অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরছি। রাতও হয়ে গেছে বেশ। আর সারাদিন বসের হুকুম তামিল করতে-করতে মেজাজটাও হয়ে আছে পুরো চারশ বিশ। উঁহু, আরেকটু বেশী, চারশো একুশ। দরজায় বারবার কলিং বেল চাপছি; কিন্তু মহারাণীর দরজা খোলার কোনো নাম নেই। একসময় বাধ্য হয়েই দরজায় ধাক্কাতে শুরু করলাম। তারপরেও দরজা খোলার কোনো লক্ষণ-ই নেই। মিনিট দশেক হয়ে গেল। এবার আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারলাম না।টেলিটকের মতো সব ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে দরজায় ধাক্কার পাশাপাশি জোরে জোরে নীলা-নীলা বলে চিৎকার করতে শুরু করলাম।
কী করা যায় বুঝতে পারছি না। সিঁড়িতে বসে মোবাইলে ডাটা অন করলাম। ভাবলাম একটা স্ট্যাটাস দেই, “আমার বউ দরজা খোলছে না, আমি এখন কী করতে পারি ফ্রান্স?” কিন্তু না, স্ট্যাটাস দেয়া যাবে না। তাহলে হয়তো দেখা যাবে এই পোষ্ট আবার ভাইরাল হয়ে গেছে। আর এই পোস্টে যে পরিমাণ হাহা রিয়েকশন পড়বে তাতে হয়তো দেখা যাবে আমার জীবনটাও একটা হাহা রিয়েকশনের কারখানা হয়ে গেছে।
যাইহোক পোষ্ট দেয়ার চিন্তা-ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ডাটা অন করলাম। একমনে ফোন স্ক্রল করছি। হঠাৎ টুং করে একটা মেসেজ আসলো। আমার বউ মেসেজ দিয়েছে, “বাইরে ওমন ষাঁড়ের মতো চিল্লাচ্ছ কেনো! একটু ভিডিও কলিং করছিলাম, তোমার চিল্লা-চিল্লিতে ঠিকমতো কথাও বলতে পারলাম না। আর দরজার লক খোলাই আছে, একটু বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করো।”
অবশেষে আমি বাসায় ঢুকতে পারলাম। কিন্তু দরজা লক করে একটু বসতে-না-বসতেই বউ আবার মেসেজ দিল, “টেবিলে খাবার রাখা আছে। ওভেনে গরম করে খেয়ে নাও। আর আমাকে একদম ডাকা-ডাকি করবে না, আমি ফ্রেন্ডদের সাথে একটু গ্রুপ চ্যাট করছি।” একটু জিরিয়ে, ফ্রেশ-টেশ হয়ে খাবার গরম করতে গেলাম। কিন্তু অভাগা যেদিকে যায়, নদী নাকি শুকিয়ে যায়। আমার বেলায়ও তাই হলো। খাবার নষ্ট হয়ে আছে।
এদিকে বউ আবার তাকে ডাকা-ডাকি করতে আগে থেকেই মানা করে দিয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে আমিও বউকে একটা মেসেজ দিলাম, “তরকারি নষ্ট হয়ে আছে, এখন কী করবো?” কিন্তু বউ আমার কোনো রিপ্লাই দিচ্ছে না। বুঝতে পারছি না বউকে ডাকবো কি-না। কিন্তু আবার সাহসেও কোলাচ্ছে না। তাই কী আর করার, বাধ্য হয়েই ড্রয়িংরুমে গিয়ে টিভি দেখতে আরম্ভ করলাম, আর বউয়ের মেসেজের অপেক্ষায় একটু পর-পর ফোনে নজর দিতে থাকলাম। মিনিট পাঁচেক পর বউ আমার মেসেজ দিল। আমিও তাড়াতাড়ি লটারি পাওয়ার মতো মহা আনন্দে ফোনে হুমড়ি খেয়ে পরলাম। মেসেজে লেখা, “হাদারাম ফ্রিজে ডিম আছে, একটা ডিম ভেজে ভাত খাও।” আমি আবার মেসেজ দিলাম, “আমি তো পেঁয়াজ কাটতে পারি না। চোখ দিয়ে পানি পড়ে।”
এবার আর আমার বউ দেরি করলো না, সাথে-সাথে রিপ্লাই দিল। আমিও খুশি হয়ে তাড়াতাড়ি ফোর-জি গতিতে মেসেজ ওপেন করলাম। কিন্তু মেসেজ ওপেন করার পর সেই খুশি আর ধরে রাখতে পারলাম না। বউ লিখছে, “এতবড় দামরা ছেলে হইছো এখনো পেঁয়াজ কাটতে জানো না কেনো? আর পেঁয়াজ কাটতে না জানলে বিয়েই-বা করতে গেলা ক্যান…আশ্চর্য!”
কেনো যে বিয়ে করতে গেলাম সেই প্রশ্নের উত্তর আমারও জানা নেই। তাই বউকেও আর রিপ্লাই দেয়া হলো না। পেটে ইতোমধ্যে খিদায় হাতি দৌড়াচ্ছে। তাই কেনো বিয়ে করতে গেলাম সেই উত্তর খোঁজা বাদ দিয়ে লক্ষী ছেলের মতন পেঁয়াজ কাটায় লেগে গেলাম। বাহ! কী সুন্দর পেঁয়াজ কাটছি। চোখও একদম জ্বলছে না। ইচ্ছে করছে বউকে টেনে তুলে এক্ষুনি ডিভোর্স দিয়ে তল্পিতল্পা সহ বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেই। যেহেতু পেঁয়াজ কাটা শিখে গেছি, এখন এই ঢংগিলা বউ দিয়েই-বা আর কী হবে!
নিজের কাজে মুগ্ধ হয়ে নিজেকেই নিজে একটা পুরস্কার দিতে ইচ্ছে করছে। পুরস্কার দিতে না পারলেও খুশির চোটে আরো দুয়েকটা পেঁয়াজ কেটে ফেললাম ঠিকই। পেঁয়াজ কাটছি। একদম কুচিকুচি করে কাটছি। কাটছি আর কাটছি। আর কাটতে কাটতে কখন যে নিজের হাতের আঙ্গুলটাও কেটে ফালা-ফালা করে ফেলেছি সে খেয়াল নেই। যেই না দেখলাম রক্তে সাদা পেঁয়াজগুলাও লাল হয়ে গেছে তখনই ও-বউগো বউ বলে শরীরের সব জোর দিয়ে একটা চিৎকার দিলাম।
বউ আমার সাথে-সাথে মেসেজ দিলো, “কী হইছে?” আমি স্বজোরে আরেকটা চিল্লানি দিয়ে বললাম, “আঙ্গুল কাটছে।” বউ আবার মেসেজ দিল, “আহারে বাবুটা আমার (সাথে তিনটা ক্রাইয়িং ইমোজি)। জ্বলতেছে না..দেখো আলমারিতে ডেটল আর তুলা রাখা আছে।” আমি মেসেজের রিপ্লাই না দিয়ে ফোনটা জানালা দিয়ে সোজা রাস্তায় ফেলে দিলাম। হাতে ডেটল-তুলা চেপে সোফায় শুয়ে আছি। ঘন্টাখানেক পর বউ আমার ঘর থেকে ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে বলল, ”ঐ হারামজাদা তরে কোনসময় থেকে মেসেজ দিতেছি? এখনো রিপ্লাই দিস না ক্যান, আমার টেনশন হচ্ছে না বুঝি!”
বউয়ের কথা শুনে রাগে আমার গাঁ জ্বলতে লাগলো। কিন্তু গাঁ জ্বালিয়ে আর কী লাভ! আমি জ্বলে-পোড়ে বার্ন ইউনিটে পড়ে থাকলেও বউ আমারে হয়তো মেসেজ দিবে, “বাবু তোমার কী খুব কষ্ট হচ্ছে? (সাথে তিনটা সেড ইমেজি)” তাই সব জ্বলা-পোড়া বাদ দিয়ে আমিও বউয়ের থেকে আরো কয়েকগুণ জোরে ষাঁড়ের মতো চিৎকার করে জবাব দিলাম, “কাল মার্কেট থেকে আগে আরেকটা ফোন কিনে আনি, তারপর খালি তোরে না, তোর মা-বাবা, ভাই-বোন, চাচা-চাচি, দাদা-দাদি, নানা-নানি, এমনকি তোর বাসার কাজের বোয়ারেও রিপ্লাই দিব।”