প্রজাপতি রঙ: ১১-১৫. আপনি আবার কষ্ট করে এলেন

প্রজাপতি রঙ: ১১-১৫. আপনি আবার কষ্ট করে এলেন

১১-১৫. আপনি আবার কষ্ট করে এলেন

আপনি আবার কষ্ট করে এলেন কেন? সাবিত্রী বলে, একাই অনায়াসে আমি চলে যেতে পারতাম।

তা পারতেন, তবে এত রাত্রে এ পথটা খুব ভাল নয়। মিলের ওয়ার্কাররা এই সময়টা মদ খেয়ে ফেরে অনেকেই।

দুজনে পাশাপাশি হাঁটছিল।

সাবিত্রী আবার মাথায় গুণ্ঠন তুলে দিয়ে আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিল।

খুব শীত পড়েছে। সুদর্শন হাঁটতে হাঁটতে একসময় বলে।

সাবিত্রী সুদর্শনের কথার কোন জবাব দেয় না।

আচ্ছা সাবিত্রী–

হঠাৎ যে কেন সুদর্শন সাবিত্রীকে তুমি বলে সম্বোধন করে, নিজেও বুঝি বুঝতে পারে না।

বলুন?

তোমার দিদির কোন শত্রু ছিল বলে তোমার মনে হয়?

শত্রু?

হ্যাঁ।

না, তেমন তো কোন কিছু শুনিনি। তবে মনে হয় আমার, হীরু সাহার দিদির ওপর একটা আক্রোশ ছিল হয়ত!

কেন? আক্রোশের কারণ ছিল কি?

ছিল—

কি?

দিদিকে হীরু সাহা একসময় বিয়ে করতে চেয়েছিল, কিন্তু দিদি flatly তাকে না করে দিয়েছিল।

তারপর?

সেই ব্যাপার নিয়ে দাদার সঙ্গে শুনেছি হীরু সাহার কথা-কাটাকাটি হয়েছিল।

পল্লীতে আর কারও কোন রকম তার প্রতি আক্রোশ ছিল না?

না। তাছাড়া আগেই তো আপনাকে বলেছি, দিদি অত্যন্ত বেপরোয়া আর দুঃসাহসী ছিল, কেউ আর থাকলেও দিদি কখনও বলেনি সে কথা আমাকে।

তোমার দাদাদের সঙ্গে দিদির সম্পর্ক কেমন ছিল?

দাদা দিদিকে দেখতে পারত না এতটুকু, ঠেস দিয়ে ছাড়া কথাই বলত না কখনও। দিদি অবিশ্যি কখনও কোন জবাব দেয়নি।

আর ছোড়দা?

ছোড়দা একটু বেশি রাগী হলেও দিদির সঙ্গে ভাল ব্যবহারই করত।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ। মধ্যে মধ্যে টাকার দরকার হলে দিদির কাছেই যে তাকে হাত পাততে হত!

কেন? সে তো শুনেছি ভালই রোজগার করে!

করলে কি হবে, অত বাবুয়ানী করলে আর মদ খেলে টাকা থাকবে কোথা থেকে!

তোমার ছোড়দা ফিরেছে?

যখন বাড়ি থেকে বের হই তখনও আসেনি—

কাল যেন বাড়িতেই থাকে, আমি না যাওয়া পর্যন্ত—বোলো তাকে।

বেশ, বলব। কিন্তু—

যদি না ফিরে এসে থাকে, তবেই তো। না এলে আর কি করবে!

না, তা নয়—বলছিলাম, আর আপনাকে আমার সঙ্গে আসতে হবে না। আমি তো বাড়ির কাছে প্রায় এসেই গেছি, এবার একা-একাই আমি বাকি পথটুকু চলে যেতে পারব।

সুদর্শন বুঝতে পারে, সাবিত্রীর ইচ্ছা নয় সে আর তার সঙ্গে যায়।

সুদর্শন দাঁড়িয়ে গেল, বললে, বেশ, যাও।

সাবিত্রী পল্লীর দিকে এগিয়ে গেল। সুদর্শন কিন্তু তারপরও অনেকক্ষণ সেইখানেই পথের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকে। সাবিত্রীর চলমান দেহটা ক্রমে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল একসময়।

চারদিকে একটু অদ্ভুত স্তব্ধতা। রাতের আকাশ থেকে নিঃশব্দে যেন শীতের হিম ঝরে পড়ছে। কোথায় যেন একটা কুকুর ডেকে উঠল। ধীরে ধীরে একসময় থানার পথে ফিরল সুদর্শন।

কয়েক পা অগ্রসর হতেই কানে এল একটা ক্ষীণ গানের সুর। কে যেন গান গাইতে গাইতেই পল্লীর দিকে এগিয়ে আসছে। ক্ষীণ হলেও গানের সুর ও কথাগুলি স্পষ্ট শুনতে পায় :

এত জল তোর কাজল চোখে পাষাণী আনলে বল্ কে—

সুদর্শন দাঁড়ায়।

গানের কথাগুলো কিছুটা যেন জড়ানো-জড়ানো। ক্রমশ গানের সুর আরও স্পষ্ট হয়। ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসে।

পরনে লংস ও গায়ে হাওয়াই শার্ট, মাথায় ও গলায় একটা কম্ফটার জড়ানো কে একজন গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছে, আবছা-আবছা দেখতে পায় সুদর্শন। এবং প্রায় আসতে আসতে হঠাৎ বোধ হয় সুদর্শনকে দেখতে পেয়েই ওর হাত দুয়েক ব্যবধানে দাঁড়িয়ে পড়ে।

ঝাপসা ঝাপসা চাঁদের আলোয় সুদর্শন দেখতে পায়, লোকটা পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করল। প্যাকেটে বোধ হয় একটাই সিগারেট অবশিষ্ট ছিল। সিগারেটটা মুখে দিয়ে পকেট হাতড়ে একটা দেশলাই বের করল। তারপর দুটো কাঠি জ্বালাবার চেষ্টা করল, কিন্তু একটাও জ্বলল না। আর কাঠি অবশিষ্ট ছিল না বোধ হয় দেশলাইয়ের বাক্সে।

বিরক্ত চিত্তে শূন্য দেশলাইয়ের বাক্সটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে দিতে বললে, লে বাবা, ফিনিশ!

হঠাৎ ওইসময় সামনে দণ্ডায়মান সুদর্শনের দিকে নজর পড়ায় ওর দিকে তাকাল এবং বললে, ম্যাচিস আছে নাকি স্যার?

সুদর্শন পকেট থেকে তার দেশলাইটা বের করে কয়েক পা এগিয়ে এসে লোকটির দিকে এগিয়ে ধরল।

.

১২.

লোকটি দেশলাইটা হাতে নিয়ে একটা কাঠি জ্বালিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে নিয়ে দেশলাইটা ফিরিয়ে দিয়ে জড়িত কণ্ঠে বললে, থ্যাঙ্কস!

ক্ষণপূর্বে দেশলাই-কাঠির আলোতেই লোকটিকে চিনতে পেরেছিল সুদর্শন—সাবিত্রীর ছোড়দা অমলেন্দু।

দেশলাইটা ফিরিয়ে দিয়ে আর একটি কথাও না বলে সিগারেট টানতে টানতে। অমলেন্দু পল্লীর দিকে এগিয়ে গেল। অমলেন্দুর দেহটা আবছা আলো-অন্ধকারে মিলিয়ে এ যেতেই সুদর্শন আবার থানার দিকে পা বাড়াল।

শীতের হিমঝরা রাত স্তব্ধ, নিঃসঙ্গ। থানার পথে ফিরতে ফিরতেই হঠাৎ কি মনে হয় সুদর্শনের, খানার দিকে না গিয়ে পল্লীর দিকেই চলতে লাগল আবার।

পল্লীর সব বাসিন্দাই ততক্ষণে যে যার ঘরে খিল এঁটে শয্যায় গা ঢেলে দিয়েছে। মাধবীদের গৃহের দিকে কেন জানি চলতে লাগল সুদর্শন। হঠাৎ কানে এল বেহালার একটা মিষ্টি সুর।

পল্লীর মধ্যেই কোথায় কে যেন বেহালা বাজাচ্ছে। সুরটা ভারি মিষ্টি এবং চেনাচেনা মনে হয় সুদর্শনের। সুরটা ধরা পড়ে—বাগেশ্রী। বাগেশ্রী সুরে চমৎকার আলাপ করছে বেহালায়। বেহালায় সেই সুরালাপের আকর্ষণে যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে যায় সুদর্শন।

সুবোধ মিত্রের সেই চেনা বাড়িটার সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়ে গেল সুদর্শন। বাইরের দিককার একটা জানলা খোলা। খোলা জানলাপথে আলোর আভাস চোখে পড়ে।

সেই ঘর থেকেই বেহালার আলাপ ভেসে আসছে। এত রাত্রে সুবোধ মিত্রের বাড়িতে কে বেহালা বাজায়? সুবোধ মিত্রের বাড়ির বাইরের ঘর ওটা।

কদিন আগে দেখা ঘরের পরিচ্ছন্ন চেহারাটা যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুদর্শনের।

বেতের একসেট সোফা। কাচের একটা আলমারি-ভর্তি বই। একটি তক্তাপোশ এক কোণে—ওপরে সুজনি বিছানো। এক কোণে একটি ধ্যানস্থ বুদ্ধমূর্তি ও চিনেমাটির সুদৃশ্য একটি ভাসে একগোছা ফুল। দেওয়ালে ঝোলানো একটি বেহালার বাক্স।

আরও দুপা এগিয়ে গিয়ে জানলাপথে ভেতরে দৃষ্টিপাত করতেই সুদর্শনের নজরে পড়ল, ঘরের মধ্যে তক্তাপোশটার ওপর বসে চোখ বুজে আপন মনে বেহালা বাজাচ্ছে সুবোধ মিত্রই।

সুদর্শন মগ্ন হয়ে যায়। ভদ্রলোকের সঙ্গীতে ও বাদ্যযন্ত্রে চমৎকার দখল!

কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে বেহালা বাজনা শুনে সুদর্শন আবার পল্লী থেকে বের হয়ে এল।

মাঝামাঝি পথ এসেছে, হঠাৎ নজরে পড়ল আগাগোড়া একটা চাদরে আবৃত কে। একজন উল্টোদিক থেকে এগিয়ে আসছে।

হাতে ধরা একটা টর্চবাতি, মধ্যে মধ্যে টর্চের আলো এদিক-ওদিক ফেলছে সন্তর্পণে।

হঠাৎ টর্চের আলো সুদর্শনের গায়ে পড়তেই লোকটা বলে উঠল, কে? কে ওখানে?

সুদর্শন জবাব দেয় না। গলার স্বরেই চিনতে পেরেছিল অবিশ্যি–প্রশ্নকারী কে?

প্রশ্নকারী আরও কয়েক বা এগিয়ে এসে সরাসরি হাতের টর্চের আলো একেবারে সুদর্শনের মুখের ওপরে ফেলে এবং সঙ্গে সঙ্গে তার বিস্ময়-চকিত কণ্ঠ হতে নির্গত হয়, রাধেশ্যাম! দারোগা সাহেব যে!

নরহরিবাবু!

রাধেশ্যাম! প্রাতঃপ্রণাম।

প্রাতঃপ্রণাম কেন? এখন বোধ হয় রাত বারোটা—

রাধেশ্যাম! রাতের আর বাকি রইল কি?

তা এত রাত্রে ফিরছেন কোথা থেকে?

রাধেশ্যাম! কোথা থেকে আর-দোকান থেকেই ফিরছি।

সুদর্শন ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করেছিল, নরহরি সরকারের হাতে একটা ঝোলা। নরহরি যেন ঝোলাটা সামলাতে একটু ব্যস্তই হয়ে ওঠে।

এত রাত্রে দোকান থেকে?

রাধেশ্যাম! রাত আর কি? দোকানে তালাটালা দিয়ে বেরুতে বেরুতে একটু বিলম্ব হয়ে যায়!

তাই তো দেখছি। একটু বেশি বিলম্বই বোধহয় হয় আপনার!

রাধেশ্যাম! বিশ্বাস নেই, বুঝলেন দারোগা সাহেব, আজকালকার দিনে আর কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না তো। তাই নিজেকেই সব দেখাশুনো করে সামলে-সুমলে আসতে হয় আর কি! রাধেশ্যাম!

তা হাতে কি? র‍্যাশন নাকি?

রাধেশ্যাম! ঠিক ধরেছেন—র‍্যাশনই।

তা বাড়িতে আপনার কটি প্রাণী?

বেশি নয়—রাধেশ্যাম—তিনটি।

আপনি, আপনার ছেলেমেয়ে, এই তো?

রাধেশ্যাম! আজকাল দিনে তিনজনের খাইখরচাই কি কম? আপনিই বলুন না?

তা তো বটেই।

রাধেশ্যাম! অগ্নিমূল্য—সব অগ্নিমূল্য, বুঝলেন না? হাত দেবার জো আছে কি?

হাত পুড়ে ছাই হয়ে যায় যেন। রাধেশ্যাম! আচ্ছা চলি, প্রণাম-রাত হল।

আসুন।

নরহরি সরকার আর দাঁড়াল না। হনহন করে চলে গেল।

সুদর্শনের মনে হল যেন কতকটা দৌড়েই তার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল নরহরি সরকার।

.

১৩.

থানায় এক এক করে ডেকে এনে সুদর্শন পরের দিন সকাল থেকে দশ নম্বর পল্লীর অনেককেই নানা ভাবে জেরা করল।

সুদর্শন প্রথমেই ডেকেছিল হীরু সাহাকে।

হীরু সাহা থানায় ঢুকেই উদ্ধত ভঙ্গিতে বলে, কি ব্যাপার স্যার, বলুন তো? থানায় আসবার জন্যে জরুরী তলব পাঠিয়েছিলেন কেন?

বসুন।

না মশাই, বসে আড্ডা দেওয়ার সময় আমার নেই। কেন তলব পাঠিয়েছিলেন বলুন?

সুদর্শন আবার গম্ভীর গলায় কতকটা যেন আদেশের ভঙ্গিতেই বললেন, বসুন।

সুদর্শনের গলার স্বরেই বোধ হয় এবার হীরু সাহা খানিকটা থতমত খেয়ে যায়। সামনের খালি চেয়ারটায় বসে পড়ে। বসতে বসতে বললে, আশ্চর্য, এ তল্লাটে থানা অফিসার হয়ে এসেছেন বলে কি জুলুম করবেন সবার উপরে।

শুনুন হীরুবাবু, জুলুম নয়—আইনঘটিত একটা ব্যাপারের জন্যই আপনাদের পল্লীর প্রত্যেককেই আমাকে ডাকতে হয়েছে। কতকগুলো কথা আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই ও তার জবাব চাই।

বেশ। বলুন কি জানতে চান?

গত উনিশ তারিখে অর্থাৎ শনিবার যে রাত্রে মাধবী দেবী নিহত হন, সে রাত্রে কখন আপনি বাড়ি ফেরেন?

কেন বলুন তো?

যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দিন!

হীরু সাহা একবার তির্যক দৃষ্টিতে সুদর্শনের মুখের দিকে তাকাল। তারপর বললে, সে রাত্রে ভোর চারটে সাড়ে চারটে নাগাদ বোধ হয় আমি ফিরেছিলাম বাড়ি।

বোধহয়? তা অত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলেন?

যাত্রার রিহার্সাল ছিল আমাদের।

সারারাত ধরে যাত্রার রিহার্সাল?

হ্যাঁ, শনিবার শনিবার সারাটা রাত ধরেই প্রায় আমাদের রিহার্সাল হয়।

কোথায় রিহার্সাল হয়? যাত্রাদলের নাম কি?

নবীন অপেরা পার্টি।

কোথায় সেটা?

জুয়েলার নরহরি সরকারকে চেনেন?

দশ নম্বর পল্লীর আপনাদের নরহরি সরকার তো?

হ্যাঁ।

তা চিনি বৈকি।

তারই পৃষ্ঠপোষকতায় আমরা দশ নম্বর পল্লীতে একটি যাত্রাপার্টি খুলেছি-নবীন অপেরা পার্টি।

কোথায় সেটা?

পল্লীতে ঢুকতে বড় রাস্তা পার হয়েই যে ছোট রাস্তাটার মুখে দোতলা লাল বাড়িটা–

যার দোতলায় একটা ব্যাঙ্ক আছে?

হাঁ। তারই একতলার ঘরে আমাদের নবীন যাত্রাপার্টির অফিস ও রিহার্সাল রুম।

কতদিন থেকে ওই যাত্রার দল খুলেছে?

বছর তিন হবে।

বটে! তা কি কি পালা করলেন?

পালা আজ পর্যন্ত দুটো হয়েছে। তৃতীয় নতুন পালার রিহার্সাল চলেছে।

কি পালা?

বীর ঘটোৎকচ।

বাঃ, বেশ নামটা তো! তা কার লেখা ওই পালাটা?

আমাদেরই দলের একজনের লেখা।

কে তিনি? আপনাদের দশের পল্লীর একজন কি?

হ্যাঁ, নরহরিদার নিজের লেখা।

বলেন কি, সরকার মশাই তো তাহলে দেখছি গুণী ব্যক্তি। তা উনিও যাত্রার দলের পার্ট করেন নাকি?

না।

কেন?

তাঁর সময় কোথায়?

খুব বিজি মানুষ, তাই না?

হ্যাঁ।

তা সে-রাত্রে রিহার্সালে আর কে কে ছিলেন?

আমরা জনা-চারেক।

মাত্র চারজনকে নিয়ে নতুন নাটকের রিহার্সাল প্রায় সারাটা রাত ধরে হল!

নতুন একটি মেয়ে নেওয়া হয়েছে যাত্রার দলে। সে-ই যাজ্ঞসেনী করবে। তাই মোশন মাস্টার তাকে আর আমাদের তিনজনকে নিয়ে বিশেষভাবে রিহার্সাল দিচ্ছিলেন।

.

১৪.

মোশনমাস্টারটি কে? সুদর্শন জিজ্ঞাসা করে।

অম্বিকাদা।

অম্বিকাদা! কে তিনি? আপনাদেরই দশ নম্বর পল্লীর কেউ?

হ্যাঁ।

তা ভদ্রলোক আর কি কাজকর্ম করেন?

স্টেট বাসের ড্রাইভার।

হুঁ। তা আপনারা তিনজন ছাড়া আর কে কে সেদিন রাত চারটে পর্যন্ত রিহার্সাল দিয়েছিলেন?

আমি, গোকুল খাঁ, আর ছিল অমলেন্দু—

অমলেন্দু, মানে অমলেন্দু ব্যানার্জী-মাধবী ব্যানার্জীর ভাই?

হুঁ।

সে-রাত্রে রাত চারটে পর্যন্ত রিহর্সালে ছিলেন অমলেন্দুবাবু?

না, রাত সাড়ে দশটা নাগাদ সে চলে যায়।

আপনি কখন রিহার্সাল-রুমে গিয়েছিলেন?

রাত সাড়ে নটা নাগাদ–খেয়েদেয়ে।

তাহলে রাত সাড়ে নটা থেকে রাত চারটে পর্যন্ত আপনি রিহার্সাল রুমেই ছিলেন?

তাই ছিলাম।

মধ্যে একবারও বাইরে যাননি?

না।

ঠিক করে মনে করে দেখুন-রাত সাড়ে দশটা থেকে রাত বারোটা সাড়ে বারোটার মধ্যে!

না।

যাননি যে প্রমাণ করতে পারবেন তো?

পারব। কিন্তু কি ব্যাপার বলুন তো?

মানে আপনাদের যার যার সঙ্গে মাধবী দেবীর পল্লীতে একটু ঘনিষ্ঠতা ছিল, তাদের সে-রাত্রের গতিবিধি সম্পর্কে আমার জানা প্রয়োজন, তাই-

আমার সঙ্গে মাধবীর ঘনিষ্ঠতা ছিল, কে আপনাকে বললে?

ও কি আর চাপা থাকে মশাই, প্রেম-ট্রেমের ব্যাপার—

ভুল করেছেন তাহলে আপনি।

ভুল করেছি?

হ্যাঁ, রীতিমত ভুল। কারণ মাধবীর সঙ্গে আমার যাকে বলে ঝগড়াই ছিল। মুখদেখাদেখিও ছিল না ইদানীং।

ঝগড়ার কারণটা কি—প্রত্যাখ্যান?

আজ্ঞে না।

তবে?

সে আপনার শুনে কি হবে!

তবু না হয় শুনলাম।

বলতে আমি বাধ্য নই।

তাহলে আপনারই ক্ষতি—

মানে?

মানে তো সহজ। পুলিশ আপনাকেও মাধবীর হত্যাকারী হিসাবে সাসপেক্টসদের দলেই ফেলবে।

তার মানে বলতে চান আমি মাধবীকে হত্যা করেছি?

সেরকম ভাবাটা কি খুব অন্যায় কিছু? আপনিই বলুন না?

হঠাৎ যেন হীরু সাহা স্তব্ধ হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। সুদর্শনের মুখের দিকে। তারপর বলে, আপনি তাই বিশ্বাস করেন নাকি?

খানিকটা সন্দেহ থেকে যাচ্ছে বৈকি!

কেন?

সে-রাত্রে আপনার গতিবিধি সম্পূর্ণ না জানা পর্যন্ত সন্দেহের তালিকা থেকে তো আপনাকে বাদ দেওয়া যাবে না।

কিছুক্ষণ আবার হীরু সাহা চুপ করে থাকে। কি যেন ভাবে, তারপর বলে, আপনি বিশ্বাস না করলে কি করতে পারি বলুন! তবে জানবেন মাধবীকে আমি হত্যা করিনি।

হত্যা করেছেন–তা কি বলেছি হীরুবাবু? তাছাড়া–

সুদর্শন কথাটা শেষ করে না, হীরু সাহার মুখের দিকে তাকায়। হীরু সাহাও ওই সময় তার মুখের দিকে তাকায়।

তাছাড়া কি? হীরু সাহা মিনমিনে গলায় যেন প্রশ্নটা করে এবারে।

আমি জানি, আপনি মাধবীকে ভালবাসতেন!

কে-কে বললে?

হ্যাঁ, তাকে আপনি বিয়েও করতে চেয়েছিলেন; এবং প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় তার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন ইদানীং।

না।

নয়?

না, আপনি মিথ্যা খবর পেয়েছেন।

মিথ্যে খবর?

হ্যাঁ। ওর মত একটা সামান্য মেয়েকে ভালবাসতে যাব আমি কোন্ দুঃখে!

দুঃখে তো মানুষ ভালবাসে না, ভালবাসাটা আনন্দেরই প্রকাশ। যাক গে সে কথা, এবার বলুন তো, মাধবীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল আপনার কি নিয়ে?

সে সম্পূর্ণ আমার পার্সোনাল অ্যাফেয়ার!

সেটাও তাহলে বলবেন না?

বলবার কিছু নেই।

হুঁ। আচ্ছা, ওর দাদা অবিনাশবাবুর সঙ্গে আপনার নিশ্চয়ই হৃদ্যতা আছে?

ওটা তো একটা ছুঁচো। আই হেট হিম!

হুঁ। হীরুবাবু, কতদূর আপনি লেখাপড়া করেছেন? না সেটাও বলতে আপনার আপত্তি আছে?

আমি স্কুল-ফাইনাল পাস।

কবে কত বছর আগে পাস করেছেন?

মাধবীর দু বছর আগে।

সুদর্শন মল্লিক হীরু সাহাকে মাধবীর নামোচ্চারণ করতে শুনে মৃদু হাসল।

আচ্ছা, অমলেন্দুবাবুর সঙ্গে আপনার হৃদ্যতা আছে কি?

অশিক্ষিত একটা বাস-ড্রাইভার, তায় বেহেড মাতাল! ওর সঙ্গে কথা বলতেও ঘৃণা হয়।

আর খগেন পাঠক?

কে, খগনা? ওই মোটর-মেকানিকটা? ওটা তো একটা বুদ্ধু দি গ্রেট নাম্বার ওয়ান!

আর কল্যাণবাবু?

ও তো আমাদের মিলের শ্রমিক ইউনিয়নের পাণ্ডা। ওকে শ্রদ্ধা করে না এ তল্লাটে কে এমন আছে?

আর সুবোধ মিত্র—আপনাদের দশ নম্বর পল্লীর?

ও আমাদের পল্লীতে থাকে বটে, তবে আমাদের কারও সঙ্গে কখনও মেশেই না। বি. এ. পাস। অফিসে ভাল চাকরি করে। তার উপর আবার চমৎকার বেহালা বাজায়। ওর সঙ্গে আমাদের মত সাধারণ লোকের বন্ধুত্ব হবে, তাহলেই হয়েছে।

আচ্ছা, নরহরি সরকার লোকটা কেমন?

কেন বলুন তো! নরহরিদার ওপরেও আপনার সন্দেহ হয় নাকি?

ছি ছি, কি যে বলেন। সাত্ত্বিক, বৈষ্ণব মানুষ, ওঁকে সন্দেহ করব কি? এমনি জিজ্ঞাসাবাদ করছিলাম।

তা এবারে আমি যেতে পারি?

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। যাবেন বৈকি।

তাহলে চললাম। নমস্কার।

সুদর্শন কোন জবাব দেয় না। সে যেন অন্যমনস্কভাবে তখন কি ভাবছিল।

হীরু সাহা বের হয়ে যায় থানার অফিসঘর থেকে।

.

১৫.

হীরু সাহার পর সুদর্শন খগেন পাঠক ও কল্যাণ বসুকেও ডেকে পাঠিয়েছিল থানায়।

তাদের দুজনের কারও কাছ থেকেই বিশেষ কোন সংবাদ সংগ্রহ করতে পারেনি সুদর্শন।

কল্যাণ বসু ওই দিন রাত্রে অর্থাৎ গত উনিশে শনিবার ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে আগের দিন থেকেই শয্যায় শুয়েছিল।

আর খগেন পাঠক নাকি ওই দিন রাত্রে ঘুমিয়েছিল। সে সত্য বলছে কি মিথ্যা বলছে, বাড়ির লোকদের জিজ্ঞাসা করলেই জানা যাবে।

তাছাড়া কল্যাণ বসু লোকটার সরু পাকাটির মত যেরকম চেহারা, তাতে করে মাধবীর মত স্বাস্থ্যবতী ও পূর্ণযৌবনা একটি মেয়েকে গলা টিপে হত্যা করাটা অত সহজ নয়। অতএব ওদের দুজনের ওপরই সন্দেহটা সুদর্শনের তেমন জোরাল হয় না।

ঐদিনই বিকেলের দিকে এল অমলেন্দু, মাধবীর ছোড়দা।

অমলেন্দু প্রথমটায় আসতে চায়নি—আসেওনি। কিন্তু সাবিত্রী যখন বললে, ছোড়দা, থানার দারোগা ডেকে পাঠিয়েছেন-একবার ঘুরে আসতে ক্ষতি কি, অমলেন্দু কি জানি কেন আর আপত্তি জানায়নি।

কি একটা ছুটির দিন যেন ছিল ওই দিনটা। তাছাড়া অফ-ডিউটিও ছিল তার।

মাধবীর হত্যা-রহস্যের ব্যাপারটাই বিকেলের দিকে থানা-অফিসঘরে একা বসে বসে ভালছিল সুদর্শন, এমন সময় অমলেন্দু এল।

সে ঘরে ঢুকেই নিজে থেকেই বলল, আমার নাম অমলেন্দু ব্যানার্জি-মাধবীর ছোড়দা আমি। আমাকে আপনি ডেকেছেন শুনলাম।

বসুন, বসুন।

অমলেন্দু বিনাদ্বিধায় একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ল।

অমলেন্দুর চেহারাটা খুব রোগা নয়, আবার মোটাও নয়-মাঝামাঝি। চোখের কোণে কালি, ভাঙা চোয়াল-দেখলেই মনে হয় দেহের ওপর রীতিমত অত্যাচার করে লোকটা। পরনে একটা পায়জামা ও একটা পাঞ্জাবি, তার ওপরে একটা আলোয়ান জড়ানো।

আপনিই তাহলে সাবিত্রী দেবীর ছোড়দা? সুদর্শন বললে।

হ্যাঁ, বললাম তো!

আচ্ছা, গত উনিশে শনিবার সন্ধ্যা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন?

আমি ও সময়টা কৃষ্ণনগরে একদল বরযাত্রী নিয়ে বাস চালিয়ে গিয়েছিলাম।

ঠিক বলছেন?

কেন, বেঠিক বলব কেন?

কিন্তু আমি যে খবর পেয়েছি অন্যরকম।

কী খবর পেয়েছেন, জানতে পারি কি?

আপনি সন্ধ্যে থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত যাত্রার রিহার্সাল দিয়েছেন!

বাজে কথা! একেবারে ডাহা মিথ্যে কথা!

বলছেন মিথ্যে কথা?

আলবৎ। কিন্তু কোন্ শালা অমন মিথ্যে কথাটা বলেছে, বলুন তো?

তা জেনে আপনার কি হবে? আপনি বলছেন রিহার্সাল দেননি, ফুরিয়ে গেল! তবে এটা যদি প্রমাণিত হয় পরে যে আপনি রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত রিহার্সাল-রুমে রিহার্সাল দিয়েছেন, ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে দাঁড়াতে পারে এই আর কি!

মানে?

মানে সেই রাত্রেই কিছু পরে আপনার বোন মাধবীকে হত্যা করা হয়েছিল কিনা!

কি বলছেন স্যার? আপনি কি শেষ পর্যন্ত তাহলে আমাকেই আমার বোনের হত্যাকারী বলে ঠাওরালেন নাকি?

সে-রাত্রে ওই সময়টা—মানে রাত দশটা থেকে রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত আপনার মুভমেন্ট সম্পর্কে যদি সঠিক প্রমাণাদি না দিতে পারেন, পুলিস আপনাকেও সন্দেহ করবে বৈকি।

বাঃ, মশাই, বেশ! চমৎকার বুদ্ধি! ভাই হয়ে আমি আমার বোনকে খুন করব।

তা প্রয়োজনে ও স্বার্থে ভাই বোনকে, বোন ভাইকে, স্বামী স্ত্রীকে ও স্ত্রী স্বামীকেও খুন অনেক সময় করে বৈকি!

হঠাৎ যেন অমলেন্দু কেমন বোবা হয়ে যায়। তারপর একসময় ধীরে ধীরে বলে,, না, স্যার, আপনি বিশ্বাস করুন, আমি তাকে সত্যিই খুব ভালবাসতাম। ব্যাপারটা শোনা অবধি কেবলই ভাবছি, কে তাকে খুন করতে পারে। যে-ই তাকে খুন করুক, যেমন করে হোক, তাকে আমার খুঁজে বের করতেই হবে।

তাহলে বলছেন না কেন, ওই সময়টা সে-রাত্রে আপনি কোথায় ছিলেন? কারণ আমি জানি, আপনি আদৌ কৃষ্ণনগরে সে-রাত্রে বাস নিয়ে যাননি—যদিও সবাই তাই জানে, আপনিও সবাইকে তাই বলেছেন।

অমলেন্দু, সুদর্শনের শেষের কথায় হঠাৎ কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে যায় আবার।

কি, তাই সত্যি নয় কি? আপনি যাননি সে-রাত্রে বাস নিয়ে কৃষ্ণনগরে?

না, যাইনি।

তবে রাত সাড়ে দশটায় রিহার্সাল ক্লাব থেকে উঠে কোথায় গিয়েছিলেন? আর তার পরের দুটো দিন কোথায়ই বা ছিলেন রাত এগারোটা পর্যন্ত?

একটা বিশেষ কাজে আমাকে এক জায়গায় যেতে হয়েছিল।

কি কাজ? কোথায় যেতে হয়েছিল?

বলতে পারব না আমি।

বলবেন না!

বললাম তো বলতে পারব না।

হুঁ। আচ্ছা, বাসের ড্রাইভারি করে আপনি কত পান?

মাইনে ও উপরি-মানে ওভারটাইম নিয়ে শতিনেক মত পাই।

তবু আপনি সংসারে কিছু তো দিতেনই না, এমন কি মধ্যে মধ্যে আবার মাধবী দেবীর কাছ থেকেও টাকা নিতেন, সত্যি কিনা?

নিতাম। তা এত খবর পেলেন কোথায়?

যেখানেই হোক পেয়েছি, কিন্তু এখন বলুন তো, একা মানুষের অত টাকার আপনার কি এমন প্রয়োজন হত?

একটু-আধটু ড্রিঙ্ক করি আমি–

তাও আমি জানি। তা এখন কি করবেন? মাধবী দেবীই তো শুনেছি এতদিন আপনাদের সংসারটা চালাতেন!

কি আর করব—ও শালার মদটাই হয়ত শেষ-বেশ ছেড়ে দিতে হবে দেখছি।

পারবেন?

বোধ হয় পারব না। তবু চেষ্টা তো করতে হবে। কারণ বড়বাবু এর মধ্যেই নোটিশ দিয়ে দিয়েছেন, বাড়িতে আর তিনি থাকবেন না, মিলের কোয়ার্টারে চলে যাবেন।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। বড়বাবু আমাদের সুখের লোটন পায়রা। অত ঝামেলা তার সইবে কেন? তাই আমিও বলে দিয়েছি

কি বলে দিয়েছেন?

যেদিন খুশি যেখানে খুশি তার সে যেতে পারে।

আগের পর্ব :

০১-০৫. আপনি বিশ্বাস না করলে
০৬-১০. অতঃপর সুদর্শন কিছুক্ষণ চুপচাপ

পরের পর্ব :

১৬-২০. সুদর্শন একটু থেমে বললে
২০-২৫. মৃতদেহটা দুজন সেপাইয়ের প্রহরায়
২৬-৩০. আমাদের পাড়ার হরগোবিন্দ
৩১-৩৫. সন্তর্পণে কিরীটী এগিয়ে চলে
৩৬-৪০. কিন্তু সুবোধ মিত্রই যে দোষী

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত