০৭. সী-সাইড হোটেল
অতঃপর তখনকার মত আমরা বের হয়ে এলাম সী-সাইড হোটেল থেকে। মহান্তির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলে ফিরে স্নান-খাওয়া সারতে সারতে বেলা প্রায় দেড়টা হয়ে গেল।
আহারাদির পর গোবিন্দলালবাবুর একটা শারদীয়া রহস্য পত্রিকা নিয়ে শয্যায় গিয়ে গা এলিয়ে দিলাম।
পুরী ভিউ হোটেলের একটা বিশেষত্ব হচ্ছে, একেবারে যেন পা বাড়ালেই সমুদ্র। মুহূর্তে মনটা ভরে ওঠে চোখ মেললেই। সামনের দিকে জানালাটা খুলে দিলাম। দুপুরের রৌদ্রে মরকতমণির মত জ্বলছে যেন সমুদ্র।
কী গাঢ় নীল। নীল সমুদ্রের প্রান্তে যেন নীল আকাশ অবগাহন করছে। সেই নীলের বুকে ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের ভাঙা আর গড়া। শীর্যে শীর্ষে তার শ্বেতশুভ্র যুইয়ের মত ফেনার মুঠো মুঠো অঞ্জলি। আর একটানা শব্দ-গোঁ-গোঁ-গোঁ। বইটা আর পড়া হল না-বুকের উপর পড়ে রইল। সামনে চোখ মেলে অলস শয্যায় পড়ে রইলাম।
সঙ্গে সঙ্গে মনের পাতায় ভেসে ওঠে কালীপ্রসাদ সরকারের প্রাণহীন দেহটা। মানুষটা কালও বেঁচে ছিল—আজ আর নেই! সমস্ত কিছুর উপরে অকস্মাৎ যেন একটা পুর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়েছে মৃত্যু।
সত্যিই কি লোকটার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে? তাকে নিষ্ঠুরভাবে কোন কিছুর সাহায্যে শ্বাসরোধ করে পৈশাচিক ভাবে হত্যা করা হয়েছে?
কিরীটীর ধারণা যখন তাই-নিঃসন্দেহে তাই ঘটেছে।
কিন্তু কেন? কে মারল–হত্যা করল অমন নিষ্ঠুরভাবে শ্বাসরোধ করে মানুষটাকে? বিয়েথা করেনি-ব্যাচিলার-নির্বাট মানুষটাপৃথিবীতে কেউই কি অজাতশত্রুর নয়? শত্রু সবারই আছে? কিংবা কোন পরশ্রীকাতর লোক হিংসার বশবর্তী হয়ে তাকে হত্যা করেছে? কিংবা শত্রুতাও নয়, হিংসাও নয়, কুটিল কোন স্বার্থের জন্য অমন নৃশংস কাজ করেছে কেউ?
কিন্তু কে? কে করল?
হরডন বিশ্বাস—তার স্ত্রী রেণুকা বিশ্বাস রামানুজ-তস্য শ্যালক—কিংবা ঐ স্কুলমিসট্রেস শ্রীমতী লতিকা গুঁই। আপাততঃ তো চোখের সামনে এই পাঁচজনকেই দেখা যাচ্ছে। তিনটি পুরুষ ও দুটি নারী।
যে কেউই কালী সরকারকে হত্যা করতে পারে। হঠাৎ মনে পড়ল আর একজন ক্ষণিক দেখা দিয়ে যে নেপথ্যচারী হয়েছে, সেই কশ্চিৎ মুক্তাব্যবসায়ী কালী সরকারের বিশেষ পরিচিত দোলগোবিন্দ শিকদার।
তাহলে হল চারটি পুরুষ-দুটি নারী। এই ছজনের মধ্যেই কি একজন হত্যাকারী? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন একসময় দু-চোখ ভরে তন্দ্রা এসেছিল, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম-ঘুম ভাঙল প্রায় তিনটে নাগাদ-ভৃত্যের ডাকে।
সে চা এনেছে।
কিরীটী ঘরে নেই। চেয়ে দেখি দরজা-পথে বারান্দায় ইজিচেয়ারটায় গা ঢেলে দিয়ে দূর সাগরের দিকে চেয়ে আছে। সত্যি, সামনের ঐ সাগর এমনি একটি বিস্ময়, এমনি অখণ্ড আনন্দ যে তার যেন শেষ নেই—কোন একঘেয়েমির ক্লান্তি নেই।
বাইরে এসে বসলাম কিরীটীর পাশে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে।
অপরাহের রৌদ্রালোকে ঝলমল করছে যেন নীল সমুদ্রের। অবিশ্রাম ঢেউ একটার পর একটা আসছে, যাচ্ছে-ভাঙছে, গড়ছে, ভাঙছে।
অবিশ্রাম একটানা গর্জন।
কিরীটীই প্রথমে কথা বলে, একটা কথা ভাবছিলাম সুব্রত—
কি?
কালী সরকারের সঙ্গে লতিকার একটা ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল ঠিকই-সেই সঙ্গে বোধ হয় রেণুকারও ছিল।
কিরীটীর মুখের দিকে তাকালাম। কিরীটী দূর সাগরের দিকেই চেয়ে আছে। বললাম, লতিকা গুঁইকে তোর কি রকম মনে হয়?
ওখানে একটা জট পাকানো আছে বলেই আমার মনে হয় সুব্রত।
কেন, লতিকার সঙ্গে রেণুকার একটা রেষারেষির ভাব আছে এবং ওদের মাঝখানে কালী সরকার ছিল বলে কি?
ঠিক তাই। দুটি নারী এবং দুটি নারীই বিশেষ আকর্ষণীয়া। যৌবনবতী বল বা না বল, ব্যাচিলার একজন পুরুষের কাছে আকর্ষণীয়।
তার মানে তুই বলতে চাস—
কিরীটী বাধা দিয়ে বলে, হ্যাঁ, বলতে চাই একা রামে রক্ষা নাই তায় সুগ্রীব দোসর! একা রেণুকা বিশ্বাসেই রক্ষা নেই, তায় আবার সঙ্গে এসে ভিড়েছে ঐ লতিকা দিদিমণিটি। তারপর একটু থেমে বলে, বুঝলি পুরুষের পক্ষে ব্যাচিলার থাকাটা এমন কিছু নিন্দনীয় নয়, কিন্তু বিশেষ একটা বয়েসে সে পুরুষ বাঘের মত হয়ে ওঠে যদি তার সামনে পড়ে লতিকা বা রেণুকার মত পুরুষ-লোভী নারী–
তাই বুঝি?
তাই। আর তাইতেই তো এখনও বলি তোকে, তোর সেই বয়েস এসে যাচ্ছে এবারে–
অতএব?
অতএব আর নয়—
বলছিস!
হ্যাঁ সর্বান্তঃকরণে কায়মনোবাক্যে—
তাহলে চল না হয় কলকাতায় গিয়ে ব্যাপারটা চুকিয়ে ফেলি!
ফুল-চন্দন পড়ুক তোর মুখে, আজই কৃষ্ণাকে জানাব। কিরীটী বলে ওঠে।
তা জানাস, কিন্তু পাত্রী একটা চাই তো?
পাত্রী! পাত্রীর তোর অভাব আছে নাকি?
তোর মতলবখানা কী বল্ তো? আর ইউ থিঙ্কিং অফ দ্যাট লতিকা গুঁই!
তোর বন্ধু, কুন্তলা দেবী তো আজও বাসর-সজ্জা রচনা করে আশার প্রদীপটি জ্বালিয়ে–
আঃ কিরীটী!
কি হল?
মৃদুকণ্ঠে বলি, কিছু না।
কিছুই যদি না তো গলার স্বরটি অমন কেন বন্ধু? কেমন ভেজা—
ঠিক আছে, তুই বকবক কর আমি চললাম।
উঠে পড়লাম আমি। সোজা সমুদ্রতীরে নেমে গেলাম।
.
ভিজে বালুর বুকে অশান্ত ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে, তারপর আবার চলে যাচ্ছে।
কেমন করে কিরীটীকে বোঝাই, কুন্তলা আমার স্বপ্নের মধ্যে ধ্যানের মত রয়েছে। সে আমার সমস্ত জীবনসত্তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বলেই তো ভয় করে তাকে স্পর্শ করতে।
সে তো স্পর্শের নয়, সে যে ধ্যানের। সে আমার জীবনের একটি রঙ, একটি সুর, একটি সঙ্গীত। জীবনের দেওয়া-নেওয়া, প্রতিদিনের তুচ্ছতার মধ্যে মলিনতা ও অভিযোগের মধ্যে তাকে কি জড়াতে পারি!
জীবনে ঘর বাঁধবার মধ্যেই কি সব? সেখানে তো জীবন প্রতি মুহূর্তে সংকীর্ণ হয়ে যায়! না না, তার চাইতে এই তো ভাল। কুন্তলা আমার নাগালের মধ্যেই রইল। যখন ইচ্ছা পাব জানি, তাই তাকে তুচ্ছ পাওয়ার মধ্যে জড়ালাম না। সে থাক অধরা হয়ে-অপ্রাপণীয়া হয়ে।
.
মধ্যে মধ্যে এসে অশান্ত ঢেউগুলো ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে পায়ের পাতা। আসছে যাচ্ছে ঢেউ নিরবধি, বিরাম নেই।
আবার মনে পড়ে কালী সরকারের কথা। মনের মধ্যে ভেসে ওঠে তার মৃত মুখখানা, আর তার পাশে পাশে ভেসে ওঠে আরও কয়টি মুখ।
হরডন বিশ্বাস, রামানুজ, দোলগোবিন্দ সিকদার, রেণুকা বিশ্বাস ও লতিকা গুঁই।
কে—এদের মধ্যে কে?
ঐ নেপথ্যচারী মুক্তা-ব্যবসায়ীই কি?
আশ্চর্য, কী বিচিত্র মানুষের হত্যালিঙ্গা!
এই দিগন্তবিস্তৃত সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়িয়েও মানুষের মনের মধ্যে দুঃস্বপ্ন নখর বিস্তার করে। গোপন লিপ্সা ক্রূর হিংসার হলাহলে ফেনিয়ে ওঠে।
কেন-কেন এমন হয়! দুদিনের জীবন—কেন মানুষ তাকে সুন্দর করে তোলে না! সমস্ত অভাব-অভিযোগ মলিনতা ও কুশ্রীতার ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে পারে না!
গতকাল সন্ধ্যায় এই বালুবেলার উপর বসে বসেই আমাদের কথা হচ্ছিল। সেই কথাগুলোই হঠাৎ মনে হয়। কালী সরকারকে দেখে কী মন্তব্য আমি করেছিলাম, সেই মন্তব্যের কথাটা মনে হয়। যাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল কোল্ড ব্লডে মার্ডার করতে পারে সেই লোকটাই কিনা শেষ পর্যন্ত নিহত হল অন্যের হাতে। এবং একটা রাতও তারপর পোয়াল না, নিষ্ঠুর মর্মান্তিক ভাবে নিহত হল!
কথাটা আনমনেই ভাবতে ভাবতে সমুদ্রতীর ধরে ভিজে নরম বালুর উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলেছিলাম।
হোটেল ছেড়ে অনেক দূর চলে গিয়েছিলাম পশ্চিমের দিকে। এসময়ে সমুদ্রতীর একেবারে নির্জন। কদাচিং কখনও একটা-আধটা মানুষ চোখে পড়ে। স্বর্গদ্বারের পরেই ক্রমশঃ সমুদ্রতীরে বাড়িগুলো কমে আসে।
একটা দুটো বাড়ি অনেক দূরে দূরে এতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল, তাও আর চোখে পড়ছে। বোধ হয় এদিকটায় তেমন লোকালয় নেই। সী-কোষ্ট ধরে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যাওয়া যায়! হয়ত মাদ্রাজ পৌঁছনো যায়। হেঁটে গেলে কেমন হয়!
সমুদ্র তো আমার পাশেপাশেই রয়েছে। অপরাহের আলোয় যেন নীল মরকতমণির মত জ্বলছে।
হঠাৎ চমকে উঠলাম।
একেবারে জলের ধার ঘেঁষে কে যেন বালুর উপর বসে আছে। বাতাসে তার আঁচল ও মাথার চুল উড়ছে। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে অপলক বসে আছে এক নারী। কে ঐ নারী।
আরও কিছুটা এগিয়ে যেতেই দ্বিতীয়বার চমকে উঠি : লতিকা গুঁই!
এখানে এই নির্জন সমুদ্রতীরে লতিকা গুঁই!
আরও এগোব কি এগোব না ভাবছি।
লতিকা গুঁইয়ের কিন্তু কোন দিকে নজর নেই। সে যেন নিজ ধ্যানে মগ্ন। আরও একটু এগিয়ে গেলাম। কোন খেয়াল নেই লতিকা গুঁইয়ের। মধ্যে একআধটা ঢেউ এসে পায়ের কাছে একেবারে পড়ছে। সেদিকেও যেন খেয়াল নেই।
অপরাত্নের আলোয় সেই সমুদ্র-তীরবর্তিনী উপবিস্টা নারীকে মনে হল যেন বড় বিষণ্ণ, বড় ক্লান্ত, বড় একা। হঠাৎ যেন চোখে পড়ল, লতিকার দু চোখের কোণ বেয়ে ক্ষীণ অশ্রুর ধারা গড়িয়ে পড়ছে। লতিকা কাঁদছে।
আস্তে আস্তে নিঃশব্দে ফিরে এলাম। আর অগ্রসর হলাম না।
.
হোটেলে ফিরে দেখি কিরীটী আর এক কাপ চা নিয়ে বসেছে।
আমাকে ফিরতে দেখে বলে, মন শান্ত হল?
আমি কোন কথার জবাব দিই না।
তুই যে কুন্তলার ব্যাপারে এতখানি টাচি সুব্রত, জানতাম না তো! ক্ষমা কর ভাই।
আমি সে কথার কোন জবাব না দিয়ে বললাম, লতিকা গুঁইকে দেখলাম।
কোথায়? নিস্পৃহ কণ্ঠে শুধায় কিরীটী।
সমুদ্রের ধারে। বসে বসে মনে হল যেন কাঁদছে।
পুওর গার্ল, কিরীটী বলে, শিক্ষকতা করতে করতেই জীবনটা গেল।
আমাদের কথা শেষ হয় না, দেখি একটা সাইকেল-রিকশা থেকে মহান্তি নামছে হোটেলের সামনে।
মিঃ মহান্তি যে, কি ব্যাপার?
আপনি আমাকে ট্রাঙ্ক কলটার খোঁজ নিতে বলেছিলেন না? সী-সাইড হোটেলে কাল যে ট্রাঙ্ক কল হয়েছে–
হ্যাঁ। খবর পেলেন কিছু?
পেলাম। দুটো ট্রাঙ্ক কল ছিল। একটা কলকাতা থেকে আর একটা রাউরকেল্লা থেকে। কিন্তু–
কি?
দুটো কলেই পি. পি.পার্টিকুলার পারসন ছিল, কিন্তু তার মধ্যে তো কালী সরকারের নাম নেই!
আগের পর্ব :
০১. মানুষের চেহারা
০২. পরের দিন সূর্যোদয় দেখব বলে
০৩. থানা থেকে আমাদের ডাক
০৪. বেঁটেখাটো গড়ন রেণুকা বিশ্বাসের
০৫. আর অপেক্ষা করলাম না
০৬. কিরীটী আবার জিজ্ঞাসা করে
পরের পর্ব :
০৭. সী-সাইড হোটেল
০৮. কিরীটী মহান্তির মুখের দিকে তাকিয়ে
০৯. পোস্টমর্টেম রিপোর্ট
১০. অদ্ভুত একটা স্তব্ধতা
১১. গাত্রোত্থান করব মহান্তি সাহেব
১২. কিরীটীর ট্রাঙ্ক কল
১৩. মহান্তি অতঃপর শুধায়