বড় ভাইয়া নিজের পছন্দে বিয়ে করে বাড়িতে ওঠার ঠিক দেড় মাসের ব্যবধানে সবাই জানতে পেরেছিল আমাদের মা কনসিভ করেছেন । তিনি দু’মাসের প্রেগন্যান্ট ছিলেন । একটা মধ্যবিত্ত পরিবারে এই সমাজের মাঝে থেকে বিষয়টা কেমন হতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । মায়ের দুই ছেলে । কোনো মেয়ে না থাকায় বাবা মা দুজনেরই মন খারাপ ছিল । আমার দাদিমা বাবা যখন অনেক ছোট তখনই মারা যান তাই বাবা চেয়েছিল একটা মেয়ে হোক । যাকে মা বলে ডাকতে পারবেন । কিন্তু সময় থাকতে চেষ্টার পরও যখন কোনো আশা দেখা যায়নি তখন দুই ছেলে নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন ।
বড় দুই ভাই বড় হলো । যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল । বাবা মা বাসায় একা । একা থাকলেও পরবর্তিতে তারা আর বাচ্চা কনসিভ করার চিন্তা ভুলেও করেন নি । সমাজ বলে একটা কথা আছে । বড় দুটো ছেলে তার মাঝে আবার বাচ্চা নেওয়া মানে ছিঃ ছিঃ অবস্থা ।
ব্যাপারটা অনাকাঙ্খিত হয়ে গিয়েছিল । তা না হলে ছেলের বিয়ের পর এমন একটা ঘটনা কেউ ইচ্ছে করে ঘটাবে না। যদিও মা বাবা দুজনই যথেষ্ট জোয়ান। কেউ দেখলে বলবে না এদের দুটো ছেলে আছে । এই খবর শোনার পর মা ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করলেন । পাড়ার মহিলাদের খবর দিতে হয়নি যে আমাদের মা আবার বাচ্চা প্রসবের প্রস্তুতি নিচ্ছেন । পাড়ার লোক জেনেছে আমার শিক্ষিত দুই ভাইয়ের ব্যবহারে । তাদের যেন নাক কেঁটে দেওয়া হয়েছিল এমন অবস্থা।
যেই বাবার সামনে কোনোদিন তারা একটা কথাও জোড়ে বলেন নি । কিন্তু এই ঘটনার পরে তাদের গলার জোড় যেন বেড়ে গিয়েছিল । দুজনই যা নয় তাই বলেছে বাবা মা কে । বাবা তাদের কথা সহ্য করতে না পেরে বলেই দিয়েছিলেন ‘ সন্তানটা তোমার মা আর আমার ভালোবাসা । তোমরা যেমন আমার সন্তান । যে আসছে সেও আমার সন্তান । যদি তোমাদের আপত্তি থাকে তবে আমি তোমার মা’কে নিয়ে অন্যত্র চলে যাব।’ এই কথার পরে ভাইয়ারা আর কিছু বলার সাহস পান নি । তবে একটা মানুষ ছিল যে এই ঘটনাকে সাপোর্ট করেছে পুরোপুরি ভাবে । সে হলো বড় ভাইয়ার বউ। যে বউকে বাড়িতে তোলা নিয়ে সংকোচ ছিল ।
পারপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে মা চেয়েছিলেন এবরশন করাতে । কিন্তু বাধ সেঁধেছিলেন আমার বাবা আর বড় ভাবী। ডাক্তার বলেছিলেন সমস্যা হবে । এমনকি বাচ্চা প্রসবের সময়ও মায়ের ক্ষতি হতে পারে । তাই বাবা বা ভাবী কেউ চায়নি এবরশন করাতে । সব ঠিকঠাক চলছিল । এরই মাঝে হঠাৎ ভাবীও সুখবর দিয়ে বসল । ভাবী নিজেও মা হতে চলেছে । এতদিন যদিও মায়ের বিষয়টা নিয়ে চেপে গিয়েছিল সবাই । এইবার শুরু হলো সবার কানাঘুষা । একই সাথে শাশুড়ি ছেলের বউ গর্ভবতি । চারপাশে ছিঃ ছিঃ পরে গেলেও শক্ত ছিলেন মা আর ভাবী দুজনই । ভাইয়া চারপাশের কানাঘুষা শুনে মায়ের সাথে কথা বন্ধ করে দিলেন । তখন মায়ের সাত মাস চলে !
ভাবী’র দু’মাসের মাথায় মিসক্যারেজ হলো কোনো কারণ ব্যতীত । দিব্বি মানুষটা ঘরে গেল আর কিছুক্ষন পরেই গগণবিদারী চিৎকার। সেইদিন ভাইয়া চুপ করে গিয়েছিল । বুঝেছিল একটা সন্তান তার মা বাবার কাছে কতটা !
দেখতে দেখতে মায়ের ডেলিভারির ডেইট চলে এলো । ভাবী তখন স্বাভাবিক অনেকটা । তবে বাচ্চা কনসিভ করতে বারণ করেছে ডাক্তার ।
মা ডেলিভারি ঘরে যাওয়ার আগে দুই ছেলের কাছে মাফ চেয়ে নিলেন । দুই ভাই কি কান্না ! কত খারাপ ব্যবহার করেছে তার জন্য তারা অনুতপ্ত । বাবা নিশ্চুপ হয়ে আছে । মা বাবাকে বলেছিল , মা হয়ত আর বাঁচবেন না । সেটাই সত্যি হলো । ডেলিভারি ঘরেই মা ‘আমাকে’ একা রেখে না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন । বাবা মেয়ে হয়েছে বলে খুশি হবেন নাকি জীবন সঙ্গিনীকে হারিয়েছেন বলে কষ্ট পাবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না ! আমাকে নিয়ে খুব কেঁদেছিলেন । খুশি আর দুঃখের কান্না আলাদা করা গেলে সেদিন হয়ত বাবার কান্নাটাও বোঝা যেত।
সেই ডেলিভারি ঘর থেকে আজকের প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া অবধী আমার দ্বিতীয় মায়ের অভাব পূরণ করেছে আমার বড় ভাবী। জন্মের দশ বছরের মাথায় বাবাও আমাকে রেখে চলে যায় না ফেরার দেশে । ছোট ভাইয়া বিয়ে করে আলাদা থাকেন । তার এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার । শুধু আমার বড় ভাইয়ার ঘরেই কোনো সন্তান আসেনি । ভাবীর মিসক্যারেজের পর বাচ্চা নেওয়া কষ্টকর হয়ে যায়। ভাবীও আর ডাক্তার দেখান নি । তার একমাত্র কারণ ছিলাম আমি ! আর ঠিক এই কারণে আমার ভাইয়েরা আমাকে তেমন পছন্দ করেনা । আমি নাকি মাকে খেয়েছি, ভাবীর বাচ্চাকে খেয়েছি , ভাবীর বাচ্চা না হওয়ার পেছনেও নাকি এই আমিই দ্বায়ী। মা কি আমি জানতাম না যদি ভাবী আমার জন্য এই ত্যাগ না করত ।
আজ আমার বিয়ের প্রস্তাব এসেছে । কিন্তু আমি এখনই এই বিয়ে করতে চাইনা। ভাবীও রাজি না । কিন্তু ভাইদের ধারনা এখন বিয়ে না দিলে হয়ত আবার কোনো অঘটন ঘটাবো আমি । ভাবী ভাইয়াকে বারণ করতে অনেক বুঝিয়েছে । কিন্তু ভাইয়ার এক কথা আমার বোন আমি যা ইচ্ছা করব । তুমি একটা কথাও বলবে না । নিজের যখন সন্তান নেই তখন অন্যকে নিয়ে মাথা ঘামাবে না । এই প্রথম বারের মত ভাবীকে আমি কাঁদতে দেখেছি।
আমাকে হাত ধরে টেনে পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে সবার সামনে শক্ত গলায় বললেন ” এই মেয়েটাকে আমি জন্ম না দিয়েও সেই জন্ম লগ্ন থেকে লালন পালন করেছি । এই মেয়েটা আমার মেয়ে । এর প্রতি বাবা মায়ের পর যদি আর কারো অধিকার থাকে তবে সেই অধিকারটা একমাত্র আমার । এর জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমার মতামত অবশ্যই নিতে বাধ্য সবাই । আমার মেয়ের জীবনের সিদ্ধান্ত আমি নিজে নিবো আর কেউ না” কথাটা বলে ভাইয়ার দিকে তাকালো ভাবী । ভাইয়ার যেন আশ্চর্য হওয়ার ভাষা নেই । যে ভাবী কখনো ভাইয়ার একটা কথারও প্রতিবাদ করেনা সেই ভাবীর এমন রুপ সবাইকে অবাক করেছে ।
আমি ভাবীর দিকে এক পলকে তাকিয়ে আছি । আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসলেও বেশ বুঝতে পারছি আমাকে ধরা হাতটি ভীষণ কাঁপছে। এই কম্পন প্রথমবারেই জয়ের । এই কম্পন অন্যায়ের বিরদ্ধে ন্যায়ের । এই কম্পন একজন ‘মায়ের’