জীবনের শেষ নামায

জীবনের শেষ নামায

মায়ের গর্ভ থেকে গর্ভপাত হবার পরপরই যখন আমার কানে ভেসে আসলো “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ(সাঃ)” তখন ঠিক বুঝে নিয়েছিলাম আমি হয়ত মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছি। জন্মের পর আপাতত চিন্তামুক্ত হয়ে শুয়ে আছি বারান্দায়। হঠাৎ কে জানি আমার এক কানে আযান আর এক কানে ইকামত শুনে দিলো। এবার আমি পুরোপুরি নিশ্চিত, এটা মুসলমানের ঘর। আমি মুসলমানের সন্তান। আযান আর ইকামত শোনার পর থেকেই আমার মনে ভয় কাজ করা আরাম্ভ করলো। না জানি কখন আমার দেহের নামাযের নোটিশ হয়ে যায়। অপেক্ষায় আছি জীবনের সেই শেষ নামাযের জন্য। চোখের দু’পাতা তখন থেকে আর বন্ধ হচ্ছিলো না। কে জানে কখন আমার দেহের নামাযের নোটিশ ঘোষণা করা হয়। জন্মের পর দেখলাম ছোট্ট একটা গর্ত থেকে আমি বিশালাকার একটা ঘরের ভিতরে খুব স্নেহে শুয়ে আছি। অবশ্য আমার স্রস্টা আমাকে দুনিয়াতে প্রেরণের আগেই খুব ভালো রেখেছিলেন। যাক! স্রস্টার আশির্বাদ তো বান্দার উপর ভালোর জন্যি।

স্রস্টার আশির্বাদ চিন্তা করে অবশ্য কিছুক্ষণের জন্য শেষ নামাযের কথা ভুলেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু তা আর হলো না। ঘরের বাইরে তাকাতেই চোখে দেখতে পেলাম বেশ সুন্দর আকাশের ছবি। সূর্য্যটাও আজ আমাকে মনে হয় চোখ মারছে আর বলছে এ পৃথিবীতে তোকে স্বাগতম। সূর্য্যিমামার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে বেশ কিছুক্ষণ পেড়িয়ে গেলো। সম্ভবত বিকেলের দিকে আবার কানে ভেসে আসলো সেই আযানের সুর,”আল্লাহু আকবার,আল্লাহু আকবর”। এবার আযানের সুর ভেসে আসলে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হলে গেলাম কিছুক্ষণের মাঝেই হয়ত আমার দেহের নামাযের নোটিশ ঘোষণা করা হবেই। আমি চুপচাপ হয়ে ভাবছিলাম স্রস্টা আমাকে কেমন দোটানায় ফেলে দিলেন। তবে আর কী! স্রস্টার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তো আর যাওয়া যাবে না। অপেক্ষায় রইলাম শেষ নামাযের।

বিকেল গুড়িয়ে রাত নেমে আসলো। এবার চিন্তামুক্ত হয়ে বিশালাকার একটা নিঃশ্বাস ফেলে মায়ের কোলে চুপচাপ শুয়ে রইলাম। আপাতত শেষ নামাযের কথা ভুলে গেলাম। রাতের অন্ধকারে ঢেকে থাকা আকাশের নিচে মায়ের কোলে থাকতে-থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম বুঝতেই পারলাম না। সারারাত অতিবাহিত হলে ফজরের নামাজের পূর্বে মুয়াজ্জিন তার মধুর কন্ঠে বলতে লাগলো,”আসসলাতু খইরুম নিনান্নাউম”। ঘুম অপেক্ষা নামায উত্তম,ঘুম অপেক্ষা নামায উত্তম। আমিও সেই মধুমাখা সুরে উঠে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠেই মনে হয়ে গেলো আমার শেষ নামাযের কথা। না জানি কখন ঘোষণা করা হয়।

সকালের সূর্য উঠে গেলো। আমাকে মা বারান্দায় শুইয়ে দিলেন। চারিদিক থেকে নতুন সব অনুভূতি প্রকাশ পাচ্ছিলো। পৃথিবীতে আসার পর এই প্রথম আমি সকালের সুঘ্রাণ নিচ্ছি। কী সেই অনুভূতি তা প্রকাশ করার নয়। মুহুর্তের ভিতরে আবার সেই স্রস্টার কথা মনে হয়ে গেলো। না জানি কখন তিনি আমার উপর রাজি হয়ে যায়। ভাবতে ভাবতেই সকালের পর মাঝদুপুর এসে গেলো। মুয়াজ্জিনের কন্ঠে আবার সেই আযানের সুর ভেসে আসলো। ভয়ে-ভয়ে এবার নিশ্চিত হয়ে গেলাম হয়ত আমার দেহের নামাযের নোটিশ এবার ঘোষণা করা হবেই। প্রাণের ভয় কে না করে! চিৎকার করতে পারছি না তবে প্রচুর কান্না করছিলাম। আমার কান্নার শব্দে মাও চলে আসলেন আর আমায় থামাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকলো।

সেদিন দুপুর গুড়িয়ে বিকেল নেমে আসলো। আপাতত আমার বয়স একদিন পেড়িয়েছে। চিন্তামুক্ত হয়ে নিঃশ্বাস নিলাম আর আমার শেষ নামায এখন হবে না। এভাবে সপ্তাহ কেটে গেলো। সপ্তাহ কেটে যেতে-যেতেই কখন যে কয়েকটা মাস কেটে গেলো আমার জীবন থেকে তা বুঝতেই পারলাম না। একবার মনে হলো দুনিয়ার দিন অতিবাহিত হবার কারণে আমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে ঠিকই পরক্ষণে আমি যে আমার শেষ নামাযের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি তা বুঝতেই পারছি না।

দেখতে-দেখতে একবছর কেটে গেলো। এতক্ষণে ভুলেই গিয়েছি আমার শেষ নামাযের কথা। সব কিছু বাদ দিয়ে বড় হচ্ছি আর ফূর্তিবাজিতে নিজের জীবন অতিক্রম করছি। আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো কাটছে আমার জীবনের কাঁটা। শেষ নামাযের ভয়ে-ভয়ে থাকতে-থাকতে আপন স্রস্টাকেই ভুলতে যাচ্ছিলাম। দুনিয়ার জীবনে এসে দুনিয়ার মায়া আমার দেহে এতোটা মেখে গেলো যে তা আর ভাষায় প্রকাশ করার না। জীবনের শেষ নামাযের কথা আপাতত ভুলে গেলাম।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত