প্রাণ

প্রাণ

আমার বান্ধবীর কথা বলছি৷ সে চমৎকার একটা মেয়ে। কথা বলে খুব আস্তে৷ বাড়ি ঘরের বাহিরে তাঁর কোনো চিন্তা নেই। রান্নাবান্নায় সবসময় তাঁর মাকে সাহায্য করে। আদর্শ, সাংসারিক মেয়ে বলতে যেমন বুঝায়। রুমা তাঁরই এক বড় উদাহারন। বড় ভাইয়ের একটা ছেলে আছে, ছেলেটা তাঁর কলিজার টুকরা। একদিন এক ভদ্রলোকের সাথে তাঁর বিয়ে হয়৷ যৌথ পরিবার। সবাই বেশ বিনয়ী। রুমার স্বামীও তাঁকে খুব ভালোবাসে। সব মিলিয়ে সে খুব খুশি আছে। যেমনটা সে চেয়েছিলো।

স্বপ্নের মতো তাঁর দিন কাটছিলো। রুমার মতো একটা শান্ত মেয়েকে কারো পছন্দ না করে উপায় নেই। তাঁর শ্বশুর শ্বাশুড়ি, ননদ সহ আশপরশী সবাই তাঁকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু যখন দুবছর পরেও সে গর্ভবতী হতে পারেনি। পেটে কোনো নিস্পাপ শিশুকে ধারণ করতে পারেনি, তখন তাঁর খুব ভয় কাজ করতে শুরু করে মনে।

সে খুব চিন্তিত থাকে। রোজ রাতে যে লোকটা এসেই জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। সে যদি বাবা না হতে পারে। এ ভালোবাসা তাঁর কপালে বেশিদিন টেকশই হবে না। তাঁর চিন্তিত মুখ দেখে লোকটা কাঁধে হাত রাখে। ভরসা দেয়, কিছুই হয়নি। সব ঠিক হয়ে যাবে। দুজনে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলো। কিছু পরীক্ষা শেষে ডাক্তার বললেন, তাঁদের দুজনেরই সমস্যা!

একজন বাবা হতে পারবেন না! আরেকজন মা হতে পারবেন না! খবরটা শুনে দুজনে বেশ স্বাভাবিক খুব দুঃখ পেলো৷ কিন্তু কেউই কাউকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করেনি৷ একের পর এক চেষ্টা তাঁরা করেই যাচ্ছে। নানা ডাক্তার দেখিয়েও কোনো ফায়দা হয়নি। এক বছর, দুবছর, তিন বছর করে করে পাঁচটা বছর পেরিয়ে গিয়েছে!

হঠাৎ একদিন রুমা জানতে পারলো তাঁর স্বামী অন্য কোথাও এক বিয়ে করেছে, সেখানে একটা মেয়ে হয়েছে! শুনে খুব কষ্ট পেলো কিন্তু সে সত্যটা মেনে নিলো। বুঝে গেলো সে, নিজেরই সমস্যা কোনো। লোকটা কোনো ভুল করেনি। দুনিয়ায় কোনো পুরুষ নেই যে বিয়ের পরে বাবা হতে চায় না। স্বামীকে বললো তাঁর নতুন স্ত্রীকে বাড়িতে নিয়ে আসতে।

স্বামী মানা করে। এই বাড়িতে রুমার যা সম্মান। তা যদি কোনোভাবে কম হয়ে যায়। তাঁর মূল্য যদি কম মনে করে কেউ। তা ভেবে তিনি আনেন না। রুমা মানলো না। একদিন নিজে গিয়ে তাঁর স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে দেখা করলো।

খুব দরিদ্র একজন মহিলা। রুমাকে দেখে বসতে দিলেন। নিজেকে খুব লজ্জিত মনে করলেন তিনি। তিনি ভাবতেও পারেননি কেউ এতোটা মনোরম হতে পারে। স্বামীর কাছে অনেক রুমার কথা শুনেছে তবে তিনি চোখে আগে কখনোও দেখেননি! রুমা মেয়েটাকে কুলে নিলো। বললো, “ আপনি না গেলেও, মেয়েটার তাঁর বাবার বাড়িতে থাকার অধিকার আছে। আমি তাঁকে নিয়ে যাবো। ”

তিনি অবাক হয়ে রুমার দিকে তাকালেন। এই মহিলা তাঁর কেউই হয় না, বলতে গেলে তাঁর মানুষটার ভাগিদার। তবুও যেন তাঁর জন্য শরীরের রক্ত মাংস খুলে দিতেও দুবার ভাববেন না। এমনই মনে হচ্ছে উনার। বললেন, আমি চিন্তিত থাকবো না। যদি আমার মেয়েটা আপনার মতো কোনো নারীর আঁচলে ঢাকা থাকে। তবে আমি ঐ বাড়িতে যেতে পারবো না। রুমা মেয়েটাকে নিয়ে আসলো। খুব যত্ন করে বড় করতে লাগলো। কিন্তু বেশি বড় করতে পারলো না। চার বছর পরে মেয়েটার জন্মদাত্রী মা মেয়েটাকে ফেরত চাইলেন।

উনার এখন এই বাড়িতে আসতেও কোনো সমস্যা নেই! রুমার কোনো সন্তান নেই এজন্য না সে যত কষ্ট পায়। তারচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে সে, যখন আম্মু আম্মু বলতে শিখা মেয়েটার সাথে তাঁর বিচ্ছেদ হয়ে গেলো! তাঁকে ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে। তাঁর স্বামী বললো, সে মাথায় আর ঝামেলা তুলে রাখতে চান না। রুমার বুক ফাটলেও, হাসি মুখে মেনে নিলো। বাস্তবতা দেখলে এটাই হওয়া উচিৎ হয়তো। লোকটার সাথে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো।

দীর্ঘ দশ বছরের সংসার। চোখ বুজলে কাছে টানার স্মৃতি, চোখ মেললে দূরে আসার স্মৃতি! এভাবেই দিন কাটছিলো তাঁর। হঠাৎ একদিন সে শুনলো, কোথাকার এক গরীব লোক তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। সে রুমার ব্যাপারে সবটা জেনেই প্রস্তাব দিয়েছে। রুমা খবরটা শুনে খুশি হবে না দুঃখিত হবে তা সে বুঝতে পারছিলো না। তবে সে রোমাঞ্চিত ছিলো, কোন লোকটা তাঁর দশ বছরের সাংসারিক জীবন মেনে নিয়েও বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে?

পারিবারিকভাবে আবার রুমার বিয়ে হলো। সে দেখতে তখনও দারুণ। কোনো বাচ্চা ধারণ করেনি বিধায় শরীরের গঠনও ভাঙেনি। অবাক করা ব্যাপার হলো, এক বছর হতেই সে গর্ভবতী হলো! সেদিন যেন তারচেয়ে খুশি দুনিয়াতে আর কেউ নেই! এমন খুশির দিনে আমার কথা মনে হয়েছিলো তাঁর। সে যখন খুব খুশি হয়। কাউকে না বললেও আমাকে বলে। সেদিন ফোন করে বলেছিলো, “ তোর বিয়াইন হবো রে, তুই বিয়াই হিসাবে যদিও খুব খারাপ হবি। তবুও তোর ছেলের হাতে আমার মেয়েটাকে দিবো! ”

সে ধরেই নিয়েছিলো তাঁর মেয়ে হবে। যদিও পরবর্তীতে তাঁর মেয়ে হয়েছে দুটো। কিন্তু সবার আগে ছেলে হয়েছে। তাঁর সাথে কথা হলে আমি বেশ প্রখরভাবে অনুভব করি। একটা মানুষের পেটে আরেকটা মানুষ, তা আল্লাহ্ এর ইচ্ছা মাত্র! তাঁর রহমত মাত্র। তিনি কোনো ইসিও, সিজিও, থ্রীজিও মানেন না। একটা মেয়ের পেটে একটা প্রাণ, কেউই দিতে পারে না, যদি উপর আল্লাহ্ না চায়! চারদিকে যতো বাবা আছে, তাঁদের যতো মুরশিদ আছে, তাঁদের ফুঁ’তে কিছুই হয় না। ভণ্ডামি আর রাত কাটানোর পরিকল্পনা মাত্র!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত