ঘূরে দাড়ানোর গল্প

ঘূরে দাড়ানোর গল্প

শফিক সাহেব হচ্ছেন “কাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল” এর প্রতিষ্ঠাতা। আজ উনি যাচ্ছেন হাসপাতালটা উদ্ভদন করতে।প্রথমে শফিক সাহেবকে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে বরণ করে নেন কলেজের অধ্যক্ষ ডা. আশিকুল ইসলাম।মাইক্রোফোন হাতে অধ্যক্ষ ডা. আশিকুল ইসলাম।তিনি প্রথমে ভদ্রতা সুলভ কথা বললেন এবং সবাইকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানালেন। আশিকুল সাহেব বললেন,আজ আমি তোমাদেরকে একটা গল্প বলবো।যে গল্পটা হয়তো আমাদের কাছে মোটিভেশনাল তবে শফিক সাহেবের কাছে ঘূরে দাড়ানোর।আজ বলবো, কি করে শফিক থেকে আজকের এই শফিক সাহেব হলেন।মানুষের কাছে এত সম্মানের হলেন সে গল্পটাই বলবো।

আশিকুল সাহেব তার অশ্রুশিক্ত চোখ মুছে নিলেন এবং বললেন, আজ থেকে কুড়ি বছর আগের কথা।আমি আর শফিক তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি।আমারা ছিলাম নিম্ম বিত্ত পরিবারের সন্তান।আমাদের বাবা তখন জমিতে কাজ করতেন,অর্থ উপার্জন করতেন।চাল আনতে পান্থা ফুরাতো আমাদের।বুঝতাম খুব টানাপোড়ার মধ্যেই সংসারটা চলতো আমাদের।সংসারের এমন টানাপোড়া দেখে আমি ও শফিক হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলাম না।স্কুল ছুটির পর দুজনে ছুটতাম করিম চাচার ইটের ভাটায়।

কাম করতাম রাত আটটা অব্দি।দেড়শো টাকা দিতো রোজ।মোটামুটি বাবার উপার্জন আর এই দেড়শো টাকাতেই বেশ চলতো আমাদের সংসার।আর রাতে ক্লাসের পড়া পড়তাম।দুজনে ক্লাসের ফাস্ট,সেকেন্ড ছিলাম।তবে স্বপ্নছিলো আমাদের আকাশ ছোয়া। বাবা বলতেন আমাদের খোকা একদিন মস্ত বড় ডাক্টার হবে।তহন এই গ্রামের মানুষের দুঃখ গুচায় যাইবো।বাজান তোমরা কিন্তু এই গ্রামের মানুষেরই পাশে থাকবা।এই গ্রামেই বসবা,প্রতি হাটে গ্রামের মানুষগো দেখবা তাদের সেবা করবা বাজান। আমরা তখন কিছুটা বুঝতাম।তখন থেকেই স্বপ্ন ছিলো ডাক্টার হবো এবং এই মেহনতপুর গ্রামের অসহায় মানুষের সেবা করবো।

এস.এস.সি পরীক্ষার বাকি মাত্র তখন ২৫ দিন।এর মধ্যে শফিকের সম্পর্ক হয় আমাদের দুই ব্যাচ জুনিয়র রহিমার সাথে।মেয়েটা দেখতে বেশ ভালোই ছিলো,চোখ,নাক টানা টানা।।রহিমার ছিলো ঘন-কালো লম্বা চুল। যা শফিকের সবচেয়ে বেশি পছন্দনীয় ছিলো।আগে থেকেই দুজন দুজনকে পছন্দ করতো।রহিমা মেয়েটাও বেশ চঞ্চল ও বুদ্ধিমতী ছিলো, সেজন্য হয়তো যাচাই করে নিয়েছে।প্রায় এক বছর পর রহিমা সম্মতি জানায়। সেদিন শফিক আমাদের সবাইকে গঞ্জ থেকে মিষ্টি এনে খাওয়ায় ছিলো।আমরা সবাই ওদের উৎসাহ দিতাম।ওদের সম্পর্ক অল্পদিনে বেশ গভীরে চলে যায়।

দেখতে দেখতে এস.এস.সি পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়।দুই মাস পর আমাদের ফলাফল বের হয়।স্কুলের নোটিশ বোর্ডে সবার রেজাল্ট টাঙ্গানো হয়।আমি প্রথম বিভাগেই উত্তীর্ণ হই।শফিক দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। শফিক তাতেই খুশি।কিন্তু আমরা এতে খুশি হতে পারি নি।কারণ শফিক খুব ভালো ছাত্র ছিলো।রহিমার সাথে সম্পর্ক হবার পর থেকে পড়াশুনা কেমন বিগ্রে গেছে ওর।যার জন্য আজ এই ফলাফল।বাড়ি থেকে শুনতে হয় বেশি কথাও। ১২ দিন বাড়িতে যেতো না শফিক।আমার কাছেই থাকতো। ওর কষ্টের কথা সব আমায় বলতো। শফিক কিছুটা আক্ষেপের সহিত বললো, দোস্ত জানিস রহিমার স্বপ্ন ডাক্টার হবার।কিন্তু রহিমারে নাকি বেশি পড়াবে না।ওর সৎ মা ওরে সব সময় বকাঝকা করে।জানিস আজ রহিমারে মেরেছেও। বল এসব শুনতে কি কারো ভালো লাগে।

শফিক একটু সময় নিয়ে বললো, আমি তো হতে পারলাম না, তবে রহিমাকে আমি ডাক্টার বানাবোই।রহিমা ডাক্টার হবার পর আমার স্বপ্নটা পূরণ হবে।এখন আর নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি না।এখন আমার স্বপ্ন শুধু রহিমাকে নিয়ে।মেয়েটা রোজ কান্না করে আমার কাছে।ভালো লাগে না আমার মোটেও।রহিমার জন্য নাকি ছেলে খুজতেছে বিয়ে দিয়ে দিবে। কথাগুলো বলার পর কিছু সময় চুপ থেকে ভেজা কন্ঠে শফিক বলে ওঠে, নাহহ! আমি থাকতে রহিমার স্বপ্ন পূরণ হবে না, সেটা হতে পারে না।আমি রহিমারে শহরে নিয়ে গিয়ে পড়াবো।ওরে ডাক্টার বানামু।প্রয়োজনে নিজে পড়া বাদ দিয়া দিমু।

আমি শুধু সেদিন শফিকের কথা শুনেছি।তখন বয়সই বা কত ছিলো।কতটুকুই বা বুঝতাম তখন।শফিক আর ভর্তি হলো না কলেজে।ক্ষেতে খামারে কাজ করা শুরু করে শফিক।কিছু দিন পর শহরে চলে যায়। আমি গ্রামের একটা কলেজ থেকেই এইচ.এস.সি শেষ করি।সুযোগ পেয়ে যাই রাজশাহী মেডিকেলে।ওখান থেকেই ডাক্টারি পড়া শেষ করি। রহিমাও এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি পাশ করে।বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য পাত্র ঠিক করে রেখেছে।দুদিন বাদেই বিয়ে।শফিক খবর পেয়েই ছুটে চলে আসে।পালিয়ে যায় দুজনে।শফিকের পরিবার জানতো সবই।পরিবারের অনুমতি নিয়েই শফিক রহিমাকে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হয়।

হটাৎ রহিমা কাঁদো গলায় বলতেছে, শফিক আমি কি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবো না? তখন শফিক রহিমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,তুমি এই নিয়ে ভেবো না।আমি বেঁচে থাকলে তুমি তোমার স্বপ্নটা পূরণ করতে পারবেই।প্রয়োজনে তোমাকে প্রাইভেট মেডিকেলে পড়াবো।তুমি আমার উপর একটু আস্থা রাখো।রহিমা শফিকের বাহু জড়িয়ে কিছুটা তৃপ্তির স্বাদ নিলো।শফিক সাত-পাঁচ ভাবতে শুরু করে দেয়।শফিক অনেক ভেবে দেখলো,রহিমাকে যদি এখন বিয়ে করে তবে রহিমার স্বপ্ন সে পূরণ করতে পারবে না।রহিমা তখনো কাঁদছে। শফিক রহিমার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো, তুমি কেঁদো না রহিমা।তোমার কান্না আমি সইতে পারি না।তোমার হাতটা যেহেতু ধরেছি সেহেতু তোমার স্বপ্নটা পূরণ করেই ছাড়বো।রহিমা শফিকের কথায় একটু নরম হলো।

