০৭. কথাটা সত্যজিৎ ঐদিনই
কথাটা সত্যজিৎ ঐদিনই সকালবেলায় চা-পান করতে করতে সবিতার কাছে বললে, আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে মিস চৌধুরী, তাহলে কলকাতায় একজন ভাল ডিটেকটিভকে এনগেজ করে আসি এ ব্যাপারে!
আমিও গত রাত থেকে ঐ কথাই ভাবছিলাম সত্যজিৎবাবু। কিন্তু নায়েবকাকাকে কি একটিবার জিজ্ঞাসা করে তাঁর মতামত নেওয়া উচিত নয়?
সত্যজিৎ সবিতার প্রশ্নের জবাবে বলতে যাচ্ছিল, নিশ্চয়ই। তাঁকে অবশ্যই একবার জিজ্ঞাসা করতে হবে বৈকি, কিন্তু তার পূর্বেই ঘরের দরজার উপরে নায়েবমশাইয়ের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কিসের মতামত মা সবি?
উভয়েই চমকে ফিরে তাকাল।
পায়ে হরিণের চামড়ার চটিজুতো থাকা সত্ত্বেও ইতিমধ্যে কখন একসময় নিঃশব্দ পদসঞ্চারে নায়েব বসন্ত সেন একেবারে ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন
এবং ওদের পরস্পরের আলোচনার শেষ কথাগুলো শুনতে পেয়েছেন, এরা। টেরও পায়নি।
এই যে নায়েবকাকা, আসুন! সবিতাই আহ্বান জানাল।
কর্তার শ্রাদ্ধের যোগাড় তো এবারে দেখতে হয়, সেই ব্যাপারেই একটা পরামর্শ করবার জন্য তোমার কাছে আসছিলাম মা। কিন্তু একটু আগে কি যেন মতামতের কথা বলছিলে মা!
সবিতা সত্যজিতের মুখের দিকে একবার পলকের জন্য দৃষ্টিপাত করে।
তারপর একটু ইতস্ততঃ করে বলে, বলছিলাম নায়েবকাকা, বাবার এই মৃত্যুর কথাটা একটু ইতস্ততঃ করে সবিতা আবার বলে, ব্যাপারটাকে আমরা এত সহজে ভুলে যাব কেন?
কিন্তু মা এক্ষেত্রে আমাদের আর করবারই বা কি আছে? দারোগাবাবুর সঙ্গে তুমি এখানে এসে পৌঁছবার পূর্বেও অনেক পরামর্শ করেছি। সমস্ত ব্যাপারটাই যেন একটা অস্পষ্ট ধোঁয়ার মত মনে হয়। কোন দিক দিয়ে কোন সূত্রেরই সন্ধান আমরা পাচ্ছি না, অন্তত যার সাহায্যে একটা অনুসন্ধান করা যেতে পারে।
সূত্র হয়ত আমরা আপাততঃ দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু এসব ব্যাপারে যোগ্য ব্যক্তিও তো আছেন। তাঁরা চেষ্টা করলে
সবিতার কথায় বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালেন নায়েব বসন্ত সেন ওর মুখের দিকে।
হ্যাঁ নায়েবকাকা, ভাবছি কলকাতা থেকে একজন সুদক্ষ ডিটেকটিভ এনে
ডিটেকটিভ।
হ্যাঁ, ডিটেকটিভ। আপনি কি বলেন?
সবিতার প্রস্তাবে বসন্ত সেনের চোখেমুখে একটা সুস্পষ্ট বিরক্তির রেখা যেন দেখা দিয়ে পরক্ষণেই মিলিয়ে যায়।
একবার আড়চোখে বসন্ত সেন সত্যজিতের দিকেও তাকালেন।
বেশ তো মা। তোমার যদি তাই ইচ্ছা হয়—
তাহলে সত্যজিৎবাবু, আপনি আজই কলকাতায় চলে যান। একজন ভাল দেখে ডিটেকটিভ একেবারে সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন।
নায়েব বসন্ত সেন কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন, তারপর হঠাৎ যেন গাঝাড়া দিয়ে গলাটা খাকারি দিয়ে বলে উঠলেন, হ্যাঁ, ভাল কথা মা, তোমার মামাবাবু, নিত্যানন্দ সান্যাল মশাই এখানে আসছেন দুচার দিনের মধ্যেই। আমাকেও একটা চিঠি দিয়েছেন, আর এই নাও তোমারও একটা চিঠি আছে।
বসন্ত সেন একটা খাম এগিয়ে দিলেন সবিতার দিকে!
মামাবাবু! মামাবাবু আসছেন? সবিতার মনে পড়ে নিত্যানন্দ সান্যালকে। মধ্যে মধ্যে কলকাতায় এসে ওর হস্টেলে ওর সঙ্গে দেখা করেছেন এবং এখানেও এসেছেন। তার মা হেমপ্রভার দুরসম্পর্কীয় পিসতুত ভাই। আপন মায়ের পেটের ভাই নয়। ওর মায়ের মৃত্যুর আগে মধ্যে মধ্যে এ বাড়িতে আসতেন। কানাইয়ের মার মুখেই শোন, তার মা নাকি ঐ সান্যাল-বাড়িতেই মানুষ। ছোটবেলায় মা-বাপ মারা যাওয়ায় ঐ মামাবাবুর মার কাছেই নাকি মা মানুষ হয়েছে এবং ঐ সান্যাল-বাড়ি থেকেই মার বিবাহ হয়।
পরবর্তীকালে নিত্যানন্দ সান্যাল চাকরিব্যাপদেশে পাঞ্জাবের লুধিয়ানায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন।
তবে দূর পাঞ্জাবে চলে গেলেও মামাবাবুর সঙ্গে ওদের সম্পর্ক বা যোগাযোগটা ছিন্ন হয়নি, এমন কি তার মায়ের মৃত্যুর পরও। কারণ বলতে গেলে তার মায়ের দিক দিয়ে একমাত্র আত্মীয় ঐ নিত্যানন্দ সান্যালই ছিলেন বেঁচে। দূরসম্পর্কীয় ভাই বোন হলেও সেই শিশুকাল হতে একই গৃহে পাশাপাশি মানুষ হওয়ার দরুন ও মায়ের ইহজগতে আর আপনার জন বলতে দ্বিতীয় কেউ না থাকায় নিত্যানন্দ সান্যাল অর্থাৎ তার ঐ মামাবাবুর মায়ের পরমাত্মীয়ই
লোকটিও চমৎকার। বাঙালীর মধ্যে সচরাচর অমন চমৎকার দেহসৌষ্ঠব বড় একটা চোখে পড়ে না। টকটকে উজ্জল গায়ের বর্ণ। খড়গের মত নাসিকা। চোখ দুটো কি হাস্যময়! একমুখ দাড়ি।
ইদানীং চুল দাড়ি সব প্রায় পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে। কারণে অকারণে হা-হা করে প্রাণ খুলে হাসেন।
একমাত্র মাথায় শ্বেতশুভ্র কেশ ও দাড়ি ছাড়া বুঝবার উপায় নেই লোকটার বয়স হয়েছে।
বয়সে তাঁর বাবার মতই।
দিন কুড়ি আগেও কলকাতায় কি একটা কাজে হঠাৎ এসেছিলেন একদিনের জন্য, তবু, ওর সঙ্গে দেখা করতে ভোলেননি।
বলেছিলেন এবারে পরীক্ষা হয়ে গেলে ওর বাবাকে বলে কিছুদিনের জন্য ওঁর কর্মস্থল লুধিয়ানায় ওকে নিয়ে যাবেন। সেখানে ওরই প্রায় সমবয়সী ওঁর একটি মেয়ে আছে—নাম তার কল্যাণী। অবশ্য কল্যাণীকে আজ পর্যন্ত সে দেখেনি।
বসন্ত সেন বললেন, তাহলে আমি উঠি মা। সত্যজিতের যাবার ব্যবস্থা দেখি গে।
সবিতা নিজের চিন্তায় অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। বললে, হ্যাঁ, তাই যান নায়েব কাকা।
বসন্ত সেন বিদায় নিয়ে ঘর হতে বের হয়ে গেলেন।
সবিতা নিত্যানন্দ সান্যালের চিঠিটা খুলে পড়তে লাগল। নিত্যানন্দ সান্যালের চিঠিটা সংক্ষিপ্ত।
কল্যাণীয়া মা সবিতা,
সংবাদপত্র মারফৎ তোমার পিতার আকস্মিক মৃত্যু-সংবাদে বিস্মিত ও মর্মাহত হইয়াছি। একাকিনী নিশ্চয়ই তুমি বিশেষ বিপদে ও অসুবিধায় পড়িয়াছ। তোমার বর্তমান অবস্থা আমি সম্যক উপলব্ধি করিতে পারিতেছি। শ্রীশ্রী দয়াময় দীনবন্ধু তোমাকে সহসা এইভাবে কেন যে বিপদগ্রস্ত করলেন বুঝিতে পারিতেছি না। প্রভুর লীলা বোঝা সত্যই ভার। যাহা হউক চিন্তা করিও না, এদিককার যা হয় একটা ব্যবস্থা করিয়া শীঘ্রই দুচার দিনের মধ্যে আমি রাজবাটি পৌঁছিব।
পুঃ। কল্যাণীকেও সঙ্গে লইয়া যাইতেছি।
ইতি
আঃ তোমার মামাবাবু
পত্রখানা পড়ে সবিতা নিজেও যেন কতকটা স্বস্তি ও শান্তি বোধ করে।
অনেকক্ষণ পরে সত্যজিৎ কথা বলে, যাক এ একপক্ষে আপনার ভালই হলো, আপনার মামা আসছেন তাঁর মেয়েকে নিয়ে। কিন্তু এত বড় একটা দুঃসংবাদ, তাঁকেই তো সর্বাগ্রে সংবাদ দিয়ে এখানে আনানো উচিত ছিল। বলতে গেলে এখনও তো দেখতে পাচ্ছি উনিই আপনার একমাত্র আত্মীয়।
সবিতা এবার সংক্ষেপে মামার পরিচয়টা দেয় সত্যজিতের কাছে, ইনি অবিশ্যি আমার নিজের আপন মামা নন। তবে আপনার জনের চাইতেও বেশী। মার দুরসম্পর্কীয় পিসতুত ভাই। এবং মা ঐ মামাদের বাড়িতেই মানুষ এবং শুনেছি ওখান থেকেই মার বিবাহও হয়েছিল।
তা যাই হোক, উনি এলে আপনি অনেকটা বল-ভরসা পাবেন তো বটেই, তাছাড়া ওঁর মেয়েও যখন ওর সঙ্গেই আসছেন—একজন সঙ্গী পাবেন, নিঃসঙ্গতাও অনেকটা আপনার লাঘব হবে।
মামার মেয়ে কল্যাণীকে কখনো আমি দেখিনি তবে শুনেছি সে আমারই সমবয়েসী।
তাহলে তো খুবই ভাল হবে।
***
ঐদিন রাত্রের গাড়িতে সত্যজিৎ কলকাতায় চলে গেল।
আগের পর্ব :
০১. প্রথম আষাঢ়ের নববর্ষা
০২. নায়েব বসন্তবাবু
০৩. অত্যন্ত আকস্মিক ভাবে
০৪. পরের দিন সত্যজিতের ঘুম ভাঙল
০৫. শ্মশান হতে ফিরে
০৬. সত্যজিৎই প্রথমে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে
পরের পর্ব :
০৮. কিরীটীর টালিগঞ্জের বাড়িতে সত্যজিৎ
০৯. কিরীটীকে নিয়ে সত্যজিৎ
১০. পায়ে পায়ে একসময় কিরীটী
১১. আকাশের বুকে ভোরের আলো
১২. কল্যাণীর পিতা নিত্যানন্দ সান্যাল
১৩. সকলে আবার নায়েবের ঘরে
১৪. লক্ষ্মীকান্ত সাহা সহসা
১৫. তাহলে বসেই পড়া যাক
১৬. আর বলেন কেন
১৭. সবিতার ডাকে কিরীটীর নিদ্রাভঙ্গ
১৮. পর পর দুটি প্রভাত
১৯. লক্ষ্মীকান্ত থানায় এসে পৌঁছালেন
২০. নিত্যানন্দ সান্যাল হাঁপাতে হাঁপাতে
২১. বিল সাঁতরে প্রমোদভবনে এসে
২২. কিরীটী ও অতীনলাল সলিসিটার
২৩. ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে