বিদ্যুৎ-বহ্নি: ১৭. ব্রজদুলাল সাহার পৈশাচিক হত্যার পশ্চাতে

বিদ্যুৎ-বহ্নি: ১৭. ব্রজদুলাল সাহার পৈশাচিক হত্যার পশ্চাতে

১৭. ব্রজদুলাল সাহার পৈশাচিক হত্যার পশ্চাতে

সেই রাত্রেই।

কিরীটী বলছিল, ব্রজদুলাল সাহার পৈশাচিক হত্যার পশ্চাতে ছিল বিচিত্র একটা নাটক। যার পাত্রপাত্রী ছিল ব্রজদুলাল সাহা স্বয়ং, তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র প্রশান্ত সাহা, তাঁর পি.এ. সাধন মিত্তির এবং তাঁর সেক্রেটারী মিস রেবেকা মণ্ডল।

বলাই বাহুল্য, বিপত্নীক ব্রজদুলালের দুর্বলতা জন্মেছিল রেবেকার উপরে। শুধু ব্রজদুলালের কেন—সাধন মিত্রেরও দুর্বলতা জন্মেছিল রেবেকার উপরে।

কিন্তু ওদের দুজনের কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি যে রেবেকা ভালবেসেছিল প্রশান্ত সাহাকে। আবার রেবেকাও তেমনি জানতে পারেনি ঘুণাক্ষরেও, প্রশান্তর তার প্রতি সবটাই ছিল নিছক একটা অভিনয়। নারীর চাইতে সে কাঞ্চনকেই জীবনে বেশী প্রাধান্য দিয়েছে।

এরপর আসা যাক ঘটনায়।

ব্রজদুলাল তাঁর ভ্রাতুস্পুত্রদের আদৌ দেখতে পারতেন না। অবিশ্যি দেখতে না পারলেও প্রশান্ত ও সুশান্তবাবুদের ধারণা ছিল ব্রজদুলাল তাদের একেবারে বঞ্চিত করবেন না। কিন্তু যে মুহূর্তে প্রশান্ত সাহা জানতে পারল ব্রজদুলালবাবু রেবেকাকে বিবাহ করবেন স্থির করেছেন—রেবেকারই মারফৎ সঙ্গে সঙ্গে সে ব্রজদুলালকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার জন্য স্থিরপ্রতিজ্ঞ হল। কিন্তু একা অত বড় দায়িত্বটা নেওয়া সম্ভব নয় তাই সে রেবেকার সাহায্য চাইল। রেবেকাও সম্মত হল, যেহেতু প্রশান্তকে সে মনে মনে ভালবাসত।

মিঃ মল্লিক শুধালেন, রেবেকাকে ব্রজদুলাল বিবাহ করবেন স্থির করেছিলেন, কথাটা জানলেন কি করে মিঃ রায়?

কথাপ্রসঙ্গে ভৃত্য জীবনই আমাকে কথাটা পরশু রাত্রে বলে ফেলেছিল। এবং কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রজদুলালের হত্যারহস্যটা আমার কাছে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায়। কেবল একটা কিন্তু থেকে যায়–

কিন্তু!

হ্যাঁ, বুঝতে পারছিলাম না রেবেকা যখন ব্রজদুলালকে বিবাহ করতে সম্মত হয়েছিল তখন এত বড় নৃশংস ব্যাপারটা কী করে ঘটতে পারে। কারণ রেবেকার অজ্ঞাতে তো এত বড় ব্যাপারটা সংঘটিত হওয়া সম্ভবপর হতে পারে না আদৌ। কিন্তু সে প্রশ্নের মীমাংসাটাও একটু আগে আজ সন্ধ্যায় অকস্মাৎই যেন হয়ে গেল পান্থশালায়।

মিঃ মল্লিক সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে, পান্থশালায়!

হ্যাঁ, পান্থশালায় সাধনবাবু আর রেবেকাকে দেখে ও তাদের কথাবার্তা শুনে। পান্থশালায় বসেই বুঝতে পারলাম, রেবেকা সাধন মিত্রের সঙ্গেও যখন প্রেমের খেলা খেলছে, তখন হতভাগ্য প্রৌঢ় ব্রজদুলালও তার অন্যতম ভিকটিম হয়েছিল স্বার্থজনিত প্রেমের খেলায় নিঃসন্দেহে!

যাক যা বলছিলাম, সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

একটু থেমে আবার সুখময় মল্লিকের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বলে, আজ যখন সুখময়বাবু আপনাকে ফোনে সকলকে ডেকে এখানে জড়ো করার জন্য বলি তখনও জানতাম না—বুঝতেও পারিনি ঘটনার পরিস্থিতি সহসা এমন হয়ে দাঁড়াবে। আমাকে যেন কোন চেষ্টাই করতে হল না, আপনা হতেই যেন সব জটগুলো খুলে গিয়ে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল।

সুখময় মল্লিক ওই সময় প্রশ্ন করেন, কিন্তু ঘটনাটা ঠিক কী ঘটেছিল বলে আপনার ধারণা মিঃ রায়? আর কেনই বা প্রশান্ত সাহা তার কাকাকে এমনি করে হত্যা করল, এবং প্রশান্তর ওপরেই বা আপনার সন্দেহ পড়ল কি করে?

কিরীটী বলে, প্রশান্ত সাহার উপরে সন্দেহ পড়েছিল আমার তিনটি কারণে।

তিনটি কারণে?

হ্যাঁ, প্রথমতঃ ব্রজদুলাল সাহার ইলেকট্রিক কারেন্টে মৃত্যু হওয়ায় এবং প্রশান্তর নিজের স্বীকৃতিতে জানতে পারা যায় যে, সে একজন ইলেকট্রিক মেকানিক, ওর দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। দ্বিতীয়তঃ তার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি, সে এক নম্বরের একজন অর্থলোলুপ। তৃতীয়তঃ ব্রজদুলালকে ও অন্তরের সঙ্গে ঘৃণা করে। সব কিছু মিলিয়ে ওর উপরে আমার সন্দেহটা দৃঢ়বদ্ধ হয়। তারপর সমস্ত ব্যাপারটা দুয়ে দুয়ে চারের মত মিলিয়ে নিতে আর আমার কষ্ট হয়নি।

একটু থেমে কিরীটী আবার বলতে লাগল, প্রশান্ত সাহা লোকটা অতীব ধূর্ত সন্দেহ নেই। সে জানত, রেবেকার প্রতি সাধনবাবুর দুর্বলতা আছে আর রেবেকা তাকে ভালবাসে। দুদিককার এই ভালবাসার ছুরি দিয়েই সে তার পথ পরিষ্কার করে নিয়েছিল। ঐদিন দ্বিপ্রহরে সাহেবের ছদ্মবেশে এসে রেবেকার সাহায্যে প্রশান্ত ব্রজদুলালের শয়নকক্ষের ইলেকট্রিক টেবিল-ল্যাম্পটা এ বাড়ির ৪৪০ ভোল্টের সঙ্গে ডিরেক্ট কানেকশন করে রেখে গিয়েছিল। সে জানত—ব্রজদুলাল রাত্রে শয়নের পূর্বে সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়েন ড্রিঙ্ক করতে করতে।

সেরাত্রেও শয়নের পূর্বে সোফায় বসে যথারীতি খবরের কাগজ পড়বার জন্য সামনের টেবিল-ল্যাম্পটা জ্বালাতে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মৃত্যু হয় হাই কারেন্টের ইলেকট্রিসিটিতে। ইতিমধ্যে নিষ্প্রদীপ হয় ঐ অঞ্চল। এবং ওই নিষ্প্রদীপের মধ্যেই কোন এক সময় অন্ধকারে ওই ঘরে সবার অলক্ষ্যে পাশের লাইব্রেরী ঘরের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করে প্রশান্ত আসল ল্যাম্পটা সরিয়ে দ্বিতীয় ল্যাম্প যথাস্থানে রেখে যায়। কিন্তু এত করেও সে তিনটি মারাত্মক ভুল করেছিল।

তিনটি মারাত্মক ভুল!

হ্যাঁ, মিঃ মল্লিক। প্রথম ভুল, রেবেকার সাহায্যে সাধনবাবুকে দিয়ে মাদ্রাজ থেকে ব্রজদুলালকে ট্রাঙ্ক কল করে তাড়াহুড়ো করে নিয়ে এসে। দ্বিতীয় ভুল করেছিল, আসল ল্যাম্পটা বদলে—দ্বিতীয় একটা নতুন ল্যাম্প সেখানে বদলে রেখে। এবং তৃতীয় মারাত্মক ভুল করেছিল, ঘরের দরজাটা খুলে রেখে দিয়ে।

হত্যা সে করেছিল নিশ্চয়ই ব্রজদুলালের সম্পত্তির লোভে? সুখময় মল্লিক বলেন। ঠিক তাই। উইলের ড্রাফট হয়ে গিয়েছে শুনে উইল পাকাপোক্ত হবার আগেই সে তাই ট্রাঙ্ক কল করে মাদ্রাজ থেকে এনে ব্রজদুলালকে হত্যা করেছিল। কারণ উইলে কোন রকম কিছু না থাকলে সম্পত্তি পেতে তো কোনন অসুবিধাই হত না। কিন্তু আর না মিঃ মল্লিক-রাত প্রায় শেষ হয়ে এল, এবারে আমি বিদায় নেব।

কিরীটী সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

ইতিমধ্যে বাইরে পুলিসের কালো ভ্যানও এসে গিয়েছিল।

হত্যাকারী প্রশান্ত সাহা ও রেবেকা মণ্ডলকে নিয়ে মিঃ মল্লিক হাজতে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন।

আগের পর্ব :

০১. পাইপটা নিভে গিয়েছিল
০২. সাহার গৃহে রেবেকা
০৩. পুলিসের রিপোর্ট
০৪. সুখময় মল্লিক যখন নীচের পারলারে
০৫. ভৃত্য জীবনকে সঙ্গে নিয়ে
০৬. অফিস-রুমটা পরীক্ষার পর
০৭. জবানবন্দি নেওয়া শুরু
০৮. কিছুক্ষণ অতঃপর সকলেই চুপ
০৯. পাটনা থেকে ফিরে এল সাধন মিত্র
১০. কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলে না
১১. পরের দিন ময়না তদন্তের রিপোর্ট
১২. পান্থশালা
১৩. পান্থশালা থেকে যখন বের হয়ে
১৪. কিরীটী প্রশান্তর মুখের দিকে
১৫. কথা বলে এবারে কিরীটী
১৬. সবাই রুদ্ধ নিশ্বাসে

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত