বিদ্যুৎ-বহ্নি: ০৭. জবানবন্দি নেওয়া শুরু

বিদ্যুৎ-বহ্নি: ০৭. জবানবন্দি নেওয়া শুরু

০৭. জবানবন্দি নেওয়া শুরু

জবানবন্দি নেওয়া শুরু করলেন অতঃপর সুখময় মল্লিক।

বাড়ির লোকজনেরা তখনও ঘরের বাইরে বারান্দাতেই সবাই দাঁড়িয়েছিল পুলিস প্রহরায়।

ভৃত্য জীবন, রামখেলন, হরি ও নারাণ। রাঁধুনী বামুন ব্রিজনন্দন। দারোয়ান মিশির ও ধনবাহাদুর। ড্রাইভার, কেরামউল্লা—অফিসের ড্রাইভার সেও থাকত ব্রজদুলালের গৃহে সার্ভেন্টস কোয়াটারে।

বাড়ির নীচের তলায় একেবারে পশ্চিম দিকে ভৃত্য ঠাকুর ও ড্রাইভারদের থাকবার জন্য আলাদা ব্যবস্থা। তারা সব ঐখানেই থাকে।

জীবন ব্রজদুলালের খাস ভৃত্য। সে একমাত্র ব্রজদুলালের কাজকর্ম ছাড়া অন্য কিছুই করত না।

নতুন লোক বলতে ওদের মধ্যে কেউই নয়।

চার-পাঁচ বছর ধরে সকলেই ঐ বাড়িতে কাজ করছে।

ভৃত্যদের মধ্যে জীবন আর নারাণ ব্যতীত অন্য কেউ তো বড় একটা উপরেই যেত না। কাজেই ভৃত্যদের কারও কাছ থেকেই জিজ্ঞাসাবাদ করে বিশেষ কোন নির্ভরযোগ্য সংবাদই পাওয়া গেল না।

সবাই রাত সাড়ে নটায় ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল একমাত্র ভৃত্য জীবন বাদে।

সে শুতে যায় রাত দশটা নাগাদ।

কিরীটী জীবনকেই একবার জিজ্ঞাস করে, রেবেকা রাত্রে কখন ফিরেছে, সে জানে কিনা?

জীবন বলে, জানি না।

দোতলায় উঠবার সিঁড়িতে কোলাপসিবল গেট দেখলাম জীবন, ওটা রাত্রে বন্ধ থাকে, না খোলা থাকে।

আমি শোবার আগে রাত সাড়ে দশটা নাগাদ রোজ বন্ধ করে দিই। জীবন জবাব দেয়।

কাল রাত্রে বন্ধ করেছিলে?

হ্যাঁ। রাত দশটায়।

রেবেকা তাহলে তিনতলায় গেল কি করে?

আজ্ঞে উনি তো প্রায়ই রাত করে ফেরেন—ওঁর কাছে ঐ গেটের একটা ড়ুপ্লিকেট চাবি আছে।

দারোয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, রাত পৌনে বারোটা নাগাদ গতরাত্রে রেবেকাকে সে গেট খুলে দিয়েছে।

কিরীটী শুধোয়, আচ্ছা মিশির, কাল রাত্রে সাধনবাবুর বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়া ও রেবেকার রাত্রে ফেরা ছাড়া আর কেউ রাত সাড়ে নটার পরও এ বাড়ি থেকে বের হয়েছে বা এসেছে কিনা মনে পড়ে?

জী, না।

বাবু যে কদিন বাড়িতে ছিল না তার মধ্যে অপরিচিত কেউ এ বাড়িতে এসেছে?

হ্যাঁ।

কে?

একজন বুড়ো সাহেব।

একজন বুড়ো সাহেব?

জী।

সে কেন এসেছিল?

সে বলেছিল সে মেমসাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চায়। সে নাকি মেমসাহেবের আত্মীয়।

দেখা করেছিল বুড়ো সাহেব রেবেকার সঙ্গে।

তা জানি না, তবে ভিতরে গিয়েছিল।

কিরীটী তখন জীবনকে ডেকে সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করে। সাহেব সম্পর্কে সে কিছু জানে কিনা।

জীবন বলে, হ্যাঁ, সেই বুড়ো সাহেব মেমসাহেবের সঙ্গে দেখা করেছিল। মেমসাহেব সে-সময় বাবুর চেম্বারে কি সব লেখাপড়া করছিল। সাহেবের কথা বলতে তিনি সাহেবকে ঐ ঘরে পাঠিয়ে দিতে বলেন। আমি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।

সাহেব কতক্ষণ ছিল?

তা প্রায় ঘণ্টাখানেক তো হবেই। জীবন বলে।

আর একটা কথা জীবন, সাধনবাবু কাল সে-সময় কি বাড়িতেই ছিলেন? কিরীটী আবার। প্রশ্ন করে।

আজ্ঞে না।

সাধনবাবু তাহলে কাল সারাদিন বাড়িতে ছিলেন না তুমি বলছ জীবন?

আজ্ঞে।

.

সবার শেষে রেবেকাকে ঘরে ডাকা হল।

বছর চব্বিশ বয়স হবে রেবেকার। নিঃসন্দেহে রেবেকাকে সুন্দরী বলা চলে। গায়ের রঙ চকচকে না হলেও বেশ ফর্সা। রোগা দোহারা দীঘাঙ্গীই বলা চলে। মুখখানি লম্বাটে ধরনের হলেও চোখ নাক ও হৃ দুটি সত্যিই সুন্দর। গতরাত্রের প্রসাধনের প্রলেপটা তখনও কিছু অবশিষ্ট আছে।

পরিধানে দামী একটা তাঁতের কালো সরুপাড় শাড়ি। হাতে চারগাছি করে সরু সোনার চুড়ি।

ভারতীয় খ্রীশ্চান না জানা থাকলে এবং হঠাৎ দেখলে অবস্থাপন্ন বাঙালী গৃহস্থঘরের মেয়ে বলেই মনে হবে বুঝি রেবেকাকে।

আপনারই নাম মিস রেবেকা মণ্ডল? থানার ওসি মিঃ মল্লিক প্রশ্ন শুরু করেন।

হ্যাঁ।

এখানে আপনি ব্রজদুলালবাবুর সেক্রেটারী হয়ে ছিলেন?

হ্যাঁ।

কতদিন এখানে আছেন?

এক বছর পাঁচ মাস।

এক্সকিউজ মি, কত করে মাইনে পান আপনি?

হঠাৎ ঐ সময় কিরীটীই প্রশ্নটা করে রেবেকা মণ্ডলকে।

কিরীটীর প্রশ্নে রেবেকা ওর মুখের দিকে ক্ষণেকের জন্য তাকাল, তারপর মৃদু কণ্ঠে বললে, পাঁচশো টাকা।

পাঁচশো টাকা! কিরীটী কথাটা পুনরাবৃত্তি করে।

হ্যাঁ।

কিরীটী টাকার অঙ্কটা শুনে কয়েক মুহূর্ত ওর চোখের দিকে চেয়ে থাকে।

তারপর ধীরে ধীরে বলে, তার মানে মাইনের ঐ পাঁচশো টাকা একরকম আপনার অল ফাউই ছিল। কারণ থাকা-খাওয়া যখন আপনার এইখানেই ছিল।

তা বলতে পারেন।

হুঁ। Decent pay! কতকটা যেন আত্মগত ভাবেই কথাটা নিম্নকণ্ঠে উচ্চারণ করে কিরীটী আবার। ও সি-র দিকে তাকিয়ে বলে, Yes carry on–

আবার প্রশ্ন শুরু হয়।

মিস মণ্ডল, আপনার আপনজন কে আছে?

আপনার বলতে আমার সংসারে এক মামা। তিনি আসানসোলে স্টেশনমাস্টার।

আর কোন আত্মীয়স্বজন–

না।

আচ্ছা, বাড়ি কোথায় আপনার?

মুর্শিদাবাদ।

সেইখানেই কি বরাবর থাকতেন?

ম্যাট্রিক পাশ করা পর্যন্ত সেখানে ছিলাম।

কিন্তু আপনি তো বললেন আপনার বলতে এক মামা ছাড়া আর কেউ নেই।

এক পিসী ছিল, বছর দেড়েক হল মারা গেছেন। তাঁর কাছেই থাকতাম মুর্শিদাবাদে।

কতদূর পড়াশুনা করেছেন?

আই এ পাশ করে স্টেনো টাইপিং শিখেছি।

এখানে চাকরি নিয়ে আসবার আগে কোথাও চাকরি করেছেন?

হ্যাঁ, বছর দুই কলকাতাতে একটা বিলাতী ফার্মে স্টেনো-টাইপিস্ট ছিলাম। সেখান থেকেই সাহা স্টীল অ্যাণ্ড কোম্পানীতে চাকরি পাই। এক বছর অফিসে কাজ করবার পর মিঃ সাহা আমাকে পাসোন্যাল সেক্রেটারী করে এখানে নিয়ে আসেন।

আপনার বস কেমন লোক ছিলেন বলে আপনার ধারণা?

হি ওয়াজ এ পারফেক্ট জেন্টলম্যান। ঠাণ্ডা মেজাজের এবং অত্যন্ত ধীর-স্থির প্রকৃতির লোক ছিলেন। নিজের এমপ্লয়িদের উপরে তাঁর অত্যন্ত দরদ ছিল। তাই তো অবাক হয়ে গিয়েছি, কেন তিনি ঐভাবে আত্মহত্যা করলেন!

রেবেকা মণ্ডলের কথা শুনে মনে হল তার বস ব্রজদুলাল সাহার আকস্মিক আত্মহত্যায় সে শুধু ব্যথিতই নয়, বিস্মিতও।

আগের পর্ব :

০১. পাইপটা নিভে গিয়েছিল
০২. সাহার গৃহে রেবেকা
০৩. পুলিসের রিপোর্ট
০৪. সুখময় মল্লিক যখন নীচের পারলারে
০৫. ভৃত্য জীবনকে সঙ্গে নিয়ে
০৬. অফিস-রুমটা পরীক্ষার পর

পরের পর্ব :
০৮. কিছুক্ষণ অতঃপর সকলেই চুপ
০৯. পাটনা থেকে ফিরে এল সাধন মিত্র
১০. কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলে না
১১. পরের দিন ময়না তদন্তের রিপোর্ট
১২. পান্থশালা
১৩. পান্থশালা থেকে যখন বের হয়ে
১৪. কিরীটী প্রশান্তর মুখের দিকে
১৫. কথা বলে এবারে কিরীটী
১৬. সবাই রুদ্ধ নিশ্বাসে
১৭. ব্রজদুলাল সাহার পৈশাচিক হত্যার পশ্চাতে

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত