লাবণ্যময়

লাবণ্যময়

স্টেশনে এসেছি ঘন্টাখানেক।পরবর্তী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম আমার সামনে এসে বসলো এক দম্পতি।মেয়েটার দু’হাত ভরতি মেহেদী, বরের হাতেও তাই । দেখে মনে হলো সদ্য বিবাহিত। মেয়েটা টকটকে একটা লাল বেনারসি পরে বসলো ছেলেটার পাশে। মেয়েটার লজ্জামাখা চেহারা, বরের দিকে আড়চোখে তাকানো,একটু পর পর বর বউয়ের মৃদু হাসি,বরের হাত এক মুহূর্তের জন্যও মেয়েটাকে ছেড়ে না দেওয়া আর মেয়েটারও বেশ ভরসায় পাঁচবছরের একটা বাচ্চার মত বরের হাত ধরে রাখা। কিছুক্ষণের জন্য স্মৃতিচারণ করলাম।মনে হলো কয়েকটা বছর পিছিয়ে ঐ সময়টায় ফিরে গেলাম।

কি এক আশ্চর্য সময়ে অবস্থান করছি আমি ! মনে হলো একই সময়ে দুইটা মুহূর্ত বাঁচছি ।বারবার সেই পুরোনো অনুভূতিগুলো নতুন হয়ে চোখে ভাসছে। নিজেকে পুনরাবৃত্তি করলাম।সময়ের সাথে সাথে কয়েকবছর এগিয়ে আসাটাকে ভুলে গিয়ে কয়েকবছর পিছিয়ে গেলাম। পহেলা ফাল্গুন ছিলো সেদিন।এমন দিনে কেউ মেয়ে দেখতে আসে ! আসলেই সেটা আমার জানা ছিলো না। মায়ের সাথে ভীষণ মন কষাকষি হলো আজকে দেখতে আসা নিয়ে।

কারণ বন্ধুরা সবাই এই দিনটা উপভোগ করবো এমনটাই চিন্তাভাবনা ছিলো।মা’কে বিষয়টা বুঝিয়ে বলতেই মা বেরোতে দিলেন।কিন্তু বিকালের আগে অর্থাৎ দুপুরের পর পরই বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হতে হবে।কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ব্যাপারটা মেনে নিলাম। মায়ের একটা ধবধবে বাসন্তী রঙের শিপন শাড়ি ছিলো।সেটাই পরে নিলাম।খোলাচুলে বেলীফুলের মালা লাগিয়ে চোখে হালকা কাজল দিলাম।দু’হাত ভরতি কাচের চুড়ি পরে নিলাম।

বাসার নিচে এসে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।এদিকওদিক তাকাতেই দেখলাম আমার বিপরীত পাশে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।ভীষণভাবে এক দেখাতেই ছেলেটাকে ভালো লেগে গেলো।কিন্তু বেশ ব্যস্ত হয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে হয়তো ছেলেটা। আমি আড়চোখে তাকে আপাদমস্তক দেখছি।মাথাভরতি কোঁকড়ান চুল।তার পরনে বাসন্তী রঙের একটা পাঞ্জাবি,বাম হাতে কালো বেল্টের একটা ঘড়ি। পাঞ্জাবির হাতা বটে রেখেছে সে।রিকশার বাহানায় আরেকটু সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম তার।এবার ভীষণ স্পষ্টভাবেই তাকে দেখছি।হঠাৎ রিকশা চলে আসাতেই সেই দেখার অবসান ঘটলো।

বন্ধুমহলে গিয়ে উপস্থিত হলাম।আড্ডায় আত্মহারা সবাই।বেশ কিছুক্ষণ সময় পেরিয়ে গেলো আড্ডাতেই।তারপর বন্ধুরা সবাই এক সাথে হাঁটা,সেলফি তোলা এভাবেই আরো কিছুক্ষণ পার হয়ে গেলো। দুপুরের খাবার শেষ হওয়ার পর বন্ধুমহলের থেকে আলবিদা বলে বেরিয়ে আসলাম।উদ্দেশ্য বাড়িতে গিয়ে হাজিরা দেওয়া। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলাম।হাতে মুহূর্তবন্ধি ছবিগুলো দেখছিলাম।

–আপনার কাছে এক্সট্রা পিন হবে ? আই মিন আলপিন। হবে ?

বিচলিত হয়ে আমায় প্রশ্ন করলো এক অপরিচিত কণ্ঠস্বর। আমি চোখ তুলে তাকাতেই অবাক হলাম অপরিচিত সেই লোকটাকে দেখে।যাকে সকালেই আমি কয়েক হাজারবার দেখেছি!

–এই যে মিস..আলপিন হবে ? তার কথাতেই ধ্যান ভাঙলো।শাড়ির কুঁচি থেকে একটা আলপিন নিয়ে তার হাতে দিলাম।

–ধন্যবাদ।

ফর্মালিটি রক্ষা করে সে আমার সামনে বসে গেলো।আমি লাফিয়ে তিন পা পিছিয়ে গেলাম।ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।ছেলেটা আমার অবস্থা দেখে মৃদু হাসলো।আর বললো,

–আরে ভয় পাচ্ছেন কেন ? আমি আপনার শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে বসিনি।বসেছি নিজের জুতা ঠিক করতে।আসলে জুতার ফিতাটা ছিঁড়ে গিয়েছে।আশেপাশে জুতা সেলাইয়ের জন্য কাউকে দেখছিনা।তাছাড়া এখানে গাড়ি বা রিকশা কিছুই পাওয়া যাবে না।হাঁটতে হবে প্রায় আধা কিলো।ছিঁড়া জুতা নিয়ে তো আর তা সম্ভব না।তাই আপনার কাছে হ্যাল্প চাইলাম। আমার সাথে বকবক করতে করতেই ছেলেটা আলপিন দিয়ে নিজের ছিঁড়া জুতাটা হাঁটার উপযুক্ত করে ফেললো।

–আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মিস..

–লাবণ্য আমি।

–ওকে,থ্যাংকস লাবণ্য।।

কথাটা বলেই ছেলেটা দৃষ্টির অগোচরে চলে গেলো। ছেলেটা হয়তো কখনোই জানবে না তাকে লাবণ্য নামের একটা মেয়ে ভীষণভাবে ভালবেসে ফেলেছিলো এই একটু মুহূর্তেই।হয়তো আর লাবণ্যর সাথে তার দেখাও হবে না।আবার হয়তো কোনো এক মুহূর্তেই দেখা হয়ে যাবে ব্যস্ত শহরের এক প্রান্তের দুই মেরুতে ! অথচ তখনও লাবণ্য ভাববে, আর একটিবার যদি দেখা হতো তার সাথে, বেশি দেরি হওয়ার আগেই। লাবণ্য সেদিন মায়ের কথা রেখেই ঠিকঠাক ভাবে বাড়িতে উপস্থিত হয়ে গিয়েছিলো।

কি আশ্চর্য আমাদের জীবন ! কতগুলো অপ্রস্তুতকৃত মুহূর্ত জীবনের অধ্যায়জুড়ে বসে থাকে! অচেনা মানুষকে ভীষণ পরিচিতই মনে হয়।মনে হয় আরও কত যুগ এই মানুষটার সাথেই ভরসার হাত ধরে, মানুষটার কাঁধে মাথা রেখে থাকা যায়।কিন্তু তা কি সবার ভাগ্যে জোটে ?

ট্রেন এসে গেলো। নবদম্পতি কাকতালীয়ভাবে আমার কামরায় পড়লো।তাদের খুনসুটিগুলো ভীষণভাবে আমায় ভাবিয়ে তুলছে।আচ্ছা বেশিরভাগ নতুন মুহূর্তগুলোকে এত সুন্দর হতে হয় কেন ? তাদের সাথে কিছুক্ষণ আলাপ হলো।সত্যি তারা নতুন বিবাহিত ছিলো।বেশ সুন্দর একটি জুটি।দুজনকেই দারুণ মানিয়েছে বলা যায়।

আমি আর তাদের ব্যক্তিগত সময়ের ভাগ নিতে চাইনি।তাই রবীন্দ্রনাথে আশালতার মাঝেই নিজেকে হারাতে শুরু করলাম।অর্থাৎ রবী ঠাকুরের, “চোখের বালি” পড়ছিলাম। কয়েকঘন্টা পর আমি নিজ গন্তব্যে এসে পৌঁছালাম।স্টেশনে নেমেই তাকে দেখে চমকে উঠলাম।যাকে প্রথম দেখেছিলাম সেই পহেলা ফাল্গুনে, যাকে আমি শাড়ির কুঁচি এলোমেলো করে আলপিন টা দিয়ে দিয়েছিলাম। হয়তো এই ছোট্ট জিনিসগুলো দেওয়ার বিনিময়ে সেই আমাকে তার আস্ত জীবনের পার্টনার হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলো সেই দিনটিতেই।

আমাকে সেইদিন বিকালে এই ব্যক্তি নিজের মা বাবা সমেত দেখতে এসেছিলেন।আমার জন্য পুরো ব্যাপারটাই কাকতালীয় ছিলো।কিন্তু আলিফ সাহবে অর্থাৎ আমার বর, তিনি নাকি আমাকে কয়েকমাস যাবত অনুসরণ করছিলেন।তিনি আমাকে আগে থেকেই পছন্দ করতেন। পুরো ব্যাপারটা আমি তার কাছ থেকে বিয়ের পরই জানতে পারি।

কয়েকবছর আগে বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে যাওয়ার সময় আমার সাথে তার কিছুক্ষণ আগে স্টেশনে যে দম্পতি দেখেছিলাম সেই নতুন দম্পতির মত চোখাচোখি, দেখভাল এবং লোকচক্ষুর আড়ালে ভালবাসা চলছিলো।সদ্য জন্ম নেওয়া অকৃত্রিম ভালবাসা ! যেটা প্রতিনিয়ত নতুন করেই পুরোনো মানুষটার জন্য জন্ম নিচ্ছে।

অথচ আজ তিনি অফিসের কাজে এত ব্যস্ত ছিলেন যে আমার সাথে আমার বাবার বাড়িতে আসতে পারেন নি।কিন্তু আমি স্টেশনে এসে দেখি উনি আমার আগেই এসে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন ! এই ছেলেটা আসলেই একটা অদ্ভুত মানুষ ! যাকে ঘৃণা নয় কেবল ভালবাসতেই ইচ্ছে করে ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত