১১. হীরা সিং কিরীটীর পূর্ব নির্দেশমত
হীরা সিং কিরীটীর পূর্ব নির্দেশমত গাড়িটা খানিকটা দূরেই পার্ক করে রেখেছিল। আমরা গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে লক্ষ্য করলাম, শ্ৰীমন্ত পালের চকচকে ফোর্ড কনসাল গাড়িটা নার্সিং হোমের সামনেই পার্ক করা আছে। অদূরে রাস্তার লাইটপোস্টের আলোয় দেখলাম, গাড়ির মধ্যে কোন ড্রাইভার নেই। শূন্য গাড়িটা পার্ক করা আছে মাত্র। গাড়ি ও গাড়ির নাম্বার দুটোই আমার যথেষ্ট পরিচত। হীরা সিং সজাগই ছিল।
আমারা এসে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়িতে স্টার্ট দিতে দিতে ঘাড় ফিরিয়ে হীরা সিং প্রশ্ন করল, কিধার যায়গা সাব?
কোঠি চল। কিরীটী বললে।
প্রথম থেকেই অর্থাৎ সেই বাথরুম থেকে বের হয়ে আসা পর্যন্ত কিরীটী যেন হঠাৎ কেমন চুপ করে গিয়েছিল। একটি কথাও বলেনি। বুঝতে পারছিলাম কিরীটীর মনের মধ্যে বিশেষ কোন একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, তাই আমিও কথা বলা নিরর্থকভেবে চুপ করেই গিয়েছিলাম।
গাড়ি ছুটে চলেছে নিঃশব্দ গতিতে রাত্রির জনহীন পথ দিয়ে। দু-পাশের বাড়িগুলো যেন ফ্রেমে আঁকা ছবির মত মনে হয়।
রাস্তার দু-পাশে লাইটপোস্টের আলো ও রাত্রির অন্ধকার মেশামেশি হয়ে যেন আলোছায়ার একটা রহস্য গড়ে তুলেছে। সেই আলোছায়ার রহস্যের মধ্যে জাগরণ-ক্লান্ত চোখ দুটো আমার যেন কেমন জড়িয়ে আসছিল। হঠাৎ কিরীটীর কথায় চমকে ওর মুখের দিকে ফিরে তাকালাম।
আমাদের নামবার সময় সিঁড়ি দিয়ে যে লোকটা উঠে গেল তাকে চিনতে পেরেছিস সুব্রত?
হ্যাঁ। শ্ৰীমন্ত পাল।
কিন্তু আমি যদি বলি সে শ্ৰীমন্ত পাল নয়!
তার মানে? বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালাম কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, শ্ৰীমন্ত পাল নয়। কিরীটী আবার বললে।
কি বলছিস কিরীটী?
ঠিকই বলছি। যদিও সামনাসামনি একদিন মাত্র ভদ্রলোকটিকে দেখেছিলাম, তবুও বলতে পারি সিঁড়িতে যার সঙ্গে একটু আগে আমাদের দেখা হয়েছে সে শ্ৰীমন্ত পাল নয়। হুবহু শ্ৰীমন্ত পালেরই ছদ্মবেশে অন্য কেউ। তবে এও বলব, সে যেই হোক তার অদ্ভুত একটা দক্ষতা আছে ছদ্মবেশ ধারণের। কিরীটীর কথাগুলো যতখানি বিস্ময় ঠিক ততখানি কৌতূহলের উদ্রেক করে আমার মনে। এবং আমি কোন কথা বলবার পূর্বেই কিরীটী আবার বলে, আচ্ছা বৈকালী সঙ্ঘ থেকে ডাক্তারের চেম্বারের দূরত্ব কতটা হতে পারে?
মনে মনে একটা হিসাব করে বললাম, মাইল তিন কি সাড়ে তিনের বেশি হবে বলে তো মনে হয় না।
তাহলে অ্যাভারেজ স্পীডে গাড়ি চালালে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা যেতে কত সময় লাগতে পারে?
তা রাস্তা খালি থাকল পনের-মোল মিনিটের বেশি নিশ্চয় নয়।
অর্থাৎ খুব বেশি লাগলে কুড়ি মিনিটের বেশি নয়।
তাই।
হঠাৎ এরপর কিরীটী সম্পূর্ণ প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল।
বললে, কাল যাচ্ছিস তো বৈকালী সঙ্ঘে?
হ্যাঁ, যাব। দু-তিন দিন যাইনি।
হ্যাঁ যাস। আর চেষ্টা করে দেখিস যদি বিশাখা চৌধুরীর কাছ থেকে মিত্রা-অশোক সংবাদ কিছু সংগ্রহ করতে পারিস?
বৌদিও কাল যাচ্ছে নাকি?
না। তার সেখানে যাবার যেটুকু প্রয়োজন ছিল তা মিটে গিয়েছে।
কি রকম!
বারুদস্তুপে অগ্নিসংযোগ করবার জন্য সামান্য একটি স্ফুলিঙ্গের প্রয়োজন ছিল— শ্ৰীমতী সেটা দিয়ে এসেছেন।
ও। তাহলে বৌদির বৈকালী সঙ্ঘে যাবার ব্যাপারে তোর সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল, বল?
তা ছিল।
বুঝতে কণ্ঠ হল না, কৃষ্ণা বৌদির বৈকালী সঙ্ঘে যাবার ব্যাপারে একটি পূর্ব পরিকল্পনা ছিল।
সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে আবার গত কুড়ি-বাইশ দিনের সমস্ত ব্যাপারগুলো পর পর ভাববার চেষ্টা করি।
কোথায় কোন ঘটনা কোন্ সূত্রে কার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলেছে,নতুন করে আবার ভাববার চেষ্টা করি।
পরের দিন রাত্রে সাড়ে দশটা নাগাদ যখন বৈকালী সঙ্ঘে গিয়ে হাজির হলাম তখন স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি যে, ঘটনার গতি কত দ্রুত বিশেষ একটি পরিণতির কেন্দ্রে এগিয়ে এসেছে।
পূর্ব পূর্ব রাতের মত আজও হলঘরে নরনারীদের ভিড় ছিল। ভিড়ের মধ্যে কোথাও বিশাখা চৌধুরীকে দেখতে পেলাম না। এবং দ্রুত অনুসন্ধানী দৃষ্টিটা চারিদিকে সঞ্চালন করেও ঘরের মধ্যে আর কোথাও আরও দুটি পরিচিত মুখও নজরে পড়ল মা। একটি অশোক রায়, দ্বিতীয়টি মিত্রা সেন। বিশেষ করে যাদের সম্পর্কে গতকাল কিরীটীর মুখ থেকে মুখরোচক সংবাদটি পেয়েছিলাম—এবং যে সংবাদটি পাওয়া অবধি মনের মধ্যে একটা কৌতূহল আমাকে কেবলই চঞ্চল করে তুলছিল—মিত্রা সেনকে অবিশ্যি ঐ সময় প্রতি রাত্রে দেখিনি, সে একটু দেরি করেই আসত, কিন্তু অশোক রায় ঠিকই উপস্থিত থাকত। মিত্রা সেন এলে তবে সে হলঘর থেকে যেত।
হঠাৎ এমন সময় এক নম্বর দরজাপথে বিশাখা চৌধুরী হলঘরে প্রবেশ করে আমাকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি আমার কাছ ঘেঁষে এসে দাঁড়ায়।
দুদিন আসনি যে বড়?
একটু কাজে বাইরে গিয়েছিলাম।
লক্ষ্য করলাম আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বিশাখা যেন হাঁপাচ্ছে। শুধু তাই নয়, চোখের মণি দুটো যেন তার কি এক উত্তেজনায় চকচক করছে। রক্তচাপে মুখখানাও যেন থমথম করছে।
কোথা থেকে আসছ? জিজ্ঞাসা করলাম।
ভীষণ পিপাসা পেয়েছিল, বারে গিয়েছিলাম। চল না,যাবে? কিছু ড্রিঙ্ক করবে?
না। ড্রিঙ্ক আমি করি না, জান তো।
তা হোক, চল। আমার অনুরোধে না হয় একটু অরেঞ্জ বা লিমনই ড্রিঙ্ক করলে।
কেন? Any special occassion!
যদি বলি হ্যাঁ—তারপরই মৃদু হেসে বললে, না, না—সে রকম কিছুনা। চলই না,–বলতে বলতে আরও একটু ঘনিষ্ঠভাবে এগিয়ে বিশাখা আমার হাতটা ধরতেই অ্যালকহলের তীব্র একটা গন্ধ তার গায়ের দামী প্যারিস সেন্টের গন্ধকেও যেন ছাপিয়ে এসে আমার নাসারন্ধ্রে ঝাপটা দিল।
থমকে ওর মুখের দিকে তাকালাম।
দুচোখের তারায় বিশাখার নেশাগ্রস্ত বিলোল দৃষ্টি। এতক্ষণে বুঝলাম বিশাখা ড্রিঙ্ক করেছে। একটু আশ্চর্য হয়েছিলাম। গত পনের-কুড়ি রাত্রির ঘনিষ্ঠ পরিচয়ে কখনও তাকে আজ পর্যন্ত ড্রিঙ্ক করতে দেখিনি। বোধ হয় নিজের অজ্ঞাতেই তাকিয়েছিলাম বিশাখার মুখের দিকে।
মৃদুকণ্ঠে প্রশ্নোচ্চারিত হল, কি দেখছ অমন করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সত্যসিন্ধু?
সহসা এমন সময় ভয়ার্ত চাপা নারী-কণ্ঠের তীক্ষ্ণ আতশব্দে চমকে সামনের দিকে তাকালাম।
সোনপুর স্টেটের মহারানী সুচরিতা দেবীর কণ্ঠস্বর।
Horrible! How Horrible!
কি! কি! ব্যাপার কি মহারানী!
কি ব্যাপার সুচরিতা দেবী!
কি হল মহারানী!
একসঙ্গে আট-দশটি বিভিন্ন পুরুষ ও নারী কন্ঠোচ্চারিত প্রশ্ন মহারানীকে উদ্দেশ করে যেন বর্ষিত হল। আমি আর বিশাখাও এগিয়ে গিয়েছিলাম।
প্রৌঢ়া মহারানীর সুন্দর মুখখানা যেন নিদারুণ একটা ভীতিতে ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে কাগজের মত। সমস্ত দেহটা তাঁর তখনও কাঁপছে মৃদু মৃদু।
শ্ৰীমন্ত পাল ও মনোজ দত্ত মহারানীর আরও কাছে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, কি মহারানী? কী?
মিত্রা—মিত্রা সেন—
কি? কি হয়েছে মিত্রা সেনের?
She is dead! Stone-dead! একটা আর্ত অস্ফুট চাপা আর্তনাদের মতই যেন ভয়াবহ ঐ কথা দুটি কোনমতে উচ্চারণ করে দুহাতে মুখ ঢেকে একটা সোফার উপরে বসে পড়লেন মহারানী কাঁপতে কাঁপতে।
বন্দুকের ব্যারেল থেকে যেন একটা বুলেট বের হয়ে এসেছে। এবং শুধু একজনের নয়, একসঙ্গে সেই ঘরের মধ্যে তখন উপস্থিত সকলেরই বক্ষ যেন ভেদ করেছে সেই একটিমাত্র বুলেট একসঙ্গে।
মহারানী তখনও কম্পিতকণ্ঠে বলে চলেছে, Oh God! কি ভয়ানক! কি ভয়ানক!……
মিত্রা সেন মারা গিয়েছে? সে কি! প্রথমেই কথাটা উচ্চারণ করলেন জমাট স্তব্ধতার মধ্যে তরুণ ব্যারিস্টার মনোজ দত্ত।
হ্যাঁ, আমি স্বচক্ষে এইমাত্র বাগানে দেখে এলাম। প্রথমটায় বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম বুঝি ঘুমোচ্ছে। কিন্তু বার বার ডেকেও সাড়া না পেয়ে, এগিয়ে গিয়ে গায়ে হাত দিতেই, বলতে বলতে হঠাৎ শিউরে উঠলেন মহারানী।
এবার এগিয়ে গিয়ে আমি কথা বললাম, আপনিস্থির-নিশ্চিতত মহারানী! সত্যিসত্যিই মিত্রা সেন মারা গেছেন?
কি বলছেন আপনি সত্যসিন্ধুবাবু! I am sure, she is dead, stone-dead!
কিন্তু ব্যাপারটা তাহলে একবার দেখা দরকার এখুনি!
আমার কথায় ঘরের মধ্যে উপস্থিত অন্যান্য সকলের যেন এতক্ষণে খেয়াল হয়। সকলেই একসঙ্গে আমার প্রস্তাবে সায় দেয়, নিশ্চয় নিশ্চয়, চলুন চলুন সত্যসিন্ধুবাবু।
চলুন তো মহারানী! কোথায়?
আমি মহারানীর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলতেই তীব্রকণ্ঠে প্রতিবাদ জানালেন মহারানী, না, না—আমি আর সেখানে যেতে পারব না। Dont request me, যান—আপনারা যান।
ঘরের মধ্যে তখন উপস্থিত ছিলেন শ্রীমন্ত পাল, মনোজ দত্ত, মহারানী অফ সোনপুর সুচরিতা দেবী, অভিনেত্রী সুমিত্রা চ্যাটার্জী, আমি ও বিশাখা চৌধুরী।
আগের পর্ব :
০১. তাসের ঘর
০২. ভুজঙ্গ ডাক্তারের সঙ্গে
০৩. বর্তমান কাহিনীর আদিপর্ব
০৪. সে রাত্রের মত আশ্বাস দিয়ে
০৫. দিন দুই পরে কিরীটী
০৬. অসাধারণ প্রসাধন-নৈপুণ্যে
০৭. নীলাম্বর মিত্র ও মনোজ দত্ত
০৮. কিরীটীর টালিগঞ্জের বাড়িতে
০৯. সমীরণ সরকার বিদায়
১০. আমার কণ্ঠের বিস্ময়ের সুর
পরের পর্ব :
১২. মহারানীর তীক্ষ্ণ প্রতিবাদের পর
১৩. বারের মধ্যে চার-পাঁচজন নরনারী
১৪. হলঘরে আমরা প্রবেশ করবার মুখে
১৫. মহারানীর জবানবন্দির পর
১৬. মীরজুমলা
১৭. ঘরে ঢুকে শুনি রঞ্জন রক্ষিত
১৮. আমি যখন নীচের বাগানে যাই
১৯. কিরীটীর বাসায় যখন ফিরে এলাম
২০. কিরীটী মৃদু হেসে বললে
২১. টেলিফোনে অশোকবাবুকে ডেকে
২২. সোফার উপরে নিঝুম হয়ে
২৩. অশোক রায় বিদায় নিলেন
২৪. বিস্মিত হতবাক সকলে