তিনি ইদানীং প্রায়শই দেখেন। স্বপ্নের বর্ণনা একেক রকম তবে বিষয়বস্তু এক। আজ যে স্বপ্ন দেখেছেন তার সারসংক্ষেপ হল, তিনি পার্কে হাঁটতে গেছেন। তাঁর বয়সী এক ভদ্রলোক হঠাৎ তাঁর পাশাপাশি হাঁটতে লাগলেন। হাই-হ্যালো করে কথা বলতে লাগলেন দুজন। হঠাৎ লোকটা সাপ হয়ে তাঁকে তাড়া করতে লাগল। সালেহ সাহেব দৌড়াচ্ছেন। দৌড়াতে দৌড়াতে তিনিও হঠাৎ সাপ হয়ে গেলেন। এটুকু দেখেই তাঁর ঘুম ভেঙে গেছে। তার প্রত্যেকটা স্বপ্নের বিষয়বস্তু থাকে সাপ। কখনো সাপের তাড়া খাচ্ছেন বা কখনো নিজেই সাপ হয়ে অন্যদের তাড়া করছেন।

আবু সালেহ সাহেবের স্ত্রী আয়েশা মরার মত ঘুমোচ্ছে। সালেহ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাট থেকে নামলেন। জগে পানি নেই। পানি তো থাকার কথা।।আয়েশা এটা নিয়মিত করে, তার তো ভুল হওয়ার কথা নয়। অগত্যা রান্না ঘরে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নাই। তার জন্য লাইট অন করতে হবে। এক দুঃস্বপ্ন ওত ঝামেলা সৃষ্টি করে!

বারান্দায় কাঠের ইজিচেয়ারে বসলেন সালেহ সাহেব। হালকা দুলতে লাগলেন। কাঠের চেয়ারে কচকচ শব্দ হচ্ছে। এই শব্দও এখন বিরক্তিকর লাগছে। ঘর থেকে সিগারেট এনে বারান্দায় মেঝেতে বসে পড়লেন তিনি। সিগারেট টানছেন আর দুঃস্বপ্নের কথা ভাবছেন। যদিও তিনি জানেন এইসব স্বপ্নের কোন ব্যাখ্যা তাঁর জানা নেই। তবুও ভাবছেন। ফজরের আজান হতে খুব বেশি দেরী নেই। আজান হলে তিনি নামাজে যাবেন। সালেহ সাহেব দুই ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত পড়েন। ফজর আর মাগরিব।

বাকি সময়গুলো কখনো পড়া হয়, কখনো হয় না। সাপ নিয়ে ভাবতেন শুরু করলেন তিনি। প্রথমেই মাথায় এলো সাপের আর কী কী নাম আছে। সর্প, নাগ, ভুজঙ্গ, আশীবিষ সালেহ সাহেব আর মনে করতে পারলেন না, মাথায় চাপ পড়ছে। মসজিদের মাইক থেকে ভেসে এল আজানের ধ্বনি। সালেহ সাহেব উঠে ওযু করে নামাজের জন্য মসজিদের দিকে রওনা দিলেন।মধ্যবয়সী ইমাম। চেহারার মধ্যে এমন একটা ভাব আছে যেন তিনি অনেক কিছু জানেন। নামাজ শেষে সবাই চলে যাওয়ার পর আবু সালেহ সাহেব ইমামকে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা ইমাম সাহেব, সাপ বিষয়ে কিছু বলেন। কথা শুনে ইমাম সাহেবের মুখ পানিশূন্য হয়ে গেল। তিনি বললেন, বুঝলাম না। কী বললেন?

-সাপ নিয়ে কিছু বলেন।
-কেমন?
-মানে আমাদের ধর্মে সাপ.. যেমন কোন পাপ করলে কবরে সাপে কামড়ায় এই আর কী। আবার কোন এক নবীর লাঠি সাপ হয়ে যেত।
-ও আচ্ছা। হাদিসে আছে,

কোন নারী যদি তার চুল বের করে চলাফেরা করে তবে সেই চুল সাপ হয়ে সেই নারীকে দংশন করবে। আর হযরত মুসা আঃ এর একটা বিশেষ লাঠি ছিল। আল্লাহ তাকে অলৌকিক ক্ষমতা দিয়েছিল যে সেই লাঠি সাপ হয়ে যেত। ফেরাউনের সাপকে মুসা আঃ এর লাঠি থেকে হয়ে যাওয়া সাপ খেয়ে ফেলেছিল।
সালেহ সাহেবের মাথায় একটা জিনিস ঢুকছে না সাপে সাপ খায় কেমনে?

আবু সালেহ সাহেব নয়টার মধ্যেই অফিসে চলে আসেন। তিনি কাউকে অফিসে দেরী করে আসার জন্য বকা দেন না। সাধারণত কেউ দেরী করে না। মালিক যেখানে আগেই উপস্থিত হয় তখন কর্মকর্তা, কর্মচারীদের আরও আগেই আসতে হয়। তিনি চেয়ারে বসতেই পিওন চিনি ছাড়া এক কাপ চা দিয়ে যায়। আজ চা আসার আগেই ম্যানেজার এসে বলল, স্যার, আশিষ বিশ্বাস আপনার সাথে পারসোনাল মিটিংয়ের জন্য এসেছেন। সালেহ সাহেব চমকে উঠে বললেন, আশীবিষ?

-সরি স্যার, আশিষ বিশ্বাস।
-ও আচ্ছা। পাঠিয়ে দেন।

ম্যানেজার কপাল ভাঁজ করে বেরিয়ে গেল। সে প্রথমবার আশীবিষ বলেছিল নাকি আশিষ বলেছিল? এরকম ভুল তো তার হওয়ার কথা নয়। ম্যানেজার বের হতেই চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সালেহ সাহেব। তিনি কি ভুল শুনেছিলেন নাকি ম্যানেজার..? না, না। ম্যানেজারের এরকম ভুল হওয়ার কথা না। আশিষ বিশ্বাস বসে আছেন সালেহ সাহেবের সামনে। এত সকালে মিটিং শুরু করতে ইচ্ছে করছে না। তবুও না করে উপায় নেই। আশিষ সাহেব বললেন, আমরা আপনার কোম্পানির প্রোডাক্ট নিতে রাজী তবে কিছু শর্ত থাকবে। কপাল কুঁচকে তাকালেন আশিষ সাহেবের দিকে। ‘সর্প’ থাকবে মানে? তিনি কি সাপুড়ে যে সর্প থাকবে? নাকি সাপের বিজনেস করছেন? তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী বললেন?

-বলছিলাম, কিছু শর্ত মানে কন্ডিশন থাকবে।
-ও আচ্ছা। হ্যাঁ, শর্ত তো থাকবেই। বলেন কী কী শর্ত?

আশিষ সাহেব শর্ত বলছেন। কিন্তু কোন শব্দই আবু সালেহ সাহেবের কানে ঢুকছে না। তাঁর সামনে বসে থাকা আশিষ সাহেবকে মনে হচ্ছে কোন সাপ যে ফোঁসফোঁস করে জিহ্বা বের করে কথা বলছে। আশিষ বিশ্বাস বুঝতে পারলেন আবু সালেহ অন্যমনস্ক। শ্রোতা যদি অন্যমনস্ক থাকে, তাহলে কথা বলে আরাম পাওয়া যায় না। আশিষ সাহেব কথা চালিয়ে যাবেন নাকি থেমে যাবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি হঠাৎ থেমে গেলেন। সালেহ সাহেব বললেন, ওকে। আপনি আপনার শর্তসমুহের লিখিত কপি ম্যানেজারকে দিবেন।

-ওকে, তাহলে উঠি?
-ব্যস্ত না থাকলে একটু বসুন।
-না। ব্যস্ত নেই।
-আচ্ছা, আপনাদের ধর্মের একটা ব্যাপারে জিজ্ঞেস করব যদি কিছু মনে না করেন।
-না, অবশ্যই জিজ্ঞেস করবেন। আমি জানলে অবশ্যই বলব।
-আপনাদের মনসা দেবী তিনিও তো সাপ, তাই না?
-হ্যাঁ।
-বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের কাহিনী যদি একটু বলতেন।
-ওটা তো অনেক বড় কাহিনী।
-সংক্ষেপে বলেন।
-আচ্ছা।

আশিষ সাহেব শুরু করলেন, চাঁদ সওদাগরের পুত্র লখিন্দর ও তার ব্যবসায়ীক বন্ধু সতীর্থ সাহার কন্যা বেহুলার জন্ম হয় সমসাময়িক কালে। দুটি শিশুই একসাথে বেড়ে ওঠে এবং একে অপরের জন্য সম্পূর্ণ উপযুক্ত বলে গণ্য হয়। লখিন্দরের পিতা চন্দ্রবণিক বা চাঁদ সওদাগর ছিলেন হিন্দু দেবতা শিবের একনিষ্ঠ পূজারী। তাই তিনি অন্য কোন দেবতার আরাধনা করতেন না। অপরদিকে শিবের কন্যা মনসা ছিলেন সর্পদেবী, কিন্তু তিনি কোথাও পূজিতা হতেন না। তাঁর পিতা শিব তাঁকে বলেন যে যদি কোন ভক্তিমান শৈব (শিবের উপাসক) প্রথম মনসার পূজা করেন তাহলেই মর্ত্যে তাঁর পূজার প্রচলন সম্ভব।

তখন মনসা চাঁদ সওদাগর কে নির্বাচন করে তাঁকেই অনুরোধ করেন মনসা পূজার আয়োজন করার জন্য, কিন্তু শিবের উপাসক চাঁদ সওদাগর মনসার প্রস্তাবে অস্বীকৃত হন। তখন ক্রোধোন্মত্ত মনসা তাঁকে শাপ দেন যে তাঁর প্রত্যেক পুত্রের জীবন তিনি বিনাশ করবেন। মনসার শাপে এইভাবে একে একে লখিন্দর ব্যতীত চাঁদ সওদাগরের সকল পুত্রই সর্পদংশনে নিহত হয়। তাই লখিন্দরের বিবাহের সময় চাঁদ সওদাগর অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে দেবতা বিশ্বকর্মার সাহায্যে এমন বাসর ঘর তৈরি করেন যা সাপের পক্ষে ছিদ্র করা সম্ভব নয়।

কিন্তু সকল সাবধানতা স্বত্ত্বেও মনসা তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সমর্থ হয়। তার পাঠানো একটি সাপ লখিন্দরকে হত্যা করে। প্রচলিত প্রথা অনুসারে যারা সাপের দংশনে নিহত হত তাদের সত্‌কার প্রচলিত পদ্ধতিতে না করে তাদের মৃতদেহ ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হত এ আশায় যে ব্যক্তিটি হয়ত কোন অলৌকিক পদ্ধতিতে ফিরে আসবে। বেহুলা সবার বাঁধা অগ্রাহ্য করে তার মৃত স্বামীর সাথে ভেলায় চড়ে বসে। তারা ছয় মাস ধরে যাত্রা করে এবং গ্রামের পর গ্রাম পাড়ি দিতে থাকে। এই অবস্থায় মৃতদেহ পঁচে যেতে শুরু করে এবং গ্রামবাসীরা তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন মনে করতে থাকে। বেহুলা মনসার কাছে প্রার্থনা অব্যাহত রাখে। তবে মনসা ভেলাটিকেই কেবল ভাসিয়ে রাখতে সাহায্য করে।

একসময় ভেলাটি মনসার পালক মাতা নিতার কাছে আসে। তিনি নদীতীরে ধোপার কাজ করার সময় ভেলাটি ভূমি স্পর্শ করে। তিনি মনসার কাছে বেহুলার নিরবচ্ছিন্ন প্রার্থনা দেখে বেহুলাকে তার কাছে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে চোখের পলকে বেহুলা ও মৃত লখিন্দরকে স্বর্গে পৌঁছে দেন। মনসা বলেন, তুমি তাকে (লখিন্দর) ফিরে পাবার যোগ্য, কিন্তু এটি কেবলি সম্ভব হবে যদি তুমি তোমার শ্বশুরকে আবার আমার পূজারী করতে পার।

“আমি পারব,” বেহুলা জবাব দেয় এবং সেই সাথেই তার স্বামীর মৃতদেহে জীবন ফিরে আসতে শুরু করে। তার ক্ষয়ে যাওয়া মাংস ফিরে আসে এবং লখিন্দর তার চোখ মেলে তাকায়। এরপর লখিন্দর বেহুলার দিকে তাকিয়ে হাসে। তাদের পথপ্রদর্শক নিতাকে নিয়ে তারা পৃথিবীতে ফিরে আসে। বেহুলা তার শাশুড়ির সহযোগীতায় চাঁদ সওদাগরকে মনসার উপাসনা করতে সম্মত করেন। এতক্ষণ একনিষ্ঠ মনযোগে শুনছিলেন আবু সালেহ সাহেব। বেশ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের কোন এক দেবতার গলায় সাপ ঝুলানো থাকে, ওটার কারণ কী? আশিষ বিশ্বাস বললেন, মহাদেব শিব নিজের গলায় সাপ পেঁচিয়ে রাখেন।

-কেন?
-এটার সঠিক কারণটা আমার এই মুহূর্তে জানা নেই।
-ওকে, সমস্যা নেই।
-কোন দরকারে জিজ্ঞেস করছেন?
-না। এমনিতেই একটু আগ্রহ।
-ভাল লাগল। কোন কিছু জানার থাকলে অবশ্যই বলবেন।
-ওকে।

আশিষ সাহেব বেরিয়ে গেলেন। আবু সালেহ সাহেবের মাথায় তখন ঘুরছে বেহুলা লখিন্দরের কাহিনী। বিকেলে বাসায় ফিরে আবু সালেহ সাহেব গোসল, লাঞ্চ করে টিভির সামনে গেলেন। ছোট মেয়েটা টিভিতে কার্টুন দেখছে। রিমোট নিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করতেই একটা বাংলাদেশি চ্যানেল এল। সেখানে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ সিনেমা হচ্ছে। নায়িকা অঞ্জু ঘোষ বীন বাজাচ্ছে আর একটা সাপ জঙ্গল, নদী পার হয়ে ছুটে আসছে। সাপের সিনেমা দেখতে ভাল লাগছে না। চ্যানেল চেঞ্জ করতে ভারতীয় চ্যানেল। এখানে আরও ভয়াবহ অবস্থা। সিনেমার নায়িকা উদ্ভট ধরণের ড্রেস পরা। সাপের মত পেঁচানো ড্রেস।

হাত মাথার উপর করতেই মুহূর্তের মধ্যে সে সাপ হয়ে গেল। বিরক্তিকর ব্যাপার। চ্যানেল চেঞ্জ করতে করতে একটা ইংলিশ চ্যানেলে এল। এখানে তো আরও ভয়ানক অবস্থা। বিশাল বড় একটা সাপ একটা মানুষকে আস্ত গিলে ফেলল। চ্যানেলটা চেঞ্জ করতেই ছোট মেয়ে সাবা বলল, আব্বু, চেঞ্জ কর না। এটা এনাকোন্ডা। এটা দেখব। সাবা বেশ আগ্রহ নিয়ে ‘এনাকোন্ডা’ দেখছে। সালেহ সাহেবের কিঞ্চিত ভয় লাগছে। কিছুটা ঘেন্নাও লাগছে এইতো, এইমাত্র যে লোকটাকে আস্ত গিলে ফেলেছিল, এখন সেই আস্ত মানুষটাকে পেট থেকে বের করে ফেলল। টিভিতে এই দৃশ্য দেখতে ভাল লাগছে না আবু সালেহ সাহেবের। তিনি উঠে নিজের শোবার ঘরে চলে গেলেন।

খাওয়াদাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়লেন আবু সালেহ সাহেব। লাইট অফ করে দিল আয়েশা। তখনি আবু সালেহ সাহেবের মনে হচ্ছে বিছানায় শীতল, নরম কিছু তাঁর পিঠের সাথে লেগে আছে। কাছে এসে আয়েশা বলল, তুমি সাপের মত মোচড়াচ্ছ কেন? সাপের কথা শুনতেই লাফ দিয়ে উঠলেন সালেহ সাহেব। তখনি তার মনে হল বিছানায় সাপ আছে। খাট থেকে নেমে লাইট জ্বালিয়ে দেখলেন কোথাও কোন সাপ নেই। ঘেমে একাকার হয়ে গেছেন সালেহ সাহেব। আয়েশা কিছুই বুঝতে পারছে না যে সালেহ সাহেব কী খুঁজছে।

-এই, তুমি এইভাবে পাগলের মত কী খুঁজছ?
-কিছু না। তুমি একটু আগে কী যেন বলেছিলে?
-কী বলেছিলাম?
-মোচড়ানো না কী যেন?
-বলছিলাম তুমি সাপের মত মোচড়াচ্ছ কেন?
-আমি সাপ? আমি সাপের মত মোচড়াচ্ছি? আমাকে দেখতে কি এনাকোন্ডার মত লাগে?
পাশের ঘর থেকে সাবা উঠে এল। সাবাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, বল তো মামনি, আমি দেখতে সাপের মত?
-না তো আব্বু।

উত্তেজিত হয়ে গেলেন আবু সালেহ। মেয়ের সামনে কী বলছেন বুঝতে পারছেন না।
আয়েশা আস্তে নরম স্বরে বলল, তোমার কী হয়েছে, বল তো? তুমি শুধুশুধু রাগে ফোঁসফোঁস করছ কেন?

-আমি রাগে ফোঁসফোঁস করছি কারণ আমি সাপ। আবু সালেহ জিহ্বা বের করে সাপের মত করলেন। আর মুখ দিয়ে ফোঁসফোঁস শব্দ করছেন। ফোঁস, ফোঁস, ফোঁস।

আয়েশা সালেহ সাহেবকে ধরে বাথরুমে নিয়ে গেল। তার মাথায় পানি ঢালতে হচ্ছে। হয়তো কোন ব্যাপারে খুব চিন্তা করছে সেইজন্য মাথা গরম হয়ে আছে। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে সালেহ সাহেব আয়নার সামনে আসতেই দেখলেন প্রতিবিম্বে তার চেহারার পরিবর্তে একটা কালো কুচকুচে সাপের মুখ। ভয়ে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলেন আবু সালেহ সাহেব। সকালে ঘুম ভাঙার পর সালেহ সাহেব রাতের কোনকিছু মনে করতে পারলেন না। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছেন তিনি অস্বাভাবিক কোন আচরণ করেছিলেন যার বিষয়বস্তু ছিল সাপ। তিনি বারান্দায় এসে আয়েশাকে বললেন, এক কাপ চা দাও তো। আয়েশা বলল, তোমার শরীর ঠিক আছে এখন?

-হ্যাঁ। আর গত রাতের জন্য সরি। আমি জানি না কী বলেছিলাম, তবে অস্বাভাবিক আচরণ করেছি এটুকু মনে হচ্ছে। আমি খুবই দুঃখিত। সাবা কোথায়?

-ও স্কুলে গেছে। তোমার আজ অফিসে যাওয়ার দরকার নেই।
-আচ্ছা। যাও, চা নিয়ে আসো।

আয়েশা চলে যাওয়ার পর বাইরের দিকে তাকালেন সালেহ সাহেব। মাটিতে পড়ে থাকা একটা লাঠিকে তিনি সাপ দেখছেন। তিনি নিজেকে বুঝ দিচ্ছেন যে ওটা সাপ নয়, ওটা লাঠি। চোখ বন্ধ করে আবার তাকালেন। না আবারও সাপ দেখলেন। এভাবে চোখ বন্ধ করছেন, চোখ মেলছেন, প্রতিবারই সাপ দেখছেন। সাপটা নড়ছে না। আয়েশা চা নিয়ে এসে দেখে সালেহ সাহেব চোখ বন্ধ করছে, চোখ খুলছে। আয়েশা জিজ্ঞেস করল, তোমার চোখে কোন সমস্যা হয়েছে?

-না।
-তাহলে এরকম করছ কেন?
-বাইরে দেখ তো সাপটা চলে গেছে কি না। আয়েশা বাইরে তাকিয়ে দেখল কোন সাপ নেই।
-হ্যাঁ, চলে গেছে তো। এখানে সাপ আসবে কোথা থেকে?

তার উত্তর না দিয়ে সালেহ সাহেব আবারও বাইরে তাকালেন এবং দেখলেন সাপটা এখনো আছে। এবার স্থির নেই। কোমর বাকিয়ে আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে। আয়েশাকে আর এ ব্যাপারে কিছু বললেন না। নিজেই বুঝলেন যে তার কোন মানসিক সমস্যা আছে। আজ অফিসে যাবেন না তবে একটা জায়গায় যাবেন বলে ঠিক করছেন সালেহ সাহেব। শার্ট, প্যান্ট পরে আয়েশাকে বললেন, টাই বেঁধে দাও তো। আয়েশা টাই বেঁধে দেওয়ার জন্য কাছে আসতেই সালেহ সাহেব দেখলেন আয়েশার হাতে একটা সাপ। সালেহ সাহেব বুঝতে পারছেন তার দৃষ্টিবিভ্রম হচ্ছে। টাই না পরেই বেরিয়ে গেলেন তিনি।

সাইকিয়াট্রিস্ট বলতে সালেহ সাহেবের ধারণা ছিল খুব গুরুগম্ভীর চেহারার বয়োবৃদ্ধ চোখে মোটা চশমার কোন লোক। কিন্তু সামনে বসে আছে খুবই অল্পবয়সী একটা মেয়ে। চোখে রিমলেস চশমা। চশমা খুলে এবং তাকে শাড়ির পরিবর্তে কামিজ পরিয়ে দিলে মনে হবে সবে মাধ্যমিক পাশ করা কোন মেয়ে যে প্রেম করার জন্য উশখুশ করছে। সাইকিয়াট্রিস্টের নাম মারজিয়া। চশমা খুলে মৃদু হেসে বলল, মি. সালেহ সাহেব। বলুন, কী সমস্যা আপনার?
সালেহ সাহেব বুঝতে পারছেন না কিভাবে শুরু করবেন। গত রাতের ঘটনা দিয়েই কি শুরু করলে ভাল হবে? একটু দম নিয়ে বললেন, গত রাতে ঘুমানোর জন্য শোবার পর আমার মনে হচ্ছিল বিছানায় কিছু আছে।

-কেমন কিছু?
-স্যাঁতসেঁতে, ঠাণ্ডা। আমার মনে হচ্ছিল সাপ আছে।
-আচ্ছা, তারপর?
-আমি নড়াচড়া করছিলাম।

আমার স্ত্রী তখন বলল যে সাপের মত মোচড়াচ্ছি কেন? আর তখন আমার খুব রাগ হয়েছিল। আমি খুব খারাপ ব্যবহার করেছি।

-সমস্যা কি এইটাই?
-না। এইটা না। পুরোটা শুনুন।

এরপর আমার মাথায় পানি ঢালার পর যখন আমি আয়নায় নিজেক দেখার জন্য তাকালাম, তখন দেখলাম আয়নার মধ্যে আমার চেহারা নেই, একটা সাপের চেহারা। এরপর আমি সবকিছুতে সাপ দেখছি। সকালে আমার স্ত্রী টাই নিয়ে আসছে কিন্তু আমি দেখছি আমার স্ত্রীর হাতে সাপ। বাইরে দড়ি বা লাঠির মত কিছু পড়ে আছে আমি দেখছি ওটা সাপ।

-এই সমস্যা?
-জ্বি।
-আর কিছু আছে?
-না। ‘না’ বলার পর মনে হল আসল কথাটাই তো বলা হয়নি। মারজিয়া বলল, আমার মনে হচ্ছে আরও কিছু বলবেন।

-জ্বি। আমি প্রায়ই একটা দুঃস্বপ্ন দেখি। দেখি যে সাপে আমাকে তাড়া করছে অথবা আমি সাপ হয়ে যাচ্ছি এবং অন্যদের তাড়া করছি।

-আচ্ছা। ছোটবেলায় সাপ নিয়ে কোন ঘটনা বা দুর্ঘটনা আছে?
-হ্যাঁ।
-সেটা বলেন।
-তখন আমি খুব ছোট।

ছয় সাত বছর বয়স। আমরা গ্রামের বাড়িতে থাকতাম। তখন বিদ্যুৎ ছিল না। এক রাতে আমার ঘরে যে মাচা ছিল, সেই মাচার নিচে একটা সাপ। হারিকেনের আলো সাপের গায়ে পড়ছে। আমি খুব ভয় পেলাম। ‘সাপ, সাপ’ বলে চিৎকার করলাম। লোকজন এসে সেই সাপ মেরে ফেলল। এরকম আরও দুএকবার ঘটেছিল।

-প্রত্যেকবারই মাচার নিচে সাপ দেখেছেন?
-না, তা নয়। তবে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাবে। একবার তো সাপের কামড় খেতে গেছিলাম।
-ও আচ্ছা। আপনার সমস্যাটা শুনে যা বুঝলাম আপনি কোন একদিন সাপের স্বপ্নটা দেখেন, তারপর আপনার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। সাপ নিয়ে একটু বেশি ভাবেন এইজন্য আপনার ভিজ্যুয়াল হেলুসিনেশন হচ্ছে। ঘুমের সমস্যা হচ্ছে?

-হ্যাঁ, বয়স হয়েছে। এখন তো একটু অনিদ্রা হওয়াটাই স্বাভাবিক।
-তা ঠিক। আপনাকে কিছু ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি। প্রতি রাতে একটা করে খাবেন।

মারজিয়া ড্রয়ার খুলে এক প্যাকেট ওষুধ বের করে দিলেন। আবু সালেহ সাহেবের মনে হচ্ছে তার সামনে একটা ছোট সাপ এগিয়ে দিয়েছে। তিনি ধরতে ভয় পাচ্ছেন। ধরতে গিয়ে হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন। মারজিয়া বুঝতে পেরে বলল, এই প্যাকেটটাকেও কি সাপ মনে হচ্ছে?

-হ্যাঁ।
-তাহলে ধরে ফেলুন। ভয় কেটে যাবে। সালেহ সাহেব প্যাকেট নিলেন। পকেটে রেখে মনে হচ্ছে সাপটা পকেটের মধ্যেই নড়াচড়া করছে। অস্বস্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ওষুধের দাম কত?
-দাম দিতে হবে না। ওষুধ কোম্পানি থেকে স্যাম্পল পাই। আমি ওগুলো বিক্রি করি না।
-ও আচ্ছা।

সালেহ সাহেব সাইকিয়াট্রিস্টের ফিস দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। পকেট থেকে প্যাকেটটা বের করে হাতে নিয়ে হাঁটছেন। আজ আর অফিসে যাবেন না। গাড়ি ছেড়ে দিয়ে রিকশা নিলেন। কিছুদূর রিকশায় এসে রিকশাও ছেড়ে দিলেন। এবার হাঁটতে লাগলেন। হাঁটতে হাঁটতে কমলাপুর বস্তিতে চলে এলেন। এখানে একটা জটলা দেখে এগিয়ে গেলেন সেদিকে। কোন এক সাপুড়ে সাপের খেলা দেখাচ্ছে। আবালবৃদ্ধ গোল হয়ে খেলা দেখছে। সাপুড়ে বলছে, খা খা খা, বক্ষিলারে খা। খা মনসা খা।

ভিড়ের মধ্য দিয়ে উঁকি দিলেন সালেহ সাহেব। সাপুড়ে একটা সাপ ধরে নিজের জিহ্বায় কামড় খেল। মুহূর্তেই লোকটার জিহ্বা নীল হয়ে গেল। একটা তাবিজ জিহ্বায় দিতেই তা আবার আগের মত হয়ে গেল। লোকজন হাততালি দিচ্ছে। সালেহ সাহেব হাততালি দিতে গিয়েও দিলেন না। সাপুড়ে এরপর লোকজনের কাছে তাবিজ বিক্রি করতে লাগল। যে পরিমাণ হাততালি পড়েছিল, সেই তুলনায় তাবিজ বিক্রি হল না। মাত্র সাতটা তাবিজ বিক্রি হয়েছে। খেলা শেষ করে সব গোছগাছ করছে লোকটা। দর্শক চলে যাচ্ছে তাদের মত। একটু দূরে গিয়ে সালেহ সাহেব আড়চোখে সাপুড়ের দিকে তাকিয়ে রইল। সাপুড়ে তা খেয়ালও করল না। সব গোছগাছ করা হলে সাপুড়ে সালেহ সাহেবকে বলল, কী কইবেন, কইয়া ফালান। কথা পেটের মইদ্দে রাখলে গ্যাশটিক হইব। চমকে উঠলেন সালেহ সাহেব। সাপুড়ে কিভাবে বুঝল? সালেহ সাহেব সাপুড়েকে তার সাপবিষয়ক সমস্যার কথা সব খুলে বললেন। সব শুনে সাপুড়ে বলল, মা মনসা আপনার উপর নারাজ।

-কেন?
-আপনি যখন ঘরে সাপ দেখছিলেন, লোক ডাইকা সাপ মাইরা ফালাইছিলেন, সেইজন্য।
-কী করা লাগবে এখন?
-একটা তাবিজ আছে। তয়..
-তয় কী?
-খরচ একটু বেশি পড়বে। এই তাবিজ আনছিলো আমার গুরু কামরূক-কামাক্ষা থেকে।
-সমস্যা নেই। আপনি তাবিজ দেন।

সাপুড়ে সালেহ সাহেবক একটা ইটের টুকরা আনতে বলল। তারপর মুঠি বন্ধ করে বলল, চোখ বন্ধ কইরা আমার সাথে বলুন, এক আল্লাহ এক রহমান।

-এক আল্লাহ এক রহমান।
-এক ঈশ্বর এক ভগবান।
-এক ঈশ্বর এক ভগবান।
-মা মনসার চরণ তলে,
-মা মনসার চরণ তলে,
-সব দিলাম কর্ম ফলে।
-সব দিলাম কর্ম ফলে।

এটুকু বলে হাতের মুঠি খুলতে বলল সাপুড়ে। মুঠি খুলে সালেহ সাহেব দেখলেন হাতের মধ্যে ইটের টুকরা নেই, আছে একটা তাবিজ। সাপুড়ে হাত বন্ধ করে দিয়ে বললেন হাতে চুমু খান। মা মনসা আপনার উপর খুশি হয়েছেন। এবার আপনি তারে খুশি করেন।

-কিভাবে?
-মানিব্যাগ বের করেন।

সালেহ সাহেব ম্যানিব্যাগ বের করলেন। সাপুড়ে বলল, মা মনসার জন্য এই মানিব্যাগে যে টাকা আছে, সেইডা দিতে পারবেন? সালেহ সাহেব বুঝতে পারছেন না তিনি কী বলবেন। সাপুড়ে আবার জিজ্ঞেস করলে সালেহ সাহেব বলে ফেললেন, পারব। সাপুড়ে সব টাকা বের করে একশোটাকার একটা নোট মানিব্যাগে ভরে বাকি টাকা নিজের কাছে রেখে মানিব্যাগ ফেরত দিল সালেহ সাহেবকে। তারপর বলল, মা মনসা খুশি হইয়া এই একশো টাকা দিয়েছে। আর তাবিজটা কোমরে বাইন্দা রাখবেন। আর কোন সমস্যা হবে না। সালেহ সাহেব হাঁটছেন। তার মানিব্যাগে প্রায় নয় হাজার টাকা ছিল যেটা সাপুড়ে নিয়ে গেছে মা মনসার নামে, তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই তাঁর। যদি তাবিজে এই সাপের সমস্যা থেকে বাঁচতে পারেন তাহলে তো ভাল।

রাতে ওষুধ খেয়ে তাবিজটা নিয়ে বাথরুমে গিয়ে কোমরে বাঁধলেন। আয়েশার সামনে বাঁধলে উল্টাপাল্টা কিছু ভাবতে পারে। ওষুধ খাওয়ার জন্য আজ তাঁর খুব তাড়াতাড়ি ঘুম এল। কিন্তু দুঃস্বপ্ন তার পিছু ছাড়ল না। আজকের দুঃস্বপ্ন ছিল আরও ভয়ানক। সালেহ সাহেব খেয়াল করলেন তার পাশে লম্বা হয়ে কেউ শুয়ে আছে। তার পাশে আয়েশার থাকার কথা, কিন্তু আয়েশা নেই। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন লম্বা হয়ে একটা সাপ শুয়ে আছে। সালেহ সাহেবের ভয় লাগছে না। সাপের দিকে তাকাতেই সাপ বলল, কী ব্যাপার সালেহ সাহেব। ভাল আছেন তো? স্বপ্নের মধ্যে সাপের কথাবলা স্বাভাবিক মনে হল। তিনিও স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, ভাল আছি।

-একটা কথা বলেন তো, আপনি এরকম একটা বোকামি কিভাবে করলেন?
-কোন বোকামি?
-ভণ্ড সাপুড়ে আপনার কাছ থেকে অনেকগুলো টাকা নিয়ে গেল আমার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য।

আপনি কি আমার হাত থেকে বাঁচতে পেরেছেন? এইযে, এখনো আপনার পাশে শুয়ে আছি। হাহাহা। সাপের হাসি শুনে সালেহ সাহেবের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি দেখলেন তার পাশে আয়েশা শোয়া এবং সে শব্দ করে কাশছে। সম্ভবত ঠাণ্ডা লেগেছে। সালেহ সাহেব চাদরটা আয়েশার গায়ে দিয়ে বারান্দায় এসে সিগারেট ধরালেন। ঘুমের ওষুধের পাওয়ার সম্ভবত শেষ। আর ঘুম আসবে বলে মনে হয় না। চেয়ারে বসে সাপ নিয়ে একটা ছড়া মনে করতে লাগলেন, বাবুরাম সাপুড়ে কোথা যাস বাপুরে? আয় বাবা দেখে যা দুটো সাপ রেখে যা।

যে সাপের দাঁত নেই সালেহ সাহেব আর মনে করতে পারলেন না। মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। হাতের সিগারেটের দিকে তাকিয়ে দেখলেন ওটা সিগারেট না, একটা ছোট সাপ। সিগারেট ফেলে দিলেন। বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে গামছা দিয়ে মুখ মুছতে গিয়ে দেখলেন ওটা গামছা নয়, ওটাও সাপ। খাটে আয়েশা নেই, লম্বা হয়ে সাপ শুয়ে আছে আর ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ছে। সালেহ সাহেব যেদিকে তাকাচ্ছেন সেদিকে সাপ দেখছেন। অসংখ্য সাপ তার চারপাশে কিলবিল করছে। গা ঘিনঘিন করতে লাগল তাঁর। সাইকিয়াট্রিস্ট মারজিয়ার চেম্বারে জবুথবু হয়ে বসে আছেন আবু সালেহ সাহেব। স্থির ভাবে বসে থাকলেও চোখের মনি স্থির নেই। এমনভাবে এদিকওদিক তাকাচ্ছেন মনে হচ্ছে তিনি কোন ভয়ঙ্কর জায়গায় বন্দি হয়ে আছেন। মারজিয়া তার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসা। সোজা হয়ে জিজ্ঞেস করল, সমস্যা বেশি হয়েছে?

-হ্যাঁ।
-আপনাকে যে ওষুধ দিয়েছিলাম, ওগুলো খেয়েছেন?
-কয়েকদিন খেয়েছি কিন্তু কাজে দেয়নি। স্বপ্ন দেখে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, আর ঘুম আসে না।
-ও আচ্ছা। নতুন কী উপসর্গ দেখা দিয়েছে?
-এখন আমি সব জায়গায় সাপ দেখি। সাপের সাথে কথা বলি। সাপ আমার সাথে কথা বলে।
-এখানেও কি সাপ দেখছেন?
-হ্যাঁ। মনে হচ্ছে চারপাশে সাপ কিলবিল করছে। আপনাকেও সাপ মনে হচ্ছে। মারজিয়ার হাসি আসছিল। এরকম সিরিয়াস রোগীর সামনে হাসা উচিৎ নয়। হাসি নিয়ন্ত্রণে এনে বলল, আপনার সমস্যা তো আসলেই খুব মারাত্মক।

-আচ্ছা, আপনি যে সাপগুলো দেখেন, তারা কি আপনাকে কামড়ায়?
-না। শুধু স্বপ্নের সাপে তাড়া করে।
-আপনার ভিজুয়াল হেলুসিনেশনের সাথে অডিও হেলুসিনেশন হচ্ছে। আচ্ছা, আপনি কি ড্রিংক করেন?
-আগে করতাম। এখন করি না।
-করবেন?

এর উত্তর দিলেন না আবু সালেহ সাহেব। মারজিয়া পিয়নকে ডেকে ড্রিংকের ব্যবস্থা করতে বলল। তার চেম্বারে সে মাঝেমাঝে ড্রিংক করে। যখন নার্ভ খুব এক্সাইটেড হয়, তখন ড্রিংক করলে নার্ভ নিয়ন্ত্রণে আসে। আবু সালেহ সাহেব দেখছেন মারজিয়া একটা সাপ ধরে সাপের মুখ থেকে বিষ বের করে গ্লাসে ঢালছে। তারপর সেই গ্লাস একটা সালেহ সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দিল। আরেকটা নিজে রেখে ঢকঢক করে খেয়ে নিল। মদের তিক্ততার জন্য মারজিয়া মুখ কুঁচকে তাকাল আবু সালেহ সাহেবের দিকে। আবু সালেহ দেখলেন মারজিয়া সাপ হয়ে গেছে। সালেহ সাহেব ড্রিংক করলেন না এই ভয়ে যদি তিনি ড্রিংক করেন তাহলে তিনিও হয়তো সাপ হয়ে যাবেন। হঠাৎ চোখের সামনে সবকিছু ঘোলাটে হয়ে গেল। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন তিনি। মারজিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সালেহ সাহেবের অফিসে ফোন করলেন।

একমাস পরের কথা। আবু সালেহ সাহেব এখন সবসময় বাসায় থাকেন। বলা চলে তিনি গৃহবন্দি। একজন ফিজিশিয়ান সবসময় তার সাথেই থাকে। তার সমস্যার কোন উন্নতি হয়নি বরং দিনদিন অবনতি হচ্ছে। এখন তিনি কথাও বলেন না। কালেভদ্রে দুএকটা কথা বলে থাকেন। বেশিরভাগ সময় সাপের মত ফোঁসফোঁস করেন। তাকে পাগলাগারদে পাঠানোর কথা বলা হয়েছিল কিন্তু আয়েশা বলল, না। তাকে বাড়িতেই চিকিৎসা করানো হবে। তাই করা হচ্ছে। আয়েশা কাছে এলে ফোঁসফোঁস কম করেন আবু সালেহ সাহেব। ‘তুমি একটু ঘুমাও।’ আয়েশা বলল। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আয়েশা। হঠাৎ ঘাড় শক্ত করে আয়েশার দিকে তাকালেন সালেহ সাহেব। কুচকুচে কালো লম্বা জিহ্বা বের করে ভয়ঙ্কর হাসি দিলেন তিনি। আয়েশা চিৎকার করার আগেই তার হাতে কামড় বসিয়ে দিলেন সালেহ সাহেব।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত