১৫. কথা বলে এবারে কিরীটী
কথা বলে এবারে কিরীটী, আমিই সুখময়বাবুকে বলেছিলাম ফোনে আপনাকে আজ একবার এখানে আসবার জন্য খবর দিতে মিঃ চ্যাটার্জী। ব্রজদুলাল সাহা, আপনার ক্লায়েন্টের উইল সম্পর্কে কয়েকটা ইনফরমেশান আমার দরকার।
উইল সম্পর্কে?
হ্যাঁ।
কিন্তু কিরীটীবাবু, আমার ক্লায়েন্ট তো কোন উইল শেষ পর্যন্ত করে যেতে পারেন নি? কেন, প্রশান্তবাবু তো জানেন সেকথা। ওঁকে তো আজই বলেছি।
রূপচাঁদ চ্যাটার্জী কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী প্রশান্ত সাহার দিকে তাকাল। কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য।
পরক্ষণেই তাকাল আবার রূপচাঁদ চ্যাটার্জীর দিকে, আপনার ক্লায়েন্টের কোন উইল নেই?
না। মাদ্রাজ যাবার আগে সর্বপ্রথম তিনি উইলের কথা আমাকে জানান।
তার আগে কখনও উইলের প্রশ্ন ওঠেনি?
না। সেই প্রথম উইলের কথা আমাকে বলেন এবং কি ভাবে উইল হবে মুখে সেটা বলে আমাকে একটা ড্রাফট তৈরী করে রাখতে বলেন, মাদ্রাজ থেকে ফিরে এসে সেটা পাকাপাকি করবেন বলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তো সব ভেস্তে গেল। মাদ্রাজ থেকে যেদিন ফিরলেন সেই রাত্রেই আত্মহত্যা করলেন।
আত্মহত্যা তো তিনি করেননি মিঃ চ্যাটার্জী! গম্ভীর কণ্ঠে কিরীটী এবার বলে।
সে কি, আত্মহত্যা করেননি?
না। স্থির কণ্ঠে কিরীটী পুনরায় প্রতিবাদ জানাল।
কিন্তু আমি যে শুনেছিলাম—
ভুল শুনেছিলেন। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। কিরীটী আবার বলে।
হত্যা করা হয়েছে?
হ্যাঁ।
বাট হাউ!
হাই ভোলটেজ ইলেকট্রিক কারেন্ট তাঁর দেহে পাস করিয়ে তাঁকে সেরাত্রে হত্যা করা হয়েছে মিঃ চ্যাটার্জী।
এতক্ষণে প্রশান্ত সাহা কথা বললে, সরি বলছেন কিরীটীবাবু, কাকাকে হত্যা করা হয়েছে?
হ্যাঁ প্রশান্তবাবু। তাঁকে সত্যিই হত্যা করা হয়েছে।
কিন্তু কে-কে তাঁকে হত্যা করবে?
যার স্বার্থ ছিল সে-ই। যাক সেকথা প্রশান্তবাবু, আপনাকে আমার যেজন্য প্রয়োজন এবং যেজন্য ডেকেছিলাম—অনুগ্রহ করে আমার সঙ্গে একবার ওপরে যাবেন কি?
ওপরে? কেন বলুন তো?
এক্সপার্ট ওপিনিয়ন নেব।
এক্সপার্ট ওপিনিয়ন কি ব্যাপারে?
আপনি তো একজন ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক, ইলেকট্রিকের ব্যাপারেই আপনার ওপিনিয়ন আমার চাই। চলুন।
ওরা ঘর থেকে বের হয়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে এগুচ্ছে, এমন সময় সাধন আর রেবেকাকে সেখানে প্রবেশ করতে দেখা গেল।
রেবেকা আর সাধন মিত্র যেন হঠাৎ ওই সময় ওদের ওখানে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে যায়।
কিরীটী কিন্তু ওদের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলে, যাক, আপনারা দুজনও এসে গিয়েছেন ভালই হল। বাকী রইলেন শুধু সুশান্তবাবু।
এরপর কিরীটী সুখময়ের দিকে তাকিয়ে বলে, মিঃ মল্লিক!
বলুন?
আপনি সুশান্তবাবুকে আসবার জন্য খবর পাঠাননি?
হ্যাঁ, লোক পাঠিয়েছি তো। যাকে পাঠিয়েছি তাকে বলেও দিয়েছি সুশান্তবাবুকে তাঁর ফ্ল্যাটে পাওয়া গেলে, হংকং হোটেলে পাওয়া যাবে। প্রয়োজন হলে সেখানেও যেতে।
তবে তিনিও হয়তো এসে পড়বেন। চলুন ওপরে যাওয়া যাক। চলুন প্রশান্তবাবু, সাধনবাবু! মিস মন্ডল, আপনিও।
.
সকলে এসে উপরে ব্রজদুলাল সাহার ঘরের তালা খুলে প্রবেশ করল।
ঘরের যাবতীয় জিনিসপত্র ব্রজদুলালের হত্যার পরদিন সকালে যেমন ছিল, যেখানে যেটি, সাতদিন পরে ঠিক তেমনিই আজও সব আছে।
কিরীটী একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে নিল।
তারপর সুখময়ের দিকে চেয়ে বললে, মিঃ মল্লিক, ভৃত্য জীবন আর দারোয়ান মিশিরকে একবার এ ঘরে ডেকে আনুন।
সুখময় মল্লিক ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কিরীটী ঘরের দক্ষিণ দিককার জানলাটা খুলে দিয়ে ভোলা জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
ঘরের মধ্যে বাকী সকলে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘরের মধ্যে অদ্ভুত একটা স্তব্ধতা যেন থমথম করতে থাকে।
মিনিট কয়েক বাদেই সুখময় মল্লিক ভৃত্য জীবন ও দারোয়ান মিশিরকে নিয়ে ফিরে এলেন।
ভৃত্য জীবনকে ঘরে ঢুকতে দেখেই কিরীটী ঘুরে দাঁড়াল, জীবন!
আজ্ঞে?
প্রশান্তকে দেখিয়ে বলে, এই বাবুকে চেনো!
কেন চিনব না আজ্ঞে, উনি তো বাবুর বড় ভাইপো?
এ বাড়িতে উনি এর আগে কখনও এসেছেন?
আজ্ঞে না।
এবারে দারোয়ান মিশিরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে কিরীটী, মিশিরজী।
জী?
ওই বাবুকো তুম্ পয়ছান্তে?
জী নেহি।
কভি দেখা নেই?
নেহি জী।
বাইরে ওই সময় জুতোর শব্দ শোনা গেল।
মিঃ মল্লিক, দেখুন তো আপনার সুশান্তবাবু বোধ হয় এলেন। কিরীটী সুখময়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে।
সুখময় মল্লিককে আর এগিয়ে দেখতে হল না।
সত্যি সুশান্ত সাহা ও একজন প্লেন-ড্রেস সি.আই.ডি অফিসার ঘরে এসে ঢোকেন।
সুশান্তর দাঁড়াবার ভঙ্গিটা যেন কেমন একটু শিথিল।
কোনমতেই যেন যে সোজা হয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না।
আজও তার পরিধানে দামী সুট ছিল।
সুশান্ত ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই বলে, কোথায় সুখময় মল্লিক, কেন সে আমাকে এখানে এভাবে ধরে নিয়ে এল আমি জানতে চাই। কোথায় সে?
কণ্ঠস্বর জড়িত। বোঝা যায় অতিরিক্ত মদ্যপানে সুশান্ত সাহা নেশাগ্রস্ত, ঠিক প্রকৃতিস্থ নয়।
কিরীটীই এগিয়ে এল, সুশান্তবাবু, বসুন সোফাটায়।
সুশান্ত বলে ওঠে, ড্যাম ইট, বসতে আমি আসিনি–কথাটা সুশান্তর শেষ হয় না, ঘরের মধ্যে অন্যান্য দণ্ডায়মান সকলের দিকে একে একে তার নজর পড়ে এবং সর্বশেষে প্রশান্তর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, এই যে বড় সাহেব, তুমিও তাহলে উপস্থিত হয়েছ! ভাল, ভাল!
কিরীটী আবার গম্ভীর এবং গলায় নির্দেশের সুর এনে বলে, বসুন সুশান্তবাবু!
বসব?
হ্যাঁ, বসুন।
আপনারা সবাই দাঁড়িয়ে থাকবেন—আর শুধু আমি বসব মিঃ রায়?
হ্যাঁ, আপনি বসুন।
ও-কে বস! তবে বসলাম।
ধপ করে সুশান্ত সোফার উপরে বসে পড়ল।
কিরীটী এবারে সাধন মিত্রের দিকে তাকিয়ে বললে, আজ এই সময় এমন যে একটা যোগাযোগ হবে, সত্যিই বলছি, ভাবতেও পারিনি সাধনবাবু। কিন্তু ঘটনাচক্রে ভগবানের ইচ্ছায় যখন যোগাযোগটা হলই, তখন যে কথাটা আপনাদের প্রত্যেককেই আমার বলবার ছিল সেটা আজই বলব।
একটু থেমে কিরীটী আবার বলতে লাগল, গত ২৩শে জুলাই রাত্রে এই কক্ষের মধ্যে নৃশংস হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল, সেই হত্যাকান্ডের কথাই বলব। কেমন করে সে রাত্রে ব্রজদুলালবাবু নিহত হয়েছিলেন আপনারা হয়ত এখনও সকলে তা ঠিকমত জানেন না।
আগের পর্ব :
০১. পাইপটা নিভে গিয়েছিল
০২. সাহার গৃহে রেবেকা
০৩. পুলিসের রিপোর্ট
০৪. সুখময় মল্লিক যখন নীচের পারলারে
০৫. ভৃত্য জীবনকে সঙ্গে নিয়ে
০৬. অফিস-রুমটা পরীক্ষার পর
০৭. জবানবন্দি নেওয়া শুরু
০৮. কিছুক্ষণ অতঃপর সকলেই চুপ
০৯. পাটনা থেকে ফিরে এল সাধন মিত্র
১০. কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলে না
১১. পরের দিন ময়না তদন্তের রিপোর্ট
১২. পান্থশালা
১৩. পান্থশালা থেকে যখন বের হয়ে
১৪. কিরীটী প্রশান্তর মুখের দিকে
পরের পর্ব :
১৬. সবাই রুদ্ধ নিশ্বাসে
১৭. ব্রজদুলাল সাহার পৈশাচিক হত্যার পশ্চাতে