১৬. ঐ ঘটনার চারদিন পরে
ঐ ঘটনার চারদিন পরে।
অরূপ থানায় তার অফিস-ঘরে বসেছিল, বেলা তখন সকাল দশটা হবে।
হাতে ধরা একটা ভাঁজকরা সংবাদপত্র। শমিতা এসে অফিস-ঘরে ঢুকল।
আপনিই তো এ থানার ও.সি. মিঃ মুখার্জী?
হ্যাঁ মিস সান্যাল, আসুন।
কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন আমি নিরুদিষ্ট বলে, কি ব্যাপার? এসবের অর্থ কি?
বসুন মিস সান্যাল।
না! আমি বসতে আসিনি। কাগজে বিজ্ঞাপন দেবার উদ্দেশ্যটা জানতে এসেছি। বলুন কি ব্যাপার?
কিরীটী রায়ই আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন, কারণ তাঁরই নির্দেশে ডি.সি. বিজ্ঞাপনটা দিয়েছিলেন?
বেশ, আমি তাহলে তাঁর কাছেই যাচ্ছি।
যেতে হবে না, আমি তাঁকে ফোনে ডাকছি। বসুন আপনি।
না। আমি সেখানেই যাচ্ছি।
বসুন, বসুন–ব্যস্ত হবেন না মিস সান্যাল। মনে হচ্ছে বিজ্ঞাপনটা কাগজে দেওয়ায় আপনি একটু ক্ষুব্ধ হয়েছেন!
তা যদি হয়েই থাকি, খুব অন্যায় হয়েছে কি? কোথায় কে খুন হয়েছে সেই ব্যাপারের সঙ্গে একজন ভদ্রমহিলাকে জড়িয়ে কাগজে কাগজে ঐ ধরনের বিজ্ঞাপন দিলে সেটার অর্থ যে কি দাঁড়ায় নিশ্চয়ই সেটা আপনাকে বুঝিয়ে দিতে হবে না?
নিশ্চয়ই না।
হঠাৎ কিরীটীর কণ্ঠস্বর শুনে যুগপৎ দুজনেই দরজার দিকে ফিরে তাকাল।
মিঃ রায়! আপনি এসে গেছেন ভালই হল। আমি আপনাকে আসবার জন্য ফোন করার। কথা ভাবছিলাম। অরূপ বলে।
হ্যাঁ, কিছুক্ষণ আগে অমলেন্দুবাবুর ফোনে জানতে পারলাম শমিতা দেবী তাঁর কাছেই আছেন, তাই এসেছিলাম অরূপ তোমাকে নিয়ে তাঁর ওখানে যাব বলে, তা দেখছি উনি নিজেই এসে গেছেন। কিন্তু মিস সান্যাল, আপনি দাঁড়িয়ে কেন, বসুন। কিরীটী বলল।
না। বসবার কোন প্রয়োজন নেই। আপনি কেন বিজ্ঞাপন দিয়েছেন সেটা জানতে পারলেই আপাতত খুশি হব। একটু যেন কঠিন কণ্ঠেই কথাগুলো বলে শমিতা।
আপনি তাহলে বিজ্ঞাপনটা দেখেই এসেছেন? কিরীটী শুধায় শমিতাকে।
হ্যাঁ। নচেৎ আপনি কি মনে করেন সোস্যাল ভিজিট দিতে এসেছি থানায়?
নিশ্চয়ই না। কিন্তু বিজ্ঞাপনটা তত দিন তিনেক হল বের হয়েছে। আপনি তাহলে আরও আগে আসেননি কেন জানতে পারি কি?
সে প্রশ্নের জবাব আমি দিতে প্রস্তুত নই।
বেশ, দেবেন না। কিন্তু প্রশ্নটা স্বাভাবিক বলেই করেছিলাম।
বাজে কথা রেখে এখন বলুন কেন বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন? আপনি কি মনে করেন আমিই সে রাত্রে গগনবিহারীকে হত্যা করেছি?
যদি সেটা ভাবিই তাহলে কি খুব অন্যায় হবে মিস সান্যাল? শান্ত গলায় কিরীটী উচ্চারণ করল।
কিরীটীর স্পষ্টোক্তিটা হঠাৎ যেন শমিতাকে স্তব্ধ করে দেয়। শমিতা কয়েক সেকেন্ড কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, আই সী! তা হঠাৎ আমাকে সন্দেহ করলেন কেন জানতে পারি কি?
প্রথমতঃ আপনি পুলিসের কাছে যে জবানবন্দি দিয়েছেন সেদিন এবং আমাকেও যা বলেছেন সেটা অকপট সত্য নয়।
মানে?
মানে আপনি খুব ভালভাবেই সেটা জানেন এবং দ্বিতীয়তঃ আপনার হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া–
নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছি এ ধারণা আপনার হল কেন?
ব্যাপারটা সাদা চোখে বিচার করতে গেলে তাই কি মনে হয় না? ভয় পেয়ে আপনি হঠাৎ গা–ঢাকা দিয়েছিলেন?
গা-ঢাকা দিয়েই যদি থাকি, নিশ্চয়ই তাহলে আজ নিজে এখানে আসতাম না!
যাক সে-কথা। কয়েকটা প্রশ্নের আমার জবাব দেবেন কি?
কি প্রশ্ন?
এক নম্বর, সেরাত্রে মানে দুর্ঘটনার রাত্রে, আপনি রাত পৌনে দশটা নাগাদ মরালী সংঘ থেকে বের হয়ে কোথায় গিয়েছিলেন?
কোথায়ও আমি বের হইনি ঐ সময়, বের হয়েছিলাম রাত সাড়ে বারোটায়।
না। পৌনে দশটায় বের হয়ে আবার রাত বারোটা নাগাদ আপনি ক্লাবে ফিরে যান। এবং সে প্রমাণও আমাদের হাতে আছে।
প্রমাণ?
হ্যাঁ। আপনি ব্যারিস্টার সত্যেন ঘোষালের গাড়ি চেয়ে নিয়ে, বিশেষ কাজ আছে একটু–বলে রাত পৌনে দশটা নাগাদ ক্লাব থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। ক্যান ইউ ডিনাই ইট?
শমিতা যেন হঠাৎ কেমন স্তব্ধ হয়ে যায়। বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিরীটীর মুখের দিকে।
বলুন? কোথায় গিয়েছিলেন সে রাত্রে?
বাড়িতে গিয়েছিলাম একটা জরুরী কাগজ আনতে ক্লাবের–
আবার সত্য গোপন করছেন! আপনি যে কোথায় গিয়েছিলেন আমি জানি।
কোথায়? কেমন যেন থতমত খেয়ে কথাটা উচ্চারণ করল শমিতা।
গগনবিহারীর ওখানে।
ইটস্ এ ড্যাম লাই!
না–ইটস্ এ ফ্যাক্ট। এবং সুবিনয়বাবু আপনাকে দেখেছেন। বলুন কেন গিয়েছিলেন?
আমি যাইনি।
গিয়েছিলেন। নাউ টেস্ মি হোয়াই?
হ্যাঁ, গিয়েছিলাম।
জানি। কিন্তু কেন? সাতদিন পরে হঠাৎ কেন গিয়েছিলেন তাঁর কাছে?
গগনবাবু আমাকে ক্লাবে ফোন করেছিলেন বিশেষ কারণে একবার দেখা করার জন্য।
দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে?
না!
কেন?
আমি ঘরে ঢুকে দেখি—
কি?
হি ওয়াজ ডেড। সারা মেঝেতে রক্ত।
আমারও অনুমান তাই। কিন্তু সত্যি কথাটা যদি সেদিন বলতেন তবে হয়ত কটা দিন আমাদের অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতে হত না। হত্যাকারীকে আগেই স্পট আউট করা সম্ভবপর হত।
আপনারা বিশ্বাস করবেন না তাই বলতে সাহস পাইনি।
হুঁ। আচ্ছা এবারে বলুন, গগনবাবু যে সমস্ত সম্পত্তি উইল করে আপনাকে দিতে মনস্থ করেছিলেন তা আপনি জানতেন, তাই না?
জানতাম। কারণ ঐ লম্পটটা আমাকে ঐ সম্পত্তির লোভ দেখিয়ে—
বিয়ে করতে চেয়েছিলেন বোধ হয়?
না।
তবে? হি ওয়ানটেড টু এজয় মি। আর সেটা বুঝতে পেরেই—
ঝগড়া করে বের হয়ে এসেছিলেন সাতদিন আগে!
হ্যাঁ।
আর সুবিনয়বাবু?
সুবিনয়!
হ্যাঁ। তাঁর আপনার প্রতি দুর্বলতা ছিল, না?
হি ইজ অ্যান ইমবেসাইল ফুল, একটা নীরেট গর্দভ। দুটো হেসে কথা বলতাম বলে তার ধারণা হয়ে গিয়েছিল তার প্রেমে আমি মজে গিয়েছি।
আর সত্যেন ঘোষাল?
হি ইজ এ গুড ফ্রেন্ড অফ মাইন।
তাঁর প্রতি আপনার কোন দুর্বলতা ছিল না?
কোনদিনও না। আর কিছু আপনার জানবার আছে?
আছে।
আর কি জানতে চান বলুন?
সেকথা জিজ্ঞাসা করবার আগে আপনাকে নিয়ে একবার গগনবাবুর বাড়িতে আমরা যেতে চাই।
গগনবিহারীর ওখানে! বা হোয়াই? কেন?
সবার সামনে একটা মোকাবিলা হওয়া আমাদের সকলেরই প্রয়োজন, তাই—
মোকাবিলা! কিসের?
সেখানে গেলেই সব জানতে পারবেন। আপত্তি আছে?
না। চলুন।
এখন নয়।
তবে কখন?
আজ রাত ঠিক দশটায়।
রাত দশটায়?
হ্যাঁ। আসতে পারবেন না?
পারব। কিন্তু—
বলুন?
আপনি কি এখনও আমার কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না?
না পারলে নিশ্চয়ই এখন আপনাকে ছেড়ে দিতাম না আমরা। আর আপনাকে আটকাব না, এখন আপনি যেতে পারেন।
শমিতা বের হয়ে যাচ্ছিল, কিরীটী পশ্চাৎ থেকে আবার ডাকল, একটা কথা শমিতা দেবী– বলুন?
অমলেন্দুবাবুকেও সঙ্গে নিয়ে আসবেন।
কেন? তাকে দিয়ে কি হবে?
আপনারা দুজনেই জানেন আপনারা পরস্পর কেউ আপনাদের এখনও ভুলতে পারেন নি। ভুল-বোঝাবুঝি যদি একটা অতীতে হয়েই থাকে সেই ভুলটারই জের টেনে চলতে হবে বাকী জীবনটা তারই বা কি মানে আছে!
শমিতা আর কোন জবাব দেয় না। মাথা নীচু করে বার হয়ে যায়।
শমিতা ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাবার পর কিরীটী বললে, সত্যি অরূপ, যোগজীবনবাবুর কাছে যেন আমি নিজেকে অত্যন্ত অপরাধী বোধ করছিলাম ঘটনাচক্রে ব্যাপারটার সঙ্গে আকস্মিক ভাবে জড়িয়ে যাওয়ায়।
আপনি কি জানতেন যে শমিতা দেবী হত্যাকারী নয়?
জানতাম।
জানতেন?
জানতাম বৈকি। নচেৎ প্রথম দিনই তোমাকে বলতাম্ ওকে গ্রেপ্তার করার জন্য।
কিন্তু জানলেন কি করে যে উনি সে-রাত্রে গগনবিহারীর ঘরে গিয়েছিলেন?
মনে পড়ে তোমার, মৃতের হাতে এক টুকরো কাচের চুরি পেয়েছিলাম?
মনে আছে বৈকি।
সেই ভাঙা কাচের চুড়ির টুকরো ও শমিতা দেবীর ডান হাতের কজীতে প্লাস্টার দিয়ে ঢাকা গোপন ক্ষতচিহ্নটাই আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল সেরাত্রে শমিতা দেবী গগনবিহারীর ঘরে গিয়েছিল।
কাচের চুড়িটা যে ওর হাতেই ছিল তার প্রমাণ কি?
যোগজীবনবাবুই বলেছিল, দুর্ঘটনার দিন দুই আগে শমিতার এক বান্ধবী কাশী থেকে কিছু কাচের চুড়ি এনে ওকে দেয়। সেগুলো তার হাতেই ছিল। অবিশ্যি প্রশ্ন করে সংবাদটা আমাকে সংগ্রহ করতে হয়েছে যোগজীবনবাবুর কাছ থেকে।
কিন্তু তাই যদি হয় তো শমিতা দেবী যা বলে গেলেন তা কেমন করে সত্য হয়? উনি তো ঘরে ঢুকে তাঁকে মৃত দেখেছিলেন!
না–দেখেনি।
তবে?
গগনবিহারী তখনও বেঁচেই ছিলেন। এবং আমার অনুমান যদি মিথ্যে না হয় তো—
কি?
তার উপস্থিতিতেই গগনবিহারী নিহত হন।
তবে নিশ্চয়ই শমিতাদেবী হত্যাকারীকে দেখেছিলেন সে–রাত্রে?
সম্ভবত দেখেনি।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না, কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে মিঃ রায়।
সব অন্ধকার দূর হয়ে যাবে আজ রাত দশটায়। যে ঘরে হত্যা হয়েছিল সেই ঘরেই হত্যাকারীকে আমার ধারণা আজ রাত্রে আমরা খুঁজে পাব। যা হোক, তুমি কিন্তু প্রস্তুত হয়ে যেও অরূপ।
যাব। কিন্তু—
আর কিন্তু নয় রাত দশটায় আজ। চলি এখন।
কিরীটী উঠে পড়ল।
আগের পর্ব :
০১. বাড়িটা তৈরি হয়েছিল
০২. নীচের তলায় দুটো ঘরে
০৩. প্রায় মিনিট দশ-পনেরো লাগে
০৪. যোগজীবন যখন ফোনটা পেলেন
০৫. মৃতদেহ পরীক্ষান্তে অরূপ মুখার্জী
০৬. কিরীটী সুবীরের কথায় মৃদু হাসল
০৭. মৃতদেহ মর্গে পাঠিয়ে
০৮. যোগজীবনবাবু বাইরের ঘরেই বসেছিলেন
০৯. রাত্রি তখন প্রায় সোয়া নটা
১০. শমিতা বাড়ি থেকে বের হয়ে
১১. ঘরে পা দিয়ে থমকে দাঁড়ায় সর্বাণী
১২. আঠার নম্বর ফ্ল্যাট
১৩. সুবীর যেন হাঁপিয়ে ওঠে
১৪. সুবীর বলে ওঠে ঐ সময়
১৫. কিরীটী আর অরূপ দোতলায় উঠে
পরের পর্ব :
১৭. সেই গগনবিহারীর গৃহে
১৮. রুক্মিণীর যৌবন