১৫. তাহলে বসেই পড়া যাক
তাহলে বসেই পড়া যাক, কি বলেন? সম্মুখের চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে, হাস্যদীপ্ত কণ্ঠে কল্যাণী বললে।
হ্যাঁ বসুন।
ঘরের কোণে একটা শাবল ও ছোট কোদালের উপরে হঠাৎ নজর পড়ে কল্যাণীর। বিস্মিত দৃষ্টিতে বস্তু দুটির দিকে তাকিয়ে কল্যাণী প্রশ্ন করলে, ব্যাপার কি? কোদাল আর শাবল দিয়ে কি হবে মিঃ রায়?
মাটি খুড়বো। হাসতে হাসতেই জবাব দেয় কিরীটী।
মাটি খুড়বেন! হঠাৎ মাটি খুড়বার কি প্রয়োজন হলো আবার?
জানেন না, মাটি খুঁড়তে খুড়তেই কত বিরাট বিস্ময়ের আমরা সন্ধান পেয়েছি! কত শত বৎসরের ঘুমন্ত অতীতকে মাটির কবর-শয্যা হতে চোখের সামনে খুঁজে পেয়েছি! তক্ষশীলা, মহেঞ্জোদড়ো, হরোপ্পা।
তা যেন হল, কিন্তু এখানেও সে সব আছে নাকি?
নেই যে তাই বা কে বলতে পারে? কবির বচন জানেন না যতন করহ লাভ হইবে রতন!
সত্যি মিঃ রায়, আপনি হেয়ালি করেও কথা বলতে পারেন!
সে কথা যাক। আপনাকে একটা কাজের ভার দিতে চাই, পারবেন?
নিশ্চয়ই। বলুন কি কাজ? উৎসাহিত হয়ে ওঠে কল্যাণী।
সন্তোষবাবুর উপরে আপনাকে একটু নজর রাখতে হবে।
সন্তোষবাবু! তাকে তো সকালবেলা থানার দারোগা arrest করে নিয়ে গেল—কিন্তু কেন বলুন তো, হঠাৎ ভদ্রলোককে arrest করল কেন?
আমার যতদূর মনে হয়, সন্তোষবাবুকে arrest করবার মত উপযুক্ত evidence লক্ষ্মীকান্ত সাহার ঝুলিতে নেই। হয়ত কয়েকটা জিজ্ঞাসাবাদ করেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে।
কিন্তু এও তো ভারী অন্যায়। এমনি করে হুট করে একজন ভদ্রলোককে arrest করে নিয়ে যাওয়া!
অন্যায় বৈকি। কিন্তু ঘটনাচক্রে এমন বিশ্রী সময়ে ও এমন বিশ্রী পরিস্থিতির মধ্যে তিনি এসে পড়েছেন যে, এ রকমটা হওয়া বিশেষ কিছুই আশ্চর্য নয়। দশচক্রে ভগবান ভূত বলে একটা প্রবাদ আছে না আমাদের দেশে, এক্ষেত্রেও অনেকটা তাই হয়েছে মিস সান্যাল।
কিরীটীবাবু?
কল্যাণীর গলার স্বরে কিরীটী যেন বেশ একটু বিস্মিত হয়েই ওর মুখের দিকে তাকাল, বলুন?
একটা অনুরোধ আমার—দাবীও বলতে পারেন। আপনি অবশ্য কথাটা মানবেন কিনা জানি না, তবে আমার কি মনে হয় জানেন, কোন কোন ক্ষেত্রে সামান্য কয়েক ঘণ্টার আলাপ-পরিচয়েই কেউ কেউ পরস্পরের কাছে এত ঘনিষ্ঠ ও এত সহজ হয়ে আসে যে ভাবতেও অনেক সময় বিস্ময় লাগে। এই ধরুন আপনার কথাই। কতক্ষণেরই বা আলাপ আপনার সঙ্গে, অথচ মনে হচ্ছে যেন আপনার সঙ্গে বুঝি কতদিনেরই না পরিচয়! হয়ত আপনি মনে মনে হাসছেন, কিন্তু
কেন, হাসবো কেন? কিরীটী হাস্যোদীপ্ত কণ্ঠেই বাধা দিয়ে বলে ওঠে।
সে যাই হোক, সেই দাবীতেই অনুরোধটা জানাচ্ছি, আপনি আমাকে আপনি বা মিস সান্যাল না বলে শুধু কল্যাণী বলে ডাকলে কিন্তু ভারী খুশী হবে এবং সেই সঙ্গে যদি আপনির দুরত্বটা তুলে দিয়ে তুমি বলে সম্বোধন করেন, তাহলে খুশীর সত্যিই বলছি অন্ত থাকবে না। তাছাড়া বয়সেও তো আমি আপনার চাইতে অনেক ছোটই হব, সেদিক দিয়েও তো অনায়াসেই আমাকে আপনি তুমি বলে ডাকতে পারেন।
বেশ তো। তুমি বলে ডাকলেই যদি তুমি খুশী হও কল্যাণী তাই হবে। কিরীটী স্নিগ্ধ কণ্ঠে জবাব দেয়।
আঃ, বাঁচলাম। এবারে নিশ্চিন্ত মনে বলি, খাওয়া-দাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে পিসেমশাইয়ের হত্যার ব্যাপারটাই ভাবছিলাম। একটা ব্যাপারে কেমন যেন খটকা লাগছে।
কি বলুন তো
আবার বলুন?
ও ভুল হয়ে গিয়েছে, বল!
আচ্ছা এই পিসিমার হত্যার ব্যাপারটা—নায়েব বলেছেন তিনি ও সম্পর্কে কিছুই জানেন না, এও কখনো হতে পারে?
কৌতুকে কিরীটী প্রশ্ন করে, কেন?
না, অনেক দিনকার পুরাতন লোক উনি এ বাড়ির, শুধু তাই নয়। পিসেমশাইয়ের একদিক থেকে যতদূর শুনলাম নাকি বন্ধুর মতই ছিলেন উনি। আমার তো মনে হয়, বিশেষ কারণেই কথাটা তিনি অস্বীকার করছেন এখন।
তুমি হয়ত ঠিকই ধরেছ কল্যাণী, তাহলেও এত তাড়াতাড়ি কোন বিষয়েই চট করে মতামত প্রকাশ করা উচিত নয়।
তারপর কানাইয়ের মার অন্তর্ধানের ব্যাপারটা!
কি মনে হয় তোমার?
এর পিছনেও কোন রহস্য আছে।
কি রকম?
পাছে কানাইয়ের মা উপস্থিত থাকলে পিসিমার ব্যাপারটা প্রমাণিত হয়, তাই হয়ত তাকে সরানো হয়েছে কৌশলে।
স্বাভাবিক।
কিন্তু বেচারীকে খুন করে কেউ ঐ বৌরাণীর বিলের জলে ড়ুবিয়ে দেয়নি তো?
তাতেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই কল্যাণী।
বলেন কি?
ঠিক তাই। একটা মিথ্যাকে ঢাকতে গিয়ে যেমন সেই সঙ্গে দশটা মিথ্যার আমদানি করতে হয়, তেমনি বহু ক্ষেত্রেই দেখা গেছে একটা হত্যার ব্যাপারকে চাপা দেওয়ার জন্য আরো দুএকটা আনুষঙ্গিক হত্যা এসে পড়ে। অথচ হত্যাকারী বোঝে না যে সে নিজে যত ধূর্ত ও ক্ষিপ্রই হোক না কেন, হত্যা তার পথ-রেখা বা চিহ্ন সর্ব ক্ষেত্রেই রেখে যাবেই পশ্চাতে। এবং সেই পথরেখা ধরে এগিয়ে চললে তাকে ধরা দিতে হবেই, সুব্রতকেও আমি বহুবার বলেছি এ কথা। কেবল একটা ছকে ফেলা—
কিন্তু সেই ছকে ফেলা
হ্যাঁ, সেজন্য কিছু সূত্রের (clue) আবশ্যক। Detection-এর মূল কথাটাই তো তাই। সুত্রকে খুঁজে বের করতে হবে
How interesting!
Interesting সন্দেহ নেই, তবে সমগ্র ব্যাপারটাকে interesting করে তুলবার জন্য স্থির বিচার-বুদ্ধি, বিবেচনা-শক্তি ও সতর্ক তীক্ষ্ণ সজাগ দৃষ্টির প্রয়োজন প্রতি মুহূর্তে। সমস্ত ব্যাপারটাই যেন একটা বুদ্ধির অঙ্ক।
বুদ্ধির অঙ্ক?
হ্যাঁ। তোমাকে যখন বর্তমান এই detection ব্যাপারে সহকর্মী হিসাবেই নিয়েছি, কয়েকটা প্রশ্ন তোমাকে ভাববার জন্য দিচ্ছি। ভেবে জবাব দিও।
প্রশ্ন? বলুন?
প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে—মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী হেমপ্রভার মৃত্যুর মধ্যে কোন যোগাযোগ আছে কিনা? ২নং প্রশ্ন হচ্ছে—যদি থেকেই থাকে তাহলে প্রথম ও দ্বিতীয় মৃত্যুর মধ্যে দীর্ঘ এই উনিশ বৎসরের ব্যবধান কেন হলো? ৩নং প্রশ্ন—ঐ উনিশ বৎসরের ব্যবধানে একই হত্যাকারীর পক্ষে একই কারণে দুজনকেই হত্যা করা সম্ভবপর কিনা? বুঝতে পারছো বোধ হয়, তৃতীয় প্রশ্নের যদি জবাবটা খুঁজে পাও, ঐ সঙ্গেই প্রথম প্রশ্নের জবাবটাও সহজ হয়ে আসবে।
হুঁ।
৪নং প্রশ্ন—দুটি মৃতদেহই ঐ একই জায়গায় বকুলবৃক্ষতলে পাওয়া গেল কেন? দুবারই হত্যার স্থান ঐ বকুলবৃক্ষতলই বেছে নেওয়া হয়েছিল, না দ্বিতীয় হত্যার পর মৃতদেহ ঐ জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল? নিয়ে যাওয়াই যদি হয়ে থাকে, কি তার উদ্দেশ্য ছিল? শুধু তাই নয়, যদি ধরে নেওয়া যায়। ঐখানেই মৃতদেহ বহন করেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, স্বভাবতই একটা প্রশ্ন। জাগবে মনে, হত্যাকারী দেহে প্রচুর শক্তি ধরে। ঐ সঙ্গে একথাও মনে হবে, তাহলে কোথায় হত্যা করা হয়েছিল?
আচ্ছা একটা কথা মিঃ রায়, আপনি কি তাহলে ধরেই নিচ্ছেন কানাইয়ের মা পিসিমার মৃত্যু সম্পকে যে কাহিনী বলেছে তা সত্য?
নিশ্চয়ই।
কিন্তু তার প্রমাণ কি?
Yes, it is an intelligent question! প্রমাণ? এক্ষেত্রে প্রমাণের চাইতে probability উপরেই আমি বেশী জোর দিয়েছি,
কিন্তু কেন?
প্রথমত কানাইয়ের মার মত একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে এ ধরনের একটা চমৎকার কাহিনী গড়ে তুলে বলবার যেমন কোন উদ্দেশ্যও থাকতে পারে না, তেমনি তার মত একজন অশিক্ষিত দাসীর পক্ষে সম্পূর্ণ পারম্পর্য ও যুক্তি বজায় রেখে এমন একটা সুষ্ঠ কাহিনী রচনা করে তুলবার ক্ষমতা থাকতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ অনেকদিনকার পুরোনো দাসী এ বাড়ির সে এবং হেমপ্রভা দেবীর বাপের বাড়ি থেকেই সে এসেছে। খাস দাসী ছিল সে হেমপ্রভা দেবীর। এবং তার প্রতি একটা প্রগাঢ় স্নেহ ও ভালবাসা গড়ে ওঠা কানাইয়ের মার পক্ষে অসম্ভব তে নয়ই—অস্বাভাবিকও নয়। সেদিক দিয়েও যদি বিচার করে দেখি তাহলে দেখা যাবে হেমপ্রভা দেবীর কোনরুপ কলঙ্ক রটে বা তাঁর চরিত্রের প্রতি কোনরুপ বাঁকা ইঙ্গিত আসতে পারে, কানাইয়ের মার দ্বারা সেটাও খুব স্বাভাবিক নয়। তৃতীয়তঃ কনাইয়ের মার মত একজন স্ত্রীলোকের ঐভাবে তারই মনিব-পত্নীর সম্পর্কে একটা কল্পিত কাহিনী গড়ে তুলে বলবারই বা কি স্বার্থ থাকতে পারে! চতুর্থতঃ ঘটনাটা আপনি প্রকাশ না করবার যে হেতু কানাইয়ের মা দর্শিয়েছে, সেটাও আমার চোখে খুবই স্বাভাবিক লেগেছে। এবং শেষ ও পঞ্চম, আচমকা এইভাবে কানাইয়ের মা নিরুদ্দিষ্টা হওয়ায় তার বর্ণিত কাহিনী যে মিথ্যা নয়—কথাটা আরো বেশী করেই আমার কাছে সত্য বলে মনে হচ্ছে। আর একমাত্র সেই কারণেই আজ সকাল থেকে কানাইয়ের মার নিরুদিষ্টা হবার পর থেকে বর্তমান রহস্যের চিন্তাধারাটা আমি একটা নির্দিষ্ট পথে চালনা করতে সক্ষম হয়েছি।
মুগ্ধ বিস্ময়ের সঙ্গেই কল্যাণী কিরীটীর যুক্তিপর্ণ আলোচনা শুনছিল। সামান্য একটা ব্যাপারকে সে কত তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসা ও যুক্তি দিয়ে বিচার করে ভাবলেও চমৎকৃত হতে হয়।
কিরীটীর কণ্ঠস্বর আবার শোনা গেল, রাজহাঁস যেমন দুধ ও জলের মধ্যে থেকে কেবল দুধটাকেই ছেকে টেনে বের করে নেয়, রহস্যের তদন্তের ব্যাপারেও আমাদের তেমনি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ঘটনার মধ্য হতে নির্জলা প্রয়োজনীয় সত্যটকু ছেকে নিতে হবে। তবেই না সমস্ত রহস্যটা সহজ হয়ে আসবে! তারপর সহসা কিরীটী নিজের হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললে, কিন্তু এবারে আমাকে একবার থানার দিকে যেতে হবে যে কল্যাণী!
এখন থানায় যাবেন?
হ্যাঁ, বেলা প্রায় আড়াইটে হল, দেখে আসি সন্তোষ-পর্ব কতদূর গড়াল! মৃদু হাস্য সহকারে কথাটা বলতে বলতে কিরীটী চেয়ারটা হতে গাত্রোত্থান করল।
কখন ফিরবেন মিঃ রায়?
বেশী দেরি হবে না। সন্ধ্যার আগেই হয়ত ফিরতে পারবো।
কল্যাণী কক্ষ হতে বের হয়ে যাবার পর কিরীটী সর্বপ্রথমে ঘরের দরজাটায় খিল তুলে দিল। সত্যজিৎ এখন সবিতার ঘরেই আছে, চট করে এ ঘরে আসবে না। মাত্র কয়েক দিন আগেকার তার ভবিষ্যৎ বাণীটা মনে পড়ে যায়, বর্তমান এই কেসেরই কথাপ্রসঙ্গে তার কলকাতার বাড়িতে বসে সত্যজিৎকে যে আশ্বাসটুকু সে দিয়েছিল সবিতা সম্পর্কে, মনের দিক দিয়ে তাদের যে অপূর্ব একটা মিল গড়ে উঠেছে এই কদিনের সান্নিধ্যেই—সেটা আর কারো চোখে না পড়লেও কিরীটীর প্রখর ও সজাগ দৃষ্টিকে এড়াতে পারেনি। দুজনের মিলেছে ভাল। এবং সামান্য এই কদিনের আলাপ-পরিচয়ে কিরীটী বুঝতে পেরেছিল বেশ বলিষ্ঠ চরিত্রের ছেলেটি। বেশীর ভাগ সময়ে সবিতা ও সত্যজিৎ প্রায় একই সঙ্গে থাকে। সত্যজিতের নিরবসর সাহচর্যে পিতার আকস্মিক মৃত্যু শোকটাও সবিতার কাছে অনেকটা সহনীয় হয়ে এসেছে। একটিবার নন্দনকাননটা ঘুরে দেখে আসতে হবে, সেই কারণেই কিরীটী কাজের দোহাই দিয়েই আপাততঃ কল্যাণীকে বিদায় দিয়েছে ঘর থকে। থানায় যাবার জন্য লক্ষ্মীকান্ত আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেও আপাততঃ তার যাবার ইচ্ছা নেই। অতএব এই হচ্ছে উপযুক্ত অবসর। নায়েব বসন্তবাবু কাছারি বাড়িতে গিয়েছেন টমটম নিয়ে। সবিতা ও সত্যজিৎ উপরে সবিতার ঘরে বিশ্রম্ভালাপে রত। নিত্যানন্দ সান্যাল এখন, দিবানিদ্রা দিচ্ছেন। বাড়ির দাসদাসীরাও এখন বিশ্রাম নিচ্ছে। কিরীটী একটা জামা গায়ে দিয়ে নিঃশব্দে ঘর হতে বের হয়ে দোতলার শুন্য বারান্দাটার উপরে এসে দাঁড়াল। দ্বিপ্রহরের নির্জনতায় সমস্ত প্রমোদভবন যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। কোথায়ও এতটুকু সাড়াশব্দ পর্যন্ত যেন নেই। কার্নিশের ওপরে কবুতরগুলিও নিস্তব্ধ। তথাপি তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে চারিদিকে এক বার তাকিয়ে নিয়ে কিরীটী সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো জামার পকেটে খুরপীর মত একটা ছোট্ট অস্ত্র নিয়ে। নিচের অনুরুপ বারান্দাটা অতিক্রম করে কিরীটী বাঁধানো আঙ্গিনাটার উপরে এসে দাঁড়াল। মাথার উপরে সূর্য অনেকটা হেলে পড়েছে, তথাপি আষাঢ়ের তীব্র রৌদ্রদাহ চারিদিক যেন ঝলসে দিচ্ছে। আঙ্গিনা অতিক্রম করে শেষপ্রান্তের একটা খালি অব্যবহার্য ঘরের মধ্যে এসে সে ঢুকল। গতকালই দ্বিপ্রহরের দিকে কিরীটী গোটা বাড়িটাই একবার ঘুরে ঘুরে দেখছিল। ঐ ঘরের মধ্যে একটা দরজা আছে। আঙ্গিনার দরজাটি ছাড়াও যে দরজাপথে প্রমোদভবনের বাইরে নন্দনকাননে যাবার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বাঁধানো পথটার উপরে গিয়ে পড়া যায়। দরজাটা খুলে কিরীটী সেই পথের উপরে এসে দাঁড়াল। ঐ পথ দিয়ে নন্দনকানন যেতে মিনিট পাঁচেকের বেশী লাগে না। নন্দনকাননে পৌঁছে কিরীটী জঙ্গলাকীর্ণ বাগানটার মধ্যে অন্যমনস্ক ভাবে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। এবং ঘুরতে ঘুরতেই একসময় কিরীটী পূর্ববর্ণিত সেই পুরাতন পত্রবহুল বকুল বৃক্ষটির নিচে ছায়ায় এসে দাঁড়াল।
এই বকুলবৃক্ষতলই হচ্ছে অকুস্থান।
একটি মৃতদেহ এই বৃক্ষতলে দীর্ঘ উনিশ বৎসর আগে আবিষ্কৃত হয়েছিল, দ্বিতীয় মৃতদেহটি মাত্র কয়দিন আগে আবিষ্কৃত হয়েছে। সহসা একটা কথা কিরীটীর মনে হয়। এই নন্দনকানন দীর্ঘকাল অব্যবহার্যই পড়ে ছিল। বহুদিন মানুষের পদচিহ্ন এখানে পড়েনি। প্রমোদভবন হতে নন্দনকাননে আসবার যে দুটি দ্বারপথ—তার চেহারা ও অবস্থা দেখলেই বোঝা যায় বহুদিন সে দ্বার দুটি ব্যবহার করা হয় নি। খোলা হয় নি ঐ দ্বার দুটি। মানুষের বর্জন ও অবহেলায় ক্রমে এই নন্দনকানন আগাছা ও জঙ্গলে পরিকীর্ণ হয়ে উঠেছিল। এসব সত্ত্বেও নায়েব বসন্ত সেন এইখানেই বা কেন তার প্রভুর অন্বেষণে এসেছিল? তবে কি এখানে মধ্যে মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী আসতেন? এবং সে সংবাদ কি বসন্ত সেনের অগোচর ছিল না? যদি ধরে নেওয়া যায় আসতেনই, তাহলে সে কথাটা জানা বসন্ত সেনের পক্ষে অন্ততঃ অসম্ভব ছিল? কিন্তু কেনই বা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী এই নন্দনকাননে আসতেন? তাঁর মৃতা স্ত্রীর কথা স্মরণ করেই কি? দীর্ঘ উনিশ বৎসর ধরে কারো স্মৃতি এমনি করে বহুন করা সম্ভব কিনা এবং সম্ভব হলেও মৃত্যুঞ্জয়-চরিত্রে সেটা সম্ভব ছিল কিনা? মৃত্যুঞ্জয় স্ত্রীকে অবশ্যই ভালবাসতেন, নচেৎ আর দ্বিতীয়বার দ্বার পরিগ্রহই বা করলেন না কেন? সংযমী ও মিতবাক পুরুষ ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় এবং চরিত্রের তাঁর ঐ দিকটা অবশ্য সবিতার কথা হতেই জানা গিয়েছে। স্ত্রীকে ভালবাসলেও তিনি কদাপি ভুলেও একমাত্র কন্যা সবিতার সঙ্গেও মৃতা স্ত্রীর সম্পর্কে আলোচনা করতেন না। কিন্তু কেন? এও কি স্ত্রীর প্রতি গভীর প্রেমেরই একটা লক্ষণ? না তার কোন নিগূঢ় কারণ ছিল? কোন কারণেই তিনি স্ত্রীর সম্পর্কে যাবতীয় আলোচনা সযত্নে ইচ্ছাপূর্বকই এড়িয়ে চলতেন, এমন কি একমাত্র কন্যার নিকটে পর্যন্ত। সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর আরো একটা কথা মনে হয়, উনিশ বৎসর পরে একদা প্রভাতে অসুস্থ স্ত্রীকে সহসা তাঁর ঘরে শয্যায় না দেখতে পেয়ে কি কারণেই বা স্ত্রী সম্পর্কে তিনি অমন সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন? স্ত্রীকে ঘরে পাওয়া যাচ্ছে না, সেজন্য তাঁর অমন লুকোচুরি করারই বা কি এমন প্রয়োজন ছিল? খোলাখুলি ভাবে ব্যাপারটা সকলের সঙ্গে আলোচনা না করে অমন রহস্যজনক ভাবে রাতারাতি অসুস্থা স্ত্রীকে চিকিৎসার দোহাই দিয়ে কলকাতায় নিয়ে চলে যাবারই বা কি প্রয়োজন ছিল? কেন সমগ্র ঘটনাকে অমনভাবে সাজানো হলো? লোকে যদি জানতই যে তাঁর স্ত্রীকে বাড়ির মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না, তাতে একটা দুর্নামের বা কলঙ্কের কথা ওঠা হয়ত স্বাভবিকই ছিল কিন্তু তার চাইতেও কি বেশী কিছু সন্দেহ মৃত্যুঞ্জয়ের মনের মধ্যে ছিল?
অতীত!
অতীতকেই সর্বাগ্রে জানতে হবে এ রহস্যের মীমাংসা করতে হলে। চিন্তিত কিরীটী নন্দনকাননের মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। এবং ঘুরতে ঘুরতেই একসময় কিরীটী একেবারে জলের ধার ঘেষে এসে দাঁড়ায়।
সহসা পাড়ের একটা জায়গা ওর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে। সেখানকার মাটিতে যে লম্বা লম্বা ঘাসগুলো আছে সেগুলো যেন মাটির বুকে একেবারে লেপটে আছে। একটু নিস্তেজ ও শুকনোও যেন। নিঃশব্দে কৌতুহলে এগিয়ে গিয়ে কিরীটী সেখানকার মাটির ঘাসগুলো পরীক্ষা করতে থাকে। নিয়মিত ভাবেই দীর্ঘদিন ধরে কোন ভারী বস্তুবিশেষের চাপে যেন সেখানকার মাটি আর ঘাস থেতলে গিয়েছে। কোন ভারী বস্তুর ধাক্কা খেয়ে খেয়ে জায়গাটা যেন চিহ্নিত হয়ে আছে আশপাশের পাড়ের অন্যান্য অংশ হতে।
কিরীটী তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চারিদিক পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। পাড়ের অন্যান্য অংশের চাইতে গাছপালাগুলোও এখানে যেন একটু ঘন সন্নিবেশিত, একটু ছায়াবহুল, একটু অন্ধকার, একটু নির্জন। বড় বড় শাখাপ্রশাখা ও পত্রবহুল দুটো পলাশবৃক্ষ। একটি পলাশবৃক্ষের তলে মস্ত বড় একটা পাথরের মত আছে। আরো একটু এগিয়ে কিরীটী পাথরটার সামনে এসে দাঁড়াল। আশ্চর্যই লাগে কিরীটীর। পাথরটা বেশ পরিচ্ছন্ন। এই জঙ্গলাকীর্ণ মানুষের অগম্য স্থানে অমনি একটি পরিষ্কার পাথর কিরীটীর দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারে না। চিন্তিত মনেই কিরীটী পাথরটার উপর এগিয়ে গিয়ে উপবেশন করল।
সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। প্রখর রৌদ্রের তেজ অত্যন্ত স্তিমিত অবসন্ন। চারিদিকে বিস্তৃত হয়ে পড়েছে একটা স্নিগ্ধ ছায়া। নিস্তরঙ্গ বিলের জল। সামনের দিকে তাকাল কিরীটী। পূর্ব ও পশ্চিম দিকে এক দিকে তার পশ্চাতে নন্দনকানন, অন্য দিকে যতদূর দৃষ্টি চলে কেবল জল আর জল। দক্ষিণদিকে অস্পষ্ট পাড়ের রেখা দেখা যায়। বৈকালের ম্রিয়মাণ আলোয় দেখা যায় কেবল একটা ধূসর রেখা। বোঝা যায় ঐদিকটার পাড়ে গাছপালা আছে। এই দ্বীপ থেকে দক্ষিণের ঐ পাড়ের দুরত্ব কতটা হবে? খুব বড়জোর আধমাইলটাক হবে হয়ত।
আরো কিছুক্ষণ বাদে কিরীটী উঠে দাঁড়াতে যাবে, সহসা ওর নজরে পড়ল দিনশেষের ম্লান আলোয় ঠিক ওর পায়ের নিচেই ঘাসের উপরে কি যেন একটা চিকঠিক করছে। কৌতূহলভরে কিরীটী ঝুঁকে নিচু হয়ে ঘাসের উপর থেকে হাত বাড়িয়ে বস্তুটা তুলে নিল।
স্বর্ণ-অঙ্গুরীয় একটি।
হাতের পাতার উপরে স্বর্ণ-অঙ্গরীয়টি রেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরীক্ষা করতে লাগল কিরীটী। ওর নজর পড়ল অঙ্গরীয়ের উপরে একটি নামের আদ্যাক্ষর লেখা, দেবনাগরী অক্ষরে অক্ষরটা হচ্ছে ল। কিরীটী অঙ্গরীয়টা বুকপকেটের মধ্যে রেখে দিল।
স্থানত্যাগ করে এবারে কিরীটী নন্দনকাননের মধ্যস্থিত বিরাম-কুটীরের দিকে অগ্রসর হলো।
আকাশের আলো যেন আরো ম্লান হয়ে এসেছে। একটা বিষণ্ণ করুণ স্তব্ধতা চারিদিকে যেন জমাট বেধে উঠছে ক্ৰমে ক্ৰমে। অদ্ভুত একটা স্তব্ধতা, কেবল মধ্যে মধ্যে চারিপাশ্বের বৃক্ষাদি হতে এক-আধটা পাতা খসে খসে পড়ছে নিঃশব্দে। সহসা কতকগুলো বিচিত্র পাখীর শব্দে চারিদিক মর্মায়িত হয়ে উঠলো। সন্ধ্যায় নীড়াগতা পাখীর দল।
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে বিরাম-কুটীরের বারান্দায় উঠলো এবং কয়েক পা অগ্রসর হতেই অস্পষ্ট আলোয় ওর নজরে পড়ল বারান্দার ধুলায় অস্পষ্ট কতকগুলো ছোট ছোট পদচিহ্ন।
ভাল করে পরীক্ষা করে দেখবার জন্য কিরীটী পকেট হতে শক্তিশালী টর্চবাতিটা বের করে বোতাম টিপে টর্চের আলোয় সেই পদচিহ্নগুলি দেখতে লাগল।
ক্ষীণ অষ্পষ্ট পদচিহ্ন! স্বভাবতঃ চট করে কারো দৃষ্টিতে পড়বে না। ভিজে কাদামাখা পায়ে কেউ কোনদিন হেঁটে গিয়েছিল। হয়ত তারই অস্পষ্ট চিহ্ন—আজও সামান্য যা বোঝা যাচ্ছে। এবং আরো নজরে পড়ল সেই পদচিহ্নগলোর আশেপাশেই ধুলোর ওপর জুতোর সোলের কতকগুলো ছাপ। ছাপগুলো প্রথম পায়ের ছাপ হতে অনেক স্পষ্ট। বোধ হয় অল্প কিছুদিন আগে মাত্র জুতো পায়ে কেউ এখানে এসেছিল। ক্রেপ সোল দেওয়া জুতোর ছাপ। প্রমোদভবনে কে কি রকম জুতো পায়ে দেয়? কিরীটীর মনে পড়ল, লক্ষ্য করেছে সে একমাত্র সত্যজিৎই ভারী ক্রেপ সোলের জুতো পায়ে দেয়। সত্যজিৎই এসেছিল হয়ত এখানে। মনে মনে হাসে কিরীটী। অনুসন্ধিৎসা আছে ছেলেটির, দেখেশুনে শেষ পর্যন্ত হালে পানি না পেয়েই তার দ্বারস্থ হয়েছে। কিন্তু পাশের ঐ অস্পষ্ট পদচিহ্নগুলো কার? পদচিহ্নের গঠন ও আকার দেখে মনে হয় কোন স্ত্রীলোকেরই পদচিহ্ন ওগলো। তবে কি সবিতাও এসেছিল সত্যজিতের সঙ্গে এখানে? কিন্তু তাই বা কি করে হবে? যতদূর মনে পড়ে ও লক্ষ্য করেছে, সবিতা তো কদাপি খালি পায়ে চলাফেরা করে না। এমন কি বাড়ির মধ্যে কক্ষেও না। এতদূর সে খালি পায়ে নিশ্চয়ই আসেনি? তবে কার পদচিহ্ন?
ক্রমে এক এক করে কিরীটী বিরাম-কুটীরের সমস্ত কক্ষগুলোই পরীক্ষা করে দেখল। অনুরূপ পদচিহ্ন আর কোথাও সে দেখতে পেল না।
দিনের বেলা আর একবার এসে বিরাম-কুটীরটা ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
বাইরে সন্ধ্যার কালো ছায়া একটু একটু করে ক্রমে যেন চারিদিক ছেয়ে ফেলছে। ধূসর আলোয় আশেপাশের গাছপালাগুলো অস্পষ্ট ছায়ার মত মনে হয়।
নির্দিষ্ট নিজের কক্ষের দ্বার ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতেই কিরীটী চমকে উঠল। ইতিমধ্যে এক সময় ভৃত্য এসে কক্ষের আলোটা জেলে দিয়ে গেলেও আলোর শিখাটা কমানো। মৃদু আলোয় কিরীটীর চোখ পড়ল কক্ষের মধ্যে একটা চেয়ার অধিকার করে বসে আছে সন্তোষ চৌধুরী।
কিরীটীর পদশব্দে সন্তোষ ততক্ষণে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।
সন্তোষবাবু?
হ্যাঁ আমি—আপনার অপেক্ষাতেই বসে আছি মিঃ রায়। মৃদু কণ্ঠে সন্তোষ চৌধুরী প্রত্যুত্তর দিল।
কি ব্যাপার? থানা থেকে কখন ফিরলেন? বসুন। বসুন।
সন্তোষ আবার চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল। কিরীটীও অন্য একটা চেয়ার টেনে মুখোমুখি হয়ে বসল।
এই মিনিট কুড়ি হবে—
তারপর কি খবর বলুন? হঠাৎ আপনাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন কেন দারোগা সাহেব?