সেলিমের বউ ও সেলিমের বউ, বলি সারাদিন খালি শুইয়া বইসাই থাকলেই হইবো! কাজ কাম গুলা কেডায় করবো শুনি? এখন কি এই বুইড়া বয়সে আমি রাইন্ধা বাইড়া তমগো খাওয়ামু! আমার হইছে যত জ্বালা, ঘরে পোয়াতি মাইয়াডা না খাইয়া রইছে সেদিকে কারো কোনো হুস নাই। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শ্বাশুড়ির কথা শুনছে শায়লা। প্রতিদিন এভাবেই চেঁচামেচি করেন তিনি। পান থেকে চুন খসলেই কথার ঝুড়ি শুনতে হয় ওকে। বিছানা থেকে ধীরে ধীরে উঠে বাহিরে গেলো শায়লা। শায়লাকে দেখেই রমিছা বেগমের মাথা যেনো আরো খারাপ হয়ে গেলো। রমিছা বেগম আরো চিৎকার করতে শুরু করলেন।
শায়লা খুব শান্ত গলায় শ্বাশুড়ী কে বললো, “আম্মা আমার শরীরটা বেশি ভালো না, মাথা ঘুরায় খুব, বিছানা থেকে মাথা তুলতে পারিনা অনেকবার বমিও করছি শায়লা কে কথা শেষ করতে না দিয়ে রমিছা বেগম ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, “বাচ্চা মনে হয় আমরা জন্ম দেইনাই, তুমি একলাই দিতাছো। মাত্র ৪মাস বাচ্চা পেটে তাতেই এমন ভাব করতাছো মনে হইতাছে দুনিয়া কিন্না ফালাইছো। বাচ্চা মনে হয় আমরা জন্ম দেইনাই, চাইর চাইরটা বাইচ্ছা কি এমনই হইছে?” শায়লা মাথা নিচু করে রান্না ঘরে চলে গেলো।
চোখের পানি শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে রান্না করতে লাগলো। আজ বাবা মা গরীব বলে ওকে এই অবস্থাতেই এত কিছু সহ্য করতে হচ্ছে, বাবার যদি অনেক ক্ষমতা থাকতো তাহলে সে কবেই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতো!
সারাদিন এমনি এমনি কেটে যায়, এক লোকমা ভাত ও মুখে তুলতে পারেনা শায়লা। স্বামী ওর জন্য বাহির থেকেও কোনো খাবার আনে না, মা দেখলে কি ভাববে এই ভেবে! শায়লাও স্বামীকে মুখ ফুটে কিছু বলেনা। “কিছু কইলেই কাইন্দা ভাসাইয়া দাও। ননীর পুতুল হইছো তাইনা? এসব নাটক বন্ধ কইরা তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করো আমার মাইয়ার ক্ষীদা লাগছে।” কথাটা বলেই রমিছা বেগম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। শায়লা মাথা নিচু করে রান্না করতে লাগলো। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস, একই বাড়িতে দুজন গর্ভবতী মহিলা অথচ দুজনের সাথে দুরকম ব্যবহার করা হচ্ছে!
শায়লা সমস্ত রান্না শেষ করে টেবিলে খাবার বেড়ে দিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে আবারও শুয়ে পরলো। এত গরমের মধ্যে রান্না করে ওর শরীরটা আরো বেশি খারপ লাগছে। শরীর এত দূর্বল যে মাথা তুলতেও কষ্ট হয়। খাবার টেবিলে সেলিম সেলিমের বোন আর মা খেতে বসেছে। সংসার টা সেলিমের টাকায় চললেও সেলিমের বউএর কোনো ক্ষমতা নেই মুখ ফুটে কিছু বলার। খাবার টেবিলে রমিছা বেগম আবারও চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিলেন। সেলিমকে বলতে লাগলেন, “দেখ সেলিম তোর বউ কিন্তু দিন দিন বেশি বেয়াদবি শুরু করে দিছে।” সেলিম এক লোকমা ভাত গালের মধ্যে দিয়ে বললো, “আবার কি করলো”
“তোর বউ সারাদিন ঘরে শুইয়া থাকে, রান্না বান্না তো দূরে থাক ঘর টাও ঝাড়ু দেয় না।”
“মা তাহলে আজকে কি তুমি রান্না করছো? সেই জন্যই তো বলি আজকের রান্না এত সুস্বাদু হলো কি করে!”
“তুই আমার সাথে ফাইজলামি করিস? এই বুইড়া বয়সে আমি রাইন্দা তোগো খাওয়ামু?”
“যাহ বাবা, তুমিই তো বললা শায়লা রান্না করে না। তাইলে এগুলা কে রান্না করছে?”
রমিছা বেগম সেলিমের কথা শুনে চুপ হয়ে গেলেন। উনি বুঝতে পেরেছেন এখন কিছু বললে নিজেকেই অপমানিত হতে হবে।
সেলিম খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে ধুতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “মা সব সময় পরের মেয়ের দোষ ধইরো না। নিজের মেয়েকে কাছে এনে রাখছো কাজ যাতে না করতে হয় সেই জন্য। তাহলে পরের মেয়েকে কিভাবে এত কাজের ফরমায়েশ দাও? দুইজনের ই তো বাচ্চা হবে তাইনা? নিজের মেয়েকে পাশে বসিয়ে খাওয়াচ্ছো আর যে মেয়েটা শরীর খারাপ নিয়েও রান্না করলো তাতে একবার ও বললে না খাওয়ার জন্য।” সেলিমের কথা শুনে রমিছা বেগম ভীষণ ক্ষেপে গেলেন কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। সকাল সকাল রমিছা বেগম মেয়েকে রেডি করছেন ডক্টর এর কাছে নিয়ে যাবেন বলে। শায়লা ৪মাসের গর্ভবতী অথচ একবার ও ডক্টরের কাছে যাওয়া হয়নি। খুব ভয়ে ভয়ে শায়লা শ্বাশুড়ির কাছে এগিয়ে গেলো তারপর বললো, “আম্মা আমিতো একবার ও ডক্টরের কাছে যাইনি চেকআপ করাতে। আমাকে আপনাদের সাথে নিয়ে যাবেন?”
রমিছা বেগম শায়লারর মুখে এমন কথা শুনে মুখটা কালো করে বললেন, “আমি আমার মাইয়ারে নিয়া যাইতেছি, ওর ভাইয়ের টাকায় ওই ডক্টর দেখাবে। তোমার যদি এতই সখ থাকে তাহলে বাপ ভাইরে খবর দাও নিয়ে যাক এসে।”
কথাটা বলেই রমিছা বেগম মেয়েকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। ডক্টর চন্দনার চেম্বারে বসে আছে রমিছা এবং ও তার মেয়ে। ডক্টর চ্ন্দনা সমস্ত টেষ্ট রিপোর্ট খুঁটে খুঁটে দেখে বললেন, “সব ঠিক আছে। তবে একটা সমস্যা….” রমিছা বেগম আৎকে উঠে বললেন, “কি সমস্যা? বাচ্চাটা ভালো আছে তো?” “রিল্যাক্স, সব ঠিক আছে তবে পেশেন্ট ৫মাসেই যেভাবে ওয়েট গেইন করেছে তাতে ফিউচার এ গিয়ে প্রবলেম হবে। মেয়ে কি আপনার কাছেই থাকে?”
“হ আমার কাছেই থাকে, এই অবস্থায় শ্বশুরবাড়ি কিভাবে রাখি?”
“হুম, সেজন্যই এই অবস্থা। সব সময় শুয়ে থাকে নিশ্চই?”
“ইয়ে মানে।”
“আপনার তো বয়স হয়েছে মেয়ের কাজ গুলো মেয়েকেই করতে দেন আর আপনি রেস্ট করেন।”
“আমি কাজ করবো কেন? ছেলের বউ আছে সে করে।”
“ওহ্ আচ্ছা। ছেলের বউ এর বাচ্চা আছে?”
“সেও ৪মাস এর গর্ভবতী।”
“বউ কে কোন ডক্টর দেখাচ্ছেন?”
“কিসের ডক্টর? এক্ষুনি ডক্টর দেখান লাগবে না, কাজ কাম করে শরীর ভালই আছে।”
“বাহ্! নিজের মেয়ের বেলায় এত বুঝেন বউ এর বেলায় বুঝেন না কেন? সে পরের মেয়ে বলে? এই আপনাদের মত কিছু মানুষের জন্য এখনো অনেক মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে সংসার করতে পারেনা। নেক্সট টাইম আমার চেম্বারে আপনাকে যেনো আর না দেখি।”
রমিছা বেগম মেয়েকে নিয়ে মুখ অন্ধকার করে বাসায় আসলেন। বাসায় এসে দেখেন শায়লা স্বামীর সাথে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। শায়লাকে শুয়ে থাকতে দেখে রমিছা বেগমের মাথা গরম হয়ে গেলো। শায়লা ঘরের কাছে গিয়ে রমিছা বেগম অকথ্য ভাষায় শায়লাকে গালি দিতে শুরু করলেন। স্বামী ঘরে থাকা সত্বেও এভাবে কথা শুনতে হবে শায়লা কখনো ভাবেনি। শায়লা শোয়া থেকে উঠে ব্যাগ গোছাতে লাগলো। শায়লা কে ব্যাগ গোছাতে দেখে সেলিম শোয়া থেকে উঠে এসে বললো, “ব্যাগ গোছাচ্ছ যে? কই যাবা?” স্বামীর কথা শুনে শায়লার শরীর জ্বালা করতে লাগলো। শায়লা রেগে গিয়ে বললো, “আমি কই যাবো না যাবো সেটা শুনে তুমি কি করবা? মা বোন আছে তাদের কথা ভাবো।”
“মানে কি?” “আমি বাপের বাড়ি যাচ্ছি। আর একেবারেই যাচ্ছি, ফিরে আসবো না আর তোমার মত কাপুরুষের কাছে। বোনের বাচ্চার চিকিৎসা করতে পারো অথচ নিজের বাচ্চার খোঁজ টাও রাখো না। বউ খাইলো না খাইলো না সেটা জানার ও প্রয়োজন বোধ করো না। বাপ ভাইয়ের কাছে গিয়েই যদি চিকিৎসা করতে হয় তাহলে তোমার কাছে কেন থাকবো?
তোমাদের মত পুরুষদের আসলে বিয়ে করাই উচিত না।” কথাটা বলেই শায়লা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। যে কাজটা আরো আগে করা উচিত ছিলো, সেই কাজটা সাহস করে আজকে করেই ফেললো শায়লা। নিজের জন্য না হলেও পেটের বাচ্চাটার জন্য সে সাহস যুগিয়েছে মনে। যেখানে তার কোনো মূল্য নেই সেখানে তাঁর বাচ্চার মূল্য থাকবে কি করে!”