সূর্যটা প্রায় রক্তিম বর্ণের হয়ে গিয়েছে। মুহূর্তেই সন্ধ্যায় নেমে এলো।প্রকৃতির আলো অন্ধকারে মিলাতেই জ্বলে উঠলো ব্যস্ত নগরীর নিয়ন আলো।রহিমা শুধু মুগ্ধ হয়ে রাতের ব্যস্ত শহরটা উপভোগ করছে।এই নিয়ন আলোয় পায়ে-পা মিলিয়ে হাটছে দুজনে।শফিকের বাহুটা জড়িয়ে অচেনা শহরকে চিনতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। লাল, নীল আলো বেশ মুগ্ধকর করে তুলেছে সময়টা।রহিমা বেশ বিস্ময়ের চোখে দেখছে এই ইট পাথরের শহরটা।মাথাটা উঁচিয়ে উঁচিয়ে দেখছে বড় বড় দালানকোঠা।সেদিনের রাত কাটিয়ে দিলো রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের নিচে।

রহিমা ঘুমিয়ে গিয়েছে তার সব চেয়ে নিরাপদ স্থান শফিকের বক্ষ ডোরে।রহিমার মুখে আচড়ে পড়া চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে আলতো করে চুমু খায় রহিমার কপালে।শফিক বেশ শক্ত করে জড়িয়ে নেয় রহিমাকে।একটু পিছনে সরে জায়গা করে নেয় শফিক।নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছুটে চলা গাড়ির দিকে। রাত গভীর হবার সাথে সাথে কমতে থাকে ছুটে চলা গাড়ির সংখ্যাও।

একটা দোকানে কাজ করতো শফিক।মাস গেলে পেতো ৮ হাজার টাকা। এত কম টাকা বেতনে কি করে সামলাবে রহিমার ডাক্টারিতে পড়ানোর খরচ।এ ব্যপারে সাত-পাঁচ না ভেবেই প্রাইভেট একটা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করায় রহিমাকে।গ্রামের আড়াই বিঘা জমি বিক্রি করে ভর্তি করায়।শফিকের বাবাও জমি বিক্রি করতে পাঁচ কথা বলেন নি।ছেলের সুখের জন্য সব বিসর্জন দিতে পারে বাবা- মা।

রহিমা এখন খুশিতে আটখানা। তার স্বপ্ন যে পূরণ হতে চলেছে।আর ওদিকে খেয়ে, না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে শফিক ও তার বাবা-মা।শফিক স্বপ্ন দেখে তার রহিমা একদিন ডাক্টার হয়ে তার সামনে এসে দাড়াবে।তখন ঘুচে যাবে এসব কষ্ট।সেই আশায় প্রহর গুনতে থাকে শফিক।জমি বিক্রি করতে করতে আছে শুধু নিজেদের থাকার ভিটেটুকু। রহিমাকে এতটাই ভালোবেসেছিলো যে তার স্বপ্ন পূরনে শফিক বিন্দু মাত্র পিছু হাটতে রাজি নয়।

রহিমার বাকি আর মাত্র একটা সেমিস্টার।আগামী পশু জমা দিতে হবে সেমিস্টার ফি।চিন্তার পড়ে যায় শফিক,কোথায় পাবে এত টাকা? তবে কি এখানেই থেমে যেতে হবে? রহিমার কাছে কোন মুখ নিয়ে যাবো আমি? এসব আত্ন-প্রশ্নের সম্মুখীন হয় শফিক। নাহহ! যে করেই হোক টাকাটা জোগাড় করতে হবে আমায়। শফিক গ্রামের পথে রওনা হয়। নাহহ! এই ভিটেটা বিক্রি করলে আমরা থাকবো কোথায় এই ভেবে মাঝ পথেই ফিরে আসে শফিক।মাথায় যে পাহাড় সমান চিন্তা।কি করে এতগুলো টাকা যোগাড় হবে।শেষমেষ কোন উপায় না পেয়ে নিজের একটা কিডনি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়। শফিকের মাথায় তখন একটাই চিন্তা টাকাটা যোগাড় করতেই হবে।অবশেষে নিজের কিডনি বিক্রি করে রহিমার সেমিস্টার ফ্রি জমা দেয়। রহিমা কখনো জানতে চায় নি এই টাকাগুলো কিভাবে যোগাড় করেছে।জানতে চাইলেও শফিক বলে নি। রহিমার পরীক্ষাও শেষ হয়ে যায়।ফলাফলের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে শফিক।

সেদিন শফিক রিক্সা চালাচ্ছিলো। হাটৎই রহিমার সাথে দেখা হয়ে যায় পথে। শফিক একেক সময় একেকটা কাজ করতো।কখনো রিক্সা,কখনো অটো,কখনো ঠেলাগাড়ি কখনো কখনো বাদামও বিক্রি করতো।শফিককে রিক্সা চালাতে দেখে রহিমা অবাক হয়ে যায়।রহিমা কল্পনা করে নি যে শফিক তার জন্য রিক্সা চালাতে পারে।নিমিষেই মুখটা অপরাধীর মত হয়ে যায় রহিমার। সম্ভবত সমাবর্তন অনুষ্ঠান থেকেই বেরিয়েছে রহিমা।রহিমার পরনে কালো পোশাক,মাথায় গ্রাজুয়েট টুপি দেখে বেশ আনন্দিত হয়েছিলো শফিক।শফিকের ইচ্ছা ছিলো যে, এই কালো টুপি সমাবর্তন শেষে সহপাঠীদের সাথে আকাশের পানে ছুড়ে মারবে।

কষ্টের আড়ালে হাসি ফুটিয়ে,রহিমার দিকে এগিয়ে যায় শফিক।রহিমাও হয়তো শফিকের জন্যই ছুটছিলো।রহিমা শফিকের হাতে তুলে দেয় তার অর্জিত সার্টিফিকেট।চোখটা পানিতে ফুফে আছে শফিকের।ঘেমে যাওয়া শফিককে জড়িয়ে নেয় রহিমা।রহিমাও যেন এই লড়াকু মানুষটাকে নিজের করে নিতে চায়।এত সময়ে রহিমা খুজে পেলো তার সুখের ঠিকানা।কিছু সময় জড়িয়ে থাকে থাকে ওরা।সে এক মহালগন সৃষ্টি হলো ওদের জন্য। ডা. আশিকুল সাবেহ একটানা বলেই যাচ্ছে শফিক সাহেবের জীবনের গল্পটা।আশিকুল সাহেব দীর্ঘ শ্বাস নিলেন।তিনি বললেন গল্পটা এখানে শেষ নয়।একটু পানি খেয়ে নিলেন আশিকুল সাহেব।আবার বলতে শুরু করলেন,

কিছুদিন পর একটা বাইনহাউজ কম্পানিতে চাকরি হয় শফিকের।ভালো বেতনও পায়।এবার রহিমাকে বিয়েটা করে নিতে চায় শফিক।কিন্তু রহিমা যে আরো পড়তে চায়।বিলেত থেকে আনতে চায় ডিগ্রীও।শফিকও কখনো রহিমাকে না বলে নি তার স্বপ্ন পূরণে।আজও না করতে পারলো না।শফিক শুধু এতটুকুই ভেবেছে এতটা পথ যেহেতু এসেছি সেহেতু বিলেত পাঠাতেও ঠেকতে হবে না। শফিকের মালিক ছিলেন একজন কোরিয়ান।নাম হলো ইয়াং চু। ইয়াং চু ও শফিকের সম্পর্ক বেশ গভীর। ইয়াং চু এর সহযোগিতায় রহিমাকে বিলেত পাঠান। কিন্তু রহিমা সেখানে যাবার পর, বছর দুই যোগাযোগ রাখে শফিকের সাথে।এর পর আর কোন যোগাযোগ করে নি।এভাবে কেটে যায় কয়েকটা বছর।

শফিক মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে খুব। হয়তো আর ফিরবে না রহিমা,এটা মেনে নিয়েছে শফিক।নতুন করে সামনের দিকে আগাতে থাকে শফিক।ধীরে ধীরে সফলতাও ধরা দিতে থাকে শফিক কে। ইয়াং চু এর বাংলাদেশ,ভিয়েতনাম, কোরিয়াতে মোট ২৪ টা বাইন হাউজ ফ্যাক্টরি আছে। ইয়াং চু সব কয়টা ফ্যাক্টরির দায়িত্ব শফিকে দেয়।শফিক বেশির ভাগ সময় কোরিয়াতেই থাকে।নিজেকে ব্যস্ততায় জড়িয়ে নিয়েছে। ব্যস্তায় মনে পড়ে না রহিমাকে।কিন্তু যখন একা থাকে সবটা সময় তাকে রহিমার স্মৃতি আকড়ে ধরে।চোখের জলও থাকতে চায় না নিয়ন্ত্রণে।শফিক ভাবতে থাকে, রহিমা হয়তো নতুন কাউকে জীবন সঙ্গী করে নিয়েছে।ভুলে গিয়েছে আমাকে।মানুষ কি করে পারে এমনটা করতে।এসব ভাবতে ভাবতে রাত পেরিয়ে সকাল হয়।আবার ব্যস্ত হয়ে যায় কর্ম জীবনে। প্রতিজ্ঞা করেছেন জীবনে কাউকে বিয়ে করবে না। প্রথম ও শেষ ভালোবাসা হিসেবে রহিমাকেই রাখতে চায় মনের গহীনে।

চশমাটা টেবিলে রেখে পকেট থেকে রোমাল দিয়ে চোখটা মুছে নেয় অধ্যক্ষ ড. আশিকুল ইসলাম।নিজের অজান্তে পানি চলে আসে চোখে। ও দিকে সবাইকে চোখের জল আড়াল করতে চেয়েও পারে নি শফিক সাহেব।শফিক সাহেবের জীবন কাহিনী শুনে সবাই চোখ মুছতে ব্যস্ত।ও দিকে শফিক সাহেবের বাবা রমজান আলী পাঞ্জাবী তেই মুছে নিলেন চোখের জল।পাশে বসে থাকা রমজান আলীর স্ত্রী অর্থাৎ শফিক সাহেবের মা তার আঁচল দিয়ে মুছে নিলেন চোখের জল।

তারপর অধ্যক্ষ ডা. আশিকুল ইসলাম বললেন, আমি একদিন শফিকের বাসায় যাই।তখন শফিক আমাকে এই হাসপাতাল সম্পর্কে বলে।ওর ইচ্ছা ছিলো ডাক্টার হবার কিন্তু হতে পারে নি।রহিমার সাথে বাঁধতে চেয়েছিলো সুখের সংসার।তবে সেটাও হলো না।তাই নতুন করে স্বপ্ন দেখছে একটা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত করতে।যাতে তার প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছরই ডাক্টার হতে পারে অসহায় মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা।সেজন্যই মেহনতপুরে নিজ অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত করে তোলেন এই কাজী মেডিকেল কলেজ।এখনে অসহয় মানুষের সেবা করে যেতে চায় প্রতিনিয়ত।

অধ্যক্ষ আশিকুল সাহেব, শফিক সাহেবের বাবাকে মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ করলো। শফিক সাহেবের বাবা টেবিলে রাখা পানির বোতল থেকে একটু পানি খেয়ে নিলেন। মাইক্রফোন হাতে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। তিনি বললেন, আমি পড়া-লেখা তেমন জানি না।ছোট বেলা থেকে আব্বার সাথে জমিতে কাজ করতাম।কিন্তু আমি চেয়েছিলাম আমার ছেলে পড়াশুনা করুক এবং ভালোকিছু করুক।তবে আজকে আমি যে তোমাদের সামনে কথা বলতে পারতেছি এটাই অনেক বড় গর্বের বিষয়।একজন বাবা এর বেশি কিছুই চায় না।

আজকের দিনটা যেমন আমার কাছে খুশির দিন তোমাদের কাছেও খুশির দিন।আজ থেকে এখানে শতশত ছেলে-মেয়ে বিনা খরচে ডাক্টারি পড়তে পারবে।এই গ্রামের মানুষ প্রয়োজনে চিকিৎসাও নিতে পারবে। আমার ছেলে আজ আমাকে আপনাদের সামনে সম্মানিত করেছে।তাই আজকের দিনে আমি আমার ছেলেকে একটা উপহার দিতে চাই।সেই উপহারটা হলো আমার হবু বউ মা রহিমা।আজ আপনারা যাকে অন্যভাবে চিনেছেন।তাকে নিয়ে খারাপ মন্তব্য করেছেন। আমি সেই রহিমার সাথেই পরিচয় করিয়ে দিবো। মঞ্চে উপবিষ্ট সকলের মধ্যে কানাকানি শুরু হয়ে যায়।ওদিকে প্রশ্নাত্মক চোখে তাকিয়ে আছেন শফিক সাহেব।জানতে চাচ্ছেন বাকি কথাগুলো।

কিছু সময় পর রমজান আলী বললেন, রহিমা একদিন আমাকে ফোন দেয়।সেদিন অনেক কথা হয় ওর সাথে ।আমার ছেলে শফিক তখন চাকুরীতে ভিষন অমনোযোগী হয়ে পড়ে।বেশির ভাগ সময় রহিমার সাথেই কথা বলতো।রহিমা আমার পরামর্শ নিয়ে শফিকের সাথে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো।কিন্তু আমার থেকে খোজ খবর নিতো সব সময়।রহিমা চেয়েছিলো শফিকও ভালো কিছু করুক। আর আপ্নারা রহিমাকে খারাপ,প্রতারক বলেছেন। রহিমা এমন মেয়ে নয়।

রহিমা গত এক মাস হলো বাংলাদেশে এসেছে।কিন্তু শফিকের সাথে দেখা করতে আমি দেই নি।ভেবেছি আজকের দিনে ওকে একটা সারপ্রাইজ দিবো।আর রহিমা আপনাদের মাঝেই বসে আছে। রমজান সাহেবের কথা শুনে আমরা সবাই থমকে যাই।শফিক সাহেব উঠে বসেন চেয়ার থেকে। তার চোখ যেন রহিমাকে খুজতেই ব্যস্ত। রহিমাকে হাত দিয়ে ইশারায় ডাক দেন রমজান আলী। শফিকের দেওয়া সেই নীল শাড়ী,নীল চুড়ি, কানের দুল পরা রহিমা।এগিয়ে আসে স্টেজের দিকে।শফিক রহিমার দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকে।চশমার নিচ দিয়ে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো শফিকের ।রহিমা শফিকের দিকে তাকিয়ে আছে।কিন্তু কাছে যাবার সাহস পাচ্ছে না।

শফিক সাহেব চশমাটা খুলে নিলেন।এগিয়ে গেলেন রহিমার দিকে।নীল শাড়ীর উপর সাদা এপ্রোন পরা রহিমা।শফিক সাহেব তৃপ্তি করে দেখে নিলেন কিছু সময়।বাকরূদ্ধ হয়ে গেলেন। পরনের শার্টটা গড়িয়ে পড়া পানিতে ভিজতে থাকে। রহিমা শাড়ীর আঁচল গুছিয়ে শফিকের ভিজে যাওয়া চোখ দুটি মুছিয়ে দিয়ে মাথাটা নিচু করে নিলেন।শফিক সাহেব দু পা এগিয়ে জড়িয়ে নিলেন বাহুডোরে।

শফিক সাহেবের শত রাগ,অভিমান নিমিষেই মিলিয়ে গেল।তার রহিমা যে তাকে ঠকায় নি।ফিরে এসেছে তার বাহুডোরে।রহিমা নিজেকে লুকিয়ে নেয় শফিক সাহেবের বাহুডোরে। ভালোবাসার মানুষের ফিরে আসার মূহুর্তগুলো অতি আনন্দঘন হয়।ফিরে আসুক সব ভালোবাসার মানুষগুলো।জড়িয়ে থাকুক তার ভালোবাসার বাহুডোরে।পরিপূর্ণ করুক আমাদের।সঙ্গী হয়ে পাশে থাকুক সারাজীবন।ভালোবাসার মানুষের মায়াভরা হাসিতে ভুলে থাকুক কষ্টের মূহুর্তগুলো।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত