বৌরাণীর বিল: ১২. কল্যাণীর পিতা নিত্যানন্দ সান্যাল

বৌরাণীর বিল: ১২. কল্যাণীর পিতা নিত্যানন্দ সান্যাল

১২. কল্যাণীর পিতা নিত্যানন্দ সান্যাল

কল্যাণীর পিতা নিত্যানন্দ সান্যাল এসে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করলেন পরক্ষণেই। পরিধানে একটা সাদা ধুতি, গায়ে একটা মের্জাই। পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি।

আসুন সান্যাল মশাই। এদের সঙ্গে আপনার পরিচয়টা করিয়ে দিই। ইনি শ্রীযুক্ত লক্ষ্মীকান্ত সাহা, এখানকার থানার বড়বাবু। ইনি মিঃ কিরীটী রায় রহস্যভেদী—আর ইনি—

নমস্কার, আসুন। আপনার পরিচয় আগেই আপনার কন্যা দিয়েছেন। লক্ষ্মীকান্ত বসন্ত সেনের বক্তব্যে বাধা দিয়ে কথাটা বললেন।

বটে! বটে! মা কালই বুঝি আগেই আমার পরিচয় দিয়েছে? কিন্তু মেয়ের কাছ থেকে বাপের পরিচয়—সেটা তো ঠিক পরিচয় পাওয়া হলো না দারোগা সাহেব! কৌতুকমিশ্রিত কণ্ঠে জবাব দিলেন সান্যাল।

কেন বলুন তো? প্রশ্ন করলেন লক্ষীকান্ত।

কেন আবার! অতিশয়োক্তিতে সে পরিচয় যে অনিবার্য ভাবেই দুষ্ট হবে। তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, সকালে উঠে কোথায় গিয়েছিলে মা-জননী? আমার এখনো উপাসনা সমাপন হয়নি। প্রভাত-উপাসনার ব্যবস্থাটা করে দাও তো গিয়ে মা

এখনি যাচ্ছি বাবা। সমস্ত ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি। কতকটা যেন লজ্জিত ভাবেই কথা কটি বলে কল্যাণী কক্ষ হতে একটু দ্রুতই নিক্রান্ত হয়ে গেল।

আপনি কালই এখানে এসে পৌচেছেন শুনলাম! কথাটা বললেন লক্ষ্মীকান্ত নিত্যানন্দ সান্যালের মুখের দিকে তাকিয়ে।

হ্যাঁ। সংবাদপত্রে সব জানা মাত্রই চলে আসতে হলো। আপনার বলতে আজ আমি ছাড়া মেয়েটার আর কেউই তো নেই। দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। ছেলেবয়সে মাকে হারাল, ত্রিসংসারে একমাত্র ছিল ঐ বাপ, তাকেও হারাল। খেদপূর্ণ কণ্ঠে কথাগুলো বললেন সান্যাল মশাই।

ঘরের মধ্যে উপস্থিত তিনজনের একজনও কেউই সান্যাল মশাইয়ের কথার কোন জবাব দিল না।

সকলেই নিঃশব্দে বসে রইল।

নিত্যানন্দই আবার কথা বললেন, কিন্তু ব্যাপার কি বলুন তো দারোগা সাহেব! এ যে একেবারে অসম্ভব, অবিশ্বাস্য! এই অজ শহর, এখানেও এসব ঘটে! কিরীটীবাবু, কথা বলতে বলতে হঠাৎ কিরীটীর দিকে ঘরে তাকিয়ে সান্যাল তাঁর বক্তব্যের শেষটুকু কিরীটীর উদ্দেশ্যেই যেন ব্যক্ত করলেন, আপনি তো শুনলাম একজন নামকরা বিচক্ষণ গোয়েন্দা, আপনিই বলুন না?

অসম্ভব হলেও ব্যাপারটা এইখানেই তো ঘটেছে মিঃ সান্যাল! জবাব দিলেন লক্ষ্মীকান্ত সাহা।

কিন্তু কে হত্যা করলো? আর তাকে হত্যা করেই বা কি লাভ?

দ্বিতীয় প্রশ্নটার আপনার জবাব পেলেই তো আপনার প্রথম প্রশ্নটার জবাবটাও আমরা পেয়ে যাই সান্যাল মশাই! এবারে জবাব দিল কিরীটীই, এবং সেটাই তো এক্ষেত্রে আমাদের তদন্তের মূল ব্যাপার!

কি জানি কিরীটীবাবু, ঘটনাটা সংবাদপত্র মারফৎ পড়া অবধিই যেন আমি একেবারে তাজ্জব বনে গিয়েছি। তারপর একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন—

আমি চৌধুরীকে তো বেশ ভাল করেই জানতাম, অমন চরিত্রবান সহৃদয় লোক হয় না আজকালকার দিনে বড় একটা। তারপর কতকটা যেন স্বগত ভাবেই বললেন, দয়াময়, সবই তোমার লীলা প্রভু!

আমাদেরও তাই বক্তব্য সান্যাল মশাই। কিরীটী আবার কথা বলে, এ দুর্ঘটনার মধ্যে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে এবং সেটা থাকতেই হবে। বিনা উদ্দেশ্যে বা বিনা কারণে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কখনো সংঘটিত হয় না। হতে পারে না। আপনি, বসন্তবাবু, আপনার দীর্ঘদিন ধরে নিহত মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীকে জানতেন। তাঁর সম্পর্কে আপনারা আমাদের যত সংবাদ দিতে পারবেন আর কারো পক্ষেই সেটা সম্ভবপর হবে না। এবং এ-ও সত্যি যে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তুচ্ছ ঘটনার মধ্যে থেকেও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বা মলবান সত্রের সন্ধান পাই যার সাহায্যে এই ধরনের তদন্ত-ব্যাপারে মীমাংসাটা সহজ ও সরল হয়ে আসে।

কিন্তু দুঃখের বিষয় কিরীটীবাবু, সান্যাল বলতে লাগলেন, এমন কোন ঘটনাই কই চৌধুরী সম্পর্কে আমার মনে পড়ছে না যেটা আপনাদের বললে আপনারা এ ব্যাপারে আলোর সন্ধান পাবেন, যে ঘটনাকে তার এইভাবে নিহত হবার সামান্যতম কারণ বলেও বিবেচনা করা যেতে পারে। তাহলেও আপনার যদি আমাকে বলেন ঠিক কি আপনারা জানতে চান চৌধুরী সম্পর্কে, তাহলে জানা থাকলে বলতে পারি কারণ সে যে আমার কতখানি আপনার ছিল সে একমাত্র আমিই জানি। আমার কোন মার পেটের বোন ছিল না কিরীটীবাবু। হেম আমার দূর-সম্পর্কীয় মামাতো বোন হলেও সহোদরারও অধিক ছিল। একই মায়ের স্নেহের অঞ্চলে সে ও আমি বর্ধিত হয়েছি। সে যে আমার কত খানি ছিল, বলতে বলতে প্রৌঢ় সান্যালের গলার স্বরটা রুদ্ধ হয়ে আসে— দুই চক্ষুর দৃষ্টি অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে ওঠে।

সান্যালের শেষের কথাগুলোতে কক্ষের আবহাওয়াটা যেন কেমন করুণ হয়ে ওঠে।

সান্যাল তাঁর ধুতির প্রান্ত দিয়ে উদগত অশ্রুকে মুছে নিয়ে আবার বলতে লাগলেন, উনিশ বৎসর পূর্বে হঠাৎ একদিন কলকাতা থেকে চৌধুরীর চিঠিতে যখন জানলাম হেমের মৃত্যু হয়েছে, সে আর ইহজগতে নেই, সেদিনের কথা আমি ভুলবো না কিরীটীবাবু। হেমের অসুখের সংবাদ পূর্বেই চৌধুরীর চিঠিতে পেয়েছিলাম বটে, কিন্তু সে যে অত শীঘ্র আমাদের মায়া কাটিয়ে তার এত সাধের সাজানো ঘর ফেলে ঐ বয়সেই মৃত্যুমুখে পতিত হবে এ যেন সত্যিই আমার স্বপ্নাতীত ছিল। হেমের মৃত্যুর পর দুবার মাত্র এখানে আমি এসেছি। —এ বাড়িতে পা দিলেই যেন হেমের শত সহস্র স্মৃতি আমার কণ্ঠ টিপে ধরেছে, তাই হাজার ইচ্ছা হলেও এদিকে আর পা বাড়াইনি। আর পা দিয়েই বা কি হবে বলুন! যার সঙ্গে সম্পর্ক সে-ই যখন রইল না! আর চৌধুরীর কথাই বা কি বলবো, কি যে ভালবাসত ও হেমকে! হেমের অসময়ে মৃত্যুতে ও যেন একেবারে হঠাৎ অল্প বয়সেই দেহ ও মনে স্থবির হয়ে পড়েছিল। বাইরে থেকে অবশ্য বুঝবার উপায় ছিল না, ভিতরে ভিতরে একেবারে শুকিয়ে। যেন নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল।

কিরীটী ও বসন্ত সেনের মধ্যে একবার দৃষ্টি-বিনিময় হয় চকিতে, যখন সান্যাল হেমপ্রভার মৃত্যুর কথা বলছিলেন। কিন্তু কিরীটী বা বসন্ত সেন দুজনার কেউই সান্যালের কথার মধ্যে কথা বলে তাঁকে বাধা দিল না। সান্যালের বক্তব্য শেষ হতেই সহসা কিরীটী বলে ওঠে, একটা কথা সান্যাল মশাই, একটু আগে আপনার ভগ্নী হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যু সম্পর্কে যে কথাটা বললেন, মানে তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছিল, তাই কি?

বিস্মিত সান্যাল কিরীটীর প্রশ্নে ওর মুখের দিকে প্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ, কেন বলুন তো?

কিন্তু কানাইয়ের মার মুখে হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যু সম্পর্কে যা জানা গিয়েছে সেটা কিন্তু, কিরীটী শেষটুকু বলতে বোধ হয় ইতস্ততই করে।

সান্যাল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন, কি শুনেছেন?

হেমপ্রভা দেবীর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেনি এবং সকলে যা জানে কলকাতায়ও তাঁর মৃত্যু ঘটেনি।

সে কি! একই সঙ্গে বলতে গেলে প্রায় কথাটা উচ্চারণ করলেন সান্যাল ও দারোগা লক্ষ্মীকান্ত সাহা।

নিষ্ঠুর সত্যকে এবার অত্যন্ত খোলাখুলি ভাবেই যাচাই করার প্রয়োজন। এতকাল যা ঘন রহস্যের অন্তরালে সকলের অজ্ঞাত ছিল আর তা থাকবে না। মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর মৃত্যুর রহস্য অতীতের আর এক রহস্যকে লোকচক্ষুর সম্মুখে উন্মোচিত করল যেন অতর্কিতেই।

কালের বিধান।

কালস্রোতে যা নিশ্চিহ্ন হয়ে ধুয়ে-মুছে একবারে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে বলেই সকলে ভেবেছিল, আজ আবার কানাইয়ের মা তাকে বর্তমানের মধ্যে এনে উপস্থিত করেছে।

ক্ষণপূর্বে উচ্চারিত কিরীটীর কথায় ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলকেই কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চুপ হয়ে থাকে।

কারো কণ্ঠ হতে এতটুকু স্বরও নির্গত হয় না।

বারেকের জন্য চকিত দ্রুত দৃষ্টি সঞ্চালনে কিরীটী ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিল।

হ্যাঁ, গতকাল সেন মশাইয়ের সঙ্গেও ঐ কথারই আলোচনা আমরা করেছিলাম—কিরীটী আবার বলে।

এ কথা কি সত্য বসন্ত? এবারে প্রশ্ন করলেন সান্যাল বসন্ত সেনকে।

না, সত্য নয়। কঠোর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে নায়েব প্রত্যুত্তর দিলেন।

নায়েব মশাই, কোন কিছু আপনার অজ্ঞাত বলেই তাকে একমাত্র সেই যুক্তিতেই মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে পারেন না। কালও আপনাকে এটুকুই বলবার চেষ্টা করেছিলাম। বিশ্বাস করুন, কানাইয়ের মা মিথ্য বলেনি।

ডাক তো বসত ভায়া একবার ঐ ঝি কানাইয়ের মাকে। কথাটা বললেন সান্যালই এবারে।

হ্যাঁ, তাই ডাকুন, সত্যিই যদি মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর স্ত্রী হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যুর ব্যাপারে কোন রহস্য থেকেই থাকে সেটাকে অতি অবশ্য যাচাই করা প্রয়োজন। লক্ষ্মীকান্ত যেন অতি উৎসাহের সঙ্গে কথাটা বললেন।

গোবিন্দ এই গোবিন্দ! বসন্তবাবু দরজার বাইরে গিয়ে ভৃত্য গোবিন্দকে ডাকলেন।

একটু পরেই গোবিন্দ ঘরের মধ্যে এসে উপস্থিত হলো, বাবু!

কানাইয়ের মাকে একবার ডেকে দে তো। যা শীগগির পাঠিয়ে দে এ ঘরে। গোবিন্দ আদেশ পালনের জন্য চলে গেল।

কিন্তু কানাইয়ের মার কথার সত্যতা যাচাই করার চাইতেও ঢের বিস্ময় সকলের জন্য অপেক্ষা করছিল, যখন গোবিন্দ এসে সংবাদ দিল সকাল থেকে কানাইয়ের মাকে বাড়ির মধ্যে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

কানাইয়ের মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সে আবার কিরে! ভাল করে। খোঁজ নিয়ে দেখ। কোথায় যাবে বুড়ী!

তীক্ষ্ণ রাগত কণ্ঠে কথাগুলো বললেন বসন্ত সেন।

আজ্ঞে ভাল করেই দেখেছি। ঠাকুর আর বনমালীও বললে, সকাল থেকে অনেক খুঁজেও তাকে পাওয়া যায়নি—

ঠিক এমনি সময় প্রথমে সবিতা ও তার পশ্চাতে সত্যজিৎ কক্ষমধ্যে এসে প্রবেশ করলে।

সবিতার চোখমুখে একটা উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে সবিতা সকলকে সেই ঘরের মধ্যে উপস্থিত দেখে, এমন কি দারোগা লক্ষীকান্ত সাহাকেও সেই ঘরের মধ্যে উপবিষ্ট দেখে প্রথমটায় যেন একটু ইতস্ততই করে কিন্তু পরক্ষণেই সে সঙ্কোচটুকু কাটিয়ে উঠে ব্যগ্র কণ্ঠে বসন্ত সেনের দিকে তাকিয়েই বলে, নায়েব কাকা, সকাল থেকে এ বাড়ির মধ্যে কানাইয়ের মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!

একটা জলজ্যান্ত মানুষ রাতারাতি কোথায় উধাও হয়ে যাবে? নিশ্চয়ই কৈাথাও না কোথাও আছে। আর একবার ভাল করে খুঁজে দেখতে বলছি মা গোবিন্দকে। জবাব দিলেন বসত সেন।

এতক্ষণ কিরীটী একটা কথাও বলেনি। একপাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল। এবারে সে কথা বললে, কানাইয়ের মা কোন ঘরে শুতো?

নীচের তলায় চাকরদের ঘরের পাশের একটা ঘরে। জবাব দিল সবিতা।

চলুন তো, একবার ঘরটা ঘুরে দেখে আসি। কিরীটী সবিতার দিকে তাকিয়ে চোখের দৃষ্টিতে তাকে অনুসরণ করতে বলে খোলা দরজার দিকে সর্বপ্রথম এগিয়ে গেল। এবং দরজার কাছাকাছি গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে লক্ষী কান্তকে সম্বোধন করে বললে, আসুন লক্ষ্মীকান্তবাবু, চলুন আপনিও এক বার দেখবেন না ঘরটা?

হ্যাঁ চলুন। লক্ষ্মীকান্তও অতঃপর তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলেন।

বসন্ত সেনও অনুসরণ করলেন ওদের।

বারান্দাটা অতিক্রম করে প্রশস্ত একটা বাঁধানো আঙ্গিনা। আঙ্গিনার দক্ষিণ প্রান্তে পর পর তিনটে ঘর। তারই একটা ঘরে কানাইয়ের মা সবিতারা এখানে আসবার পর থেকে রাত্রে শুচ্ছিল। ওদের এখানে আসবার পূর্বে অবশ্য কানাইয়ের মার জিনিসপত্র ঐ ঘরের মধ্যে থাকলেও, উপরের তলার একটা ঘরেই শুতো সে। পাশের দুখানা ঘরের একটায় থাকে বনমালী, অন্যটায় গোবিন্দ ও ঠাকুর!

নাতিপ্রশস্ত ঘরখানি। ঘরের দরজাটা খোলাই ছিল। সবিতাই ঘরের সামনে এসে ঘরটা দেখিয়ে দিতে সর্বাগ্রে কিরীটীই ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।

ঘরের মধ্যে জিনিসপত্র বিশেষ কিছু তেমন নেই! একধারে একটা টিনের পুরাতন রং-চটা ট্রাঙ্ক, ছোট একটা মিলারের চ্যাপ্টা তালা লাগানো। তারই পাশে একটা মাটির কলসী ও তার উপরে পরিষ্কার কাঁসার লাস উবড় করা।

দেওয়ালের গায়ে গায়ে পেরেকের সাহায্যে দড়ি টানিয়ে খানকয়েক সাদাকাপড় পরিষ্কার শাড়ি ঝোলানো আছে।

কিরীটী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে একবার চারিদিকে তার অভ্যস্ত তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে ঘরের মধ্যে পর পর যে দুটি বদ্ধ জানালা ছিল সে দুটি খুলে দিল।

এক ঝলক হাওয়া ও আলো ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল। জানালা দুটো বিলের দিকে। জানালা খুললেই দিগন্তপ্রসারী বৌরাণীর বিলের জল চোখে পড়ে।

কিরীটী শয্যাটার দিকে এগিয়ে গেল। শয্যার মলিন চাদরটা জায়গায় জায়গায় কুচকে আছে এবং মাথার বালিশটা বিছানার একধারে পড়ে আছে।

অতঃপর কিরীটী ঘরের মেঝেটা তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে পরীক্ষা করতে করতে হঠাৎ হাঁটু গেড়ে এক জায়গায় বসে পকেট থেকে একটা লেন্স বের করে সেটার সাহায্যে কি যেন দেখতে লাগল।

অন্যান্য সকলে কৌতুহলী হয়ে কিরীটীর পশ্চাতে এসে দাঁড়ায়।

মিনিট দেড়েক বাদে কিরীটী আবার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল এবং সবিতার মুখের দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করল, কানাইয়ের মা তো বিশেষ করে আপনার কাজ-কর্মই দেখাশোনা করত, তাই না?

হ্যাঁ। ইদানীং বয়স হওয়ায় তাকে বিশেষ কাজকর্ম তো করতে দেওয়া হতো না। নিজের খুশিমত যা টুকটাক কাজ একটু-আধটু করত।

কাল রাত্রে শেষবারের মত তাকে কখন আপনি দেখেন?

রাত এগারটার কিছু পরে সে আমার কাছ থেকে চলে আসে।

আজ সকালে কখন সর্বপ্রথম জানতে পারেন যে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না?

এই তো ঘণ্টাখানেক আগে। রোজ সকালে সে আমার জন্য চা নিয়ে যেত, আজ যায়নি দেখে খোঁজ করতেই তো বনমালী এসে আমাকে বললে কানাইয়ের মাকে পাওয়া যাচ্ছে না খুঁজে।

বনমালী কোথায়?

বনমালীকে ডেকে আনা হল ঘরের মধ্যে।

এই যে বনমালী, তুমি কোন্ ঘরে গতকাল রাত্রে শুয়েছিলে? কিরীটী প্রশ্ন করল।

এই ডানদিককার পাশের ঘরটাতে বাবু।

আজ সকালে তোমার দিদিমণি খোঁজ করবার আগে কানাইয়ের মাকে যে পাওয়া যাচ্ছে না, জানতে না?

আজ্ঞে না। খুজতে এসেই তো দেখলাম এ ঘরে সে নেই।

কাল রাত্রে শেষ কখন তার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল?

খাওয়ার সময় রাত্রে, তখন সাড়ে দশটা হবে—

তারপর?

আজ্ঞে তারপর আমি ঘুমোতে চলে আসি ঘরে, আর তার সঙ্গে দেখা হয়নি কাল রাত্রে।

রাত্রে কোন রকম শব্দ শুনেছিলে এ ঘরে?

না।

খুব ঘমিয়েছিলে বুঝি?

আজ্ঞে। বৃষ্টি হওয়ায় বেশ ঠাণ্ডা পড়েছিল—

ঠাকুর কোথায়? তাকে একবার ডেকে আন তো! বনমালী গিয়ে রন্ধনশালা হতে ঠাকুরকে পাঠিয়ে দিল।

বছর ত্রিশ-পয়ত্রিশ বয়সে হবে লোকটার। ঢ্যাঙা রোগা চেহারা। গায়ের। রং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। গালের হনু দুটো বিশ্রীভাবে সজাগ হয়ে আছে। পুরু কালো ঠোঁট। উপরের পাটির দাঁত বিকশিত হয়েই আছে। লোকটার স্বভাব বোধ হয় বেশ পরিচ্ছন্ন। পরিষ্কার একটা খাটো ধুতি পরিধানে। গলায় লম্ববান ধবধবে একগুচ্ছ পৈতা।

তুমিই এ বাড়িতে রান্না কর? কিরীটীই প্রশ্ন করে।

আইজ্ঞা কর্তা।

কি নাম তোমার?

আইজ্ঞা অধীনের নাম যোগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রাঢ়ী শ্রেণী।

বাড়ি কোথায়?

আইজ্ঞা সোনারাং।

কত দিন আছ এ বাড়িতে?

তা আপনাগোর আশীর্বাদে ধরেন গিয়া এক বৎসর তো হইবই।

তুমি এই পাশের ঘরেই শোও তো?

আইজ্ঞা।

কানাইয়ের মাকে বাড়ির মধ্যে কাল রাত থেকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না জান?

আইজ্ঞা কি কইলেন? কানাইয়ের মায়েরে খুইজা পাওয়া যাইতেছে না। কন কি! যাইবো কনে? এহানেই কোথায় হয়ত হইবো। খুইজা দেখুম?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত