ভার্সিটিতে যাবো কিন্তু কোথাও আমার বাইকের চাবি খুঁজে পাচ্ছি না। মনের ভুলে কয়েক বার বলে ফেললাম, মা আমার বাইকের চাবিটার একটু খোঁজে দাও তো। একটু পরেই মনে হলো মা তো আর বেঁচে নেই। আজ ২১ দিন হলো মা মারা গেছে কিন্তু এখনো কিছু হারিয়ে ফেললে মনের ভুলে মাকে ডাকতে থাকি….
বাসা থেকে নিচে নেমে এসে দেখি গ্যারেজে আমার বাইকটা নেই। শুধু আমার বাইক না বাবার প্রাইভেট কারও নেই। গেইটের সামনে তাকিয়ে দেখি নতুন যে দারোয়ান রাখা হয়েছিলো সেও নেই। তারমানে দারোয়ানটাই কি আমাদের গাড়ি বাইক চুরি করেছে। তাড়াহুড়ো করে বাবার কাছে গেলাম। বাবা তখন রুমে বসে খবরের কাগজ পড়ছে। আমায় ঢুকতে দেখে বাবা খবরের কাগজের থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– এমন করে হাঁপানি রোগীদের মত হাঁপাচ্ছিস কেন? আমি তখন কিছুটা রাগ করে বাবাকে বললাম,
— যাকে তাকে বিশ্বাস করলে এমনটাই হয়। মোবারক নামের যে লোকটাকে দারোয়ানের চাকরি দিয়েছিলে সেই মোবারক আমার বাইক আর তোমার গাড়ি নিয়ে পালিয়েছে। আমার কথা শুনে বাবা তখন বললো,
– কোন কিছু না জেনে অন্যকে দোষারোপ করাটা গুনাহ্’র কাজ। ভালো করে খেয়াল করে দেখ; মোবারক হয়তো পাশের দোকানে বসে চা খাচ্ছে। আর তোর বাইক আর আমার গাড়ি আমি নিজেই বিক্রি করে দিয়েছি। আমি অবাক হয়ে বাবাকে বললাম,
— কি!!!
বিক্রি করে দিয়েছো মানে? এখন আমি ভার্সিটি যাবো কিভাব? বাবা আমার চোখের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে খবরের কাগজে নজর দিতে দিতে আমায় বললেন,
— তোদের ভার্সিটির সবাই কি তোর মত R15 বাইক নিয়েই ভার্সিটিতে যায় নাকি? আজকের পর থেকে বাসে করে ভার্সিটি যাবি।
বাবার কথা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। রাগে বাসা থেকে বের হয়ে এলাম। মা মারা যাবার পর থেকেই দেখছি বাবা জানি কেমন হয়ে গেছে সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করছি। এমন সময় কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুললাম। দরজা খুলে দেখি পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা, মাথায় টুপি দেওয়া অনেক গুলো হুজুর। আমায় দেখে একজন সালাম দিয়ে বললো,
– এটা কি রহমান সাহেবের বাসা? আমি মুখ থেকে ব্রাশটা সরিয়ে বললাম,
— হ্যাঁ, কিন্তু উনাকে আপনাদের কি দরকার? একজন মুরব্বি লোক মিষ্টি হেসে আমাকে বললো,
– আসলে মার্কেটের ভিতরের জমিটা মসজিদ বানানোর জন্য উনি আমাদের দান করেছেন। সেই বিষয়েই কথা বলার জন্য উনার কাছে এসেছি…
মুরুব্বি লোকের মুখ থেকে এই কথাটা শুনার পর আমি উনার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলাম। দৌঁড়ে বাবার কাছে গেলাম। বাবা তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথার চুল ঠিক করতেছিলো। আমি বাবাকে বললাম,
— বাবা, তুমি নাকি মার্কেটের ভিতরের জমিটা দান করে দিয়েছো? বাবা মুচকি হেসে বললো,
– হ্যাঁ। আমি রেগে গিয়ে বাবাকে বললাম,
— তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে,
ঐ রকম দামী জমি কি কেউ দান করে দেয়? মাস খানেক আগেও তুমি বলেছো এই জমিতে এপার্টমেন্ট বানাবে আর এখন তুমি দান করে দিলে! বাবা আমার কাঁধে হাত রেখে মুচকি হেসে বললো,
– দামী জমি দামী কাজেই ব্যবহার করছি। এই জমিতে আল্লাহর ঘর হবে। দুনিয়ায় আল্লাহ ঘরের চেয়ে দামী জিনিস আর কিছু হতে পারে না।
বাবার এমন কথা শুনে আমি বাবাকে কিছু বলতে পারলাম না। শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম সন্ধ্যার দিকে যখন বাসায় ফিরছি তখন আমাদের মহল্লার কমিশনার সাহেব আমায় ডাক দিলেন। আমি উনার কাছে গিয়ে সালাম দিলাম কিন্তু উনি আমার সালামের উত্তর না দিয়েই রেগে আমায় বলতে লাগলো,
~ তোমার বাবা কিন্তু কাজট ভালো করছে না। তোমার বাবা যদি ভেবে থাকে এইসব দান দক্ষিনা করে মানুষের মন জয় করে সামনে কমিশনার নির্বাচনে দাঁড়াবে তাহলে কিন্তু সেটা ভুল ভাবছে। রাজনীতিতে আমি কিন্তু পাকা খেলোয়াড়। তাই সময় থাকতে তোমার বাবাকে সাবধান করে দিও রাতে খাবার টেবিলে বাবাকে প্রশ্ন করলাম,
— বাবা, তোমার প্লেনটা কি বলো তো? আমাদের যা কিছু ছিলো সবি তো দান করে দিচ্ছো। মানুষ আমাকে গরীবের হাতেম-তায়ের ছেলে বলে খেপায়। সত্যি করে বলো, তোমার কি সামনে কমিশনারের নির্বাচন করার ইচ্ছে আছে?
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
– আরে সামান্য কমিশনার পদের নির্বাচনের জন্য আমি এত কিছু করবো না কি। আমি তো মেয়রের পদের চিন্তা ভাবনা করছি। বাবার কথা শুনে আমার হেচকি উঠে গেলো। বাবা পানির গ্লাসটা আমার দিকে বাড়িয়ে বললো,
— নে, পানি খা সকাল সকাল বাবা আমায় ডেকে বললো,
– তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবি পরে আয়। আমার সাথে এক জায়গায় যাবি। আমি অবাক হয়ে বললাম,
— কোথায় যাবে? বাবা আস্তে আস্তে আমার কানের কাছে এসে বললো,
– নির্বাচনের বেশি দেরি নেই। টাকা পয়সা জোগাড় করতে হবে। তুই তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে আয় আমি আর বাবা মহাখালী আসলাম। মহাখালী টু উত্তরা একটা বাসে উঠলাম। বাবা কানে কানে আমায় বললো,
— তুই শুধু আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাক। দেখ আমি কিভাবে টাকা সংগ্রহ করি। তারপর তুইও না হয় অন্য বাস থেকে টাকা সংগ্রহ করবি এই কথা বলে বাবা সমস্ত যাত্রীদের সালাম দিলেন। কিছু হাদিসের কথা বললেন তারপর সমস্ত যাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন, আমাদের এলাকায় একটা মসজিদের কাজ চলছে আপনারা যে যা পারেন আমাদের সাহায্য করেন। কিছু কিছু মানুষ বাবার কথা পাত্তা না দিয়ে বাসের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে.. আর কিছু কিছু মানুষ ৫-১০ টাকা বাবার হাতে দিচ্ছে আর বাবা সেইগুলো হাসিমুখে নিচ্ছে। এই মুহুর্তে আমার চোখের সামনে এইসব কি হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি শুধু বাবার দিকে হা করে তাকিয়ে আছি। আমার মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হচ্ছিলো না। বাস থেকে নেমে আমি বাবাকে বললাম,
— বাবা, তুমি ঠিক আছো তো? এইসব তুমি কি করছো? তুমি মানুষের কাছ থেকে নির্লজ্জ- বেহায়ার মত টাকা চাইছো! বাবা কপালে জমে থাকা ঘাম মুছতে মুছতে আমায় বললো,
– ইঞ্জিনিয়ারিং পদে আমার চাকরিটা হয় সাড়ে সাত লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে। আমাদের সময় সাড়ে সাত লাখ টাকা মানে অনেক টাকা। চাকরি পাবার পর থেকে আমি শুধু চিন্তা করতাম এই টাকাটা আমি কিভাবে উশুল করবো। আস্তে আস্তে আমি দুর্নীতির মায়াজালে আটকা পড়লাম। আমার মাসিক বেতন ছিলো ২৭ হাজার টাকা অথচ এই সামান্য টাকা বেতন পেয়েও আমি নিজে বাড়ি করেছি,জায়গা জমি কিনেছি,গাড়ি কিনেছি, তোকে সবচেয়ে ভালো স্কুল-কলেজে পড়িয়েছি। তুই যা চেয়েছিস আমি তাই তোকে দিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস কর এইগুলো একটা জিনিসও হালাল পয়সায় কিনা না। টাকার লোভে আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তোর মা আমাকে অনেকবার বুঝিয়েছে কিন্তু আমি বুঝি নি। উল্টো তোর মাকে নানা রকম বাজে কথা বলেছি। শুধু তোর মুখের দিকে তাকিয়ে তোর মা আমায় ছেড়ে যায় নি।
অপারেশনের আগের দিন তোর মা আমার হাত ধরে বলেছিলো, “তোমার এই অসৎ পয়সা দিয়ে আমার অপারেশন করালে আমি কিন্তু মারা যাবো।” আমি তোর মার কথার কোনো গুরুত্ব দেই নি। উল্টো তোর মাকে বলেছিলাম, ছোট একটা অপারেশন,এতেই তুমি মরার কথা চিন্তা করো কেন? তাছাড়া দেশের নাম করা ডাক্তার তোমার অপারেশন করবে। অথচ দেখ তোর মার কথায় সত্যি হলো….
তোর মা মরে যাবার পর মনে হলো, আমার টাকাটা যদি হালাল হতো তাহলে হয়তো তোর মা আজ বেঁচে থাকতো। তাই আমি আমার সমস্ত অবৈধ সম্পদ, টাকা- পয়সা মানুষকে দান করে দিয়েছি। এখন মসজিদ নির্মাণ করার জন্য মানুষের ধারে-ধারে যাচ্ছি সাহায্যে জন্য; কারন আমার মত অনেক পাপী মানুষ এই শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই পাপী মানুষ গুলোর মধ্য দিয়ে কেউ যদি মন থেকে আল্লাহ ঘর নির্মাণ করার কাজে ১০ টাকা দিয়ে থাকে, হতে পারে আল্লাহ এই উসিলায় উনাকে বা উনাদের মাফ করে দিয়ে হেদায়েত দিতে পারেন আমি বাবার কথাগুলো শুনছিলাম আর আমার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তেছিলো। বাবার কথা বলা শেষ হলে আমি যখন চলে যাবো তখন বাবা আমায় বললো,
– কি রে, কোথায় যাচ্ছিস? আমি তখন আমার চোখে জমে থাকা জলটা মুছতে মুছতে বললাম,
— বাসটা থেমেছে….