আধকপালী মাথাব্যাথা

আধকপালী মাথাব্যাথা

ওরিয়েন্টেশন এর পর আজকে ভার্সিটিতে নীরার দ্বিতীয় দিন।যতটা আনন্দ হবে ভেবেছিল তার কিছুই হচ্ছে না।যাকে দেখছে তাকেই মাস্টার্সে পড়ে বলে মনে হচ্ছে।আর সে সবে ফার্স্ট ইয়ার, হুহ।একটা ক্লাস হয়েছে।সবাই এদিক ওদিক ঘুরছে।নীরাও কয়েকজনের সাথে আছে তবে আকাশ পাতাল চিন্তায় ও আসলে কারও সাথেই নেই।হঠাৎ দূরে কয়েকটা ছেলের দিকে চোখ পড়ল নীরার।ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট এর সাথে লাগোয়া শিরীষ গাছের নীচে বসে আড্ডা দিচ্ছিল।গ্রীন টিশার্ট পড়া ছেলেটার মুখে নীরার চোখ আটকে গেলো।কিছুক্ষন কি একটা ভেবে পাঁচ ছয়জনের দলটার দিকে এগুতে লাগলো।নীরার বান্ধবীরা ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল।নীরা সোজা গ্রীণ টিশার্ট পড়া শ্যামলা ছেলেটার সামনে গিয়ে ব্যাকুল স্বরে জানতে চাইলো আপনার নাম শিঞ্জন?

নীরা একটা জারুল ফুল রং এর সালোয়ার কামিজ পড়ে আছে।পাটভাঙা সুতির ওড়না সোজা করে দেওয়া।পিঙ্গল বর্ণের চুলগুলো বেণী করে বাধা,তবু কিছু অবাধ্য চুল কপালে, গালে আলুথালু হয়ে পড়ে আছে।রোদের আলোয় ফর্সা গাল লাল রং পেয়েছে।ছেলেটা শিঞ্জন নাহলেও এমন রূপবতীর সামনে যেকোনো ছেলের শিঞ্জন হতে আপত্তি থাকার কথা নয়।নীরার উদ্বিগ্নতা ছেলেটাকে স্পর্শ করল না মনে হয়, সে বেশ গম্ভীরভাবে বলল,, হুম।আপনি? আপনার ছোট বোনের নাম তটিনী? হুম আপনার দেশের বাড়ি চাপাই? হুম ছোটবেলায় সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে বা পায়ে হাঁটুর নিচে ব্যাথা পেয়েছিলেন না- হুম শিঞ্জন এতই আবাক হয়েছে যে হুম ছাড়া বাকী সমস্ত ওয়ার্ড ও ভুলে গেছে।নীরা বিশ্বজয়ের হাসি হেসে বলল, আপনার গালের তিলটা কিন্তু আগের জায়গাতেই আছে,নামতে নামতে মুখ থেকে খসে পড়েনি।

শিঞ্জনের বিস্ময় যেন কাটছেই না! ওর বন্ধুরা ধাক্কা দিয়ে বলল, কি হু হু করছিস! তুই ও কিছু জিজ্ঞেস কর যেমন ওর খালার নাম মিলি কিনা, রান্নাবাটি খেলতে গিয়ে আঙুল কেটে ফেলেছিল কিনা Something like that সবাই হেসে উঠল।নীরার হুস হলো ও এতক্ষণ এতগুলো ছেলের সামনে এইসব প্রশ্ন করছিল, অস্বস্তিতে ছেয়ে গেল ওর মুখটা।দ্রুত সরে যেতে যেতে বলল, আচ্ছা আসি,ভালো থাকবেন। নীরা অনেকটা চলে গেলে শিঞ্জন বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল, এটা কি হল!! মেয়েটাতো মনে হয় অনেক জুনিয়র।তোরা এভাবে কেন বললি। বন্ধুদের মধ্যে থেকে ঝাকড়া চুলের বাহারওয়ালা ছেলেটা বলে উঠল কারন,তুই কিছুই বলছিস না। কিভাবে চিনিস মেয়েটাকে? আরে চিনি নাতো! অপরাধীর মতো বলল শিঞ্জন। বন্ধুরা একসাথে বলে উঠল, না চিনলে গিয়ে চেন,চলে গেল তো। আরে তাইতো, বলে শিঞ্জন নীরার চলে যাওয়ার দিকে তাকাল।ততক্ষণে নীরা নেই। প্রথমে একটু আফসোস হলো কিন্তু পরে ভাবলো আরে একই ভার্সিটি তো, খুঁজে পাওয়া কোন বিষয়ই না।

পরদিন বেলা বারোটার মধ্যে নীরার সমস্ত ডিটেইলস শিঞ্জন পেয়ে গেল।অবশ্য ডিটেইলসের প্রয়োজন ছিলনা। কেননা নীরা নামটা শোনার সাথে সাথেই ওর মনে পড়ে গেছে।নীরাকে ও চিনলো না,,কি আশ্চর্য!! মেয়েরা আসলেই শুয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হয়।পাঁচ বছরে এত পরিবর্তন যে চিনতেই পারলো না।এই মেয়েটার সাথে ও ছোট থেকে বড় হয়েছে।একদম পাশাপাশি বাসায় থাকত ওরা।বাইরের দিক থেকে আলাদা গেইট থাকলেও ভেতরের দিকে দুই ফ্যামিলি একই উঠান ব্যবহার করতো।নীরার কাঁঠালচাঁপা আর গন্ধরাজ গাছগুলো ওদের আঙ্গিনা পেরিয়ে শিঞ্জনদের আঙ্গিনায় চলে এসেছিল। একটায় নীরার ক্লাস শেষ হলো। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমেই দেখল শিঞ্জন দাঁড়িয়ে আছে।নীরা মাথা নিচু করে ফেলল।শিঞ্জন নীরার সামনে এসে কোনোরকম সংকোচ ছাড়াই বলল, ওদিকটায় চলো।

নীরা অবাক হয়ে তাকালো এরপর শিঞ্জনের পিছু পিছু যেতে লাগল।মনে মনে হাজারটা গালি দিচ্ছিল,নীরা। এই ছেলেটার কথা শুনছে কেন সে আর কেনইবা সে তার পিছুপিছু যাচ্ছে! কিছুদূর গিয়ে তারা একটা রঙ্গন গাছের নিচে থামল। অদ্ভুত সুন্দর ফুল ফোঁটে আছে গাছটাতে । এই রং এর রঙ্গন নীরা আগে দেখেনি।একছড়া ফুল ওর ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।শিঞ্জন বোধহয় বুঝতে পারলো।একটা বড় ঝোঁকা ছিঁড়ে নীরার দিকে ধরল। নীরা কিছু না ভেবেই ফুলগুলো হাতে নিল। কিছুক্ষনের জন্য শিঞ্জনের কথা ভুলে ফুলগুলো তে হাত বুলালো,গন্ধ নিলো,গালে ছোঁয়ালো। শিঞ্জন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।ও যেন আগের নীরাকে খোঁজে পাচ্ছে।হুম,এইতো সেই নীরা।ফুল নিয়ে এমন পাগলামি নীরা ছাড়া আর কে করবে? নীরার বাগানের গন্ধরাজ ছিঁড়লে কি রাগটাই না করতো। ফুলগুলোকে আদর করা শেষ হলে আমার দিকেও একটু তাকাও -শিঞ্জন কৌতুক করে বলল। নীরা চোখ তুলে তাকালো কিন্তু কিছু বলল না।

কালকে আমাকে আপনি করে বলছিলে যে- এমন প্রশ্নে নীরা কি বলবে ভেবে পেল না।এতদিন পরে দেখা হঠাৎ করে তুমি বলতে কেমন যেন লাগছিল।শিঞ্জন ভ্রু কুঁচকে বলল, আমার যতদূর মনে পড়ে তুমি আমাকে তুমি করেই ডাকতে। নীরার মাথায় যেন হঠাৎ উওর চলে এসেছে সে একটু হেসে বলল, আপনিও তো আমায় তুই করে বলতেন এখন তুমি বলছেন যে!! তুমি চাও আমি তুই করে বলি?কিছুটা হেসে বলল শিঞ্জন। নো নো নো।এখন শুনতে অড লাগবে। শিঞ্জন প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করল, ঢাকা কবে এসেছো? এইতো কিছুদিন আগে। শিঞ্জন বলার মতো আর কিছু খোঁজে পাচ্ছে না,উফ! অথচ এক সময় এই মেয়ের সাথে কথা বললে সময় কোন রাস্তা দিয়ে যেত টেরই পেতোনা। হঠাৎ করে শিঞ্জনের মুখটা ভয়ে ছেয়ে গেল। নীরা বোধহয় বুঝলো। জিজ্ঞেস করল,
কি হলো? অস্বস্তিগুলোকে একপাশে রেখে সে জিজ্ঞেস করলো,তোমার বাবার আধকপালী মাথাব্যাথা ভালো হয়েছে?

এই আধকপালী মাথাব্যাথার একটা কাহিনী আছে।নীরার বাবা আসলাম সাহেবের নীরাকে নিয়ে সবসময়ই একটা ভয় কাজ করতো।মেয়েটা সুন্দরী। শুধু সুন্দরী না কিছু মেয়ে আছে যাদের দেখলে প্রথমেই ঘটকালির কথা মাথায় আসে।নীরা সেইরকম সুন্দরী।মফস্বলের মতো একটা জায়গায় মেয়েকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকতেন ।এত ছোট মেয়েকে তো আর বিয়ে দেওয়া যায় না তবুও প্রস্তাব আসতো।উনি না করে দিতেন কিন্তু কিছু মানুষের নজর এড়াতে পারতেন না।চিন্তার পরিমাণ বেশি হলেই উনার আধকপালী মাথাব্যাথা উঠতো।তখন হাসতে হাসতে বলতেন, তোর বিয়ে না হলে এই ব্যাথা সারবে নারে নীরা! নীরার একটু সময় লাগলো কথাটা বুঝতে।বোঝার পর বলল, হুম হয়েছে।

শিঞ্জন অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।যেনো কথাটা হজম হচ্ছে না।ঢোক গিলে বলল, কবে হলো? গত মাসের আঠারো তারিখ। শিঞ্জন কি বলবে ভেবে পেলো না।ঘাসের উপর বসে পড়ল।নীরাও সামনাসামনি বসলো।মুগ্ধ দৃষ্টিতে ও তাকিয়ে আছে শিঞ্জনের দিকে।মানুষটা একটুও বদলায়নি।আজও কষ্ট পেলে আগের মতোই ধপ করে বসে পড়ে।কি পাগলামিটাই না করেছিল চাঁপাই ছেড়ে চলে আসার সময়।নীরার কথা শুনে কেমন হতভম্ব হয়ে গেছে।যেন পৃথিবীতে তার আর কিছু অবশিষ্ট নেই।এতই যখন দরদ পাঁচ বছর যোগাযোগ রাখেনি কেন?ফাজিল একটা।উচিত শিক্ষা হয়েছে।শিক্ষা সফরটা পাঁচ বছরের জন্য হলে ভালো হতো।শিঞ্জন হাসার চেষ্টা করে বলল,, কি করে সে? নীরা অবাক হওয়ার ভান করে বলল, কে?

শিঞ্জন দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলল,, আধকপালী মাথাব্যাথার ওষুধটা- নীরা বেশ মজা করে বলল, কি আর করবে মানুষের মাথায় চড়ে বসে থাকে। শিঞ্জন নিষ্প্রাণ গলায় বলল, মানে?আচ্ছা থাক বাদ দাও।ওষুধটা দেওয়ার আগে একবার ফোন তো করতে পারতে।নাম্বার তো ছিলই!!! নীরা মনে মনে বলল, আহারে! নিজে যেন রোজ দশবার করে ফোন করত। বদ ছেলেকে আরও কিছুক্ষন শাস্তি দিতে পারলে ভালো হতো।নীল হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে আর পারল না।আকাশ সমান অবাক হয়ে বলল, মাথাব্যাথার বাম লাগানোর জন্য আপনার পারমিশন নিতে হবে? শিঞ্জন রীতিমতো চিৎকার করে বলল, মানে? মানে ছোট ফুফু ইন্ডিয়া থেকে বামটা এনেছে।গত মাসের আঠারো তারিখ শেষ মাথাব্যাথা ছিল।এরপর মাথাব্যাথা শুরু হতে চাইলেই বাম থেরাপি। শিঞ্জন মুখটা হা করে মাথাটা এপাশ ওপাশ ঘুরালো।

নীরা দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,, পাঁচ বছর আগে বাবার আধকপালী মাথাব্যাথার ওষুধ হতে চেয়েছিলেন। এখন যদি আমার ফুলকপালী পাগলামীর ওষুধ হতে চান তাহলে একদম আমার সাথে যোগাযোগ করবেন না।সাবেক মাথাব্যাথাওয়ালার সাথে যোগাযোগ করবেন সরাসরি। বলেই নীরা হাঁটা ধরলো।নকশা করা কাপড়ের ব্যাগটা পিঠের ওপর ফেলে দুলতে দুলতে যাচ্ছে।যেনো তার মতো সুখী আর কেউ নেই। শিঞ্জন দুই হাত মেলে সবুজ ঘাসের ওপর শুয়ে পড়লো।হাতদুটো ভাজ করে মাথার নিচে দিয়ে ভাবলো,, মেয়েটাকে রোজ একগুচ্ছ গন্ধরাজ দিতে হবে।গন্ধরাজ ওর বড় প্রিয়।।।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত