বিষকুম্ভ: ০৯. সমীরণ সরকার বিদায়

বিষকুম্ভ: ০৯. সমীরণ সরকার বিদায়

০৯. সমীরণ সরকার বিদায়

সমীরণ সরকার বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম।

স্পষ্ট বুঝলাম ঘরে বসে থাকলেও কিরীটী চারিদিকে সতর্ক নজর রেখেছে। এবং ব্যারিস্টার রাধেশ রায়ের একমাত্র পুত্র তরুণ ব্যারিস্টার অশোক রায়ের ব্যাপারকে কেন্দ্র করে কিরীটীর চিন্তাধারা যে যে দিকে বিস্তৃত হয়েছিল সেই সব দিকগুলো এখনও তার মন জুড়ে রয়েছে। কিন্তু একটা জিনিস যা আমাকে বিস্মিত করেছিল, অশোক রায়ের ব্যাপারে কিরীটীর এবারকার নিষ্ক্রিয়তা। কখনও কোন রহস্যের সম্মুখীন হলে ইতিপূর্বে কিরীটীকে কখনও এমনি দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় হয়ে বড় একটা বসে থাকতে দেখিনি।

তাই প্রশ্ন না করে পারলাম না, সোজাসুজি কথাটা পাড়লাম।

অশোক রায়ের ব্যাপারটা আর কিছু ভেবেছিস কিরীটী?

কিরীটী বোধ হয় নিজের চিন্তার মধ্যে তন্ময় হয়ে ছিল। হঠাৎ আমার প্রশ্নে চমকে আমার মুখের দিকে তাকাল।

বললে, কি বলছিলি সুব্রত?

বলছিলাম অশোক রায়ের কথা–

না। সেদিন তোকে তার সম্পর্কে যতটুকু বলেছিলাম তার বেশী আর বিশেষ কিছুই এখনও জানতে পারিনি।

তোর কি মনে হয় অশোক রায়ের ব্যাপারে আমাদের ডাক্তার ভুজঙ্গ চৌধুরীর সত্যি কোন যোগাযোগ আছে?

তোর কি মনে হয়? কিরীটী আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করল।

আমার তো মনে হয়, অশোক রায়ের যদি কোন মিস্ট্রি থাকে তা ঐ বৈকালী সঙ্ঘের মধ্যেই, মিত্রা সেনের সঙ্গেই। ভুজঙ্গ ডাক্তারের সঙ্গে বৈকালী সঙ্ঘের তো কোন যোগাযোগই আজ পর্যন্ত খুঁজে পেলাম না।

এবং তাতে করে তো সুস্পষ্টভাবে এটা প্রমাণ হয় না যে, ভুজঙ্গ ডাক্তারের সঙ্গে অশোক রায়ের কোন গোপন যোগাযোগ নেই, ডাক্তার ও রোগীর সম্পর্ক বাদেও। বরং আমার তো মনে হয় বৈকালী সঙ্ঘের মেম্বারদের অনেকরই যখন গভীর রাত্রে গোপন অভিসার আছে ডাক্তারের চেম্বারে, তখন দুয়ে দুয়ে চারের মত সব কিছুর ভেতরে একটা গোপন যোগসূত্রও। আছে। কিরীটী বলে।

তাহলে তুই বলতে চাস ডাক্তার ভুজঙ্গ চৌধুরীরও অলক্ষে যোগাযোগ আছে বৈকালী সঙ্ঘের সঙ্গে?

বলতে চাইলেই বা সেটা বলতে পারছি কোথায়! ডাক্তার তো শুনলাম ভুলেও কোনদিন রাত নটার পর বাড়ি থেকে বের হন না। আজ পর্যন্ত কেউ তাঁকে কখনও বৈকালী সঙ্ঘের ধারেকাছেও যেতে দেখেনি। তাছাড়া সম্মানিত, খ্যাতিসম্পন্ন একজন নামকরা চিকিৎসক হিসাবে তাঁর সমাজে সর্বত্র পরিচয়। এবং শুধু তাই নয়, আজ পর্যন্ত বৈকালী সঙ্ঘ সম্পর্কেও কোন খারাপ রিপোর্ট পুলিস সংগ্রহ করতে পারেনি। আমার বক্তব্যটা বুঝতে পারছিস বোধহয়!

পারছি। মৃদু কণ্ঠে বললাম।

আর একটা কথা, এ মাসের তিন তারিখে দূর থেকে অশোক রায়ের গাড়ি ফললা করে ব্যাঙ্ক পর্যন্ত গিয়েছিলাম।

তারপর?

যথারীতি এবারেও সে আড়াই হাজার টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে তার সঙ্গিনী এক নারীর হাতে—যিনি গাড়িতেই উপবিষ্টা ছিলেন—তুলে দিতে দেখেছি।

সঙিনী সেই নারীকে দেখলি?

দেখলাম, কিন্তু দুঃখিত, তিনি তোমার মিত্রা সেন নন।

তবে?

মিত্রা সেন নন এই পর্যন্ত বলতে পারি। তবে বয়সে দূর থেকে তাঁকে তরুণী বলেই মনে হল। এবং দেখতেও সুন্দর।

তারপরেও তাদের নিশ্চয়ই ফলো করেছিলি?

করেছিলাম। কিন্তু ঘণ্টাখানেক সমস্ত ডালহৌসি স্কোয়ার, ধর্মতলা ও ফ্রি স্কুল স্ট্রীটটা চক্কর দেবার পর থিয়েটার রোড ধরে যেতে যেতে হঠাৎ একসময় দেখলাম শ্রীযুক্ত অশোক রায়ের বদলে গাড়ি চালাচ্ছেন তাঁর সেই সঙ্গিনীটি এবং অশোক রায় গাড়িতে নেই কোথায়ও।

বলিস কি?

তাই। তবে বার চার-পাঁচ ট্রাফিকের জন্য গাড়িটা দাঁড়িয়েছিল চার-পাঁচ জায়গায়। এবং এর পরে বুঝেছিলাম সেই সময়েই এক ফাঁকে অশোক রায় গাড়ি থেকে নেমে আমার দৃষ্টির বাইরে চলে গিয়েছে। তবে এর মধ্যেও একটা কথা আছে যা ভাবছি–

কি?

প্রতিবারই ব্যাঙ্ক থেকে ফেরবার পথে সেদিনকার মত ঐরকম অনির্দিষ্টভাবে গাড়িটা রাস্তায় রাস্তায় চক্কর দিয়ে একসময় অশোক রায়কে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়, অন্যের দৃষ্টি থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য, না সেদিন আমি তাদের ফলো করছি জেনেই ঐ পন্থা ধরেছিল?

নিশ্চয় না। তুই যে সেদিন তাদের ফলো করবি তা তারা জানবেই বা কি করে?

তোর কথাই যদি মেনে নিই তো ব্যাপারটা আরও গোলমেলে হয়ে দাঁড়াচ্ছে—

অর্থাৎ?

অর্থাৎ সেদিন না হলেও কোন একদিন কেউ তাদের ফলো করবে ভেবেই যদি তারা প্রতিবারই ঐ ধরনের সাবধানতা নিয়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে প্রথমত ব্যাপারটা খুব ক্লিয়ার নয়। দ্বিতীয়ত এর পশ্চাতে যে ব্রেন আছে তা রীতিমত তীক্ষ্ণ এবং সুদূরপ্রসারী। আচ্ছা গাড়িটা কার?

অশোক রায়েরই নিজস্ব গাড়ি, মরিস টেন লেটেস্ট মডেলের। কিন্তু তারপর আরও আছে বন্ধু! ঘটনাটির ঐখানেই পূর্ণচ্ছেদ নয়।

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালাম কিরীটীর মুখের দিকে আবার।

কিরীটী বলতে লাগল, ফলো করতে করতে গাড়িটা এসে একসময় দাঁড়াল হল অ্যাণ্ড অ্যাণ্ডার্সনের বাড়ির সামনে। আরোহিণী গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে গিয়ে প্রবেশ করলেন। আমি অপর ফুটপাতে আমার ভাড়াটে ট্যাক্সিতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম দরজার দিকে তাকিয়ে তীর্থের কাকের মত।

তারপর?

মিনিট দশেক বাদে এবারে যিনি দোকান থেকে বের হয়ে সোজা গাড়িতে উঠে বসে স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিলেন, তিনি কিন্তু সেই মহিলাটি নন, যিনি এতক্ষণ গাড়ি চালাচ্ছিলেন!

তবে আবার কে?

কে বলে মনে হয়? নামটা শুনে জানি চমকে উঠবি, তবু শোন, স্বয়ং অশোক রায়।

বলিস কি!

হ্যাঁ। এবং সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে সোজা এবারে ব্যারিস্টার সাহেব হাইকোর্টের দিকেই চললেন।

আর সেই তরুণীটি?

মিথ্যা সে মরীচিকার পিছনে আর ছুটে লাভ নেই বলে আমিও সুবোধ বালকের মত গৃহে পুনরাগমন করলাম। তাহলেই বুঝতে পারছ লেনদেনের ব্যাপারটা একটু জটিল।

তবে মিত্রা সেনের সঙ্গে অশোক রায়ের ব্যাপারটা কি? প্রশ্ন করলাম এবারে আমিই: সেটাও কি তবে নিছক প্রেম নয়? অন্য কিছু?

অতদূর অবিশ্যি এখনও পপছিতে পারিনি। তবে আজ রাত্রে একটা ব্যাপারে অনেস্ট অ্যাটেম্পট নেব ভাবছি।

কিসে?

ইচ্ছে করলে তুমি আমার সঙ্গে থাকতে পার।

কোথাও যাবে নাকি?

হ্যাঁ।

কোথায়?

পার্ক সার্কাসেডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর চেম্বার-কাম নার্সিং হোমে।

রাত্রে মানে কখন? কটার সময়?

রাত ঠিক বারোটায়।

কিন্তু তোকে অত রাত্রে সেখানে ঢুকতে দেবে কেন?

যাতে দেয় সেই ব্যবস্থাই করা হয়েছে। রাত্রে নটার পর আসিস। এলেই যথাসময়ে সব জানতে পারবি।

কিরীটীর ওখান থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম বটে কিন্তু কিরীটীর মুখে শোনা অশোক রায়ের ব্যাপারটাই মনের মধ্যে আনাগোনা করতে লাগল। কে সে তরুণী, যাকে প্রতি মাসে এমনি করে গত আট-নয় মাস যাবৎ ঠিক নিয়মিত মাসের প্রথমেই আড়াই হাজার টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে দিয়ে যাচ্ছে সে! আর কেনই বা মাসে মাসে ঐ টাকা দিচ্ছে? মিত্রা সেনের সঙ্গেই বা তাহলে অশোক রায়ের সম্পর্কটা কি! তা ছাড়া কিরীটী ইঙ্গিতে যে কথা বললে, বৈকালী সঙ্ঘের সঙ্গে ভুজঙ্গ ডাক্তারের চেম্বারের একটা অলক্ষ্য যোগাযোগ আছে, সেটাই বা আসলে কি ধরনের যোগাযোগ! ভুজঙ্গ ডাক্তারকে তো গত পনের-কুড়ি দিনে কখনও দেখি নি বৈকালী সঙ্ঘে যেতে। অবশ্য লোকটার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মধ্যেও যেন কেমন একটা অস্বাভাবিকতা আছে। ঠিক একেবারে নরম্যাল নয়।

কিরীটী বলছিল রাত্রি নটার পর তার ওখানে যেতে। কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত বিলম্ব যেন আর সইছিল না। সাড়ে সাতটার পরই বের হয়ে পড়লাম কিরীটীর বাড়ির উদ্দেশ্যে।

কিরীটী তার বাইরের ঘরেই বসে একটা কাগজের গায়ে পেনসিলের সাহায্যে কিসের যেন নকশা আঁকছিল। আমার পদশব্দে মুখ না তুলেই বললে, আয় সুব্রত! এত তাড়াতাড়ি এলি, খেয়ে আসিসনি নিশ্চয়!

না।

ঠিক আছে, একসঙ্গে খাওয়া যাবেখন।

কিরীটীর পাশে বসে তার সামনে অঙ্কিত নকশাটার দিকে তাকালাম, কিসের নকশা রে ওটা?

ডাক্তার ভুজঙ্গ চৌধুরীর চেম্বার ও নার্সিং হোম যে ফ্ল্যাট বাড়িটার মধ্যে আছে সেই বাড়ির নকশা। বাড়িটার মালিক এককালে ছিলেন এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসায়ী আলি ব্রাদার্সের ছোট ভাই মহম্মদ আলি।

একদিন ছিল মানে? এখন আর নেই নাকি?

না। নকশাটার উপরে পেনসিলের আঁচড় কাটতে কাটতে মৃদুকণ্ঠে জবাব দিল কিরীটী।

তবে বর্তমান মালিক কে?

ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী।

কথাটা শুনে যেন আমার বিস্ময়ের অবধি থাকে না। কিরীটী বলে কি! বর্তমানে বাড়িটার মূল্য ন্যূনপক্ষে হলেও দেড় লক্ষ টাকার কম নয়! বললাম, সত্যি বলছিস?

আগের পর্ব :

০১. তাসের ঘর
০২. ভুজঙ্গ ডাক্তারের সঙ্গে
০৩. বর্তমান কাহিনীর আদিপর্ব
০৪. সে রাত্রের মত আশ্বাস দিয়ে
০৫. দিন দুই পরে কিরীটী
০৬. অসাধারণ প্রসাধন-নৈপুণ্যে
০৭. নীলাম্বর মিত্র ও মনোজ দত্ত
০৮. কিরীটীর টালিগঞ্জের বাড়িতে

পরের পর্ব :
১০. আমার কণ্ঠের বিস্ময়ের সুর
১১. হীরা সিং কিরীটীর পূর্ব নির্দেশমত
১২. মহারানীর তীক্ষ্ণ প্রতিবাদের পর
১৩. বারের মধ্যে চার-পাঁচজন নরনারী
১৪. হলঘরে আমরা প্রবেশ করবার মুখে
১৫. মহারানীর জবানবন্দির পর
১৬. মীরজুমলা
১৭. ঘরে ঢুকে শুনি রঞ্জন রক্ষিত
১৮. আমি যখন নীচের বাগানে যাই
১৯. কিরীটীর বাসায় যখন ফিরে এলাম
২০. কিরীটী মৃদু হেসে বললে
২১. টেলিফোনে অশোকবাবুকে ডেকে
২২. সোফার উপরে নিঝুম হয়ে
২৩. অশোক রায় বিদায় নিলেন
২৪. বিস্মিত হতবাক সকলে

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত