সময়

সময়

প্রিয়া এই নিয়ে ২৪ বার ফোন দিয়েছে। প্রায় ১ ঘন্টায় ২৫টা ফোন দিয়েছে কিন্তু মোবাইল সাইলেন্ট করে কাজ করছিলাম তাই খেয়াল করতে পারি নি। এখন একটু কাজের চাপ কম তাই ফোনটা ব্যাক করতে যাবো আর তখনই আবার ফোনটা আসলো। আর লেট না করে ফোনটা ধরলাম। আমি কিছু বলার আগে প্রিয়া বলতে শুরু করলো…

— আচ্ছা কয়টা ফোন দিয়েছি দেখছো তো। বাসায় তো মানুষ মরে গেলেও তুমি ফোন তুলবে না।
— আসলে…
— আসলে কাজের খুব চাপ। এটাই বলবে তো। বিয়ে হওয়ার পর থেকে গত ৪ বছর ধরে এই এক লাইন বলে যাচ্ছো। কাজের প্রতি এতো ভালবাসা তাহলে কাজকেই বিয়ে করতে পারতে তাই না। আমাকে বিয়ে করলে কেন?

— প্রিয়া আমার কথাটা একটু বুঝার চেষ্টা তো করো।
— আমি কোন কথা শুনতে চাচ্ছি না। আগামী ৩ দিনের ছুটি নিয়ে বাসায় আজকে আসবে নয়ত আসতে হবে না।
— প্রিয়া…

আর কোন কথা না শুনেই ফোনটা কেটে দিলো। প্রিয়া তো কোন ভুল বলে নি যে আমি ওর কথার কোন উত্তর দিবো। গত ৪ বছর ধরেই এমন হচ্ছে। আমাদের ৩ বছরের একটা ছেলে আছে । সে মোটামোটি ভালই পাকা কথা বলে। কিন্তু আমি ওকে ঠিক মত সময় দিতে পারি না। আগে তো মাঝে মাঝে আমার কোলেও আসতো না।

রাতে আইসক্রিম আর চকলেট নিয়ে বাসায় আসলাম। প্রিয়া দরজাটা খুলে দিয়ে সোজা রুমে চলে গেল। আমার সাথে কোন কথাও বলছে না। আমিও কথা না বলে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। আমার ছেলে বেশ ঘুমাচ্ছে। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি প্রিয়া অন্য পাশে ফিরে শুয়ে গেছে। আমি খাবার টেবিলে গিয়ে দেখলাম সব খাবারই গরম। মনে হচ্ছে একটু আগে রান্না হয়েছে। আর প্রিয়া যে খায় নি সেটাও বুঝতে পারছি। প্রিয়া খাটে শুয়ে আছে। আমি ওর মাথার সামনে হাটু ভেঙ্গে বসলাম। ও চোখ বন্ধ করে আছে। আমি ওর মাথায় হাত রেখে বললাম….

— প্রিয়া কাজ তো আমি তোমাদের জন্যই করি আর আমাদের ছেলে নির্বানের একটা ভবিষ্যৎ আছে। তার জন্য তো টাকা জমাতে হবে তাই না।
— ( চুপ করে আছে)
— অনেক বেশি রাগ করাটাই স্বাভাবিক কিন্তু আমাকে একটু বুঝার চেষ্টা করো।
— সেই চার বছরে আর কত তোমায় বুঝবো। আমাকে কি তুমি একটু বুঝেছো? (কান্না করে দিলো)
— একদম কাঁদবে না প্লিজ।
— এখন কাছে আছো বলে বলছো কেঁদো না। আর যখন তুমি বাসায় থাকো না তখন আমার কান্না কে থামায় বলতে পারো।

— সরি, এই যে কান ধরছি। এখন থেকে তোমাকে বেশি বেশি সময় দিবো। খুশি তো।
— না খুশি না।
— তাহলে?
— বলো আমাকে আর আমাদের ছেলেকে বেশি বেশি সময় দিবে।
— হুমম দিবো। ( নাক টেনে দিলাম)
— তো রাজ মশাই চলো খাবে চলো।
— হুমম চলো।
— কিন্তু….

প্রিয়া আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। বুঝতে পারছি পাজিটা চাচ্ছে ওকে কোলে করে খাবার টেবিলে নিয়ে যাই। আমি আর অপেক্ষা না করে প্রিয়াকে কোলে তুলে নিলাম। তারপর খাবার টেবিলের উপর বসালাম। প্রিয়া ছোট বাচ্চাদের মত হাত দুটি জোড় করে রেখেছে। বুঝলাম যে আজকে এই পিচ্ছিকে খাইয়ে দিতে হবে। তাই আর কিছু না ভেবে ভাত মেখে ওর দিকে খাবারটা এগিয়ে দিতেই ও আমার হাতটা আমার মুখের সামনে দিয়ে বলল….

— সারাদিন আমাদের জন্য কষ্ট করো বুঝি তো। নিজের খাবারটা কি সময় মত খেতে পারো না?
আমি বলে বুঝাতে পারবো না ওই সময় আমার কেমন ফিলিংস হয়ে ছিল তবে এটা সত্যি যে নিজেকে খুব ভাগ্যবান লাগছিল। প্রতিটা মেয়ে ছেলেদের উন্নতির চাবিকাঠি। তার প্রমান হয়ত এই প্রিয়া। এরপর আমি ওরে খাইয়ে দিতে লাগলাম।

খাওয়া দাওয়া শেষে প্রিয়াকে আবার কোলে করে খাটে দিয়ে এসে আমি জানালার পাশে দাড়ালাম। প্রিয়াকে বড্ড বেশি ভালবাসি আমি, কিন্তু কাজের কারনে সময় দিতে পারছি না। সকালে ঘুম ভাঙ্গলো কারো উল্টাপাল্টা গিটার বাজানোর কারনে। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখি আমার সরূপ পূত্র নির্বান গিটারের তার গুলো কে টুং টাং করছে। আর ওর দিকে তাকেই নির্বান দৌড়ে এসে আমার পিঠে বসলো। আর চুল ধরে টানতেছে। আর তখনই প্রিয়া এসে হাজির।

— কি ব্যাপার আজ এতো সকাল সকাল বাপ বেটার খেলা শুরু হয়ে গেছে।
— আর বলো না।আমার ঘুমটা নষ্ট করলো।
— যেমন বাপ তার তেমন বেটাই হওয়া উচিত।
— শুধু আমার দোষ দিয়ো না। নির্বানের মাঝে ওর মায়ের কিছু স্পেশাল গুনও আছে।
— মায়ের কি কি গুন শুনি?
— এই যে বেসুরে গান গাওয়া, একটু বেশি রাগ করা আরো কত কি?
— কি বললে আমি বেসুরে গান গাই। বলেই আমাকে মারতে শুরু করলো। প্রিয়া মারছে ঠিক আছে কিন্তু সাথে নির্বানও দেখা দেখি দিচ্ছে।ওদের অত্যাচার শেষ হতেই প্রিয়া বলল…

— ওই ফ্রেশ হতে যাও, তোমার খাবার দিচ্ছি।
— এখনই কেন?
— তোমায় নিয়ে একটু শপিংয়ে যাবো তো?
— কিন্তু আমি তো অফিস থেকে ছুটি আনি নি।

প্রিয়া কাজ করা থামিয়ে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রুম থেকে চলে গেল। এদিকে ঘরটা ঠান্ডা হয়ে গেল। প্রিয়া চুপচাপ নাস্তা বানাতে লাগলো। আর আমিও চলে গেলাম ফ্রেশ হতে। আমি খাবার টেবিলে বসে আছি আর প্রিয়া আমার খাবার দিচ্ছে তখন আমি বললাম…

— একটা ডিজাইন এপ্রুভ করাতে আজ বিকেলে অফিস থেকে চট্টগ্রাম যেতে হবে। ২ দিন ওইখানে থাকবো কিছু কাজে।
— আমি জানতে চেয়েছি একবার।
— আমি চট্টগ্রাম থেকে এসেই তোমাকে অনেক সময় দিবো।
— ও তাহলে রাতে শুধু সান্তনা দিয়ে ছিলে। তোমরা ছেলেরা পারোও বটে। কাল রাতে কত রকম প্ল্যান করে ছিলাম।
— সব পূরণ হবে। একটু সময় দাও।
— অনেক সময় দিয়েছি আর পারছি না। এবার আমি যা ভাল বুঝবো তাই করবো। তুমি যাও তোমার অফিসে।
— প্রিয়া বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু?
— আমি কিছু বললেই সেটা বেশি হয়ে যায় আর তুমি যেটা সাড়ে চার বছর ধরে সময়ের পর সময় দিয়ে যাচ্ছো সেটা কিছু না।
— ধুর খাবোই না।

খাবারের প্ল্যাট টা দূরে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাড়ালাম। আর নির্বান আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হয়ত একটু ভয় পাচ্ছে। আমি না খেয়েই বাসা থেকে বেরিয়ে পরলাম। প্রিয়া একটা শব্দও ভুল বলছে না কিন্তু আমার তো হাত পা বাধাঁ। বাসা থেকে বের হতেই হালকা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। আমি কোন রকমে দৌড়ে একটা সি এন জি নিয়ে অফিসে চলে আসলাম। আজ একটা বারও প্রিয়া ফোন দিচ্ছে না। আমি মাকে ফোন দিলাম…

— হ্যালো মা।
— হুমম রাজ বল।
— প্রিয়া কোথায় এখন?
— বউ মা তো মাত্র ব্যাগ ঘুছিয়ে চলে গেল। বলে গেছে ওর সময় হলে ও ফিরবে। তোর সাথে কোন ঝগড়া হলো নাকি। সকালে তোদের মাঝে তর্কাতর্কি দেখলাম।
— না মা তেমন কিছু না। আচ্ছা আমি রাতের ট্রেনে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি বাই।
— আচ্ছা তবে সাবধানে।

আমি অনেকবার ফোন দিয়েও প্রিয়া ফোন তুলে নি। এবার কাজটা শেষ করে আসি তারপর প্রিয়াকে নিয়ে কোথাও লম্বা জার্নিতে যাবো। চট্টগ্রাম ট্রেন এসে পৌছাঁলো ভোরে। আমরা ৪ জন কলিগ এসেছি। প্রথমে আমাদের থাকার জায়গা নেওয়া হলো। বলল, সকালটা রেস্ট নিতে, বিকালে ডিজাইন নিয়ে বসবে। খুব ক্লান্ত থাকার কারনে ঘুমিয়ে গেলাম। এদিকে আমার ফোনে চার্জ নেই সেটাও খেয়াল ছিল না। দুপুরের দিকে ঘুম ভাঙ্গতেই ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি মোবাইল বন্ধ। তারপর মোবাইল টা চার্জে দিয়ে আমি ফ্রেশ হতে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে এসেই ফোনটা অন করতেই কিছুক্ষণ পর আমার ফোনটা বেজেঁ উঠলো। তাকিয়ে দেখি প্রিয়ার ফোন…

— হ্যালো
— বাবা রাজ বলছো, আমি প্রিয়ার বাবা।
— জ্বী বাবা বলুন।
— তুমি এখন কোথায়?
— কেন বাবা?
— প্রিয়ার তো সকাল থেকেই জ্বর। ওকে নিয়ে আমরা হাসপাতালে এসেছি। ওর রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে। গত ১ সপ্তাহ ধরে নাকি এই জ্বরটা আসছে। তুমি কি জানো না।
— না বাবা প্রিয়াতো কিছুই বলে নি।
— মেয়েটা একটু চাপাঁ স্বভাবের তাই বলে একটু খোজঁ রাখবে না। একটা পরিবার চালাতে টাকার থেকেও সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন ভালবাসা আর বিশ্বাস। প্রিয়া জ্বরের ঘুরে তোমার নামই করছে।
— বাবা আমি এখনই রওনা দিচ্ছি।

আমি আর অপেক্ষা না করে অফিসে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি আমার ফ্যামিলির মানুষ অসুস্থ। আমি বিকাল ৪টার ট্রেনে উঠে যাই। টিকিট পাই নি বলে দাড়িয়ে আসতে থাকি। প্রায় সাড়ে আট ঘন্টা পর আমি নরসিংদী এসে পৌছাই। রাত এখন বারটা বাজে। ৪০ টাকার ভাড়া ১৫০ টা দিয়ে নার্সিং হোমে রওনা দিলাম। আসার পথে অনেক বার প্রিয়ার বাবার সাথে কথা বলেছি। আমি হাসপাতালে আসতে রাত দেড়টার মত বাজলো। আমি হাসপাতালে এসেই প্রিয়ার বাবাকে ফোন দিলাম। কারন হাসপাতালের গেট লাগানো। আর এখন রোগীর সাথে দেখা করাও যাবে না। তবে রোগীর সাথে ২ জন থাকতে পারবে। প্রিয়ার বাবা মা দুইজনেই এখানে আছে। হাসপাতালের ডিউটি দেওয়া ডাক্তারের স্পেশাল পারমিশনে আমাকে ভেতরে আসতে দিলো। আমি প্রিয়ার কেবিনের সামনে গেলাম। আমি প্রিয়ার বাবাকে বললাম….

— এমন হলো কিভাবে?
— কাল দুপুরে প্রিয়া যখন আমাদের বাসায় আসে তখন একা একা খুব কেঁদে ছিল। এমন কি খাওয়া দাওয়াও করে নি। তারপর রাতে অনেক বৃষ্টি হয় আর সকালে প্রিয়াকে দেখি ছাদে পড়ে আছে। এরপর তারাতারি হাসপাতালে নিয়ে আসি। তোমাকে সকাল থেকে ফোন দিলেও মোবাইল বন্ধ পাই। সব দোষ আমারই। মেয়েটা আমার থেকে কি চেয়ে ছিল, একটু সময় তাই তো। আর আমি কি দিলাম? আমার চোখ দিয়ে জল পড়ছে কিন্তু বুঝতে পারতেছিনা প্রিয়ার সামনে কেমন করে দাড়াবো? ‘আমি আস্তে আস্তে প্রিয়ার রুমে গেলাম।প্রিয়ার বাবা মা বেরিয়ে গেল। আমি প্রিয়ার হাতটা স্পর্শ করতেই প্রিয়া শক্তিহীন হাতে আমার হাতটা ধরার চেষ্টা করতে লাগলো। আমার ভিতরটা কেপেঁ উঠছিল। মেয়েটা এখনো ঘুমায় নি। আমি ওর কানের সামনে বললাম…..

— এতো ভালবাসো কেন? একটু কম ভালবাসতে পারো না।
— তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য অসুস্থ হওয়া ছাড়া আমার কাছে কোন পথ ছিল না।
— পাগলী একটা, এখন কথা না বলে চুপচাপ ঘুমাও।
— আমি ঘুমালে কোথাও চলে যাবে না।
— না আর কখনো না।

প্রিয়া চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছে আর আমি ওর হাতটা ধরে বসে রয়েছি। এই পাগলীকে আর কাঁদানো যাবে না। অনেক কেঁদেছে। ওর কিছু হয়ে গেলে আমায় শয়তান বলে রাগাবে কে?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত