১৭. সবিতার ডাকে কিরীটীর নিদ্রাভঙ্গ
সবিতার ডাকে কিরীটীর নিদ্রাভঙ্গ হলো।
কিরীটী চোখ মেলে দেখল শয্যার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে সবিতা। তার চোখেমুখে সুস্পষ্ট উদ্বেগ।
কি হয়েছে সবিতা দেবী?
আপনি শীগগির একবার নিচে চলুন। লক্ষ্মীকান্তবাবু এসেছেন। নায়েব কাকাকে arrest করে নিয়ে যাচ্ছেন—এ সব কি মিঃ রায়! নায়েব কাকাকে arrest করছেন কেন?
কিরীটী শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে জামাটা গায়ে দিতে দিতে বলে, কেন লক্ষ্মীকান্ত সাহা নায়েব মশাইকে arrest করেছেন আমি কেমন করে তা বলবো বলুন? তা তিনি কিছু বলেননি কেন ওঁকে তিনি arrest করছেন?
না। কেবল বললেন—এ সব পুলিসের সিক্রেট ব্যাপার, সকলের কাছে বলতে তিনি রাজী নন।
এক্ষেত্রে আমিই বা তাহলে কি করতে পারি বলুন? নির্লিপ্তভাবে কিরীটী জবাব দেয়।
কিন্তু আমাদের তো একটা প্রতিবাদ করা উচিত।
পূর্বের মতই পরম নির্বিকার ও শান্তভাবে জামার বোতামগুলো লাগাতে লাগাতে কিরীটী বলল, পুলিসের কোন কাজে প্রতিবাদ করলে তো তারা আপনাকে সমর্থন করবে না সবিতা দেবী!
তাই বলে অন্যায় জুলুম! সবিতার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে।
অন্যায় জুলুমই যে তাই বা কি করে আপনি বুঝলেন? চলুন দেখি!
কিরীটী প্রস্তুত হয়ে নিতে নিতে বললে। উভয়ে নিচে বসন্ত সেনের ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।
ঘরের মধ্যে দুখানা চেয়ারে মুখোমুখি নিঃশব্দে বসে আছেন বসন্ত সেন, থানার দারোগা লক্ষ্মীকান্ত সাহা আর একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে সত্যজিৎ।
ওদের পদশব্দে বসন্ত সেন ও লক্ষ্মীকান্ত দুজনেই মুখ তুলে তাকালেন।
নমস্কার লক্ষ্মীকান্তবাবু। ব্যাপার কি! এত সক্কালেই? প্রশ্ন করে হাসিমুখে কিরীটী আর একটু এগিয়ে যায় ঘরের মধ্যে।
লক্ষ্মীকান্তর মুখখানা অত্যন্ত গম্ভীর। গম্ভীর কণ্ঠেই প্রতিনমস্কার জানিয়ে লক্ষ্মীকান্ত বললেন, মিঃ রায় এসেছেন ভালই হলো। সবিতা দেবী, সত্যজিতবাবু আপনারা অনুগ্রহ করে একটু যদি পাশের ঘরে যান! মিঃ রায়ের সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা ছিল।
কিরীটীই নিঃশব্দে চোখের ইঙ্গিতে সত্যজিৎ ও সবিতাকে কক্ষ ত্যাগ করে যেতে ক্ষণেকের জন্য অনুরোধ জানায়।
দুজনেই নিঃশব্দে কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল কিরীটীর চোখের ইঙ্গিতে।
দরজাটা এবারে ভেজিয়ে দিন মিঃ রায়। পূর্ববৎ গম্ভীর কণ্ঠেই লক্ষয়ীকান্ত বললেন।
মৃদু হেসে কিরীটী এগিয়ে গিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এল।
বসন্তবাবুকে গতরাত্রেই এসে কয়েকটা প্রশ্ন করেছিলাম মিঃ রায়। কিন্তু উনি বলছেন আমার সে-সব প্রশ্নের কোন জবাব দিতেই উনি নাকি বাধ্য নন। তাই এক্ষেত্রে একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমাকে আইনের প্রয়োগ করতে হচ্ছে।
মিথ্যে কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই লক্ষ্মীকান্তবাবু। আমি প্রস্তুত, আপনি চলুন। শান্ত দৃঢ়কণ্ঠে সহসা কথা বললেন বসন্ত সেন।
কাল আপনি আমাকে আপনার সঙ্গে থানায় গিয়ে দেখা করতে বলেছিলেন, কিন্তু পরের দিক থেকেই শরীরটা কেমন ভাল লাগছিল না তাই
গেলে ভালই করতেন মিঃ রায়। অনেক interesting কথা শুনতে পারতেন।
তাই নাকি? কি রকম? কাল রাত্রে যখন আপনি এসেছিলেন টের পেয়েছিলাম কিন্তু ভাবলাম বসন্তবাবুর সঙ্গে হয়ত কোন গোপনীয় জরুরী। কথা আছে তাই আর বিরক্ত করিনি আপনাকে।
হ্যাঁ, আপনি হয়ত শুনে সুখীই হবেন, কাল সন্তোষবাবুকে থানায় নিয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় অনেক রহস্যই উৎঘাটিত হয়েছে যার ফলে সম্পূর্ণ কেসটাই একটা definite shape নিয়েছে। প্রথমে অবশ্য ভদ্রলোক মুখ খুলতে চাননি কিন্তু জানেন তো মুখ খুলবার দাওয়াই আমাদের জানা আছে—চাপে পড়ে সব প্রশ্নের জবাব শেষ পর্যন্ত দিয়েছেন।
বটে! কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকায় কিরীটী লক্ষ্মীকান্তর সাফল্যে গদগদ মুখের দিকে।
সহসা এমন সময় বসন্ত সেন তাঁর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কথা বললেন, কিন্তু আমি আপনাকে বলছি, সন্তোষবাবু যে সব চিঠি আপনাকে দেখিয়েছেন। একটাও তার সত্য নয়; কারণ গত চব্বিশ বৎসর একখানা চিঠিও মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী কাউকে লেখেননি। এমন কি তাঁর মেয়েকেও তিনি নিজহাতে চিঠি কোনদিন লেখেননি। চিঠি যা লেখা হতো তাঁরই জবানীতে আমার হাত দিয়েই।
প্রশ্ন করল এবারে কিরীটীই, কেন তিনি নিজহাতে চিঠি লিখতেন না তার কোন কারণ ছিল কি?
হ্যাঁ ছিল।
সেই কারণটাই তো আপনার কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম। লক্ষ্মীকান্ত বলে ওঠেন, কিন্তু উনি বলতে রাজী নন।
রাজী নন কেন? প্রশ্নটা কিরীটীই করে।
না, রাজী নই। আপনাদের বর্তমান তদন্তের ব্যাপারের সঙ্গে আমার ও প্রশ্নের জবাবের কোন সংস্পর্শ আছে বলেই আমি মনে করি না। তাছাড়া মৃত্যুঞ্জয়ের হাতের লেখা আমার যথেষ্ট পরিচিত, চিঠিগুলো আমাকে দেখালেই আমি দপ্তরের খাতাপত্রে তাঁর হাতের যে সব লেখা আছে তার সঙ্গে মিলিয়ে সত্য মিথ্যা প্রমাণ করে দিতে পারবো, কিন্তু দারোগা সাহেব চিঠিগুলো আমাকে দেখাতেই রাজী নন!
কিরীটী বসন্ত সেনের কথায় লক্ষ্মীকান্ত সাহার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল এবং বললে, সে চিঠিগুলো আপনার কাছেই আছে বুঝি মিঃ সাহা?
হ্যাঁ। আসবেন আপনি থানায়, দেখাবোখন।
চিঠিগুলো সেন মশাইকে দেখাতে আপনার সত্যিই আপত্তি আছে নাকি?
বর্তমানে আছে, কারণ আপনি চিঠিগুলো পড়লেই জানতে পারবেন।
হুঁ। শুধু, এই জন্যই কি আপনি ওঁকে arrest করেছেন?
না, আরো দুটো কারণ আছে।
আরো দুটো কারণ আছে?
হুঁ, যে রাত্রে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী নিহত হন সে রাত্রে উনি এখানে উপস্থিত ছিলেন না, ওঁর জবানবন্দীতে বলেছিলেন উনি
না, ছিলাম না তাই বলেছি। মহাল দেখতে গিয়েছিলাম, রাত প্রায় গোটা তিনেকের সময় ফিরি। জবাবটা দিলেন বসন্ত সেন।
কিন্তু সত্যি কথা তো তা নয়। আপনি সেদিন আদপেই এ বাড়ি হতে বের হননি। নিজের ঘরের মধ্যেই ছিলেন।
কথাটা এবারে বলেছিল কিরীটী।
কিরীটীর কথায় যুগপৎ চমকে দুজনেই বসন্ত সেন ও লক্ষ্মীকান্ত সাহা ওর মুখের দিকে বিস্মিত প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকায়।
সে কি! তবে যে আপনি গতরাত্রে বলছিলেন জমিদারী সংক্রান্ত কোন একটা বিশেষ গোপনীয় ব্যাপারেই কোন একটা মহালে আপনাকে যেতে হয়েছিল এবং গোপনীয় বলেই মহালের নামটা আপনি বলবেন না? তীক্ষ্ণকণ্ঠে এবারে বসন্ত সেনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা শেষ করলেন সাহা, হুঁ! আসলে আপনি তাহলে এ বাড়ী ছেড়ে সেদিন কোথায়ও যাননি!
কিরীটীর কথায় ও লক্ষ্মীকান্ত সাহার চ্যালেঞ্জে নায়েব বসন্ত সেন যেন একেবারে পাথরের মতই স্তব্ধ অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
মুখখানাও যেন ঐ মুহূর্তে তাঁর মনে হচ্ছিল একেবারে পাথরেই গড়া ভাবলেশহীন। ক্রোধ, বিরক্তি, হতাশা, ব্যথা, লজ্জা, অপমান কোন কিছুই যেন প্রকাশ পাচ্ছে না মুখের স্থির অচঞ্চল রেখাগুলোতে।
নায়েব মশাই, এ কথা তাহলে সত্যি? পুনরায় প্রশ্ন করলেন লক্ষ্মীকান্ত সাহা।
জানি না। আপনাদের কোন প্রশ্নেরই জবাব দিতে রাজী নই লক্ষমীকান্তবাবু। আপনি আমাকে arrest করতে এসেছেন করুন। কোথায় আমাকে নিয়ে যেতে চান, চলুন আমি প্রস্তুত। নিরতিশয় একটা তাচ্ছিল্যের সুরই যেন নায়েব বসন্ত সেনের কণ্ঠস্বরে ঝরে পড়ল।
আপনি তাহলে জবাব দেবেন না। আবার প্রশ্ন করলেন লক্ষ্মীকান্ত।
না।
এখন মনে হচ্ছে কানাইয়ের মার অন্তর্ধানের ব্যাপারেও আপনি লিপ্ত আছেন। লক্ষীকান্ত বললেন।
যেমন আপনার অভিরুচি ভাবতে পারেন। মিথ্যে আপনি সময় নষ্ট করছেন দারোগা সাহেব। আমার মুখ থেকে আপনি একটি প্রশ্নেরও জবাব পাবেন না।
লগুড়াহত জানোয়ারের মতই এবারে যেন লক্ষ্মীকান্ত সাহা একেবারে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং তীক্ষ্ণ কর্কশ কণ্ঠে বলেন, কিন্তু আমিও লক্ষ্মীকান্ত সাহা। আপনাদের মত বহু নায়েবকেই আমার দেখা আছে। চলুন আগে থানায়, তারপর দেখা যাবে আপনাদের মত ঘুঘু চরিত্রের লোককে
দারোগা লক্ষ্মীকান্তর কথাটা শেষ হল না, মুহূর্তে বাঘের মতই থাবা মেরে রুদ্রার্জুন বসন্ত কেন লক্ষ্মীকান্তর বক্তব্যটা অর্ধপথে থামিয়ে দিলেন লক্ষ্মীকান্ত! ভুলো না এটা বসন্ত সেনের এলাকা। এখনি যদি তোমাকে জ্যান্ত হাত পা বেধে সামনের ঐ বৌরাণীর বিলের জলের ঠাণ্ডা পাঁকের নিচে পুঁতে ফেলি তোমার ফিরিঙ্গি বাপঠাকুদ্দার সাধ্যও হবে না তোমার লাশ খুঁজে বের করে! এ তোমার থানার চৌহদ্দী নয়—ভদ্রলোকের সঙ্গে ভদ্রভাবে কথা বলতে শেখনি এখনো।
ঠাণ্ডা বাররু-স্তূপ যেন সহসা একটি মাত্র স্ফুলিঙ্গে প্রচণ্ড শব্দে ফেটে দাবানলের মতই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে।
শান্ত ভদ্র বসন্ত সেনের মধ্যে যে এমন একটি রুদ্র ভয়ঙ্কর রূপ ভস্মাচ্ছাদিত হয়ে চাপা পড়েছিল ভাবতেও যেন বিস্ময় লাগে।
বসন্ত সেনের এ যেন এক অভিনব রূপ।
বৃদ্ধের সমস্ত শরীরটা যেন একটা নিষ্কাশিত তীক্ষ্ণ ধারালো অসির মত ঋজু হয়ে উঠেছে। ক্ষণপূর্বের পাথরের মতই স্থির অচঞ্চল মুখখানি যেন মুহর্তে রুদ্রাগ্নির মতই ধকধক করে জ্বলে উঠেছে।
এককালে জমিদারের নায়েবদের যে দোর্দণ্ডপ্রতাপের কথা শোনা যেত এ যেন সেই পুরাতন দিনেরই নায়েব। সরকারী কোন আইন বা নীতির এরা ধার ধারে না, এদের আইন এদের কাছে। অশিষ্ট অবাধ্য প্রজাকে বেত্রাঘাতে জর্জরিত করে এদেরই পূর্ব-পুরুষেরা হয়ত একদা অন্ধকার স্যাঁতসেতে গুপ্তকক্ষে জীবন্ত কবর দিত। রাতারাতি খুন করে লাশ মাটির নীচে পুতে ফেলত, নয়তো পুষ্করিণীর তলায় গলায় পাথর বেধে ড়ুবিয়ে দিত। অথবা জ্যান্ত দেওয়ালের সঙ্গে ইট দিয়ে রাতারাতি গেথে ফেলত।
লক্ষ্মীকান্ত নিজেও বোধ হয় এতটা আশা করেননি। মুহূর্তের জন্য তাই বোধ হয় তিনিও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পাথরের মতই নিশ্চল অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকেন এবং হিংস্র জানোয়ারকে নিয়ে ঘাঁটানো আর বিবেচনার কাজ হবে না ভেবেই নিজের রূপ এবারে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর হত্যাপরাধের সন্দেহে আপনাকে আমি গ্রেপ্তার করছি। বসন্তবাবু
লক্ষ্মীকান্তর মুখের কথা শেষ হতেই সহসা যেন বাজের মত তীক্ষ্ণ উচ্চকণ্ঠে হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলেন বসন্ত সেন।
কিরীটী লক্ষ্মীকান্ত দুজনেই চমকে ওঁর প্রচণ্ড হাসির শব্দে ওর মুখের দিকে তাকায়। বসন্ত সেন হাসছেন, হাঃ! হাঃ! হাঃ!
কেউই ওঁর হাসিতে বাধা দেয় না।
হাসি থামিয়ে বসন্ত সেন ব্যঙ্গমিশ্রিত কণ্ঠে বলেন, এই বিদ্যা আর বুদ্ধিরই এত দন্ড! তুমি বের করবে মৃত্যুঞ্জয়ের হত্যাকারীকে! এর চাইতে সে আত্মহত্যা করে মরেছে বা অদৃশ্য কোন আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছে, যে রিপোর্ট দিয়েছিলে সেই যে ছিল ভাল। মিথ্যা তোমার কাদা ঘেটে নোংরা হওয়াই সার হবে লক্ষ্মীকান্তবাবু। কিন্তু বড় গলায় তো আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে চলেছ, শেষ পর্যন্ত তোমার আইন দিয়ে আমাকে বেধে রাখতে পারবে তো দারোগাবাবু! যাগগে। মরুক গে। চল কোথায় যেতে হবে—
বসন্ত সেনের উচ্চারিত প্রতিটি কথা যেন নিষ্ঠুর ব্যঙ্গের ছুঁচ বিধিয়ে দেয় দারোগা লক্ষ্মীকান্তর সর্বদেহে।
লজ্জায় অপমানে আক্রোশে তিনি যেন ফুলতে লাগলেন। রোষকষায়িত লোচনে চেয়ে রইলেন ক্ষণকাল বসন্ত সেনের মুখের দিকে। মুখ দিয়ে তাঁর কোন বাক্যও সরে না।
হাতকড়াও দেবে নাকি! না এমনিই গেলে চলবে দারোগাবাবু? আবার প্রশ্ন করলেন বসন্ত সেন।
না, এমনি চলুন আমার সঙ্গে
কিন্তু যদি রাস্তায় তোমাকে একটা থাপড় কষিয়ে দিয়ে পালিয়ে যাই, ধরে থাকতে পারবে তো? ঐ তো তোমার চেহারা! আমার শক্তির খবর জান তো! বৃদ্ধ হলেও এখনও লাঠি হাতে নিয়ে যদি দাঁড়াই, তুমি তোমার থানার সমস্ত চেলা-চামুণ্ডাদের নিয়েও সামনে আমার দাঁড়াতে পারবে না।
লক্ষ্মীকান্ত বসন্ত সেনের কথার কোন জবাবই দেন না।
এবারে মৃদু হেসে বসন্ত সেন বললেন, না, ভয় নেই চল। দেখেই আসা যাক তোমার আইনের দৌড়টা কত দূর!
অগ্রে অগ্রে বসন্ত সেন ও পশ্চাতে লক্ষ্মীকান্ত সাহা কক্ষের বদ্ধ দরজাটার দিকে অগ্রসর হলেন। দরজার কাছবরাবর গিয়ে হঠাৎ বসন্ত সেন ঘরে দাঁড়িয়ে কিরীটীকে সম্বোধন করে বললেন, চললাম কিরীটীবাবু, মৃত্যুঞ্জয়ের সলিসিটার রায় অ্যাণ্ড বোসের অতীনলাল কাল-পরশুর মধ্যে হয়ত এসে পড়বেন। তাঁকে আসতে লিখেছিলাম। মৃত্যুঞ্জয়ের উইলের ব্যাপারে মিঃ বোস আসছেন, সান্যাল মশাই রইলেন, সত্যজিৎ রইলো, সকলের সামনে যেন উইলটা পড়া হয়। সম্পত্তির প্রবেট নিতে হবে, মৃত্যুঞ্জয়ের ঘরে সিন্দুকে নগদ টাকা আছে। চাবিটা আমি সবি মার হাতে গতকালই দিয়ে দিয়েছি।
কিরীটী এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি। নির্বাক শ্রোতা হয়েই সমগ্র দৃশ্যটা আগাগোড়া উপভোগ করছিল। এখনও চুপ করেই রইল।
হঠাৎ অতঃপর লক্ষীকান্তের দিকে ঘরে তাকিয়ে বসন্ত সেন বললেন, এক মিনিট দারোগা সাহেব। তুমি একটু বাইরে যাও, আমি কিরীটীবাবুর সঙ্গে কথা বলে এক্ষুনি আসছি।
নিঃশব্দে লক্ষ্মীকান্ত দ্বিতীয় আর বাক্যব্যয় না করে দরজাটা খুলে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
নিঃশব্দে বসন্ত সেন দরজাটা আবার ভেজিয়ে দিয়ে দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়ালেন সম্মুখে দণ্ডায়মান কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে।
কিরীটীবাবু!
বলুন।
আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?
বলুন!
এ ব্যাপারে আর আপনি থাকবেন না। এখান থেকে চলে যান। আপনার পুরো ফিসই আমি দেবো। সবিতা আর সত্যজিৎ ওরা বুঝতে পারবে না—
কিন্তু
তাছাড়া ভেবে দেখুন, কি হবে আর মিথ্যা কাদা ঘাঁটাঘাঁটি করে
আপনি কি তাই মনে করেন? তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কথা কয়টি বলে কিরীটী তাকাল বসন্ত সেনের মুখের দিকে।
হ্যাঁ, তাই মনে করি। এটকু অন্ততঃ বুঝবার আমার শক্তি আছে কিরীটীবাবু, এবং পেরেছিও। আপনি লক্ষ্মীকান্ত নন, তাই আবার অনুরোধ জানাচ্ছি, আপনি ফিরে যান। বরং আপনার প্রাপ্যের চাইতে বেশীই কিছু—
ভুল করছেন আপনি সেন মশাই। বুঝতেই যখন কিছুটা আপনি আমাকে পেরেছেন, এটকুও আপনার বোঝা উচিত ছিল, টাকার লোভ দেখিয়ে আমাকে আপনি নিরস্ত করতে পারবেন না। তাছাড়া আরো একটা কথা, আমাকে এ কেসে নিযুক্ত করেছেন আপনি নন-সবিতা দেবী। তিনি যদি এখন আমাকে যেতে বলেন আমি সানন্দে এই মুহূর্তে চলে যাবো, অন্যথায়—
তাহলে আপনি স্থিরপ্রতিজ্ঞই?
কথা যখন দিয়েছি, একটা মীমাংসা না করা পর্যন্ত আমার যাবার উপায় নেই সেন মশাই। আমাকে ভুল বুঝবেন না। সত্য-সন্ধানী আমি—সত্য-বন্ধ!
নিঃশব্দে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন বসন্ত সেন কিরীটীর চোখের প্রতি চোখ রেখে।
শাণিত তরবারির মতই দুজোড়া চোখের দৃষ্টি পরস্পর যেন পরস্পরের প্রতি নিবন্ধ হয়ে আছে।
বেশ তবে তাই হোক। নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বসন্ত সেন জবাব দিলেন।
একটা কথার জবাব আপনার কাছে পেতে পারি কি সেন মশাই? হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করে।
কি?
এমন কোন স্ত্রীলোককে আপনি কি জানেন, যিনি মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর বিশেষ পরিচিতাই হয়ত ছিলেন, যার নামের আদ্যাক্ষর হয়ত ছিল ল—
কিরীটীর কথা শুনে চকিতের জন্যই যেন বসন্ত সেনের চোখের তারা দুটো জ্বলে উঠে আবার স্বাভাবিক হয়ে এল। শান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন বসন্ত সেন, না—
হুঁ। আর একটি কথা বলুন! বৌরাণীর বিলে নৌবিহারের জন্য এদের কোন নৌকা বা বোট ছিল কি?
না। জবাবটা বসন্ত সেন এবারে যেন একটু ইতস্তত করে দেন।
আপনার ঠিক স্মরণ আছে?
আছে বৈকি।
হ্যাঁ, একটা কথা গতকাল আপনাকে বলা হয়নি, কানাইয়ের মার ঘরের মেঝেতে কতকগুলো অস্পষ্ট ক্লেপ-সোলের জুতোর ছাপ দেখেছিলাম। এবং ঠিক অনুরূপ জুতোর ছাপ নন্দনকাননের মধ্যস্থিত বিরাম-কুটীরের ঘরের মেঝেতেও দেখেছি। প্রথমে ভেবেছিলাম তোর ছাপগুলো বুঝি সত্যজিৎবাবুরই, পরে বুঝেছি তা নয়
আমি তো ক্রেপসোল দেওয়া জুতো পরি না রায় মশাই! শান্তকণ্ঠে জবাব দেন বসন্ত সেন।
জানি। কিরীটীর ওপ্রান্তে বঙ্কিম হাসির একটা রেখা জেগে ওঠে এবং ধীরকণ্ঠে বলে, আচ্ছা নমস্কার। প্রয়োজন হলে আমাকে সংবাদ দিতে পারেন সেন মশাই। কারণ—
কিরীটীর কথাটা নায়েব বসত সেন শেষ করতে দিলেন না, প্রশান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন, তার প্রয়োজন হবে না। ধন্যবাদ। নমস্কার।
অদ্ভুত দৃঢ়তার সঙ্গে অতঃপর ঘাড় উঁচু করে দরজাটা খুলে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে বসন্ত সেন কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
কিরীটী নির্নিমেষে বসন্ত সেনের গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইল। ওষ্ঠপ্রাতে আবার তার সেই ক্ষণপূর্বের বঙ্কিম হাসি জেগে ওঠে।