আত্নশুদ্ধি

আত্নশুদ্ধি

রাগে ফাইজার গা জ্বলে যাচ্ছে। মামুন কিছুক্ষণ আগে কল করে বলেছে, তার মা আসছে। ‘বুড়িটা কেন যে মরে না! আসলে আমার বাসার পরিবেশটাই নষ্ট করে ফেলবে।!’ রাগে গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে গেল ফাইজা। এখন নাকি আবার হরেক রকমের রান্না করতে হবে!

মামুন বাবা-মার একমাত্র ছেলে। ছোট একটা বোন, তার বিয়ে হয়েছে কয়েক বছর আগে। বাবা-মাকে নিয়েই মামুনের ছোট্ট সংসার। দেখেশুনে ফাইজার সাথে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছে দুই বছর আগে। নাক উঁচু স্বভাবের ফাইজা শুরু থেকেই শ্বশুর-শাশুড়িকে সহজভাবে নিতে পারেনি। আলাদা সংসার পাতার জন্য বরাবরই মামুনকে চাপ দিতো। মামুন সংসারে শান্তি বজায় রাখতে চাকরির অজুহাতে বউকে নিয়ে শহরে চলে আসে। গ্রামে বাবা-মা থাকেন। মাঝে মাঝে চিকিৎসার জন্য ডাক্তার দেখাতে বৃদ্ধ বাবা-মা আসেন ছেলের কাছে। কিছুদিন থেকে চলে যান। এই সময়টুকুও ফাইজা সহ্য করতে পারে না। সব আক্রোশ গিয়ে পড়ে মামুনের ওপর। বাবা-মা থাকা অবস্থায় মামুন অশান্তি এড়াতে চুপ করে থাকে।

দুপুর নাগাদ মামুন তার মা রাবেয়া বেগমকে নিয়ে বাসায় এলো। কপট হাসিমুখে ফাইজা দরজা খুলে দিলো। পান খেয়ে হাসি মুখে রাবেয়া বেগম ফাইজা জড়িয়ে ধরলেন। ‘কেমন আছো মা? জানো তোমরা দূরে দূরে থাকো আমার বাড়িটা এক্কেবারে শূন্য লাগে।’ ‘ভালো আছি মা। আপনাকে কতদিন দেখি না! আপনারা এখানে চলে এলেই তো পারেন।’ মিথ্যার ঝুলি খুলে দিলো ফাইজা। মুখে যতই সুন্দর কথা বলুক, রাবেয়া বেগম বোঝেন বউমা তাদের কাছে রাখতে চায় না। দুপুরে খেয়ে দেয়ে রাবেয়া বেগম ঘুমিয়ে পড়লেন। ফাইজা দাঁতে দাঁত পিষে মামুনকে বললো,’তোমার মায়ের আক্কেল নেই? বিচ্ছিরি পান খাওয়া গন্ধ শরীরে আমাকে জড়িয়ে ধরলো! উফ কবে যে যাবে?’ ‘মা শুনতে পাবে। মা তো এখানে সবসময়ের জন্য থাকতে আসেনি। আশা করি তুমি মার সামনে সিনক্রিয়েট করবে না।’ ‘আমি সিনক্রিয়েট করি!’

‘আজব! কখন বললাম সিনক্রিয়েট করো? বললাম যেন না করো। আমার মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না বলে দিলাম। তাকে আদর যত্নে রাখবে।’ ফাইজা তর্ক না করে উঠে অন্যঘরে গিয়ে ঠাস করে দরজা আটকে দিলো। ডাক্তার দেখিয়ে প্রায় এক সপ্তাহ রাবেয়া বেগম ছেলের বাসায় রয়েছেন। এরই মাঝে খুশির খবর পেলেন, ফাইজা মা হতে চলেছে। খুশিতে আত্নহারা হয়ে গেলেন। খুব ভোরে উঠলেন নিজেই রান্না করবেন বলে। ফাইজা কি খাবে তা জানার জন্য তাকে ডাকতে গেলেন। এমন সময় শুনতে পেলেন ফাইজা ও মামুন তর্ক করছে। ‘তোমার মাকে কবে রেখে আসবা?’ ‘কেন থাকলে কী সমস্যা?’

‘উনি নিজেই একটা সমস্যা, দেখেছো আমার বাসাটার কী হাল! যেখানে সেখানে বসে পান চিবুচ্ছে! বিশ্রী গন্ধ! ভালো করে বলে দিবা উনি যেন আর না আসে। আমার বাচ্চা হলে নোংরা হবে। আমি ওনাকে রান্না করে খাওয়াতে পারবো না।’ ‘মুখ সামলে কথা বলো ফাইজা, উনি আমার মা। উনার যা ইচ্ছে করবেন। রান্না করে খাওয়াবে না মানে? তুমি বাধ্য।’ ‘তুমি হয় ওনাকে আজ বাসায় পাঠিয়ে দিবা নয় আমি বাপের বাড়ি চলে যাবো।’ ‘কি বললা তুমি? সামান্য কারণে তুমি বাপের বাসায় যাবে? আমার মাকে নিয়ে তোমার এত সমস্যা কেন?’ ‘আমার ওনাকে ভালো লাগে না। ব্যস! আমি চাই না উনি আর এখানে থাকুক। আগামীকাল আমার জন্মদিন, লোকজন আসবে। এসে ওই মহিলাকে দেখবে!’ ‘ফাইজা তুমি যদি আর মাকে নিয়ে একটা কথাও বলো আমি তোমাকে !’ ‘কি কি বলো মারবে!’

‘তুমি আমার সন্তানের মা হতে যাচ্ছো, তা না হলে তোমাকে ঘাড় ধাক্বা দিয়ে বের করে দিতাম। বাবা-মা আমাকে অনেক কষ্টে বড় করেছেন। তুমি দুদিন হলো এসে তাদেরকে আমার জীবন থেকে সরিয়ে দিতে চাইছো? উনি তোমাকে কত ভালোবাসেন! তুমি একটু সহজ হতে পারো না?’ ‘বের করে দিবা দাও, দাও এক্ষুণি দাও।’ মামুন ফাইজাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হলো। মা থাকা অবস্থায় এমন কিছু করা ঠিক হবে না যাতে মা কষ্ট পায়। বের হতেই তার মায়ের সাথে চোখাচোখি হলো। মামুন লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। মা সবই জেনেছেন।

রাবেয়া বেগম কান্না গলায় আটকে বললেন,’আমি তোর কাছেই যাচ্ছিলাম, আজই চলে যাবো। তোর বাবা একলা মানুষ, আমাকে রেখে আয়। আজ তোর প্রিয় খাবার রান্না করে দেই বাবা? আবার কবে আসি না আসি তার ঠিক নেই।’

রাবেয়া বেগম রান্না করেছেন। মামুনের সে খাবার গলা দিয়ে নামছে না। রাবেয়া বেগম ভাবছেন, ভাগ্যিস মামুনের বাবা আসেননি। মানুষটা এসব সহ্য করতে পারতো না। তিনি তো তার শাশুড়ির সাথে কখনো এমন করেননি! শাশুড়ি ছিল তার কাছে মায়ের সমান। তবে কেন তার ভাগ্যে এমন বউমা? তিনি ভেবেছিলেন মেয়েকে বিয়ে দিয়ে মেয়ে দূরে গেছে, ছেলে বিয়ে দিয়ে মেয়ে আনবেন। কিন্তু এই ছিল তার কপালে! বউ তাকে সহ্যই করতে পারে না।

দুদিন পর সকালে দরজায় কলিংবেলের শব্দ। ফাইজা দরজা খুলতেই দেখলো মামুন দাঁড়িয়ে। ফাইজা জিজ্ঞেস করলো, কি ব্যাপার, কিছুক্ষণ আগেই না অফিস যাবে বলে বের হলে, এখনই চলে এলে? কিছু ফেলে গেছো?
মামুন হেসে বলল,’আর বলো না। কিছুদূর যেতেই দেখি মা-বাবা আসছেন। তাই অফিসে গেলাম না। ওনাদের নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। ক’দিন থাকবেন এখানে। দারোয়ান ব্যাগ-পত্র নিয়ে আসছে। শিগগির রান্নাবান্না করো।’ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো, কি! দুদিন আগেই না তোমার মা গেল, এবার আবার বাবাসহ বস্তি বাসায় তুলে আনছো? আমি ওই বস্তিবাসীদের আমার বাসায় জায়গা দেবো না। আর রান্না করে খাওয়াবো? এক্ষুণি তুমি তাদের ফিরে যেতে বলো।

মামনুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফাইজা চেঁচামেচি করতেই থাকলো। তারপর হঠাৎই চুপ করলো সে। দরজার সামনে মামুন নয় ফাইজার বাবা-মা দাঁড়িয়ে রয়েছে। মুহূর্তেই সবকিছু নিস্তব্ধ! ফাইজার মা ঠাস করে ফাইজাকে চড় বসালেন। তারপর ব্যাগ নিয়ে ফাইজার বাবাকে বললেন, ফিরে চলো। এটা আমাদের মেয়ে নয়। ভুল করে অন্যকারো বাসায় ঢুকে পড়েছি।

ফাইজা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের পা জড়িয়ে ধরলো,’মা আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দাও।’ পা ছাড়িয়ে নিলেন তিনি। ‘আমি তোর মা নই। আমার লজ্জা হচ্ছে তোর মা আমি!’ ফাইজার বাবা বললেন, বাবা মামুন, বাবা-মা হিসেবে আমরা মেয়েকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি। মানুষ করতে পারিনি। ভাবিনি কখনো আমার মেয়ে এত নিচ হতে পারে। তোমার বাবা-মাকে বলো যেন আমাদের ক্ষমা করে দেয়।

ফাইজার কান্না উপেক্ষা করে তার বাবা-মা চলে গেলেন। মামুন নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো। এমন একটা দিন ফাইজার পাওনা ছিল। বাবা-মা বাবা-মাই হয়। তা নিজের হোক কিংবা অন্যের। প্রতিটা মেয়েরই বোঝা উচিত বিষয়টা। আজ সে বউ কিন্তু একদিন সেও মা হবে, শাশুড়ি হবে। সম্মান না দিলে কখনো সম্মান পাওয়া যায় না। প্রতিটা বাবা-মারই উচিত মেয়েকে উত্তমরূপে শিক্ষা দেওয়া, শ্বশুর-শাশুড়ি বাবা-মার চেয়ে কম নন। এই ধারা, এই শিক্ষা শুধু একজন নয়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বজায় থাকলেই কেবল বউ শাশুড়ি যুদ্ধ নয় বরং বন্ধু হয়ে উঠবে।

ফাইজা কাঁদতে কাঁদতে দাঁড়িয়ে বললো,’মামুন আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চলো। আমি তাকে অনেক অপমান করেছি। আমি তার কাছে মাফ চাইব, মাফ না করা পর্যন্ত তার পা ধরে পড়ে থাকবো।’ মামুনের চোখ কেন যেন জল চলে এলো। পুরুষ মানুষের কান্না মানায় না। ফাইজা রাবেয়া বেগমকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। ‘মা আমাকে মাফ করে দিন। আমি ভুল করেছি। আপনি, বাবা আমার কাছে থাকবেন। আমার সন্তানকে আমি আপনাদের দায়িত্বে মানুষ করতে চাই।’ রাবেয়া বেগম ফাইজার চোখ মুছিয়ে দিলেন। ‘কেঁদো না মা। আমি ওসব কখন ভুলে গেছি! সন্তান ভুল করেই থাকে, তাই বলে কি মায়েরা রাগ করে থাকে? দেখো আমি একটুও রাগ করিনি।’

ফাইজা কাঁদতে কাঁদতে হেসে ফেললো। ‘সত্যি বলছেন!’ ‘সত্যি!’ ফাইজা রাবেয়া বেগমকে জড়িয়ে ধরলো,’মা পানের গন্ধ নেই কেন? পানের গন্ধ ছাড়া আপনাকে মানায় না।’ ‘আমি তো পান খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি!’ ‘বন্ধ করা চলবে না। আপনি আবার পান খাবেন। আমি বানিয়ে দেবো। মামুন, যাও বাজার থেকে পান কিনে নিয়ে এসো।’ মামুন ফিক করে হেসে দিলো। তাড়াতাড়ি সে বাজারের দিকে রওনা দিলো। আজ তার বড়ই সুখের দিন। দূর হয়ে যাক সকল কলহ-বিবাদ, মনোমালিন্য, তর্ক নয় মেনে নিয়েই হোক সুখের সংসার।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত