বই পড়া

বই পড়া

আমার খুব দুঃখ হয় যখন কেউ প্রশ্ন করে, আপু কি বই পড়ব? বা কোন লেখকের বই পড়ব সাজেস্ট করো৷ অধিকাংশের বয়স কুঁড়ির কম, মাত্র হুমায়ূন আহমেদের বই পড়া শুরু করেছে বা ফেসবুকে গল্প পড়তে পড়তে মলাটের মোড়ানো পৃষ্ঠায় চোখ বুলাতে ইচ্ছা জেগেছে।এই বাচ্চাগুলিকে বলা যায় না কমিক থেকে শুরু করো। চাচা চৌধুরী,সাবু,রাকা,পিঙ্কি,বল্টু দের সাথে লাফালাফি না করেই এরা শৈশব পাড় করে এসেছে। তিন গোয়েন্দা যে বিপুল উম্মাদনা ওরা টের পাবে না। কিশোর পাশা, মুসা আমান, রবিড মিটফোর্ড এই নামগুলো যার বন্ধু হয় নি জানি না সে কি নিয়ে শৈশবে ফ্যান্টাসিতে ভুগত। রহস্য পত্রিকার সে এক অদ্ভুত সম্মোহন! আহ! যারা নাইন-টেনে বা কলেজে উঠার পর বই পড়া শুরু করেছে তারা কখনই ত্রিশ টাকার সেবা প্রকাশনীর নিউজপ্রিন্টের আবেগ অনুভব করতে পারবে না।

এদেশে লোকে বই পড়া শুরু করে হুমায়ূন আহমেদ দিয়ে। তারপর কিছুদিন সমরেশ, সুনীল শেষপর্যন্ত শরৎচন্দ্রে গিয়ে ঠেকে। দু’চারটা বই পড়ার পর তারা হন্নে হয়ে ভালো বই খুঁজে। অনেকজনকে শুনি নাম আওড়াতে শুনেছি-মেমসাহেব, জননী, ক্রিতদাসের হাসি, শবনম, কবি,আরণ্যক যতসব মাস্টারপিস বই পড়ে তারা বিমোহিত। জিজ্ঞেস করেছিলাম,

-তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের কবি কেমন লেগেছে?

-দারুণ বই। কালো যদি হয় মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দো কেনে!

-সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন পড়েছেন?

-দু’পাতা পড়ে রেখে দিছি, এত মোটা বই ভালো লাগে না।

আমি বুঝি না যার কাছে সাতকাহন দুই পৃষ্ঠা পড়ার পর একঘেয়ে লেগেছে সে কিভাবে আরো উচ্চমার্গীয় কবি শেষ করে, মানুষ বড়ই অদ্ভুত। আমি রুচিশীলদের দলে তা শোঅফের জন্যেও আজকাল লোকে বই পড়ে। পড়তে পড়তে পড়ুয়া হওয়া ভালো। প্রথমেই যদি পোলাও কোরমা খেয়ে অভ্যস করেন।ডাল-ভাত মুখে রুচবে! আনিসুল হক, ইমদাদুল হক মিলন, সুমন্ত আসলাম আরো দুচারজনের বই পড়ে শেষে ওপাড় বাংলায় হাত দিন। ফেসবুকের লেখা ছাড়া আর কোনো বই পড়ে নাই তারকাছে সুনীলের ত্রয়ী লাগবে খটমটে ইতিহাসের বই, বুদ্ধদেব মাধুকরী গদ্য কবিতা। নতুন পাঠক সহজ অথচ ছোট বই পড়তে চান? গোটা জহির রায়হান সমগ্র আছে, আলাউদ্দিন আল আজাদের তেইশ নম্বর চলচ্চিত্র,সেলিনা হোসেন,সৈয়দ মুজতবা আলী আরো কত শত নাম। আপনি স্রেফ পড়তে বসে যান, তামাম দুনিয়া ছাপার হরফে ধরা দিবে।

তবে প্লিজ, প্রথম শরৎ,মানিক ধরবেন না। এই বেচারা কেতাদুরস্ত। ভেতরটা নিংড়ে নিবে। দেখবেন কপিলা বোনজামাইয়ের সাথে ঢলাঢলি করছে , শশী ডাক্তার গায়ের বধূর সাথে প্রেম করছে তবু আপনার পরকীয়া লাগছে না। ভদ্রলোক মুন্সীয়ানা ইনি যাই লিখেন পাঠককে তা বিশ্বাস করতে হয়।বাংলার ভাষার সৌভাগ্য এই ভূমিতে একজন মানিকের জন্ম হয়েছিল, দূর্ভাগ্য আমাদের আমরা প্রথমেই মানিককে না চিনে বিদেশী সাহিত্য নিয়ে লাফঝাপ করি।যা কিছু ভালো তাহাই শরৎ৷ তাই দেব দাসের আপনার নর্তকী চন্দ্রমুখীকেও ভালো লাগবে।রাজলক্ষীকে পতিতা লাগবে না এমনকি রামের দুষ্টুমিতে অন্তর জুড়ে মায়ায় ভরাট হবে। মানিক যেখানে পাতায় পাতায় ঈশ্বরের বিবেককে কটাক্ষ করে যে যার মত বাঁচার তাগিদ দেন সেখানে শরৎ শুধুই ভালোবাসতে শেখান।দয়ার শরীর না হলে শরতের নায়িকা হওয়া যায় না।

যাদের সাহিত্যে যৌনতা নিয়ে প্রবল আপত্তি আসুন তাদের সাথে একটু গপ্পো গপ্পো করি। এদের প্রধান অস্ত্র রবীন্দ্রনাথ। গুরুদেব স্রেফ নারী-পুরুষের শারীরিক প্রবৃত্তিকে নিভৃতে রেখে তার বিপুল রচনা সম্ভার সৃষ্টি করে গেছেন। তিনি যে উপেক্ষা করেছেন তা কিন্তু নয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে তার লেখার অনুরাগী ছিল সমাজের উচ্চমার্গীয় তথাকথিত ভদ্রলোকগণ। তার গান কবিতা আকারে আবৃত্তি করত ভাইপো-ভাইঝিরা। যেখানে আপনার পাঠকসব পরিচিত সেখানে কলমে লাগাম টানা আবশ্যক।

মানিক বন্দোপাধ্যায় থেকে শুরু করে ওপাড়ের বুদ্ধদেব গুহ, সমরেশ বসু এপাড় বাংলায় হুমায়ুন আজাদ, তসলিমা নাসরিন সেক্সুয়াল ব্যাপারখানা তাদের লেখায় ঘুরেফিরে এসেছে। মজার ব্যাপার হল, মানিককে কেউ আক্রমণ করে না। বেচারা মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন তা নয় যেখানে মানুষের জীবনশৈলী নিপুণভাবে ফুটে উঠে সেখানে কাহিনীর প্রয়োজনে বেশ্যামাগী শব্দখানাও শ্রুতিমধুর শোনায়। বুদ্ধদেব, সমরেশে নারী-পুরুষের চরিত্রের বৈচিত্র্য এত সমৃদ্ধি লাভ করে যে সেখানে দু’পাতা অ্যাডাল্ট কনসেপ্ট পড়তে আপনার খারাপ লাগবে না।তবু নিজের সামান্য অভিজ্ঞতা শেয়ার করি ক্লাস এইটে থাকতে আমি সমরেশের “সম” পড়ে নাড়া খেয়েছিলাম। ভুল বয়সে ভুল বই বলে একটা কথা থাকে তাই সমরেশ, বুদ্ধদেব ১৮+ বয়সেই হজম করা উচিত।

পাক সার জমিন সাদ বাদ, নারী বইদুটো নিয়ে প্রচুর তর্কযুদ্ধ হয়। হুমায়ুন আজাদের বেশকিছু বই পড়ার সুযোগ হয়েছিল। কিছু কৈশোরে কিছু পরিণত বয়সে। কেন যে তার লেখা আমাকে সম্মোহিত করে নাই ঈশ্বর জানেন। তিনি নারী শরীরে বর্ণনা করতে যেসব উপমা ব্যবহার করতেন পড়তে আমার শরীর কেমন ঘেন্নায় রি রি করে উঠত, বাকিটা নাই বলি উনার অন্ধভক্তরা আমার উপর কামানদাগা নিয়ে ছুটে আসবেন। তসলিমা নাসরিন একটা আক্ষেপের নাম। ভদ্রমহিলা স্রেফ যৌনতাকে কেন্দ্র করে পুরুষের চুল ছানাছানি না করলে আমরা বাংলা সাহিত্যে আরেকজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক পেতাম। উনার কবিতা, ভাষার মননশীল ব্যবহার জানান দেয় উনি লিখতে জানেন। উনি মেধার অপপ্রয়োগ করেছেন বাকিটা তার ব্যক্তিগত। হরিশংকর জলদাসের কসবি পড়ে ধাক্কা খেয়েছি৷ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা,চিলেকোঠার সেপাই এইসবের রিভিউ চাওয়া পাপ।

তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, বিমল মৈত্র, আশাপূর্ণা দেবী, ফাল্গুনীর যেখানে যা পাবেন পড়ে ফেলবেন। বঙ্কিমকে দয়া করে স্টার জলসার দেবী চৌধুরানীর সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না। বঙ্কিম কঠিন লাগে একবার না হোক পাঁচবারে সহজ হবে।আনন্দমঠ, কপালকুণ্ডলা, দুর্গেশনন্দিনী হাজারবার পড়ার পরও সজীবতা হারায় না।

পাঠক হিসেবে আপনি যদি সর্বভূক হন আপনি বিশেষ বিশেষ আশীর্বাদ প্রাপ্ত আপনি পার্থিব, দূরবীন থেকে শুরু করে ফেলুদা সমগ্র সবকিছুতে আনন্দ খুঁজে পাবেন। আজকাল এত ভালো সব বাংলা থ্রিলার লেখা হচ্ছে প্রশংসা করতে গিয়ে আমি স্রেফ ভাষা হারিয়ে ফেলি।মাশুদুল হোকের ভেন্ট্রিলোকুইস্ট, শরীফুল হাসানের সাম্ভালা সিরিজ, ঋভু এছাড়া আর্কন, ঈশ্বরের মুখোশ, ব্লাডস্টোন, রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেন নি এক একটা মাস্টারপিস।

২৩ বছর জীবনে কোনো কিছুই অর্জন করতে পারি নাই তারপরও যখন চোখ বন্ধ করে ভাবি গোটা কতক বই পড়া আছে বুকের ভেতর এক প্রকার প্রশান্তি অনুভূত হয়। এক জীবনে আপনি সমস্ত পৃথিবী চষে বেড়াতে পারবেন না,একশত জন্মের সাধ পাবেন না কিন্তু এক হাজার বই আপনার চোখের সামনে এক হাজার জগৎ খুলে দেবে। দুঃখ,জরা, বার্ধক্য জীবনের সমস্ত ব্যথাবেদনা থেকে নিজেকে লুকানোর সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হল বই পড়া। এত সস্তার টাইম ট্রাভেল মেশিন আপনি আর কোথায় পাবেন?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত