কপালে নীল টিপটা দিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে অবাক হয়েই তাকিয়ে রইল অধরা। নিজের চেহারা দেখে নিজেই নিজের প্রেমে পড়তে ইচ্ছা করছে। ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখা মেকাপ ফাউন্ডেশনের বক্সগুলো দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে পড়ল অধরা। মেহমান হয়তো চলে এসেছে। আজ তাকে দেখতে আসবে। যদিও এটা নতুন বা প্রথমবার না। এর আগে আরও নয় বার তাকে নয়টা ছেলে দেখতে এসেছিল। প্রথম মনে হয় ছেলে তাকে পছন্দ করেছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত গিয়ে তা দেখা পর্যন্তই থাকে, বিয়ে পর্যন্ত যায় না। বিয়ে না হওয়া নিয়ে যতটা কষ্ট অধরা পায়, তারচেয়ে বেশি কষ্ট পায় তার মাবাবার অসহায় মুখ দেখে। কয়েকটা ছেলে তো অধরাকে দেখতে এসে তার ছোট বোনকে পছন্দ করে ফেলে। পুরাই ইজ্জতের ফালুদা।
হামিদা মেয়েকে ডাকতে এলেন। দেখলেন মেয়ে রেডি হয়ে বসে আছে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তার মুখটা হেসে উঠে মুহূর্তেই কালো মেঘ জমে গেল। প্রতিটা বিয়ে ভেঙে যাওয়া একটা মেয়ের জন্য কতট কষ্টের তা তিনি বোঝেন। হামিদার তো নিজের প্রথম বিয়ে ভেঙে যাওয়ার কথা শুনেই আত্মহত্যা করতে মন চেয়েছিল। যদিও অধরা তার মত নরম মনের মেয়ে নয়, সে তার বাবার মত শক্ত মনের মানুষ। মেয়েদের মন শক্ত হওয়া ঠিক?
-চল, ওনারা বসে আছেন।
-কে কে এসেছেন?
-ছেলে, আর তার ফুফু, খালা।
-আর কেউ না?
-গার্জিয়ান পক্ষের ওনারা দুজনই।
-ও।
অধরা শাড়ির আঁচলটা মাথায় না দিয়েই বের হতে লাগল। তার মা পিছন থেকে ডেকে বললেন, আঁচলটা মাথার উপরে টেনে দে। প্রত্যেকবার তো তাই করি। এবার নাহয় একটু উল্টো করলাম।
-উঁহু। মেয়ের কাছে গিয়ে নিজেই শাড়ির আঁচলটা টেনে দিলেন। বললেন, আমার মেয়েটাকে তো সত্যি বৌ বৌ লাগছে।
-ছাড়ো তো। তুমি না মা, খুব ন্যাকা হয়ে যাচ্ছ দিনদিন। পিছনে দেখ, শাড়িটা ঠিক আছে কি না।
-ঠিক আছে চল। দেরী হয়ে যাচ্ছে রে।
ঘরে ঢোকার আগেই ভিতরের পরিবেশ বোঝার চেষ্টা করছে অধরা। ছেলের খালা অথবা ফুফু কেউ একজন বকবক করেই যাচ্ছে। তার বকবকানির বক্তব্য হল নিজের ভাই এবং ভাতিজার গুণকীর্তন করা। অধরার বিরক্ত লাগছে, আবার হাসিও পাচ্ছে। অধরাকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন হামিদা। মিষ্টি করে সালাম দিল অধরা। ছেলের খালা অধরাকে বলল, বস মা। অধরা বসল। ছেলে একটা স্ট্রাইপ শার্ট পরা। মুখটা ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। ছেলের মুখ দেখতে হলে অধরার মাথা উঁচু করতে হবে। এ সমাজ মাঝেমধ্যে মেয়েদের মাথাকে উঁচু করতে দেয় না। অধরার প্রতি ছেলের ফুফুকে কেমনযেন অনাগ্রহী মনে হচ্ছে। এবার তিনি নিজের বক্তব্য শুরু করলেন।
-তা, আপা শোনেন। আমার বিয়ের আগে শামীমের বাপ দেখতে আসল। অধরার খালা জিজ্ঞেস করলেন, শামীমের বাপ মানে?
-আমার বড় ছেলের নাম শামীম। তা আপা, তারপর দেখতে এসে সে কী কাণ্ডকারখানা! হেঁটে দেখাও, বসে দেখাও, কেশে দেখাও। মাথার চুল থেকে শুরু করে পা পর্যন্ত দেখা। কী বিশ্রী অবস্থা, বোঝেন?
ছেলের খালা, অধরার খালা-ফুফু সবাই হো হো করে হেসে উঠল। যদিও অধরার কাছে মনে হচ্ছে সবাই মেকি হাসি হাসছে। বেশকিছুক্ষণ পর তারা মূল বিষয়ে আগ্রহ দেখালো। অধরাকে অবশ্য হেঁটে, বসে, কেশে, হেসে দেখাতে হয়নি। ছেলের ফুফু অধরার মুখের থেকে হাত পায়ের দিকে বেশি তাকাচ্ছে। সেই ব্যাপারটা অধরার মত বুদ্ধিমতী মেয়ের বুঝতে কষ্ট হল না। বেশ অবজ্ঞার স্বরে তিনি বললেন, ঘটক বলেছিল মেয়ে নাকি শ্যামলা। কই? মেয়ে তো কালো।
লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে অধরার। মাথা তুলতে পারছে না সে। মাথা তুললে হয়তো দেখবে লজ্জায় তার মা হয়তো শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে আছে। অধরা বসে থাকবে নাকি উঠে যাবে বুঝতে পারছে না। তাকে সমাধান দিল তার খালা। বলল, অধরা, ঘরে যা মা। অধরা উঠে চলে গেল। পাশের ঘরে দরজার আড়ালে মেঝেতে বসে পড়ল সে। কাঁদছে না সে, অবাক হচ্ছে। এই একবিংশ শতাব্দীর মানুষও মানুষের গায়ের রঙ দেখে বিচার করে। কী আজব!
অধরার খালা তার বোন অর্থাৎ অধরার মাকে বলল, আপা, তুই ওই ঘরে যা। বোনের কণ্ঠস্বর পরিবর্তন হয়েছে দেখে হামিদা আর কথা বাড়ালো না। হামিদা দরজা পার হতেই নরম স্বরে বলল, তখন যেন কী বলছিলেন আপনি? মেয়ে তো শ্যামলা না, কালো। আচ্ছা, আমরা কি কখনো বলেছি যে আমাদের মেয়ে।ফর্সা বা শ্যামলা? আমরা জানি আমাদের মেয়ে কালো। তবে আরেকটা জিনিস জানলাম তা হল, আপনাদের মত সাদা চামড়ার লোকদের ভিতরটা খুবই কালো, নোংরা। আমাদের মেয়ে যদি আপনাদের পছন্দ হত, তবুও আমরা আপনাদের সাথে সম্পর্ক করতাম না। আপনারা আসতে পারেন।
এক দমে কথা বলে লম্বা নিঃশ্বাস করল ছাড়ল অধরার খালা। ছেলের ফুফু কিছু বলতে চাচ্ছিল, তাকে বলল, আপা, আর কথা বললে অপমানিত হবেন, তারচেয়ে বরং চলে যান। এই কথার পর আর বসে থাকা যায় না। ছেলেসহ তার খালা-ফুফু যারা এসেছিল, সবাই চলে গেল। অধরার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। সে উঠে চলে গেল বাথরুমের দিকে। শাওয়ারের নিচে পানি পড়ার ঝুমঝুম শব্দ। কিন্তু অধরার নিঃশব্দে কান্নাটা কেউ বুঝল না। তার কান্নাটা নিজের বিয়ে না হওয়াটা নয়, মধ্যবিত্ত পরিবারের মাবাবার অসহায় মুখটার কথা ভেবে।
শাওয়ারের পানিতে ধুয়ে গেল মেকাপ ফাউন্ডেশন। বারান্দায় গিয়ে চুল ছেড়ে দিয়ে অধরা ইজিচেয়ারে শুয়ে আছে। তার বাবা ছোটবেলায় তাকে কৃষ্ণকলি বলে ডাকত। এই নামের অর্থ তখন বুঝত না অধরা। অধরাকে তার বাবা গান শোনাতো, কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক। মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে কালো মেঘের কালো হরিণ-চোখ। ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে, মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে। কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।।
আজ অধরা এই গানের অর্থ বোঝে। শুধু অর্থ না, এর শানেনজুল, তর্জমা, বিশদ ব্যাখ্যা, বাস্তবতা সবই বোঝে। শুধু বোঝে না, সৌন্দর্য কি শুধুই গায়ের রঙ? মাধ্যমিকের স্মৃতি খুব টানে অধরাকে। তখন সে মফস্বল শহরে বাবার পৈত্রিক বাড়িতে থাকত। কৈশোরে থাকা অবস্থাতেই যৌবনে পদার্পণ করে প্রতিটা মেয়ে। মন থেকে যায় কিশোরী কিন্তু শরীর তখন নবযৌবনা। সেই সময়টাতে প্রায় প্রত্যেকের জীবনে প্রথম প্রেমের আবির্ভাব হয়। অধরারও জীবনে প্রথম প্রেম এসেছিল। সেই দিনটার কথা ভেবে খুব হাসি পায় অধরার।
সামনে টেস্ট পরীক্ষা। লেখাপড়ার খুব চাপ। কোচিং, স্কুল করে কূল পাওয়া যায় না। একদিন কোচিং থেকে ফেরার পথে রাস্তার মোড়ে সাব্বিরকে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। অধরা প্রথম ভেবেছিল সাব্বির হয়তো অধরার বান্ধবী লাবণ্যকে প্রপোজ করবে। লাবণ্য মনেমনে পছন্দ করত সাব্বিরকে। কিন্তু কাছে আসতেই সাব্বির ফুলগুলো বাড়িয়ে দিয়ে বলল, অধরা, আই লাভ ইউ। অধরার মায়াবী চোখদুটো তখন বিস্ময়ে এবং রাগে লাল হয়ে জ্বলছে। সে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো সাব্বিরের দিকে। ভয়ে সাব্বির ফুল ফেলে দিয়ে ভোঁদৌড় দিল। ফুলগুলো পড়ে রইল রাস্তায়।
অধরার সব বান্ধবীর বিয়ে হয়ে গেছে। গত বছর লাবণ্যের বিয়ে হল। শুধু তারই হচ্ছে না। শুধু একটাই কারণ সে কালো। আচ্ছা, ওদের ব্যাচে আর কেউ কি কালো ছিল না? সাব্বিরের কোন খবর জানে না। স্কুল কলেজের বেশিরভাগ বন্ধুবান্ধব সেটেল্ড। দুএকজন ভ্যাগাবন্ড যারা জেমসবন্ডের ভাব নিয়ে ঘুরত, তারাও রাজনীতি করে উঠে গেছে। সৌরভ নামে একজন নাকি আগামীতে সংসদ নির্বাচন করবে।
কখন যে সন্ধ্যা হয়ে রাত নেমে গেছে খেয়ালই হল না অধরার। বেলকনি থেকে তার ঘরে যাওয়ার আগে বাবামায়ের ঘরের সামনে দিয়ে যেতে হয়। অধরা না চাইতেই তার বাবার মুখোমুখি তাকালো। চাকরি চলে যাওয়া হতাশাগ্রস্থ যুবকের মুখটা যেমন থাকে, অধরার বাবার মুখটা সেরকম। অধরা সান্ত্বনামূলক দুইট কথা বলতে গিয়েও বলতে পারল না। নিজের ঘরে চলে এলো। অনেকদিন ভার্সিটি যাওয়া হয় না। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা তাই ক্লাস কম। বাসায় থাকতে ভাল লাগছে না অধরার। বান্ধবী রিয়াকে ফোন করে ভার্সিটি আসতে বলল। ফজিলাতুন্নসা হলের সামনে থামল রিয়া। এখানেই অধরার থাকার কথা। ক্যান্টিনে ঢুকেই দেখল কোণার টেবিলে পিছন ফিরে বসে আছে লম্বাকেশী। ভার্সিটিতে প্রত্যেকের কিছু নাম আছে। অধরার নাম লম্বাকেশী। কোমরের নিচে তার চুল নেমে এসেছে। কিন্তু ভার্সিটির কেউ তার কৃষ্ণকলি নাম জানে না।
-কিরে, কতক্ষণ আগে আসছিস?
-এইতো। দশ মিনিট।
-আর বলিস না। জ্যামে আটকেছিলাম। শোন, কার্ড পেয়েছিস?
-কিসের কার্ড?
-নবনীতার বিয়ে।
-ও আচ্ছা। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল অধরা, কী খাবি?
-কফি। কফির অর্ডার করে চুপচাপ বসে আছে অধরা। রিয়া জিজ্ঞেস করল, তোর কি মন খারাপ?
-নাহ।
-কী হয়েছে, বল প্লিজ।
-পরে বলছি। কফি শেষ কর।
ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে রিকশা নিয়ে টিএসসির দিকে রওনা দিল ওরা। রিকশায় বাতাসে অধরার চুলগুলো উড়ছে। মুখের উপর থেকে একগাছি চুল সরিয়ে অধরা বলল, আমার বাবামায়ের জন্য খুব খারাপ লাগে, বুঝলি?
-কেন?
-আমার আরও দুইটা ভাইবোন আছে। তাদেরকে নিয়ে বাবামায়ের কোন টেনশন নেই। সব চিন্তা আমাকে নিয়ে।
-এটা তো ভাল।
-ভাল না। আমাকে নিয়ে কিসের টেনশন এটা জানিস?
-কিসের?
-বিয়ের। আমার বিয়ে দিতে না পেরে তারা খুবই কষ্টে আছে।
রিয়া ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে বলল, কী করবি বল? তোর মত ট্যালেন্টেড মেয়ে খুব কম আছে। কিন্তু কেউ তোর ট্যালেন্টকে বিচার করবে না। সবাই তোর বাইরের সৌন্দর্যকে মূল্যায়ন করবে। আমাদের বাঙ্গালি সংস্কৃতি এখন শারীরিক সৌন্দর্যের কাছে মাথা নত করে আছে। রিয়ার কথার ইঙ্গিত বুঝতে পারছে না অধরা। রিকশা টিএসসি এসে পড়ল। রিকশা থেকে নেমে ভাস্কর্যের সিড়িতে বসল ওরা। অধরা নিজের মন খারাপটা লুকিয়ে রাখতে পারছে না। অধরার এই অবস্থা দেখে রিয়া বলল, এরকম মনমরা হয়ে থাকিস না তো। তুই মনমরা হয়ে থাকলে তোর বাপমায়ের কষ্ট কমবে না। চল।
-কোথায়?
-জানি না। কিন্তু চল। আজ ঘুরব।
কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা মনেমনে রিয়ার টানাটানিতে আর থাকতে পারল না অধরা। অধরারও ইচ্ছা করে এরকম চপলাচঞ্চলা হয়ে থাকতে। কিন্ত সবসময় বাবামায়ের মুখ তার চোখের সামনে ভাসে।
ফেসবুকে লগইন করল অধরা। খুব একটা সময় দেওয়া হয় না। Other Message এ গিয়ে Message Request এ একটা মেসেজ দেখে কপাল কুঁচকে তাকালো স্ক্রিনের দিকে তাকালো, SA Turzo নামের একটা আইডি থেকে মেসেজ এসেছে, “কৃষ্ণকলি???” অধরা অবাক হল। কারণ এই নাম তার স্কুলের ফ্রেন্ডরাই জানে। কিন্তু তূর্য নামে তার কোন ক্লাসমেট বা বন্ধু নেই বা ছিল না। যদিও ফেসবুকে আসল নাম ব্যবহার করা লোক কম আছে। বেশ খানিকক্ষণ ভেবে অধরা রিপ্লাই দিল, হুম। আমি কৃষ্ণকলি। কিন্তু আপনি কে? এই মেসেজের উত্তর আসবে কখন তার গ্যারান্টি নেই। অধরা তার মাকে ডেকে বলল, একটু চা খাওয়াবে মা?
-তোরে না চা খাইতে নিষেধ করা আছে?
-কেন? চা খাইলে কী হয়?
-চা খাইলে নাকি গায়ের রঙ কালো হয়ে যায়।
-আমি তো এমনিতেই কালো। আর কত কালো হব? আর কালো হলে কি তোমরা আমাকে ত্যাজ্যকন্যা করে দিবে?
-যা, তো ঢং করিস না।
আমি চা নিয়ে আসছি। হামিদা চলে গেলে বারান্দায় এসে বসল। ইজিচেয়ারে দুলতে অধরার ভালই লাগে। ছোটবেলায় তাদের বাসায় বড় একটা দোলনা ছিল। তাকে, তার ভাইবোনকে তার বাবা দোলনায় দুলাইতো আর গান গাইতো, দোল দোল দুলুনি রাঙা মাথায় চিরুনি এনে দেবে হাট থেকে মান তুমি কর না। হামিদা চা নিয়ে এসেছে। একট চেয়ার টেনে মেয়ের পাশে বসল সে। অধরা চেয়ারে হালকা দুলছে। তার দৃষ্টি জানালা বেয়ে দূরের আকাশে একফালি চাঁদের দিকে। কী অবাক করা ব্যাপার? চাঁদের গায়ের কলঙ্ক মেনে নিবে কিন্তু মেয়েদের কালো রঙের শরীর মেনে নিবে না। মাঝেমাঝে এসব কারণে পুরুষজাতির উপর বিরক্ত হয় অধরা।
-তোর কি মন খারাপ মা? মায়ের কথায় ঘোর কাটলো অধরার।
-মন খারাপ হবে কেন?
-এবারেও তোর বিয়েটা দিতে পারলাম না।
-কী যে বল না, মা। আমি বিয়ের জন্য পাগল হয়ে আছি নাকি?
-এই, শোন না। একটা গান শোনা তো মা..
-এই রাতদুপুরে গান গাইবো? তোমার কি মাথাখারাপ?
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে অধরা গান ধরল মাঝির লাগি আছি জাগি সকল রাত্রিবেলা, ঢেউগুলো যে আমায় নিয়ে করে কেবল খেলা। ঝড়কে আমি করব মিতে, ডরব না তার ভ্রুকুটিতে দাও ছেড়ে দাও ওগো আমি তুফান পেলে বাঁচি।। তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে তোমার খোলা হাওয়া হামিদা মুগ্ধ হয়ে মেয়ের গান শুনছে। কী মধুর কণ্ঠ! নিজের অজান্তেই চোখ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল হামিদার। সেই দৃশ্য অধরার চোখ এড়ায়নি। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মোবাইলে টাইম দেখল, আটটা বাজে। হামিদা পিরিচে ঢেকে চা দিয়ে গেছে। উঠে বসল অধরা। চায়ে চুকচুক করে চুমুক দিতে দিতে ফেসবুকে ঢুকল সে। সেই আইডি থেকে মেসেজ এসেছে।
-পরিচয়টা নাহয় দিবো। কিন্তু ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টটা কি এক্সেপ্ট করবেন না? অধরা উত্তর দিল, অপরিচিত কাউকে না জেনে আমি আমার লিস্টে এড করি না। ওপাশ থেকে সাথে সাথে উত্তর এল, তাই? এটা খুব ভাল। গুডমর্নিং
-থ্যাংকস।
-আচ্ছা। আপনি খুঁজে বের করুন। আমি কে হতে পারি? আপনাকে কিছু ক্লু দিই। ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে অধরার কাছে। সে বলল, ওকে।
-আমি আপনার সাথে স্কুলে পড়েছি। আপনি আমাকে খুব ভয় দিয়েছিলেন?
-কিভাবে ভয় দিয়েছিলাম?
-আপনার তীক্ষ্ণ অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে।
-এটা কোন কথা হল? আরও সহজ কিছু বলেন।
-আমার নাম ‘S’ দিয়ে।
-শান।
-উঁহু। আপনার এক বান্ধবী আমাকে পছন্দ করত। আপনার বান্ধবীর নাম লাবণ্য। এবার চিনতে অসুবিধা হল না। খুবই বিস্ময়ের সাথে অধরা বলল, তুমি মানে তুই?
-হুম।
-আমার আইডি কোথায় পেলি?
-লাবণ্য দিয়েছে।
-ও। কোথায় আছিস তুই?
-সিডনি। আগামী সপ্তাহে দেশে আসছি।
-ওকে। আয়, সাবধানে আসিস।
-পরে কথা হবে। বাই, টেক কেয়ার।
এক সপ্তাহ ফেসবুকের মেসেজিংয়ে কথা হয়েছে সাব্বিরের সাথে। সাব্বির দেশে আসার পর দুইদিন কথা হয়নি। একদিন অপরিচিত নাম্বার থেকে একটা ফোন এল। রিসিভ করেই অধরা বলল, কিরে সাব্বির, কেমন আছিস?
-ভাল। তুই? আর আমার নাম্বার কিভাবে চিনলি?
-ভাল। আমাকে অপরিচিত কে ফোন করবে বল?
-তোর কণ্ঠটা আগের চেয়ে মিষ্টি হয়েছে।
-ভালই তো ফ্লার্ট করতে পারিস।
-নারে। তোর অগ্নিদৃষ্টিতে পুড়ে আর ফ্লার্ট করতে পারি না।
-হাহাহা। সেদিনের কথা মনে পড়লে খুব হাসি পায়। প্রপোজ করে কী দৌড়টা না দিলি।
-আর লজ্জা দিস না। কাল কোথায় আসব?
-শাহবাগ আয়। তারপর দেখি, কোথায় যাওয়া যায়।
শহরে গোধূলি খুব একটা উপভোগ্য হয় না। অধরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফোন করছে সাব্বিরকে। কিন্তু সাব্বির ফোন তুলছে না। যথেষ্ট রাগ হচ্ছে অধরার। রাস্তার পাশে একা একটি মেয়ে এভাবে সন্ধ্যের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো দেখায় না। কালো রঙের একটা মরিস মাইনর গাড়ি অধরার গা ঘেঁষে ব্রেক কষল। একটু ভয় পেয়ে পিছনে যেতেই গ্লাস খুলে মুখটা বের করে সাব্বির বলল, তুই আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়েছিস। সাব্বিরের সেই ছেলেমানুষি চেহারা আর ভঙ্গি দেখে রাগ করতে পারল না অধরা। হেসে দিল সে। গাড়ি থেকে নামতে নামতে সাব্বির বলল, প্রহর শেষে আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ।
-তুই তো আগের মত ঢঙ্গি রয়ে গেলি ছেলেমানুষি করিস এখনো!
-ছেলেমানুষ তো আর মেয়েমানুষি করতে পারি না। গাড়িতে ওঠ।
-কোনদিকে যাবি?
-আজ তোকে নিয়ে হারিয়ে যাবো।
-তোর সাহস আছে? ফুল দিয়ে পালিয়ে যাওয়া প্রেমিক তুই।
-লজ্জা দিস না। ওঠ।
জ্যামের মধ্য দিয়ে এগোতে এগোতে সদরঘাটে এসে পড়ল ওরা। ততক্ষণে রাত নামতে শুরু করল। সদরঘাটে একটা রেস্টুরেন্টের দোতলায় বসল ওরা। জানালা দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদী দেখা যায়। সারিসারি লঞ্চ ঘাটে বাঁধা। লঞ্চে রঙিন আলো জ্বলছে। পরিবেশটা বেশ রোমাঞ্চকর। সাব্বির অধরার কাছে জিজ্ঞেস করল, কী খাবি?
-তুই বিদেশ থেকে এসেছিস। তুই বল,তুই কী খাবি?
-ঢাকায় এসে কাচ্চিবিরিয়ানি ছাড়া আর কী খাওয়া যায়?
-ওকে, এবার অর্ডার কর।
-যথা আজ্ঞা। সাব্বির ওয়েটারকে ডেকে কাচ্চিবিরিয়ানি এবং কোকের অর্ডার করল। সাব্বির আনমনে তাকিয়ে আছে অধরার দিকে। অধরা বলল, এভাবে কী দেখিস?
-তোকে।
-আমাকে দেখার কী আছে? কালো, কুৎসিত একটা মেয়ে।
সাব্বির তার মানিব্যাগ বের করে বলল, দেখ তো, একে চিনিস নাকি? অধরা মানিব্যাগের ছবিটা দেখে অবাক হল। স্কুলে রেজিস্ট্রেশনের সময়ে তোলা পাসপোর্ট সাইজের একটা ছবি।
-তুই এটা কোথায় পেলি?
-তোর সামনে ভিতু ছিলাম। কিন্তু স্টুডিওওয়ালার কাছে সাহস দেখিয়ে এই ছবি নিয়েছিলাম।
-কেন?
-এতকিছুর পরেও জিজ্ঞেস করছিস যে কেন?
-জানিস, আমার বিয়ের জন্য দশ জায়গা থেকে ছেলে দেখতে এসেছিল।
-তাই? কয় জায়গা বিয়ে হয়েছে?
-ফাজলামি রাখ। সিরিয়াস কিছু কথা শোন।
-ওকে, বল।
-দশ জায়গা থেকে দেখতে এলেও কেউই আমাকে পছন্দ করেনি। কারণ আমি দেখতে কালো।
-শোন, ওরা বাহ্যিক সৌন্দর্য বলতে সাদা বোঝে যা তাদের হীনমন্যতার পরিচয়।
-আর আমার বিয়ে নিয়ে আমি টেনশন করি না, কিন্তু আমার বাবামা টেনশন করে। এইজন্য খারাপ লাগে।
-একটা কথা বল তো, তুই কি চাস কেউ তোকে ভালবেসে বিয়ে করুক?
অধরা কথা বলল না। বাইরে তাকিয়ে আছে। লঞ্চ ছাড়ছে। লঞ্চের ভেঁপু বাজছে। কী কর্কশ শব্দ! আর সাব্বির তাকিয়ে আছে কৃষ্ণকলির একজোড়া মায়াবী চোখের দিকে। দুই মাস পরের কথা। সাব্বির আর অধরার বিয়ের পর তারা হানিমুন করতে অস্ট্রেলিয়া এসেছে। মধ্যরাত। বেলকনিতে রাখা দোলনায় বসে দুজনে চাঁদ দেখছে। সাব্বির বলল, একটা গান শোনাও না।
-কী গান শুনবে?
-একটা দারুণ রোমান্টিক গান।
অধরা গান ধরল, দোলনা একা একা দুলতে পারে না তাকে দোলাতে হয়। তুমি দোলা দাও আর আমি দুলে যাই দোলনায় দোলনায় দোলনায়। চাঁদের নিজের কোন আলো নেই, জানো? সূর্য আড়াল থেকে আলো দিয়ে যায়। তুমি দোলা দাও আর আমি দুলে যাই দোলনায় দোলনায় দোলনায় দোলনায় বসে পৃথিবীর অন্যতম সেরা দম্পতি দুলছে। সাব্বিরের কাঁধে মাথা রেখেছে অধরা। তাদের দৃষ্টি দূরের আকাশে পূর্ণ চাঁদটার দিকে।