বৌরাণীর বিল: ০৮. কিরীটীর টালিগঞ্জের বাড়িতে সত্যজিৎ

বৌরাণীর বিল: ০৮. কিরীটীর টালিগঞ্জের বাড়িতে সত্যজিৎ

০৮. কিরীটীর টালিগঞ্জের বাড়িতে সত্যজিৎ

কিরীটীর টালিগঞ্জের বাড়িতে সত্যজিৎ, সুব্রত ও কিরীটীর মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল।

সত্যজিৎ তার এক বন্ধু অমিয়র চিঠি নিয়ে প্রথমে সুব্রতর সঙ্গে দেখা করে এবং সুব্রত সত্যজিৎকে সঙ্গে নিয়ে কিরীটীর ওখানে আসে।

কিরীটী হাসতে হাসতে একসময় বললে কিন্তু একটা কথা যদি আমাকে খুলে বলেন সত্যজিৎবাবু, তাহলে বড়ই সুখী হই।

বলুন কি জানতে চান!

আপনি তো সম্পূর্ণ তৃতীয় ব্যক্তি, but why you are so much interested?

কিরীটীর প্রশ্নে সত্যজিতের মুখটা রাঙা হয়ে ওঠে।

সেটুকু কিরীটীর দৃষ্টি এড়ায় না। মৃদু হেসে সে বলে, বুঝেছি। আর বলতে হবে না। আচ্ছা আপনাদের মধ্যে কোন পূর্ব-পরিচয় বা সাক্ষাৎ আলাপ ছিল?

সত্যজিৎ এতক্ষণে লজ্জা ও সঙ্কোচটা কাটিয়ে উঠেছে, স্মিতকণ্ঠে বললে, তাহলে আপনাকে কথাটা খুলেই বলি কিরীটীবাবু। আপনাকে বলেছি, আমার বাবা ও মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী গ্রামে একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়তেন। আমাদের বাড়ি রাজবাড়িরই পাশের গ্রামে মহেশডাঙায়। মাঝে থাকে একটা খাল। মহেশডাঙা থেকে প্রত্যহ খাল পার হয়ে বাবা পাশের গ্রামের স্কুলে পড়তে আসতেন। মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী জমিদারবাড়ির ছেলে; এন্ট্রান্স পাস দেবার পর আর তিনি লেখাপড়া করেননি। বাবারও লেখাপড়া হয়ে ওঠেনি অর্থাভাবে। এবং পাস দেবার কিছুদিন পরেই বাবা একবস্ত্রে কোনমতে ভাগ্যান্বেষণে পালিয়ে যান সুদূর বর্মায়। ক্ৰমে বাবা সেখানে গিয়ে কাঠের ব্যবসা করে নিজের অবস্থা ফেরান। দুই বন্ধুর মধ্যে ভাগ্যক্রমে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও যোগাযোগটা ছিন্ন হয়নি কখনও। নিয়মিত পত্ৰমারফৎ পরস্পর পরস্পরকে সকল সংবাদ দেওয়ানেওয়া করতেন। আমার চাইতে সবিতা বছর ছয়েকের ছোট। দুই বন্ধুর মধ্যে পত্র মারফৎই কথা হয়েছিল, আমার সঙ্গে বাবা সবিতার বিবাহ দেবেন। অবশ্য এসব কথা কিছুই আমি জানতাম না। পরে মাস পাঁচেক আগে বিলেত থেকে ফিরে আসার পর বাবা একদিন আমাকে ঘরে ডেকে বললেন সব কথা। এবং তাঁর ইচ্ছাটুকুও জানালেন। কিন্তু আমি রাজী হলাম না। যাকে কোনদিন দেখিনি, যার সম্পর্কে কিছুই জানি না বলতে গেলে, তাকে হঠাৎ বিবাহ করে ঘরে আনব, কেন যেন মনের থেকে এ ব্যাপারে কিছুতেই সাড়া পাচ্ছিলাম না। কিন্তু বাবা বার বার আমাকে বলতে লাগলেন তাঁর বাল্যবন্ধুকে তিনি কথা দিয়েছেন, অন্যথায় তিনি দত্তাপহারক হবেন। অবশেষে বাবার পীড়াপীড়িতে কতকটা বাধ্য হয়েই আমি বললাম, বেশ, এখানে এসে সেই মেয়েকে দেখে যদি আমার পছন্দ হয় তাহলে আমি এ বিবাহে রাজী আছি। বাবা তাঁর বন্ধুকে পত্র মারফৎ সব কথা জানালেন। মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীও এ বিষয়ে দেখলাম অত্যন্ত। আধুনিক মনোভাবাপন্ন ছিলেন। তিনি পত্রোত্তরে জানালেন, তাই হবে, আমি যদি গিয়ে তাঁর মেয়েকে দেখে পছন্দ করি তাহলে এ বিবাহ হবে। আর তাছাড়া এও তিনি জানালেন, আজ পর্যন্ত তাঁর মেয়েকে এ বিবাহ সম্পর্কে কোন কথাই জানাননি যখন তখন আমার গিয়ে তাঁর মেয়েকে দেখার মধ্যে কোন অসুবিধাই থাকতে পারে না। সেই অনুসারেই সামনের গ্রীষ্মের বন্ধে সবিতা বাড়ি যাবে, আমাকেও ঐ সময়েই যেতে লিখলেন।

আপনি তাহলে সেই ব্যবস্থা অনুযায়ীই এসেছেন বাংলাদেশে?

হ্যাঁ।

আচ্ছা পরে আপনার সঙ্গে ও সবিতা দেবীর সঙ্গে ও-সম্পর্কে কোন কথাবার্তা হয়েছে

না।

ভাল কথা, নায়েব বসন্ত সেন যখন চৌধুরী-বাড়িতে বহুদিন আছেন, এ সম্পর্কে নিশ্চয়ই তিনি সব কিছু জানেন?

জানাটাই তো স্বাভাবিক। এবং আমার মনে হয় জানেনও, কারণ আমি যে আসছি সে কথাটা যখন তিনি চৌধুরী মশাইয়ের কাছে শুনেছিলেন তখন ও কথাটা কি আর শোনেননি?

তা বটে। তবে আপনার সঙ্গে ঐ সম্পর্কে কোন কথা হয়েছে কি?

না।

আপনার বাবাকে তাঁর বন্ধুর নিহত হবার সংবাদটা নিশ্চয়ই আপনি দিয়েছেন?

দিয়েছি।

আর বিবাহ সম্পর্কে আপনার মতামতটা? কিরীটীর চোখের কোণে কৌতুকের চাপা হাসি।

সত্যজিৎ চাপা হাসির সঙ্গে জবাব দেয়, শুধু আমার মতামত হলেই তো এক্ষেত্রে চলবে না মিঃ রায়। সবিতা দেবীরও এখন বয়স হয়েছে, লেখাপড়া শিখেছেন, তাঁর নিজস্ব একটা মতামতও তো আছে এ ব্যাপারে।

হ্যাঁ, তা একটা আছে বৈকি। তবে তাঁকে না দেখে এবং তাঁর সঙ্গে আলাপপরিচয় না করেই তাঁর সম্পর্কে আপনার মুখ থেকে যতটুকু জেনেছি, আপনার যখন এ বিবাহে অমত নেই তখন তাঁর দিক থেকে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

কেন বলুন তো? একজনের সঙ্গে আলাপ করে অন্যের thoughtreadingও আপনি করতে পারেন নাকি দুর থেকেই?

তা একটু-আধটু পারি বৈকি। নহলে এত সহজে এ ব্যাপারে আমি রাজী হতাম না। বিশেষ করে যখন জানতে পারছি এ ব্যাপারের শেষটুকু মধুরেণ সমাপ্ত হবে; এর আগের অধ্যায়ে যত দুঃখই থাকুক না কেন, সেটাই মনকে আমার inspiration যুগিয়েছে। নইলে সত্য কথা বলতে কি আপনাকে, আজকাল তথাকথিত হত্যা-রহস্যের মীমাংসার ব্যাপারে যেন কোন interestই পাই না। সেই অর্থ, সেই লালসা, সেই প্রেম, সেই প্রতিহিংসা প্রত্যেকটি হত্যার ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত দেখতে পাই এমনভাবে জড়িয়ে থাকে যে, শেষ পর্যন্ত শেষ দৃশ্যে হয় হাতকড়া বা ফাঁসির দড়ি দিয়ে এমন একটা করুণ রসের সৃষ্টি করে যে, নিজের উপরও যেন ধিক্কার এসে যায়।

কিন্তু সত্যিকারের culprit বা দোষীকে ধরিয়ে দেওয়াও তো নাগরিক হিসাবে আপনার একটা মহৎ কাজ বা কর্তব্য।

তা ঠিক আমার ক্ষেত্রে প্রযুক্ত নয় সত্যজিৎবাবু। এককালে একটা মোহ ও vanity বশেই এ lineয়ে হাত দিয়েছিলাম। বুদ্ধির খেলায় একজনকে ধরাশায়ী করতে একটা অপূর্ব পুলক অনুভব করতাম। ক্রমে সেটা একটা নেশায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এখন নেশাটা এসেছে থিতিয়ে।

কেন?

তার কারণ দেখতে পাই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তথাকথিত ঐ সব ভিলেনের দল অপরাধই করে বটে, তবে অপরাধের artটাকে জানে না।

অপরাধের আর্ট?

হ্যাঁ। আর্ট বলতে অবশ্য এক্ষেত্রে আমি এখানে ভিলেনের চাতুরীটাকেই mean করেছি। বলাই বাহুল্য আপনার ব্যাপারটা সে পর্যায়ে পড়ে না, কারণ আপনার কাছ হতে আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা শুনে আমার যতদূর মনে হচ্ছে, হেমপ্রভা চৌধুরী ও মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর হত্যার ব্যাপার দুটো একসূত্রে তো গাঁথা নয়ই, হত্যাকারীও এক নয়।

সত্যজিৎ যেন একটু বিস্মিত হয়েই কিরীটীর মুখের দিকে তাকায় এবং বলে, কিন্তু তাই যদি হবে, তাহলে দুটো মৃতদেহ একই জায়গায় পাওয়া গেল কেন? Why peculiar coincidence!

ঘটনার পারম্পর্য বা সামঞ্জস্য এক এক সময় এরকম অদ্ভুত ঘটতে দেখা যায় সত্যজিৎবাবু, কিন্তু দীর্ঘ উনিশ বছরের ব্যবধানে একই হত্যাকারী প্রথম হত্যার পর দ্বিতীয়বার হত্যা করবে এটা আদপেই স্বাভাবিক নয়।

কিন্তু

সত্যজিৎবাবু, time factor is a very important factor! আমাদের দেশে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়ে থাকে, হত্যাকারী একটা ক্ষণিক উত্তেজনার মুহূর্তেই হত্যা করে বসে। পূর্ব-পরিকল্পিত ভাবে সব situation কে closely watch করে হত্যা করে না। অবশ্য একেবারেই যে হয় না তা আমি বলতে চাই না, কারণ নজিরের অভাব নেই। যেমন ধরুন পাকুড় মার্ডার কেস, ভাওয়ালের মধ্যম কুমারকে হত্যার প্রচেষ্টা প্ল্যান করেই এবং সময় নিয়ে ঐ সব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে একটু ভেবে দেখলেই এবং সমগ্র ঘটনাকে ভালভাবে পর্যালোচনা করে দেখলে বুঝতে পারবেন সেরকম কিছু নয়। প্রথমটা দ্বিতীয়টাকে follow করেনি, তবে দ্বিতীয় হত্যাটা প্রথম হত্যাটার cause বা কারণ হতে পারে। সে যাক। এ ধরনের মতামত প্রকাশ করবার আগে আমাদের অনেক কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য এ ব্যাপারে জানা প্রয়োজন। এবং আরো অনেক কিছু বিবেচনা করে দেখা প্রয়োজন। অর্থাৎ যাকে আমরা তদন্তের ব্যাপারে findings বলি—সব এখনও আমাদের হাতে তো আসেনি।

তাহলে কবে আমরা রওনা হচ্ছি মিঃ রায়?

শুভস্য শীঘ্রং! আজই রাত্রের গাড়িতে হলেই বা ক্ষতি কি?

বেশ তো, তবে সেই রকম ব্যবস্থাই করি।

করুন।

অতঃপর সত্যজিৎ তখনকার মত কিরীটীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাত্ৰোত্থান করে।

আগের পর্ব :

০১. প্রথম আষাঢ়ের নববর্ষা
০২. নায়েব বসন্তবাবু
০৩. অত্যন্ত আকস্মিক ভাবে
০৪. পরের দিন সত্যজিতের ঘুম ভাঙল
০৫. শ্মশান হতে ফিরে
০৬. সত্যজিৎই প্রথমে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে
০৭. কথাটা সত্যজিৎ ঐদিনই

পরের পর্ব :
০৯. কিরীটীকে নিয়ে সত্যজিৎ
১০. পায়ে পায়ে একসময় কিরীটী
১১. আকাশের বুকে ভোরের আলো
১২. কল্যাণীর পিতা নিত্যানন্দ সান্যাল
১৩. সকলে আবার নায়েবের ঘরে
১৪. লক্ষ্মীকান্ত সাহা সহসা
১৫. তাহলে বসেই পড়া যাক
১৬. আর বলেন কেন
১৭. সবিতার ডাকে কিরীটীর নিদ্রাভঙ্গ
১৮. পর পর দুটি প্রভাত
১৯. লক্ষ্মীকান্ত থানায় এসে পৌঁছালেন
২০. নিত্যানন্দ সান্যাল হাঁপাতে হাঁপাতে

২১. বিল সাঁতরে প্রমোদভবনে এসে
২২. কিরীটী ও অতীনলাল সলিসিটার
২৩. ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত