০৮. কিরীটী মহান্তির মুখের দিকে তাকিয়ে
কিরীটী মহান্তির মুখের দিকে তাকিয়ে শুধায়, তবে কার নাম আছে?
একটা কল ছিল এইচ. বিশ্বাসের নামে। আর একটা ছিল কোন্ এক গনেন ব্যানাজীর নামে। লোকটা নিউজ-পেপার রিপোর্টার। লতিকা গুঁই যে ট্রাঙ্ক কলে কালী সরকারের সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে বললে, এখন মনে হচ্ছে সেটা মিথ্যা। তাছাড়া
থামলেন কেন বলুন? কিরীটী ওর দিকে তাকিয়ে তাগিদ দেয়।
মনে হচ্ছে লতিকা গুঁই যেন কিছু লুকোচ্ছে।
কি লুকোবে?
আমার যেন মনে হচ্ছে সে অনেক কিছুই হয়ত জানে এ ব্যাপারে।
তা যদি সে লুকিয়েই থাকে তো আমরা ঠিকই জানতে পারব মিঃ মহান্তি। ডোন্ট ওরি। আপনাকে কতকগুলো কথা বলি, মন দিয়ে শুনুন।
বলুন?
এক নম্বর, কিরীটী বলে, ঐ সী-সাইড হোটেলটা তৈরী করতে মোটামুটি কত টাকা আন্দাজ খরচ হয়েছে এবং কত ট্যাক্স হোটেলের বাড়িটার জন্য দিতে হয়—
আর?
শুনুন দু নম্বর, খরচের টাকার অঙ্কটা তো জানতেই হবে, দ্বিতীয়তঃ কি ভাবে কনট্রাকটারকে সে টাকা payment হয়েছে-by cheque or cash এবং তিন নম্বর
বলুন?
বেহালার নার্সারী ও নিউ মার্কেটের ফুলের স্টল কত টাকায় বিক্রী হয়েছিল এবং কে কিনেছিল?
আর কিছু?
কিরীটী বলতে থাকে, চার নম্বর-জগমোহিনী স্কুলের চাকরি রেণুকা বিশ্বাস ছেড়ে দিয়েছিল নিজেই, না তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। যদি ছাড়িয়ে দেওয়া হয়ে থাকে তো কেন? পাঁচ নম্বর-রেণুকা ও হরডনের বিয়ের পরে ও আগে কালী সরকারের সঙ্গে ওদের দুজনের কোন যোগাযোগ ছিল কিনা! ছয় নম্বর-কালীর ভাইপো সাধন সরকারকে একটি ইনটিমেশন দিতে হবে–
আর কিছু?
হ্যাঁ, আর একটা কথা, দোলগোবিন্দ সিকদার নামে একটি লোক-লোকটি দেখতে সুন্দর, ফর্সা রঙ, ভাসা-ভাসা বড় বড় চোখ, চোখের তারা কটা এবং মাথার চুলও কটা। ঝলঝলে একটা স্যুট পরনে—আর বাঁ কপালের উপর আধ-ইঞ্চি পরিমাণ একটি জড়ল আছে। এই লোকটির সন্ধান এই পুরী শহরে করতে পারেন কিনা দেখুন।
কিন্তু–
সম্ভবতঃ লোকটা বিদেশী এবং শুনেছি ব্যবসায়ী। পার্ল-মার্চেন্ট অর্থাৎ মুক্তোর ব্যবসায়ী।
মুক্তো-ব্যবসায়ী!
হ্যাঁ। স্টেশনে একজন পুলিস নিযুক্ত করুন নজর রাখার জন্য।
যদি অলরেডি চলে গিয়ে থাকে পুরী ছেড়ে?
তাহলে আর কি করবেন!
খোঁজ করব কোথায় লোকটার?
আগে হোটেল ও ধর্মশালাগুলোতে করুন, তারপর শহরে করুন।
কিন্তু লোকটা কে?
বললাম তো মুক্তোর ব্যবসায়ী।
তা যেন বুঝলাম, কিন্তু এই মামলার সঙ্গে–
কালী সরকারের সঙ্গে লোকটার পরিচয় ছিল, আর গতকাল সন্ধ্যায় সী-বীচে লোকটাকে কালী সরকারের সঙ্গে আমরা দেখেছি।
তা না হয় খুঁজে দেখব, তবে আমার কিন্তু ধারণা—
কি ধারণা আপনার?
ঐ হোটেলওয়ালী রেণুকা বিশ্বাস স্ত্রীলোকটি আদৌ সুবিধার নয়।
কিন্তু তাতে করে আপনি কি খুব একটা এগুতে পারবেন মিঃ মহান্তি এই হত্যার ব্যাপারে?
মানে?
যদি আমাদের অনুমান সত্যিই হয় যে, তাকে স্ট্যাঙ্গেল করে অর্থাৎ গলা টিপে হত্যা করে পরে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে আত্মহত্যা প্রমাণ করবার জন্য, সেক্ষেত্রে রেণুকা। বিশ্বাসের মত একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে কি–
অর্থাৎ আপনি বলতে চান সম্ভব কিনা? আপনি ঐ মেয়েমানুষটিকে চেনেন না, আমি কিছু কিছু জানি।
জানেন?
হ্যাঁ। এখানে জমি হোটেল ও লাইসেন্সের ব্যাপারে ওই স্ত্রীলোকটি মধ্যে মধ্যে আমার কাছে যেত। সেই সময় কথায় কথায় ওর অনেক পরিচয়ই আমি জানতে পারি।
কি জেনেছেন বলুন না!
সেদিন আপনাকে ঐ স্ত্রীলোকটি সম্পর্কে সব কথা বলিনি কিন্তু আজ বলছি শুনুন–বিয়ের আগে রেণুকা ছিল দাশরেণুকা দাশ নামেই অন্ততঃ পরিচয় ছিল, যদিচ ওর জন্ম মিশ্র রক্তে–
কি রকম?
ওর বাপ ডাঃ আর্থার মূর ছিল সাঁওতাল পরগণার এক মিশনারী হাসপাতালের ডাক্তার। জাতে স্কচ।
কার কাছে শুনলেন একথা?
ও নিজেই বলেছে।
কে, রেণুকা?
হ্যাঁ। কথায় কথায় একদিন ও আমাকে বলেছিল ওর জীবনটা নাকি বড়ই বিচিত্র। ছোটবেলায় ছিল প্রচণ্ড দস্যি মেয়ে। দৌড়, লাফ-ঝাপ, কুস্তি, ছোরা খেলা, লাঠি খেলা, বন্দুক ছোঁড়া–
বলেন কি!
হ্যাঁ। সব তার পালক বাপের উৎসাহে। আসলে ঐ মিশনারী ডাক্তারের ঔরসে রেণুকার জন্ম হলেও লোকে জানত ওর আড়াই বছর বয়সের সময় মা মরে যাওয়ায় ঐ মিশনারী ডাক্তারই তাকে অনুগ্রহ করে পালন করেছে। যা হোক যা বলছিলাম, গায়েও বেশ শক্তি ধরত। ডাক্তার বাপ অবিশ্যি ওকে যে কেবল খেলাধূলা, দৌড়ঝাপেই উৎসাহ দিয়েছে তাই। নয়—লেখাপড়াও কিছু কিছু শিখিয়েছিল। কিন্তু লেখাপড়ায় ওর তেমন মন ছিল না।
তারপর?
পনের কি ষোল বছর বয়স যখন, এক সার্কাস পার্টির সঙ্গে ও পালিয়ে যায়। চার বছর ছিল সেই দলে। নানা ধরনের দৈহিক কসরত দেখাত। তারপর একদিন সার্কাস পার্টির ম্যানেজারকে ছুরি মেরে–
বলেন কি! এ যে রীতিমত এক উপন্যাস! তারপর?
সুব্রতই কথাটা বলে।
হ্যাঁ, ব্রতবাবু। মহান্তি বলতে থাকে, ম্যানেজার রাত্রে ওর তাঁবুতে এসেছিল। ও ছুরি মেরে পালায় সেখান থেকে। ও ফিরে আসে আবার মিশনারী বাপের কাছে। ক্রমে ম্যাট্রিক ও আই-এ পাস করে। ট্রেনে একদিন কলকাতায় যেতে যেতে টি. টি. হারাধন বিশ্বাসের সঙ্গে ওর আলাপ হয়। আলাপ ক্রমে ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়। ঐ সময় ঐ মিশনারী ডাক্তার মারা যান এবং হারাধনের প্রচেষ্টাতেই জগমোহন গার্লস স্কুলে ও চাকরি পায়।
তারপর?
কিন্তু সেখানে ও এক বছরের বেশী চাকরি করতে পারে না।
কেন?
হোস্টেলে থাকত ও–মানে ঐ স্কুলেরই হোস্টেলে। সেখানে কি একটা চুরির ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে এবং নিজে থেকেই ও চাকরি ছেড়ে দেয়।
সুব্রত বলে ওঠে, এ যে সত্যিই এক উপন্যাস দেখছি! মিশ্ররক্তে-জম্ম—একটি মেয়ে –কিছুদিন সার্কাসে—সেখান থেকে ম্যানেজারকে ছুরি মেরে পালালো-তারপর পড়াশুনা ও হোস্টেল-সেখানেও চুরি–theft–
সত্যিই উপন্যাস সুব্রতবাবু, মোহান্তি বলে—কিন্তু ঐ পর্যন্ত এসেই ওর জীবনের কিছুটা অংশ কেমন যেন ধোঁয়াটে–
মানে? কিরীটী প্রশ্ন করে।
ঐখানে বছর দুয়েকের কথা এলোমেলো ভাবে চলেছে। কেবল একটি কথা স্পষ্ট
কী?
ঐ সময় ও হারাধন বিশ্বাসকে বিয়ে করে। হারাধন তখন তার পালক পিতার মৃত্যুতে বেহুলার নার্সারী ও ফুলের স্টলটা পেয়ে সে দুটো নিয়ে মেতে আছে। তারপর ওদের বিয়ের পর কি হল-হঠাৎ ও চলে এল।
কে চলে এল? রেণুকা বিশ্বাস?
হ্যাঁ। চলে এল কলকাতা থেকে গোপালপুর-অন-সীর এক হোটেলে, চাকরি নিয়ে।
তারপর?
তারপর এক বছর পরে এই পুরী শহরে আবির্ভাব ও এই হোটলের পত্তন-হারাধনের স্টল ও নার্সারী বিক্রি–
একটা কথা মিঃ মহান্তি! কিরীটী প্রশ্ন করে।
বলুন?
আচ্ছা ওর ঐ ভাইটি—
ঐ রামানুজ দাশের কথা বলছেন?
হ্যাঁ। ওর সম্পর্কে কি জানেন?
বিশেষ কিছুই জানি না। ওর সঙ্গে আজকেই তো হেটেলে প্রথম পরিচয় হল বলতে গেলে।
রেণুকা বিশ্বাসের মুখে ওর ভাই সম্পর্কে কিছু শোনেন নি?
না।
কিছু বলেনি সে?
না। তা না-ই বা জানা থাকল, কি জানতে চান ঐ রামানুজ সম্পর্কে বলুন? সব জেনে নেব।
বিশেষ কিছু না, এই হোটেলে ও কতদিন আছে, এর আগে কোথায় ছিল, কি করত।
ও আর এমন কি শক্ত, বলেন তো এখুনি ওকে এখানে ডেকে যা জানবার আমরা জেনে নিতে পারি মিঃ রায়।
না মহান্তি সাহেব, তাড়াহুড়ো নয়, ধীরেসুস্থে জানুন। ও যেন না কোনক্রমে আপনাকে সন্দেহ করতে পারে!
তবে কি মিঃ রায়, ঐ রামানুজকেই আপনি–
সন্দেহের কথা যদি বলেন মহান্তি সাহেব, অত্যন্ত সন্দিগ্ধ মন আমার-হরডন বিশ্বাস, রেণুকা বিশ্বাস, রামানুজ দাশ সকলকেই আমি—এমন কি কালী সরকারের দুপাশের ঘরে যে বোর্ডার দুজন আছে, রামগতি কানুনগো ও সুধাপ্রিয় মল্লিক তাদেরও–
কিরীটীর কথা শুনে বিস্ময়ে মহান্তি মস্ত বড় এক হাঁ করে।
একেবারে বন্ধ, কোন রা নেই। অনেকক্ষণ পরে ঢোক গিলে বলে, তবে—
কি তবে? নিশ্চয়ই। সকলকার উপরেই আপনার নজর রাখতে হবে-যাদের যাদের নাম এইমাত্র আমি করলাম। তারপর একুট থেমে কিরীটী বলে, মিঃ মহান্তি, এই দেখুন সী-সাইড হোটেলের কালী সরকার দুটো ঘর নিয়ে থাকত সেই ঘরের পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে মোটামুটি একটা প্ল্যান আমি খাড়া করেছি। বলতে বলতে কিরীটী আমাদের সামনে একটা কাগজ মেলে ধরে।
দেখলাম কাগজটায় একটা নকশা আঁকা আছে।
কিরীটী বলে, সাত ও আট নম্বর ঘর নিয়ে ছিল কালী সরকার। ছয় নম্বর ঘরে ছিল রামগতি কানুনগো, নয় নম্বর ঘরে সুধাপ্রিয় মল্লিক আর তের নম্বর ঘরে থাকেন আমাদের রামানুজ দাশ মশাই।
একটু থেমে আবার কিরীটী বলে, রামগতি কানুনগো আর সুধাপ্রিয় মল্লিক-রামানুজের সঙ্গে সঙ্গে ওদেরও সম্পর্কে যতটা জানা যায় জানতে চেষ্টা করুন, এবং এই যাদের নাম করলুম ইনকুডিং আমাদের লতিকা গুঁই—আপাততঃ এই কয়জনের প্রত্যেকের উপর নজর রাখবেন এবং ওঁদের জানিয়ে দেবেন বিনানুমতিতে কেউ ওঁরা শহর ছেড়ে বাইরে যেতে পারবেন না।
বেশ, তাই হবে।
অতঃপর মহান্তি বিদায় নিল।
কিরীটী আর এক দফা চায়ের অর্ডার দিল।
চা-পানের পর বললে, চল, সমুদ্রের ধারে গিয়ে খানিকটা ঘোরা যাক। কালী সরকার। সকাল থেকে স্কন্ধারূঢ় হয়ে মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। একেই বলে বরাত-বুঝলি সুব্রত! এলাম পুরীর সমুদ্রকে উপভোগ করতে কটা দিন, তা না, পঁচিশ বছর বাদে এক কালী সরকার : এসে আবির্ভূত!
কেন, তুই তো বলিস টেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে!
যা বলেছিস। নে চল।
কিছুক্ষণ অনির্দিষ্ট ভাবে ভিজে বালুর উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে একসময় ক্লান্ত হয়ে আমরা বালুবেলার উপরেই বসে পড়ি।
সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল ইতিমধ্যে। সমুদ্রতীর ঘেঁষে হোটেলগুলোতে সর আলো জ্বলে উঠেছে। রাস্তার আলো কিন্তু জ্বলেনি!
অন্ধকার সমুদ্রতীরে বহু লোক-আবছায়া ঘেরাফেরা করছে।
কিরীটী একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে বলে, লোকটা শুধু ম্যাথমেটিকসই জানত না, অঙ্কশাস্ত্রের মত টাকা-পয়সার হিসেবটাও বুঝত।
হঠাৎ কার কথা বলছিস?
কালী সরকার, আবার কে? তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার কালী সরকার সম্পর্কে জানতে পেরেছি–
কি?
লোকটা স্টেকে ব্রীজ খেলত।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। চারজন কালী সরকারের ঘরে বসে খেলত।
কে কে?
মনে হচ্ছে কালী সরকার, হরডন বিশ্বাস ও শ্রীমতী বিশ্বাস তিনজন। বাকি চতুর্থজন যে কে বুঝতে পারছি না।!
রামানুজ নয় তো?
না।
তবে হয়ত হোটেলের বর্তমান বোর্ডারদের মধ্যেই কেউ!
তাই হবে। বলতে বলতে কিরীটী যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। অন্ধকারে ওর মুখের দিকে তাকালাম কিন্তু মুখটা ভাল দেখা গেল না। বুঝলাম কালী সরকারের মৃত্যু-ব্যাপারে-একমাত্র তাকে কেউ হত্যা করেছে, এ ছাড়া আর বিশেষ এখনও রহস্যের মীমাংসার ব্যাপারে অগ্রসর হতে পারেনি। অন্ধকারেই এখনও ঘুরছে।
বললাম, হ্যাঁ রে, অঙ্কশাস্ত্রের মত টাকা-পয়সার হিসাবের কথা কি বলছিলি?
হ্যাঁ, একটা লেনদেনের ব্যাপার—
কার সঙ্গে কার?
কালী সরকারের সঙ্গে কারও বলেই মনে হয়!
তোর কি মনে হয়?
আপাততঃ চায়ের পিপাসা পেয়েছে-ওঠ চল্।
অগত্যা উঠতে হল।
আগের পর্ব :
০১. মানুষের চেহারা
০২. পরের দিন সূর্যোদয় দেখব বলে
০৩. থানা থেকে আমাদের ডাক
০৪. বেঁটেখাটো গড়ন রেণুকা বিশ্বাসের
০৫. আর অপেক্ষা করলাম না
০৬. কিরীটী আবার জিজ্ঞাসা করে
০৭. সী-সাইড হোটেল
পরের পর্ব :
০৯. পোস্টমর্টেম রিপোর্ট
১০. অদ্ভুত একটা স্তব্ধতা
১১. গাত্রোত্থান করব মহান্তি সাহেব
১২. কিরীটীর ট্রাঙ্ক কল
১৩. মহান্তি অতঃপর শুধায়