অন্তরালের অন্তঃপুরে

অন্তরালের অন্তঃপুরে

আজকে যদি তাড়াতাড়ি বাসায় না আস তাহলে আমাকে আর খুঁজে পাবেনা। মিতুর কথা শুনে রাফি বিদ্রুপ চোখে ওর দিকে তাকায়। তা কোন চুলোয় যাবে শুনি?বিয়ের পর তো একটা রাত ও বাপের বাড়ি থাকনি।আর থাকবে কি করে এসির বাতাস খাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে যে!বাপের বাড়ি গিয়ে কি ভাললাগে? যেখানে গেলে আর ফিরে আসতে হবেনা সেখানেই যাব।কথাটা বলেই মিতু ওড়নায় চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল।

রাফি জানে একটু পরেই মিতু এসব ভুলে যাবে।বিয়ের পর থেকে কম অপমান তো করেনি ও মেয়েটাকে।কিন্তু কখনোই ও গায়ে মাখেনি।আজ ওদের বিবাহবার্ষিকী। তাই মিতু রাত থেকে ঘ্যান ঘ্যান করছে তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার জন্যে।কিন্তু রাফির এসবে কোন আগ্রহ নেই।সত্যি বলতে বাসায় ফিরতে হয় তাই ফেরা।এই সংসারের প্রতি ওর কোন আগ্রহ নেই।

তখন সবে মাত্র রাফির চাকরি হয়েছে।একদিন ওর মা জরুরীভভাবে বাড়িতে যেতে বলল।রাফিও ছুটে গেল বাড়িতে।কিন্তু বাড়িতে যেয়েই ও অবাক।বাড়ি ভর্তি মেহমান।বাড়িটাও সাজানো বিয়ে বাড়ির মত।রাফি বাড়ির ছোট ছেলে।এ বাড়িতে বিবাহযোগ্য আর কেউ নেই।তাই ও বুঝতেই পারছিলনা বিয়েটা কার।পরে যখন জানলো তখন আর কিছুই করার ছিলনা।ওর মা রীতিমত ব্লাকমেইল করে ওকে বিয়েটা করালো।

বিয়ে বাড়ির হুড়হুড়িতে বউকে ঠিকমত দেখতেই পারেনি রাফি।বিয়েটা যেভাবেই হোক বউ নিয়ে একটা স্বপ্ন তো সব ছেলেরাই দেখে।কিন্তু বাসর রাতে বউ দেখে রাফির মাথা ঘুরছিল।বউ ইয়া মোটা।গায়ের রং ফর্সা।কিন্তু এত মোটা একটা মেয়ের সাথে মা কেন ওর বিয়ে দিল তা ওর মাথায় ঢোকেনি।রাফি বউ দেখে কি বলবে ভেবে না পেয়ে বেলকুনিতে গিয়ে বসল।কিছুক্ষন পর এসে দেখে বউ ঘুমাচ্ছে। সেই সাথে নাক ডাকছে।বিছানায় যেভাবে শুয়েছে তাতে রাফির শোয়ার কোন জায়গা নেই।সারাটা রাত ও সোফার উপর শুয়ে অনেক কষ্টে রাতটা পার করল।
বিয়ের দুদিন পরেই কাজের বাহানায় কর্মস্থলে ফিরতে চেয়েছিল ও।কিন্তু মা এক প্রকার জোর করেই মিতুকে ওর সাথে পাঠিয়ে দিল।

মিতুকে নিয়ে বাইরে যেতনা রাফি।পাছে কেউ ওর মোটা বউ দেখে ফেলে।কারনে অকারনে মেয়েটার সাথে বাজে ব্যবহার ও করত।কিন্তু ওর বাসায় যেই আসত তারই মিতুকে ভাললাগত।ব্যাপারটা রাফির মাথায় ঢুকতনা।কি এমন আছে যা দেখে সবাই ওর এত প্রশংসা করে?মেয়েটার শখ বলতে কিছু নেই।সারাদিন রান্নাবান্না আর মেয়েকে নিয়ে পরে আছে।কখনো যদি রাফি ওকে বাইরে খেতে বলেছে তো সেদিনই রাফির পছন্দের একগাদা খাবার রান্না করবে।বিয়ের অনেকদিন পর যখন ওদের মেয়ে অর্থী হয়নি।রাফি সেদিন মিতুকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিল।বাইরে গিয়ে মিতু বেশ খুশি ছিল।সারাক্ষন বকবক করছিল।কিন্তু যখনি বিল দেখল ওর মুখ চুপসে গেল।এর কয়েকদিন পরেই ইউটিউব থেকে শিখে সেগুলো তৈরি করে রাফিকে খাওয়ালো। জানো এগুলো বানাতে আমার কত খরচ হয়েছে? রাফি অবাক চোখে বউয়ের দিকে তাকালো। কত? মাত্র ৩০০ টাকা।অথচ ওই দিন ১৫০০ টাকা বিল দিয়েছিলে তুমি। রাফি আর কথা বাড়ায়নি।জানে এর সাথে বেশি কথা বলে লাভ নেই।এর না আছে বুদ্ধি আর না আছে অনুভুতি।

অফিসে যেয়ে রাফির মনটা ভাল হয়ে গেল।অনেকক্ষন সাংসারিক ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকা যাবে।কিন্তু অফিসে যেয়েই দেখল শামীম ভাইয়ের মন খুব খারাপ।এই সেই শামীম যাকে রাফি ভীষণ ঈর্ষা করে।কি সুন্দরি বউ উনার।আর কি স্মার্ট। প্রায় দিন অফিস শেষে শামীম ভাইয়ের জন্যে দাড়িয়ে থাকে।হয়ত দুজনে একসাথে রেস্টুরেন্টে যায়। নিজেদের মত সময় কাটায়।আহ! রাফির জীবনে এসব শুধুই কল্পনাবিলাসিতা।

কয়েকবার চেষ্টা করেও শামীম ভাইয়ের পেট থেকে কোন কথা বের করা গেলনা।কিন্তু লাঞ্চের সময় যখন দুজন ক্যান্টিনে খেতে গেল তখন রাফি সুযোগ বুঝে আবার জিজ্ঞেস করল।শামীম ভাই তো পারলে কেঁদেই দেয়।
আর বলনা রাফি কি একটা বিয়ে করেছি মানুষ না হাতি কে জানে। শামীমের কথা শুনে রাফি মনে মনে বলল,আপনি কেন হাতি বিয়ে করবেন?হাতি তো বিয়ে করেছি আমি।

শামীম ভাই বলতে লাগল।বিয়ের পর থেকে এই মেয়ের চাহিদার কোন শেষ নেই।দামি দামি শাড়ি, কসমেটিকস তার প্রতি মাসে চাইই চাই।তাছাড়া মাসের অর্ধেক দিন তার রান্না করতে ভাললাগেনা।দেখো তোমরা প্রতিদিন বউয়ের রান্না করা খাবার খাও।আর আমি এই ক্যান্টিনের খাবার খাই।অনেকদিন তো অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর বলে রাতে কিছু রান্না করবেনা।তখন আবার বাইরে যেয়ে খাবার আনতে হয়।ছেলেটাকে জন্মের পর থেকে রেখেছে বুয়ার কাছে।স্কুলে ভর্তি করার আগে থেকে টিচার রেখেছে।ক্লাস থ্রির বাচ্চার পেছনে আমার প্রতিমাসে ১২ হাজার টাকা খরচ।ভাবতে পার কি সাংঘাতিক ব্যাপার।অথচ একটা গ্রাজুয়েট মেয়ের পক্ষে এই বাচ্চাকে পড়ানো ত পান্তাভাতের মত।কিন্তু ছেলেকে সময় দিলে তার রুপসজ্জা করবে কে? আমি সত্তিই হাপিয়ে গেছি ভাই।তোমার আগে থেকে এই অফিসে আছি।অথচ দেখ এখনো কিছুই করতে পারলামনা।আর এদিকে তোমরা গাড়ি বাড়ি সব করে ফেলেছ।

শামীমের সাথে কথা বলে রাফি নিজের ডেস্কে গিয়ে বসল।সত্যিই ত এই কয়েক বছরে ও অনেক কিছুই করেছে।মিতুর বাড়তি কোন চাহিদা নেই।তাছাড়া মেয়েকে জন্মের পর থেকে ওই দেখাশুনা করছে।এমনকি এখনো পর্যন্ত ওকে কোন টিচারের কাছেও দেয়নি।রাফির মাঝে মাঝেই ইচ্ছা করত একটা সুন্দরি ম্যাডাম অর্থীকে পড়াতে আসবে।মাঝে মাঝে তার সাথে মেয়ের পড়া নিয়ে আলোচনা হবে।কিন্তু মিতুর জন্যে সেসব কিছুই হয়নি।

শামীম ভাইয়ের কথা শুনে রাফির মনের ভিতরটা পরিষ্কার হয়ে গেল।সত্যিই কি অন্ধকারের মধ্যেই না ছিল ও এতদিন।চিন্তার মধ্যে থেকে বেড়িয়ে এলো মোবাইলের রিংটোন শুনে।অর্থীর স্কুল থেকে কল এসেছে।ওকে জানালো আজ মিতু অর্থীকে আনতে স্কুলে যায়নি।রাফির ভীষণ চিন্তা হল। মিতু কদাচিত মেয়েকে আনেনি।তাও ঘন্টাখানেক আগেই রাফিকে জানিয়েছে।কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলায়নি তো আবার?

মিতুর মোবাইলে কল করল কয়েকবার।কিন্তু ও ধরলনা। বাসার ল্যান্ডলাইনে কল দিল।কিন্তু সেটাও বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেল।তাড়াতাড়ি বসকে বলে রাফি অর্থীর স্কুলে গেল।ওকে নিয়ে দ্রুত বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল।কিন্তু আজ যেন পথ ফুরাচ্ছেইনা।রাফি ঘেমে যাচ্ছে।মিতুর কিছু হয়ে গেলে ও কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেনা।অর্থী স্কুলে কি কি হয়েছে সব বাবাকে বলছে।কিন্তু রাফির কানে সেসব পৌছাচ্ছেনা। বাসার সামনে আসতেই রাফির চোখ পড়ল নিচে অনেক পুলিশ দাঁড়িয়ে। রাফি নিশ্চিত হয়ে গেল মিতু কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে।মিতুর কিছু হলে অর্থীকে কিকরে সামলাবে সেটা ভেবেই ওর কান্না পেল।মেয়েটা মাকে ছাড়া কিছুই বোঝেনা।

রাফি গাড়ি থেকে নেমে একজন কনেস্টবলের সামনে গিয়ে ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল কি হয়েছে?
কনেস্টবলের কথা শুনে তো ওর মাথা ঘুরতে লাগল। ওদের পাশের ফ্লাটে নাকি ইলেকট্রিক মিস্ত্রী সেজে দুইজন লোক ঢুকে পরেছিল।তারপর অস্ত্র বের করে ওদেরকে জিম্মি করে সবকিছু নিয়ে যেতে চেয়েছিল।কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেই সময় পাশের ফ্লাটের মহিলা ওখানে ছিলেন।উনিই বুদ্ধি করে দুই ডাকাতকে ধরে দড়ি দিয়ে বেধে পুলিশকে খবর দিয়েছে।এতক্ষনে রাফির যেন ঘাম দিয়ে জ্বর সারল।যাক মিতুর তাহলে কিছু হয়নি।হয়ত এইসব ঝামেলার কারনে মেয়েকে আনার কথা ভুলে গেছে।

রাফি বাসায় ঢুকতেই দেখল মিতু সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে।আর এক লোক ক্যামেরায় ওর ছবি তুলছে।রাফি ভিতরে ঢুকতেই মিতুর মুখে খই ফুটতে লাগল।জানোনা আজ কি হয়েছে?তুমি চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষন আমার মন খারাপ ছিল। তারপর রান্না শেষ করে ভাবলাম একটা কেক বানাই।মেয়েটা কেক খেতে ভালবাসে।তুমি যদি অনেক রাতে আস তাতে বা কি এমন হবে?কিন্তু কেক বানাতে গিয়ে দেখি চিনি নেই।এই ভর দুপুরে বাইরে যেতে ইচ্ছা করছিলনা।তাই ভাবলাম ভাবির কাছ থেকে একটু চিনি আনি।ওমা যাওয়ার পর সেকি কাণ্ড!দুই বদমায়েশ লোক বাসায় ঢুকে ডাকাতি করতে চেয়েছিল।আমিও দিয়েছি ইচ্ছামত।বিয়ের আগে ক্যারাটে শিখেছিলাম।অনেক দিন পর সেটা ঝালিয়ে নিলাম।বলেই মিতু অভিনয় করে সেসব দেখাচ্ছে।রাফি অবাক বিষ্ময়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

মিতুর অনেক নিশেধ সত্ত্বেও রাফি ওদের নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে গেল।অর্থী আজ ভীষণ খুশি।ওর বন্ধুরা প্রায় রেস্টুরেন্টে খেয়ে ওকে গল্প শোনায়।কাল ও সবাইকে গল্প বলবে।মিতুও আজ কিছু বলছেনা।মেয়ের খুশি দেখে ও হয়ত কিছু বলতে চাচ্ছেনা।ওর কাছে অর্থীই সব।

অর্থী ঘুমিয়ে পরেছে কিছুক্ষন আগে।রাফি বেলকনিতে বসে আছে।একটু পর মিতু এলো এক কাপ কফি নিয়ে।সত্যি এই মুহুর্তে রাফির মনটা কফিই চাইছিল।মিতুকে না বলতেই ও সবকিছু বুঝে ফেলে। কফির মগটা দিয়েই মিতু চলে যাচ্ছিল।রাফি ওকে থামালো। কোথায় যাচ্ছ? ঘুমাতে হবে।সকালে মেয়ের স্কুল। আমার পাশে একটু বস। তোমার সাথে গল্প করি। মিতু পাশের চেয়ারে বসল। আচ্ছা এই যে আমি তোমাকে সারাক্ষন বকাঝকা করি তোমার খারাপ লাগেনা?

খারাপ তো একটু লাগেই।তবে পরক্ষনেই আমি ভুলে যাই।আমার মাও সারাক্ষন আমাকে বকত।কিন্তু মার চাইতে বেশি আমাকে কেউ ভালবাসেনি।তুমিও বকো তারমানে তুমিও আমাকে ভালবাস। সত্যি মিতু আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালবাসি।এতদিন আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম।তাই কিছুই বুঝতে পারিনি।কিন্তু আজ আমার ঘোর কেটে গেছে। মিতুর দিকে তাকাতেই রাফি দেখল ঘুমিয়ে ও বেহুশ হয়ে গেছে।সেই সাথে বিকট শব্দে নাক ডাকছে।কারো নাক ডাকার শব্দ যে এত মোহময় হয় সেটা আজকের আগে রাফি কখনো বোঝেনি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত