বিষকুম্ভ: ১৪. হলঘরে আমরা প্রবেশ করবার মুখে

বিষকুম্ভ: ১৪. হলঘরে আমরা প্রবেশ করবার মুখে

১৪. হলঘরে আমরা প্রবেশ করবার মুখে

হলঘরে আমরা প্রবেশ করবার মুখেই কানে এসেছিল বহু কণ্ঠের মিশ্রিত চাপা একটি গুঞ্জন। আমাদের ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেইযেন সেটা সহসা থেমে গেল। ভাষাহীন একটা অখণ্ড স্তব্ধতা যেন সহসা ঘরের মধ্যে জমাট বেঁধে উঠল।

কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গে আমিও হলঘরের চতুর্দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলাম।

বুঝতে পারলাম, ইতিমধ্যেই বাকি যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যেও দুঃসংবাদটা প্রচারিত হয়ে গিয়েছে। কারণ হলঘরের মধ্যে সকলেই উপস্থিত ছিলেন। দেখতে পেলাম না কেবল সকলের মধ্যে বিশেষ দুটি প্রাণীকে। একজন হচ্ছেন বৈকালী সঙ্ঘের প্রেসিডেন্ট রাজেশ্বর চক্রবর্তী, দ্বিতীয় অশোক রায়। আরও একটা ব্যাপার যা আমার দৃষ্টিকে এড়ায় নি, সেটা হচ্ছে ঘরের মধ্যে উপস্থিত নরনারীর চোখেমুখেই যেন একটা চাপা ভয় ও আশঙ্কা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রত্যেকেরই মনের উদ্বেগ যেন প্রত্যেকের নীরবতার মধ্যেও চাপা থাকেনি।

ঘরের মধ্যে সে সময় উপস্থিত ছিলেন মহারানী অফ সোনপুর স্টেট সুচরিতা দেবী,ব্যারিস্টার মনোজ দত্ত, শ্ৰীমন্ত পাল, সুধীরঞ্জন, অভিনেত্রী সুমিত্রা চ্যাটার্জী, বিশাখা চৌধুরী, নিখিল ভৌমিক, রমা মল্লিক, সোমশ্বর রাহা আর দুজন ভদ্রলোক, যাঁদের মধ্যে মধ্যে দেখলেও নাম জানতাম না, পরে ঐ রাত্রেই জবানবন্দি নেবার সময় জেনেছিলাম,রঞ্জন রক্ষিত ও সুপ্রিয় গাঙ্গুলী। এঁদের মধ্যে রঞ্জন রক্ষিত শেয়ার মার্কেটের একজন চাঁই, বয়স পঁয়তাল্লিশের মধ্যে ও সুপ্রিয় গাঙ্গুলী একজন ফিল্মজগতের প্রোডিউসার-ডাইরেকটার।

.

কিরীটীর পরামর্শমতই বার-রুমে রজত লাহিড়ীকে সামনে রেখে কিরীটী তার জেরা শুরু করল—প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে সেই ঘরে একের পর এক ডেকে এনে।

প্রথমেই ডাক পাঠানো হল মীরজুমলার সাহায্যে প্রেসিডেন্টকে। তিনি তাঁর নিজস্ব ঘরের মধ্যেই অপেক্ষা করছিলেন।

ডান পা-টি একটু টেনে টেনে একটা মোটা লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে প্রেসিডেন্ট এসে ঘরের মধ্যে ঢুকলেন।

বসুন মিঃ চক্রবর্তী, আপনিই এখানকার প্রেসিডেন্ট? প্রশ্ন করলেন রজত লাহিড়ী।

নিদিষ্ট চেয়ারটা টেনে একটু যেন কষ্ট করেই বসতে বসতে প্রেসিডেন্ট মৃদুকণ্ঠে বললেন, হ্যাঁ।

আপনার ডান পায়ে কি কোন দোষ আছে নাকি মিঃ চক্রবর্তী? হঠাৎ প্রশ্ন করে এবার কিরীটী।

কিরীটীর দিকে না তাকিয়েই মৃদুকণ্ঠে জবাব দিলেন প্রেসিডেন্ট, আর বলেন কেন, old age-এর বায়নাক্কা কি একটা! রিউম্যাটিজ, এনলার্জ প্রস্টেট, তার উপরে আবার ক্রনিক ব্রংকাইটিস। বলার সঙ্গে সঙ্গেই বারকয়েক খুকখুক করে কাশলেন রাজেশ্বর চক্রবর্তী। নেহাৎ এরা ছাড়ে না, নাহলে এ বয়সে আর এইসব ঝামেলা পোষায় বলে যেন কথাটা শেষ করলেন কোনমতে!

চোখেও তো দেখছি আবার কালো চশমা ব্যবহার করছেন! চোখেও কোন দোষ আছে। নাকি মিঃ চক্রবর্তী? কিরীটী আবার শান্তকণ্ঠে প্রশ্ন করল।

হ্যাঁ। সে তো আজ নয়, বহুদিন থেকেই ভুগছি, হাইপার মেট্রোপিয়া না কি ডাক্তারেরা বলেন। জবাব দিলেন রাজেশ্বর।

হুঁ। তা শুনেছেন বোধ হয় দুঃসংবাদটা?

হ্যাঁ, সত্যসিন্ধুবাবু—আপনাদের ঐ সুব্রতবাবু একটু আগে মিঃ পালের সঙ্গে আমার অফিসঘরে গিয়ে সুসংবাদটা দয়া করে শুনিয়ে এসেছেন। চমৎকার ছদ্মনামটি নিয়েছিলেন বটে সুব্রতবাবু। সত্যসিন্ধু! সত্যের একেবারে সাক্ষাৎ মূর্তি! বলেই আবার বার কয়েক কেশে নিলেন।

কিরীটী যেন কি একটা কথা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তাকে বাদ দিয়ে রাজেশ্বর চক্রবর্তী বলে উঠলেন, তা দেখুন—ভাল কথা, আপনার নামটা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি? কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি শেষ করলেন কথাটা।

জবাব দিলাম আমিই, ওর নামটা শোনেননি? কিরীটী রায়।

কিরীটী রায়? মানে সেই শখের গোয়েন্দা–

হ্যাঁ।

সুখী হলাম মিঃ রায় আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে। তা দেখুন মিঃ রায়, আমি বলছিলাম নামেই এখানকার প্রেসিডেন্ট আমি। কাজকর্মের মধ্যে কেবল হিসাব-নিকাশটাই রাখতে হয় বৈকালী সঙ্ঘের। অবিশ্যি ঐ সঙ্গে এখানকার ডিসিপ্লিন রাখবারও দায়িত্ব একটা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে কমিটি থেকে। কিন্তু এখানকার মেম্বারদের পার্সোনাল ব্যাপারে আমার কোন দায়িত্ব নেই।

কথাটা একটু স্পষ্ট করে যদি বলেন মিঃ চক্রবর্তী? প্রশ্ন করলেন লাহিড়ীই এবার।

বলছিলাম এরা যদি কেউ পরস্পরের প্রেমে পড়ে বা আত্মহত্যা করে, সে ব্যাপারে আমি আপনাদের কি সাহায্য করতে পারি বলুন? আপনাদের ঐ সত্যসিন্ধুবাবুকেই জিজ্ঞাসা করে দেখুন না, কিছুদিন তো এখানে উনি যাতায়াত করেছেন, এখানকার হালচালও নিশ্চয়ই কিছুটা বুঝেছেন। আমার সঙ্গে এই সঙ্ঘের ঐ প্রেসিডেন্টের পদটি ছাড়া আর বিশেষ কোন সম্পর্ক নেই। নতুন মেম্বার এলে তার পরিচয়টা করিয়ে দিই একবার হলঘরে এসে, নচেৎ হলঘরেই বলুন, বারই বলুন বা এ বাড়ির অন্য কোন জায়গাই বলুন, কখনও আমি পা বাড়াই না। বলে আবার বার দুই কাশলেন।

কিন্তু একটা কথা যে আপনার আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না মিঃ চক্রবর্তী? কিরীটী প্রশ্ন করে আবার।

বলুন?

এখানকার ডিসিপ্লিনের ব্যাপারটা যখন এঁরা আপনার হাতেই তুলে দিয়েছেন

তা দিয়েছেন বটে। তবে সেটা একান্ত অফিস-সংক্রান্তই। কারোর ব্যক্তিগত গণ্ডি পর্যন্ত সেটা যেমন কখনও এক্রোচ করিনি এবং করার আমি প্রয়োজনও বোধ করিনি কোনদিন। এখানকার যারা মেম্বার, তারা সকলেই সম্ভ্রান্তবংশীয়, সমাজ বা সোসাইটিতে তাদের যথেষ্ট পরিচয় ও স্বীকৃতি আছে। ভল-মন্দ বোঝবার তাদের নিজেদের বয়সও হয়েছে।

কিন্তু এ কথাটা কি সত্যি নয় মিঃ চক্রবর্তী যে, এ সঙ্ঘ গড়বার পিছনে নিশ্চয়ই কিছু একটা উদ্দেশ্য আছে? প্রশ্ন করে আবার লাহিড়ীই।

উদ্দেশ্য আর কি! দশজনের কোন একটা জায়গায় মেলামেশার মধ্যে দিয়ে খানিকটা নির্দোষ আনন্দ লাভ করা!

শুধুমাত্র নিদোষ খানিকটা আনন্দই? আর কিছু নয়? জিজ্ঞাসা করে কিরীটী।

না। আমি যতদূর জানি তাই।

কিন্তু এখানে ড্রিঙ্কের ব্যবস্থা আছে, ফ্ল্যাশও চলে শুনেছি? কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন করে।

তা চলে একটু-আধটু।

একটু আধটু নয়। পুরোপুরি নাইট ক্লাবই এটা একটা।

নাইট ক্লাব বলে আপনি ঠিক কি মীন করতে চাইছেন জানি না মিঃ রায়, তবে আপনাদের তথাকথিত আইনভঙ্গের কোন ব্যাপারই এখানে ঘটে না। সেটা ভাল করে খোঁজ নিলেই একটু জানতে পারবেন। বলে আবার একটা কাশির ধমক যেন সামলে নিলেন মিঃ চক্রবর্তী।

নাইট ক্লাব বলতে ঠিক যা মীন করে, আমিও ঠিক তাই মীন করেছি মিঃ চক্রবর্তী। কিন্তু যাক সে কথা। আপনার এখানকার কাজটা কি পেইড? না অনারারী?

সম্পূর্ণ অনারারী, মিঃ রায়।

তাহলে এ সঙ্ঘের ওপর আপনারও একটা অন্তরের টান আছে বলুন! নইলে প্রতি রাত্রে এই বয়সে, বিশেষ করে আপনার এ নানাবিধ বোগজর্জর দেহ নিয়ে সাড়ে নটা থেকে রাত বারোটা একটা পর্যন্ত এখানে চেয়ারে বসে থাকেন কি করে?

আর একটা কাশির দমক সামলে নিয়ে মিঃ চক্রবর্তী বললেন, তা যে একেবারে নেই, বললে মিথ্যাই বলা হবে মিঃ রায়। কথাটা তাহলে খুলেই বলি। বিয়ে-থা করিনি, বাপ-পিতামহ জমিদারি করে বেশ কিছু অর্থও রেখে গিয়েছিল, একমাত্র বংশধর তাদের আমি। চিরকাল হেসে খেলে স্ফুর্তি করেই কাটিয়ে বছর সাতেক আগে গাঁয়ের বসবাস তুলে দিয়ে কলকাতায় যখন চলে আসি, সময় কাটছিল না, সেই সময়ই এখানকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট সুখময়বাবুর সঙ্গে পরিচিত হয়ে এখানে এসে ঢুকি।

হুঁ, তারপর?

পরে হঠাৎ তাঁর মৃত্যু হওয়ায় এরা সকলে মিলে আমাকে ধরে বসল, প্রেসিডেন্টের পদটা আমাকে নেবার জন্য। ভাবলাম মন্দ কি, এমনিতেই তো এ বয়সে ঘুম কম। সময়টা কাটানো যাবে।

তা বেশ করেছেন। সময় ভালোই কাটাচ্ছেন, কি বলেন? প্রশ্ন করলেন আবার রজত লাহিড়ী।

আপনাদের জিজ্ঞাসাবাদ যদি শেষ হয়ে থাকে–

হ্যাঁ, আপাতত আপনি যেতে পারেন। বললে কিরীটী। কেবল একটা প্রশ্ন, সামনের শনিবার অশোক রায়ের সঙ্গে মিত্রা দেবীর বিবাহের সব স্থির হয়েছিল, জানেন কিছু?

না।

.

এবার এলেন মহারানী সুচরিতা দেবী।

বসুন মহারানী ঐ চেয়ারটায়। রজত লাহিড়ী বললেন।

মহারানী চেয়ারে বসবার পর কিরীটী প্রশ্ন করল, আপনিই প্রথমে মিত্রা সেনের মৃতদেহ দেখতে পান, তাই না?

আমিই প্রথমে সকলকে হলঘরে এসে জানাই।

লক্ষ্য করলাম প্রশ্নটার জবাব একটু ঘুরিয়ে দিলেন মহারানী।

আজ রাত্রে কখন আপনি এখানে আসেন?

রাত পৌনে নটা হবে বোধ হয় তখন।

আপনি যখন হলঘরে এসে ঢোকেন আর কেউ সে ঘরে ছিলেন?

ছিল।

মনে আছে আপনার, কে কে ছিলেন তখন হলঘরে?

হ্যাঁ। শ্ৰীমন্ত পাল, সুমিতা চ্যাটার্জী, নিখিল ভৌমিক, রমা মল্লিক আর সুপ্রিয় গাঙ্গুলী।

আর কেউ ছিল না?

না।

তারপর আপনি হলঘর থেকে কখন বেরিয়ে যান?

মিনিট পনেরো বাদেই। মানে সওয়া নটা নাগাদ বলুন?

ঐ রকমই হবে।

কোথায় যান হলঘর থেকে বের হয়ে?

বার-রুমে।

সেখানে কতক্ষণ ছিলেন?

মিনিট পনের-কুড়ি হবে। মাথাটা সন্ধ্যা থেকেই ধরেছিল, তাই বার-রুমে গিয়ে একটা রাম ও লাইম খেয়েও যখন মাথাটা ছাড়ল না, বাগানে গিয়েছিলাম একটু খোলা হাওয়ায় ঘুরতে।

সঙ্গে সে সময় আপনার কেউ ছিল, না একাই গিয়েছিলেন বাগানে?

একাই গিয়েছিলাম।

বার-রুমে যখন আপনি যান, সে সময় সে ঘরে আর কেউ ছিল?

ছিল।

কে?

রঞ্জিত রক্ষিত আর বিশাখা চৌধুরী।

আর কেউ ছিল না?

না।

অশোকরায় বামিত্রাসেনকে তাহলে আপনি হলঘর বাবার-রুমেকোথাও আজ দেখেননি?

না।

বেশ। তারপর বলুন বাগানে গিয়ে আপনি কি করলেন?

বাগানের মধ্যে কিছুক্ষণ এলোমোলো ভাবে ঘুরে বেড়াই, তারপর দক্ষিণ দিকের ঐ কুঞ্জের কাছাকাছি যেতেই মনে হল–

কি, থামলেন কেন? বলুন? কিরীটী তাড়া দিল মহারানীকে।

মনে হল একটা যেন দ্রুত পদশব্দ বাঁ দিককার বড় ঝোপটা বরাবর মিলিয়ে গেল। কিন্তু সে সময় অতটা খেয়াল হয়নি।

কেন?

কারণ বাগানে তো অনেকেই যেত, তাই ভেবেছিলাম হয়ত কেউ—

তারপর বলুন।

আর একটু এগুতেই আবছা চাঁদের আলোয় হঠাৎ নজরে পড়ল, বেঞ্চের ওপর একাকী বসে আছে যেন কে! প্রথমটায় চিনতে পারিনি। তাছাড়া যে বসেছিল তার সামনাসামনি যাবারও আমার তেমন ইচ্ছে ছিল না। ফিরে আসছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কেমন যেন মনটার মধ্যে কিছু বোধ হওয়ায় যে বসেছিল তার বসবার বিশেষ ভঙ্গীটি দেখে এগিয়ে গেলাম আরও একটু কাছে। এবারে মনের কিছুটা যেন আরও স্পষ্ট হল। যে বসে আছে, তার মাথাটা বুকের কাছে ঝুলে পড়েছে যেন কি এক অসহায় ভঙ্গীতে। কাছে এগিয়ে যেতে এবারে চিনতে পেরেছিলাম, সে আর কেউ নয়, মিত্রা সেন। কয়েক মিনিট থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম

তার দিকে সন্দিগ্ধভাবে তাকিয়ে। সাড়া দেবার জন্য গলা-খাঁকারি দিলাম। কিন্তু অপরপক্ষ থেকে কোনো সাড়াই পাওয়া গেল না। এবারে কেমন একটু যেন বিস্মিতই হলাম। মৃদুকণ্ঠে ডাকলাম, মিস সেন! কোনো সাড়া নেই তবু। এই পর্যন্ত বলে মহারানী থামলেন।

বলুন, তারপর? আবার কিরীটী তাগিদ দিল।

আরও একটু কাছে এগিয়ে গিয়ে এবারে বেশ একটু উচ্চকণ্ঠেই ডাকলাম, মিস্ সেন! মিস্ সেন্! তবু সাড়া নেই। যেমন তিনি বুকের কাছে মাথা ঝুলিয়ে বসেছিলেন তেমনই রইলেন।

ঘুমিয়ে পড়েননি তোভেবে হাত বাড়িয়ে তাঁর গায়ে হাত দিয়ে মৃদু একটা ধাক্কা দিয়ে ডাকলাম, মিস্ সেন! মিস্ সেন! না, তবু সাড়া নেই। এবারে কেন জানি না হঠাৎ গা-টা যেন আমার কেমন ছমছম করে উঠল। চারদিকে একবার তাকালাম। আশেপাশে কেউ নেই। কেবল চাঁদের আলো ও অন্ধকারে আবছা একটা আলোছায়ার থমথমানি। ঠিক সেই মুহূর্তে কী আমার মনে হয়েছিল জানি না, পরক্ষণেই আঙুল দিয়ে তার কপাল স্পর্শ করতেই যেন মনে হল, কোনও মানুষের জীবন্ত শরীর নয়, অত্যন্ত ঠাণ্ডা প্রাণহীন কি একটা স্পর্শ লাগল আমার আঙুলের ডগায়। সঙ্গে সঙ্গে সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল আমার। বলতে বলতে হঠাৎ যেন নিজের অজ্ঞাতেই আবার শিউরে উঠে মহারানী কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত চাপা কণ্ঠে বললেন, that uncanny sensation! I will never forget and I cant explain you even what it was!

হঠাৎ চুপ করে গেলেন মহারানী।

সকলেই আমরা মহারানীর ভয়-বিহ্বল মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছি। স্তব্ধ ঘরটার মধ্যে কেবল ওয়াল-ক্লকের পেণ্ডুলামটার একঘেয়ে টকটক শব্দ হয়ে চলেছে।

কয়েকটি মুহূর্ত স্তব্ধতার মধ্যেই কেটে গেল।

বিহ্বল বিমূঢ় হয়ে কয়েকটা মুহূর্ত সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

তারপর আবার মহারানী বলতে শুরু করলেন, এবং যখন সম্বিৎ ফিরে এল হঠাৎ যেন মনে হল, মিস সেন বেঁচে নেই। সে মৃত। কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রুদ্ধশ্বাসে সেখান থেকে ছুটে পালিয়ে আসি। সোজা একেবারে হলঘরে এসে ঢুকি। Now I find. she is really dead! সত্যিই সে আর বেঁচে নেই। কিন্তু এখনও যেন আমি ভাবতে পারছি না মিঃ রায়, কী করে এ দুর্ঘটনাটা ঘটল আর কেনই বা ঘটল? কেন সে আত্মহত্যা করল?

কিন্তু আত্মহত্যা তো নয় মহারানী! বললে কিরীটী।

চমকে তাকালেন মহারানী কিরীটীর মুখের দিকে। প্রশ্ন করলেন, আত্মহত্যা নয়? তবে—

নিষ্ঠুর হত্যা। Cold-blooded murder!

মার্ডার! She has been murdered! এ আপনি কী বলছেন, মিঃ রায়! How impossible!

আমার ধারণা আমি ঠিকই বলেছি। মিস্ সেনকে হত্যাই করা হয়েছে মহারানী।

কিন্তু কে তাকে হত্যা করবে, আর কেনই বা করবে? She was so nice! So Charming! সকলেই তাকে ভালবাসত।

আপনি হয়ত জানে না মহারানী, বুকভরা ভালবাসার অমৃত থেকেই অনেক সময় বিষের ফেনা গেঁজিয়ে ওঠে। তাছাড়া এখানে আপনারা যাঁরা যাতায়াত করেন, তাঁদের কার মনে কোন্ গোপন ভালবাসা, ব্যর্থতা, ক্রোধ, হিংসা বা বিদ্বেষ জমা হয়ে আছে তা জানবেন কি করে?

কিন্তু–

না, মহারানী! তা যদি না হত তো এমনি নিষ্ঠুর হত্যা তার ভয়াবহ রূপ নিয়ে প্রকাশ পেত না। কিন্তু থাক সে কথা। আজ এই মুহূর্তে না হলেও, জানতে আমরা পারবই। আর একটা প্রশ্ন আপনাকে আমি করব।

বলুন।

জানতেন কি, অশোক রায় ও মিত্রা সেনের মধ্যে বিবাহের দিন পর্যন্ত স্থির হয়ে গিয়েছিল?

Absured, impossible! বিশ্বাস করি না আমি।

সত্যিই হয়ে গিয়েছিল, রেজেস্ট্রি অফিসে পদের নাম পর্যন্ত রেজিস্ট্রি হয়ে গিয়েছিল।

সত্যি বলছেন?

হ্যাঁ। একবর্ণও মিথ্যে নয়, যা আমি বললাম।

আশ্চর্য তো!

মাত্র একটি শব্দই নির্গত হল মহারাণীর কণ্ঠ হতে।

মহারানীর চাপা কণ্ঠে উচ্চারিত আশ্চর্য শব্দটি ও সেই মুহূর্তের তাঁর চোখ ও মুখের চেহারা স্পষ্টই যেন আমার কাছে ব্যক্ত করল—বিস্ময়ই নয়, আরও একটা কিছু সেই সঙ্গে। কিন্তু সেটা যে ঠিক কী যেন বুঝে উঠতে পারলাম না।

পরমুহূর্তে আবার কিরীটী প্রশ্ন করল মহারানীকে, তা এতে আশ্চর্য হবার কি আছেমহারানী? এত দিন পরে হয়ত মিস্ সেন তাঁর জীবনের যোগ্য সাথী খুঁজে পেয়েছিলেন, তাই তাঁরা বিবাহ করবেন স্থির করেছিলেন।

আজ যখন মিত্রা বেঁচে নেই তখন আসল কথাটা বলতে আর আমার দ্বিধা নেই মিঃ রায়। মিত্রাকে আমি দীর্ঘদিন থেকে জানি। এক সময় she was my classmate! সেই থেকে ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হবার সুযোগ হয়। পুরুষ জাতটার প্রতিই she had a peculiar complex

কি রকম?

সে বলতো পুরুষের জন্মই নাকি মেয়েদের মন যোগানোর জন্য এবং যে কোনো পুরুষের চোখের সামনেই দেহের প্রলোম তুলে তাকে নাচানো যেতে পারে। আর সেইটাই ছিল তার জীবনের একমাত্র নিষ্ঠুরতম খেলা বা সেই নিষ্ঠুরতম খেলার মধ্যে দিয়ে সে আনন্দলাভ করাটাই একমাত্র নেশা! স্ত্রীলোক হয়ে জন্মেও সে যে কত বড় হৃদয়হীন নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিল, আর কেউ না জানলেও আমি জানতাম। আর সেই নিষ্ঠুর খেলায় শুধু অশোক রায় কেন, তার আগে অসীম বোস, সুধীর মিত্র প্রভৃতি কতজনার যে সে সর্বনাশ করেছে সে তো আমার অজানা নয়!

কথাগুলো বলতে বলতে একটা অবিমিশ্র ঘৃণা যেন মহারানীর কণ্ঠ হতে ঝরে ঝরে পড়তে লাগল। আমরা সকলেই নিঃশব্দে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছিলাম। কয়েকটা মুহূর্ত থেমে আবার মহারানী বলতে লাগলেন, তাই বলছিলাম অশোক রায় মিত্রার মৃত্যুর কথা জানতে পারলে, আজ দুঃখ পেলেও, পরে একদিন বুঝতে পারবে মিত্রার মৃত্যু was a blessing to him in disguise!

 

আগের পর্ব :

০১. তাসের ঘর
০২. ভুজঙ্গ ডাক্তারের সঙ্গে
০৩. বর্তমান কাহিনীর আদিপর্ব
০৪. সে রাত্রের মত আশ্বাস দিয়ে
০৫. দিন দুই পরে কিরীটী
০৬. অসাধারণ প্রসাধন-নৈপুণ্যে
০৭. নীলাম্বর মিত্র ও মনোজ দত্ত
০৮. কিরীটীর টালিগঞ্জের বাড়িতে
০৯. সমীরণ সরকার বিদায়
১০. আমার কণ্ঠের বিস্ময়ের সুর
১১. হীরা সিং কিরীটীর পূর্ব নির্দেশমত
১২. মহারানীর তীক্ষ্ণ প্রতিবাদের পর
১৩. বারের মধ্যে চার-পাঁচজন নরনারী

পরের পর্ব :
১৫. মহারানীর জবানবন্দির পর
১৬. মীরজুমলা
১৭. ঘরে ঢুকে শুনি রঞ্জন রক্ষিত
১৮. আমি যখন নীচের বাগানে যাই
১৯. কিরীটীর বাসায় যখন ফিরে এলাম
২০. কিরীটী মৃদু হেসে বললে
২১. টেলিফোনে অশোকবাবুকে ডেকে
২২. সোফার উপরে নিঝুম হয়ে
২৩. অশোক রায় বিদায় নিলেন
২৪. বিস্মিত হতবাক সকলে

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত