১৫. কিরীটী আর অরূপ দোতলায় উঠে
কিরীটী আর অরূপ দোতলায় উঠে গগনবিহারীর শয়নঘরটার তালা খুলে প্রবেশ করল। ঘরটাতে সেই দিন থেকেই তালা দেওয়া ছিল। ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটী দাঁড়িয়ে পড়ে। ঘরের আলোটা জ্বলছে।
অরূপ দেখতে পায়নি আলোটা। বুঝতে পারেনি কারণ ঘরে জানলায় জানলায় পদা টাঙানো থাকলেও পিছনের কাচের সাসী দিয়ে যে আলো পদা ভেদ করে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করছিল। সেটা পযাপ্ত।
কি ব্যাপার মিঃ রায়?
ঘরের আলোটা জ্বলছে—
তাই তো!
সেদিন এনকোয়ারীর শেষে যখন ঘরে তালা-বন্ধ করে যাও, আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যাওনি অরূপ?
গিয়েছিলাম তো। আমি নিজে নিভিয়ে দিয়েছি ঘরের আলো।
কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে মৃদু কণ্ঠে বললে, গত দুদিনের মধ্যে ঘরে কেউ এসেছিল–
আপনার তাই মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ। এবং যে এসেছিল সে তাড়াতাড়িতে আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছে।
কে? কে আসতে পারে?
কিরীটী অরূপের প্রশ্নের কোন জবাব না নিয়ে ঐ শয়নঘর থেকে পাশের ঘরে যাবার জন্য মধ্যবর্তী দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল। দরজাটা বন্ধ। দরজার কপাটে হাত দিয়ে ঠেলল কিরীটী। কিন্তু খুলতে পারল না।
ভিতরের দিককার ছিটকিনিটা আটকানো।
কিরীটী ঘরে দাঁড়িয়ে ডাকল, অরূপ!
বলুন?
সেদিন যাবার সময় এই দরজার ছিটকিনিটা কি তুলে দিয়ে গিয়েছিলে?
ঠিক মনে পড়ছে না। অরূপ বলে।
সম্ভবত দাওনি। মনে হচ্ছে এটা খোলাই। দেখা যাচ্ছে দরজাটার দুদিক থেকেই আটকাবার ব্যবস্থা আছে। তুমি পাশের ঘরে গিয়ে ওপাশ থেকে দরজাটা খুলে দাও তো।
অরূপ চলে গেল। একটু পরেই ছিটকিনি নামাবার শব্দ হল অন্য ঘর থেকে এবং দরজাটা খুলে গেল।
পাশের ঘরটাই গগনবিহারীর বসবার ঘর।
বসবার ঘরের দরজাটা খোলাই ছিল।
এখন বুঝতে পারছ অরূপ, কাল বা পরশু কোন একসময় রাত্রে কেউ গগনবাবুর শোবার ঘরে ঢুকেছিল!
মৃদু গলায় কতকটা যেন আত্মগতভাবেই কথাগুলো বললে কিরীটী।
রাত্রে এসেছিল?
হ্যাঁ, এ ঘরের আলোটাই তার সাক্ষী।
কথাটা বলতে বলতে কিরীটী আবার মধ্যবতী দরজাপথে শয়নঘরে এসে ঢুকল। অরূপও ওর পিছনে পিছনে আসে।
অরূপ?
বলুন?
ঐ আলমারির চাবিটা কোথায়?
সেদিন তো কোন চাবি পাইনি।
গগনবিহারীর আলমারি ওয়াড্রোব ও দরজার চাবি নিশ্চয়ই ছিল?
থাকাই তো উচিত।
তবে পাওনি কেন?
চাবির ব্যাপার সকলকেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিন্তু কেউ বলতে পারল না।
সুবীর ও সুবিনয়বাবুকে জিজ্ঞাসা করেছিলে? তাঁরা কি বলেন?
সুবীরবাবু বলেছিলেন, গগনবিহারী নাকি তাঁর চাবির রিংটা সর্বদা নিজের কাছেই রাখতেন। হি ওয়াজ ভেরি পাটিকুলার অ্যাবাউট হিজ কীজ।
তবে চাবির রিংটা কি হল?
তারপর একটু থেমে বলে, চাবির রিংটা যে পাওয়া যায়নি তা তো তুমি আমাকে বলনি অরূপ?
তদন্তের রিপোর্টে অবিশ্যি নোট করা আছে ডাইরীতে–তবে আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।
এখন তাহলে মনে হচ্ছে চাবিটা যে সরিয়েছিল সে-ই কাল বা পরশু কোন এক সময় রাত্রে এই ঘরে এসেছিল। ভাল কথা, আর একটা খবর শুনেছ?
কি?
গত পরশু রাত থেকে শমিতা দেবী নিরুদ্দিষ্ট!
সে কি, কে বলল?
তাঁর দাদা যোগজীবনবাবু।
কিরীটী অতঃপর সেরাত্রের ঘটনাটা সংক্ষেপে বলে গেল।
মিঃ রায়!
বল?
আচ্ছা ঐ শমিতা দেবীই কি–সেরাত্রে—
গগনবিহারীকে হত্যা করেছে কিনা জানি না, তবে এটা ঠিক সেরাত্রে কোন এক সময় শমিতা দেবী এই ঘরে এসেছিল।
কিন্তু তিনি তো ভেইমেন্টলি–
অস্বীকার করেছেন। ঠিকই। তাহলেও যে প্রমাণ সে রেখে গিয়েছিল ঘরে এবং যে প্রমাণ সে তার দেহে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল–সেই দুটোর যোগফল যে দুয়ে দুয়ে চার সেটা তো আর অস্বীকার করতে পারবে না! কিন্তু কথা হচ্ছে, কখন এসেছিল সে? কত রাত্রে? এবং তখন আর কেউ এ ঘরে ছিল কিনা? শোন অরূপ, শমিতা দেবীকে আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে–যেমন করেই হোক।
যদি কলকাতা ছেড়ে তিনি চলে গিয়ে থাকেন?
না, তা যায়নি। আর যাবেও না আমার ধারণা। অন্ততঃ গগনবিহারীর মৃত্যুর ব্যাপারটার উপর একটা সমাপ্তির যবনিকা না নেমে আসছে যতক্ষণ।
গগনবাবুর বন্ধু মানে ঐ যোগজীবনবাবু–ওর দাদা কি বলছেন?
তিনি কিছুই বলতে পারছেন না। কেকে ওখানে? কথাটা বলতে বলতে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে দুই ঘরের মধ্যবর্তী আধভেজানো দরজাটার দিকে ছুটে যায়, দড়াম করে ঠেলে দরজাটার কপাট দুটো খুলে ফেলে কিরীটী। চকিতে একটা রঙিন বস্ত্র যেন মনে হল পাশের ঘরের বাইরে। যাবার দরজাপথে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কিরীটী ছুটে যায় সেই দরজাটার দিকে এবং চেঁচিয়ে ওঠে, রুক্মিণী!
রুক্মিণী দাঁড়াল না। সে তার ঘরে ঢুকে গেল। রুক্মিণীর অপস্রিয়মাণ শাড়ির অঞ্চলপ্রান্তটা অরূপেরও নজরে পড়ল। কিরীটী এগিয়ে গেল রুক্মিণীর ঘরের দিকে–কারণ বসবার ঘরের পরের ঘরটাই রুক্মিণী ও রামদেওর ঘর।
রুক্মিণী তাড়াতাড়িতে দরজাটা বন্ধ করতে পারেনি। কিরীটী খোলা দরজাপথে রুক্মিণীর ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে অরূপও। দুজনেই দেখতে পেল শয্যার উপর রুক্মিণী শুয়ে, চোখে-মুখে আঁচল চাপা। তার বুকের কাছটা ঘন ঘন আন্দোলিত হচ্ছে।
কিরীটী নিঃশব্দে মুহূর্তকাল শায়িত রুক্মিণীর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় ডাকল, রুক্মিণী!
রুক্মিণী সাড়া দেয় না।
রুক্মিণী, উঠে বস। হিন্দীতেই কিরীটী বলে, আমি জানি তুমি জেগে–উঠে বস।
শির মে বহুৎ দরদ বাবুজী। কোঁকাতে কোঁকাতে রুক্মিণী বলে। ওঠে না–চোখও মেলে
না।
ওঠ–ওঠ বলছি!
কিরীটীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠের নির্দেশে রুক্মিণী আর শুয়ে থাকে না। উঠে বসে খাটের উপর। ঐ ঘরটাও বেশ সাজানো–গোছানো।
একপাশে একটা কাঠের আলমারি, দেওয়ালে একটা প্রমাণ-আরশি। বড় সাইজের একটা খাট। একটা আলনা। তার উপরে শাড়ি ও জামা ভাঁজ করা। গোটা-দুই প্যান্ট ও শার্টও আছে। একটা স্টীলের ট্রাঙ্ক।
কেয়া বাত বাবুজী! কোঁকাতে কোঁকাতে রুক্মিণী আবার বলে।
পাশের ঘরে গিয়েছিলে কেন?
হায় রাম! আমি তো শুয়েছিলাম শির দরদ করছিল বলে। আমি তো যাইনি।
মিথ্যে কথা বলে কোন লাভ নেই। বল, কেন গিয়েছিলি?
হায় রাম! সচ্ বলছি বাবুজী—
যাসনি তুই?
গঙ্গামাঈকি কসম বাবুজী—
চাবিটা কোথায়?
চাবি?
হ্যাঁ। তোর সাহেবের আলমারির চাবি। কোথায় আছে বের করে দে।
সে হামি কি জানি?
তোর কাছেই আছে। বের কর। নাহলে দারোগা সাহেব এখুনি তোকে থানায় ধরে নিয়ে যাবে।
রুক্মিণী চুপ করে থাকে।
অরূপ যাও, নীচে যে সেপাই পাহারায় আছে তাকে আন। ওকে থানায় নিয়ে গিয়ে হাজতঘরে বন্দী করে রাখ।
রুক্মিণী তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে, কেন বাবুজী–হামার কি কসুর হল?
তুই তোর সাহেবের আলমারির চাবি চুরি করেছিস।
না।
আবার ঝুট বলছিস?
নেহি–ঝুটু নেহি—
ওর ঘরটা সার্চ কর তো অরূপ!
পাওয়া গেল না। রুক্মিণীর ঘরের সবকিছু তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোন চাবি পাওয়া গেল। কিন্তু চাবি না পাওয়া গেলেও, রুক্মিণীর ট্রাঙ্কের মধ্যে বেশ ভারি ওজনের একজোড়া সোনার বালা, কিছু দামী প্রসাধন দ্রব্য, গোটা–দুই দামী শাড়ি ও একটা ছোট টিনের কৌটোর মধ্যে পাওয়া গেল একশো ও দশ টাকার নোট মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজারের মত টাকা।
ঐ টাকা কার? কিরীটী প্রশ্ন করে।
হায় রাম! কার আবার–আমার!
তুই তো মাইনে পেতিস না–অত টাকা তুই কোথায় পেলি?
আমি–আমি কেমন থতমত খায় রুক্মিণী।
বল, কোথায় পেলি? তোর সাহেব তোকে দিয়েছিল–তাই না?
না। রামদেও আমার মরদ—
আবার ঝুটু বলছিস! সাহেবের সঙ্গে তোর গোপন আশনাই ছিল–-সাহেব তোকে দিয়েছে।
রুক্মিণী চুপ।
শোন, এখনও সব কথা খুলে বলনা হলে এখুনি তোকে থানায় পাঠাব।
গঙ্গামাঈকী কসম–আমি কিছু জানি না বাবুজী। তোর গোড় লাগি—
রামদেও–তোর মরদ কোথায়?
কেমন করে জানব?
তুই জানিস সে কোথায়?
না, জানি না।
রামদেওর কোন ফটো আছে?
আছে। ছিল তো ঐ ট্রাঙ্কের মধ্যে।
কোথায়? তোর বাক্সের মধ্যে তো পাওয়া গেল না?
তবে আমি জানি না।
ঠিক আছে। অরূপ ওকে নিয়ে গিয়ে হাজতে রাখ। আর খবরের কাগজে রামদেও ও শমিতার নামে বিজ্ঞাপন দাও তাদের বর্ণনা দিয়ে।
রুক্মিণী চেঁচামেচি কান্নাকাটি শুরু করে দেয়, তাকে যখন গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সুবীর আর সুবিনয় এসে সিঁড়ির নীচে দাঁড়ায়।
সুবীর জিজ্ঞাসা করে, ওকে অ্যারেস্ট করলেন নাকি দারোগাবাবু?
হ্যাঁ। অরূপ জবাব দেয়।
আপনাকে আগেই বলেছিলাম, ও মাগীই যত নষ্টের গোড়া। সুবীর বলে।
সুবিনয় কিন্তু কোন কথা বলে না।
সে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
আগের পর্ব :
০১. বাড়িটা তৈরি হয়েছিল
০২. নীচের তলায় দুটো ঘরে
০৩. প্রায় মিনিট দশ-পনেরো লাগে
০৪. যোগজীবন যখন ফোনটা পেলেন
০৫. মৃতদেহ পরীক্ষান্তে অরূপ মুখার্জী
০৬. কিরীটী সুবীরের কথায় মৃদু হাসল
০৭. মৃতদেহ মর্গে পাঠিয়ে
০৮. যোগজীবনবাবু বাইরের ঘরেই বসেছিলেন
০৯. রাত্রি তখন প্রায় সোয়া নটা
১০. শমিতা বাড়ি থেকে বের হয়ে
১১. ঘরে পা দিয়ে থমকে দাঁড়ায় সর্বাণী
১২. আঠার নম্বর ফ্ল্যাট
১৩. সুবীর যেন হাঁপিয়ে ওঠে
১৪. সুবীর বলে ওঠে ঐ সময়
পরের পর্ব :
১৬. ঐ ঘটনার চারদিন পরে
১৭. সেই গগনবিহারীর গৃহে
১৮. রুক্মিণীর যৌবন