অর্পণ

অর্পণ

বাবা হতে চলেছেন আলতাফ সাহেব। অফিস শেষে বাসায় দেরী করে আসার অভ্যাসটা বদলে ফেলেছেন। স্ত্রী রাবেয়ার প্রতি অন্যরকম ভালবাসা কাজ করে এখন। তাই একটু তাড়াতাড়ি রাতে ঘরে ফেরেন এখন আলতাফ সাহেব। খুব শীঘ্রই সন্তানদের মুখ দেখতে চলেছেন তিনি।রাতে ঘরে ফেরার সময় এখন প্রায়ই তার হাতে শোভা পায় বেলি ফুল কিংবা শিউলি ফুলের মালা।স্ত্রীর পছন্দের বলে কথা।

সেদিন অফিসে একটা ফোন আসতেই ছুটে যান হাসপাতালে। হাসপাতালের রিসিপশন পেরিয়ে করিডোরে পৌছতেই বাবার দেখা পান আলতাফ সাহেব। বাবা এসে হাসিমুখে বুকে জড়িয়ে নেন। বাবার মুখেই সুসংবাদটা পান যে তিনি জোড়া ছেলে সন্তানের বাবা হয়েছেন। খুশিতে কেদে ফেলেন। তবে স্ত্রীর অবস্থা বেশি ভাল না। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এর ফলে প্রায় মৃত্যুশয্যায় তার স্ত্রী। আইসিউতে লড়াই করতে করতে শেষমেশ পৃথিবী ছেড়ে যান স্ত্রী রাবেয়া বেগম। আকাশ ভেঙে পরে আলতাফ সাহেবের মাথার উপর। কি করবেন কিছুই বুঝতেছেন না। অতি শোকে একদম পাথর হয়ে গেছেন। দুধের দুটো বাচ্চা! কি করবেন তাদের নিয়ে।তারা বেচে থাকবে তো এই চিন্তায় দিশেহারা তিনি। পৃথিবীর সব ভুলে গিয়ে এই চিন্তায় বুদ হয়ে বসে আছেন তিনি।

ঠিক তখন ই তার নিঃসন্তান বন্ধু করিম সাহেব এসে পাশে দাড়ালেন। কাধে হাত রেখে স্বান্তনা দিলেন তাকে। সাথে এ ও বললেন যে করিম সাহেবের যেহেতু কোন সন্তান নেই তাই ছেলেদুটো তাকে দিয়ে দিতে। যাতে করে তিনি ও তার স্ত্রী নিঃসন্তান থাকার কষ্ট ভুলে গিয়ে বাচ্চা দুটোকে মানুষ করতে পারেন। আলতাফ সাহেবের কাছে আর কোন উপায় ছিল না। তিনি তার ছেলেদুটোর প্রাণ বাচাতে রাজী হয়ে গেলেন করিম সাহেবের প্রস্তাবে।

নিঃসন্তান করিম দম্পতির ঘরে খুবই আদর যত্নে বাচ্চাদুটি বড় হতে লাগল। করিম সাহেব ও তার স্ত্রী এত কেয়ার করেন যে বুঝার কোন উপায় নেই যে সন্তানদুটো তাদের নয়। ভালবাসা,আদর,যত্নের বিন্দুমাত্র কমতি রাখেননি করিম সাহেব। এভাবেই অন্যান্য বাচ্চাদের ন্যায় বেড়ে উঠতে থাকে রাফি আর নাফি। চলতে থাকে জীবন।থেমে থাকার উপায় নেই। কেউ থেমে থাকে না৷ সময়ের সাথে তাল মেলাতে সবাই ব্যস্ত। ছেলেরা এখন বড় হয়ে গেছে। দুজনকেই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন করিম সাহেব। এবার তাদের হাতে সংসারের দায়িত্ব দিয়ে একটু অবসর সময় কাটাতে চান তিনি।

ওদিকে আলতাফ সাহেব অনেকদিন বাদে দ্বিতীয় বিবাহ করেন। ঘর আলোকিত করে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী। এবার তিনি বেশি একটা খুশি নন। একেতো পুরনো কষ্ট,তার উপর তিনি চেয়েছিলেন একটা ছেলে হয়ে গেল মেয়ে। সব কষ্ট বুকে চেপেই মেয়েকে মানুষ করতে থাকেন। মেয়েটা হয়েছেও অনেক আহ্লাদী। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে কোন কিছুই না করতে পারেন না আলতাফ সাহেব।প্রথম প্রথম অতটা ভাল না বাসলেও এখন তিনি খুব ই ভালবাসেন মেয়েকে।মেয়েটা বাবা ছাড়া কিছুই বুঝে না। সারাদিন বাবা বাবা করে৷ বাবার কথার অবাধ্য হওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না।

মেয়েকে সাথে নিয়েই সেদিন তার বড় ছেলে রাফির বিয়েতে যান তিনি।খেয়ে দেয়ে ছেলেকে কিছু কথা বলে বিদায় নেন । আবার ও সেই ছেলে না থাকার কষ্টটা অনুভব করতে থাকেন। বড় ছেলেকে বিয়ে করানোর পর থেকেই সংসারে কিছুটা অশান্তির সৃষ্টি শুরু হতে থাকে। ছেলে ও বউ দুজনেই এখন করিম সাহেব ও তার স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করে কড়া কথা বলে। পারিবারিক কলহ আরকি।

যেই স্বপ্ন নিয়ে করিম সাহেব ছেলেদুটোকে আপন করে নিয়েছিলেন তার কিছুই হলো না। উল্টো তাদের কারণে এখন বেচে থাকাটা আরো কষ্টকর হয়ে উঠেছে তার। বউয়ের প্ররোচনায় বড় ছেলে রাফি দিন দিন আরো উগ্র হয়ে উঠছে৷ জমিজমা টাকা পয়সা ভাগ বাটোয়ারা করে আলাদা হয়ে যেতে চাচ্ছে এখন। তা দেখে ছোট ছেলে নাফিও বড় ভাই আর ভাবীর সাথে যোগ দিয়েছে। কি আর করবে৷ বাবা, মা বুড়ো হয়ে গেছে কয়দিন পর মরে গেলে তো তাকে ভাই আর ভাবীর সাথেই হবে তাইনা?

এইসব ঝামেলা,চিন্তা পেরেশানির ধকল সামলাতে পারেননি করিম সাহেব। তার উপর বয়স ও তো হয়েছে। শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন একদম। হাসপাতালে ভর্তি করা হল তাকে। অবস্থা খুবই বেগতিক৷ হয়ত আর বাঁঁচবেন না। খবর শুনে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ছুটে গেলেন আলতাফ সাহেব। বিপদেই বন্ধুর পরিচয়। গিয়ে দেখেন করিম সাহেব আবোল তাবোল বকছেন শুধু। পাশে স্ত্রী ছাড়া কেউ নেই। ছেলেরা আর বউ আসেনি। প্রচন্ড একটা ধাক্কা খেলেন আলতাফ সাহেব। ছেলেদুটো তো তারই ছিল মূলত। বাবা মায়ের শেষ ইচ্ছেই থাকে শেষ বয়সে যেন ছেলেরা সাথে থাকে। আর করিম সাহেবের ব্যাপারটা পুরো উল্টো। তিনু হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন আর তার ছেলেরা তার সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে ব্যস্ত। এগুলাও ভাবতেই আলতাফ সাহেবের মাথা ঘুরে গেল।

একটু নড়েচড়ে বসলেন। চোখদুটো বন্ধ করলেন এক মুহুর্তের জন্য। সাথে সাথে মেয়ের মায়াবী চেহারাটা ভেসে চোখের সামনে।মেয়েটা খুব কেয়ার করে তার। এই প্রথমবার অনুভব করলেন ছেলেদুটোর থেকে মেয়েটাকেই তার প্রয়োজন বেশি। যে ভালবাসা অর্পণ করেছিলেন বহুদিন আগে বন্ধুর হাতে সেই ভালবাসার জন্য আজ আক্ষেপ হচ্ছে খুব। সেই দুঃখ ও হচ্ছে তার বন্ধুর এই অবস্থার জন্য।

আস্তে উঠে গিয়ে বন্ধুর পাশে গিয়ে বসলেন। তখন ও শ্বাস -প্রস্বাস চলছে করিম সাহেবের। হাতদুটো ধরে অঝোর ধারায় কাদলেন। নিজের অজান্তেই কেদে ফেল্লেন আলতাফ সাহেব। যদি জানতেন এমন হবে তবে হয়ত কখনোই তাদের পৃথিবীর মুখ দেখাতেন না। তবে যা হওয়ার হয়ে গেছে এখন আর বদলানো সম্ভব না কিছুই।বন্ধুর কাছে ক্ষমা চেয়ে এবার উঠে গেলেন আলতাফ সাহেব। বন্ধুর শীতল হয়ে যাওয়া হাতটা একসাইডে কাত হয়ে ঝুলে রইল হাসপাতালের বেডে।

যে ভালবাসার জন্য সেদিন পাগল হয়ে কেদেছিলেন আলতাফ সাহেব সে ভালবাসা অর্পণ এর জন্য ও আজ কাদলেন অঝোর ধারায়। সেদিনের কান্নাটা ছিল একটু আশা আকাঙ্ক্ষার আর আজকের কান্নাটা ভর্ৎসনা কিংবা আফসোস এর। ভালবাসা সবার জন্য এক রকম হয়ে আসে না। কারো হয় সুখের আবার কারো বেদনার। কেউ ভালবেসে সুখী হয় আর কেউ করিম সাহেবের মত দুঃখভরা হৃদয় নিয়েই চলে যায় পরপারে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত