বসন্ত রজনী: ১২. কিরীটীর ট্রাঙ্ক কল

বসন্ত রজনী: ১২. কিরীটীর ট্রাঙ্ক কল

১২. কিরীটীর ট্রাঙ্ক কল

ঠিক সাড়ে ছটায় কিরীটীর ট্রাঙ্ক কল এল।

ঘরের দরজা বন্ধ করে প্রায় সাত মিনিট কিরীটী কালী সরকারের সলিসিটারের সঙ্গে কথা বলে বেশ হৃষ্টচিত্তেই ঘর থেকে বের হয়ে এল। মুখে পরিতৃপ্তির হাসি।

বলি, কি ব্যাপার?

হারানো সূত্রটি মিলে গিয়েছে। কিরীটী বললো।

কিসের হারানো সূত্র?

হত্যার উদ্দেশ্যটা অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছিলাম। উদ্দেশ্যটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

পেয়েছিস?

হ্যাঁ। আমি একটু বেরুচ্ছি। ঘণ্টাখানেক বাদে ফিরব। কথাটা বলে কিরীটী বের হয়ে গেল। মনে হল, বাইরে খুশি খুশি হলেও ভিতরে সে যেন তখনো আগের মতই উত্তেজিত।

.

রাত সাড়ে এগারটায় আমি, কিরীটী ও মহান্তি পূর্ব-পরিকল্পনা মত লতিকার হোটেলের দিকে চললাম।

যেমন যেমন বলেছিলাম, সেইভাবে সব ব্যবস্থা করেছেন তো মিঃ মহান্তি? কিরীটী শুধাল।

হ্যাঁ। কিরীটীর প্রশ্নের উত্তরে জানাল মহান্তি।

অন্ধকার রাত।

বীচের রাস্তায় মিউনিসিপ্যালিটির আলো জ্বলছে বটে, কিন্তু সে আলো এতই সামান্য যে থাকা-না-থাকা বোধ হয় দুই-ই সমান। অন্ধকারে সমুদ্র দেখা যায় না বটে, তবে গর্জন শোনা যাচ্ছে।

বীচের একেবারে গোড়ায় ফ্ল্যাগস্টাফের কাছে একটু ভিতরের দিকে লতিকার হোটেলটা। বীচে তখন একটি জনপ্রাণী নেই। ঐ সময় থাকার কথাও নয়। পিছনের দরজা-পথে আমরা নিঃশব্দে লতিকা যে হোটেলে ছিল সেই হোটেলে প্রবেশ করলাম।

একতলার একটা ঘরে আলো জ্বলছিল।

কিরীটী বললে চুপিচুপি, ঐটাই লতিকার ঘর।

হঠাৎ কানে কথা এলে-নারী-কণ্ঠ এবং লতিকার কণ্ঠ।

দাঁড়াও—আমি জানতাম তুমি আসবে।

নারীকণ্ঠের জবাব এল, জানতে?

হ্যাঁ, জানতাম। আর কেন যে এসেছ তাও জানি।

তবে তো খুবই ভাল!

এগিও না বলছি। স্টপ-স্টপ!

কিন্তু লতিকার কথা শেষ হল না। সহসা একটা শব্দ—

তারপরই একটা ধস্তাধস্তির শব্দ ও সেই সঙ্গে কেমন যেন একটা চাপা গোঁ গোঁ শব্দ।

কিরীটী যেন ছুটে গিয়ে লাফিয়ে পড়ল দরজার উপর, এবং আমাকেও বললে, সুব্রত উই-উই মাস্ট গেট ইন! দরজাটা ভাঙ। মহান্তি কুইক—

তিনজনের মিলিত চাপে দরজাটা ভেঙে পড়ল।

হুড়মুড় করে ঘরের মধ্যে তিনজন ঢুকে পড়ি। দেখি শয্যার উপর পড়ে আছে লতিকা, আর এক নারী তার উপরে ঝুঁকে রয়েছে তখনও।

কিরীটী ছুটে গিয়ে এক ঝটকায় সেই দ্বিতীয় নারীকে সরিয়ে দিয়ে লতিকার গলা থেকে সিল্কের রিবনের ফাঁসটা টেনে খুলে ফেলল তাড়াতাড়ি।

লতিকা নেতিয়ে পড়ে আছে তখনও শয্যার উপরে। সংজ্ঞাহীনা।

দ্বিতীয় নারী তখন ঘর থেকে পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু কিরীটী গর্জে ওঠে, নো ইয়ুজ-পালাবার চেষ্টা এখন বৃথা।

মহান্তির বিস্ময়-বিস্ফারিত কণ্ঠ থেকে বের হয়, এ কি, মিসেস বিশ্বাস?

কিরীটী বলে, না।

মিসেস বিশ্বাস নয়?

না—তার ছেলে রামানুজ।

রামানুজ। রেণুকা বিশ্বাসের ছেলে!

হ্যাঁ। খুব দক্ষ অভিনেতা রামানুজ। মিসেস বিশ্বাসের ছদ্মবেশে প্রথম রাত্রে উনিই এখানে এসেছিলেন এবং সেই সময়ই লতিকা দেবী ওঁকে চিনতে পারে আর তাই রামানুজ ওঁকে প্রাণের ভয় দেখিয়ে যায়।

ইতিমধ্যে লতিকার চোখে-মুখে জলের ছিটে দিয়ে হাওয়া করতে সে চোখ মেলে তাকায়।

আমি–, ক্ষীণ কণ্ঠে লতিকা সাড়া দেয়।

ভয় নেই মিসেস সরকার–you have been saved-কিরীটী বলে, হত্যাকারী ধরা পড়েছে–

ধরা পড়েছে। লতিকা ভাঙা গলায় প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ-ওই যে দেখুন, পালাতে পারেনি।

ঘরের এক কোণে রামানুজ তখনো একটা চেয়ারে পুলিসের প্রহরায় বসে।

কিন্তু আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না মিঃ রায়! ক্ষীণকণ্ঠে লতিকা বলে, রামানুজ–

হ্যাঁ, রেণুকার ছেলে রামানুজ—

রেণুকা বিশ্বাসের ছেলে-রামানুজ! কেমন যেন আমার গোলমাল হয়ে যাচ্ছে!

হ্যাঁ–জট ঐখানেই পাকিয়ে ছিল এবং হত্যার বীজও ঐখানেই ছিল।

হত্যার বীজ!

তাছাড়া কি? সত্যিই বিচিত্র নাটক! ওই রামানুজ কে জানেন?

আসল পরিচয়—অর্থাৎ রেণুকার গর্ভজাত হলেও ওর জন্মদাতা বাপ কে জানেন?

কে? লতিকা ক্ষীণকণ্ঠে প্রশ্ন করে।

সে হচ্ছে আপনারই স্বামী-কালী সরকারের অপরিণামদর্শিতার ফল—দুষ্কৃতির ফল–কালী সরকার ও রেণুকার ক্লেদাক্ত, কামনা-পঙ্কিল অন্ধকারময় জীবনের কোন এক বসন্ত রজনীর স্বাক্ষর।

কি বলছেন আপনি মিঃ রায়? সত্যি?

সত্যি-নিষ্ঠুর মর্মান্তিক সত্যি লতিকা দেবী! কিন্তু ঐ হতভাগ্য সেটা কোন দিনই জানতে পারেনি। ও চিরদিন জেনেছে ও রেণুকার ভাই।

কিন্তু আপনি-আপনি সে কথাটা জানলেন কি করে? মহান্তি প্রশ্ন করে।

প্রথমটায় অবিশ্যি নিছক অনুমানের উপরে নির্ভর করে-এবং যা চোখে দেখেছি তাই বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে।

কি রকম?

কিরীটী বলে, আপনারাও যদি চোখ মেলে দেখতেন তবে দেখতে পেতেন—রামানুজ রেণুকা ও কালী সরকারের চেহারার মধ্যে similarity দেখতে পেতেন, কেমন করে রেণুকা ও কালী সরকারের চেহারার ছাপ পড়েছে ঐ রামানুজের চেহারায়–

কিন্তু–

শুনুন মিঃ মহান্তি—

কিরীটীই বলতে থাকে, প্রথম দিন দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল, কারণ রামানুজের কটা চুল, চোখ ও গৌর গাত্রবর্ণ রেণুকার মত হলেও মুখের গঠনটা অবিকল কালী সরকারের মত। এবং কথাটা যে সত্য সে সম্পর্কে আমি স্থির-নিশ্চিত হই আজই সন্ধ্যায় কালী সরকারের অ্যাটর্নীর সঙ্গে কথা বলে। কালী সরকারের উইলে লেখা আছে, পুরীর সী-সাইড হোটেলটার একমাত্র মালিক কালী সরকার নিজে।

সে কি! মহান্তি বলে ওঠে, হোটেলটা তবে–

না, আসলে হোটেলটা কালী সরকারেরই। রেণুকা বিশ্বাসের সঙ্গে একটা চুক্তিপত্র আছে। যদিও সবাই জানে রেণুকা ও হরডন বিশ্বাসই হোটেলের মালিক। যাই হোক, যা বলছিলাম, ঐ হোটেলটা রামানুজ দাশকে দিয়েছে লেখা আছে।

রামানুজ ঐ সময় চেঁচিয়ে ওঠে, মিথ্যে কথা!

কিরীটী বলে, মিথ্যা কথা নয়। তোমার জননী দেবী ওইখানেই ভুল করেছে রামানুজ সাহেব। পাছে হোটেলটি হাতছাড়া হয়ে যায় কালী সরকারের মৃত্যুর পর, কালী সরকারকে নিয়ে এসে কৌশলে সেরাত্রে তোমাকে দিয়ে হত্যা করিয়ে সমূদ্রের জলে ভাসিয়ে দেয়। অ্যাও ইউ ফুল-ইউ কিলড ইয়োর ওন ফাদার—নিজের বাপকে তুমি হত্যা করেছ-যে বাপ তোমার ভালটাই চেয়েছিল শেষ পর্যন্ত।

না, না-হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে রামানুজ যেন পাগলের মতই-মিথ্যা—এ মিথ্যা–

না রামানুজ সাহেব, এ মিথ্যা নয়। কালী সরকারের অ্যাটর্নীও জানে সে কথা—তুমি তার অবৈধ সন্তান হলেও তোমার প্রতি তার একটা দুর্বলতা ছিল, মমতা ছিল।

কিন্তু আমি—I never dreamt of it- লতিকা বলে।

একমাত্র কালী সরকারের অ্যাটর্নী ছাড়া আর যারা জানে সে হছে ঐ রেণুকা বিশ্বাস।

হরডন বিশ্বাস জানে না?

না, সে জানে না। তবে না জানলেও তার মনে বোধ হয় ইদানীং একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছিল–

সন্দেহ?

হ্যাঁ মহান্তি সাহেব-সন্দেহ। সন্দেহ হচ্ছে তার স্ত্রী ও কালী সরকারকে নিয়ে—তাই সে কালী সরকারকে ডেকে পাঠায় পুরীতে।

তারপর?

কালী সরকার অবিশ্যি ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি-মানে সন্দেহ করেনি। সে সরল মনেই এসেছিল। তারপর আমার যা অনুমান, খুব সম্ভবতঃ কালী সরকারকে চেপে ধরে হরডন বিশ্বাস এবং তখন অনন্যোপায় কালী সরকার ব্যাপারটা মিটিয়ে নেবার জন্য কলকাতা থেকে তার অ্যাটর্নীকে আসতে বলে নতুনভাবে উইল করবার জন্য।

সত্যি?

বললাম তো, সবটাই আমার অনুমান। যা হোক, সমস্ত শলাপরামর্শ হত কালী ও হডনের মধ্যে, তার ঘরে বসে ব্রীজ খেলতে খেলতে। আসলে ব্রীজ খেলাটা ছিল সম্ভবতঃ eyewash-এবং ঐ সময় কোন একদিন রাত্রে হয়ত রেণুকা আড়িপেতে ব্যাপারটা জানতে পারে—যার ফলে সে অনন্যোপায় হয়ে তখন ছেলেকে পরামর্শ দেয় কালীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলবার জন্য, হতভাগ্য রামানুজকে হয়ত বুঝিয়েছিল, অন্যথায় হোটেল থেকে সে বঞ্চিত হবে।

হরডন তাহলে ব্যাপারটা জানে না বলতে চান?

সম্ভবতঃ না।

আগের পর্ব :

০১. মানুষের চেহারা
০২. পরের দিন সূর্যোদয় দেখব বলে
০৩. থানা থেকে আমাদের ডাক
০৪. বেঁটেখাটো গড়ন রেণুকা বিশ্বাসের
০৫. আর অপেক্ষা করলাম না
০৬. কিরীটী আবার জিজ্ঞাসা করে
০৭. সী-সাইড হোটেল
০৮. কিরীটী মহান্তির মুখের দিকে তাকিয়ে
০৯. পোস্টমর্টেম রিপোর্ট
১০. অদ্ভুত একটা স্তব্ধতা
১১. গাত্রোত্থান করব মহান্তি সাহেব

পরের পর্ব :
১৩. মহান্তি অতঃপর শুধায়

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত